• ঢাকা
  • শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Songbad Prokash

ইনস্টাগ্রাম

টুইটার


লিংকডইন

পিন্টারেস্ট

গুগল নিউজ


প্রেমের ঘটনায় মানসিক ভারসাম্যহীন অর্থনীতিতে মাস্টার্স তোফাজ্জলের প্রাণটা নিভল ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে’


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪, ০৩:২৩ পিএম
প্রেমের ঘটনায় মানসিক ভারসাম্যহীন অর্থনীতিতে মাস্টার্স তোফাজ্জলের প্রাণটা নিভল ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে’
মাসুদ কামাল ওরফে তোফাজ্জল, যখন সুস্থ ছিলেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে শিক্ষার্থীদের গণপিটুনিতে নিহত মাসুদ কামাল ওরಞফে তোফাজ্জল ছিলেন আপনজনহারা একজন মানুষ। তার বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নে। প্রেমঘটিত কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তার বাবা দুর্ঘটনায় মারা যান ২০১৬ সালে, ২০১৯ সালে মা মারা যান ক্যানসারে। তার বড় ভাই, যিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন, তিনিও ক্যানসারে মারা যান গত বছর।

মা-বাবা ও ভাই হারানোর পর তার থাকা-খাওয়ার ঠিকঠিকানা ছিল না। কখনো বরগুনায় শুভানুধ্যায়ীদের বাড়িতে, কখনো ঢাকায় ভবঘুরে জীবন কাটাতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছিল ꦆতার অস্থায়ী আস্তানা।

মোবাইল ফোন চুরির অপবাদ দিয়ে বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাতে প্রথম দফা তাকে হলের অতিথি কক্ষে নিয়ে মারধর করা হয়। এরপর ক্যান্টিনে নেওয়া হয় খাওয়াতে। এরপর তার ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। ২৫ থেকে ৩০ শিক্ষার্থী দল বেঁধে তোফাজ্জলকে বেধড়ক পেটাতে থাকে। স্টাম্প দিয়ে পিষে দেওয়া হয় হাতের আঙুল। বেশুমার মারে তার শরীর থেকে ঝরতে থাকে রক্ত। রক্তভেজা শরীরে তাকে নাচতে নির্দেশ দেন শিকജ্ষার্থীরা। এমন মর্মন্তুদ ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় কষ্টমাখা জীবন। তার ওপর নির্মমতার খণ্ড খণ্ড ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অনেকে এর সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলেছেন।

তোফাজ্জলের ভবঘুরে জীবন বর্বরতায় শেষ
এ ঘটনায় ⛎ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অজ্ঞাত শিক্ষার্থীদের নামে মামলা হয়েছ🤪ে।

তোফাজ্জল বরগুনার পাথরঘাটা🦹র কাঁঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী গ্রামের মৃত আবদুর রহমানের ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে তোফাজ্জল ছিলেন ছোট। একসময় তিনি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতিও ছিলেন।

প্রায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেখা যেত তাকে। নানাজনের কাছ থেকে খাবার চেয়ে নিতেন। আবার অনেক সময় টাকাও চাইতেন। অধিকাংশ সময় রাꦏত কাটাতেন ফুটপাতে।

তোফাজ্জল এমন মৃত্যুর খবর মেনে নিতে পারছে না তার পরিবারের সদস্যরাও। তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী শরীফা আক্তার বলেন, “মানসিক সমস্যা থাকায় সে পর💮িবার থেকে বিচ্ছিন্ন 𒁏হয়ে পড়েছিল। তাই বলে তাকে হত্যা করতে হবে? আমরা এই হত্যার বিচার চাই।”

তোফাজ্জল হত্যার বিচার চান তার চাচা ফজলুল হকও। ঢামেক মর্গে গিয়ে দেখা গেল কান্নায় ভেঙে পড়েন তোফাজ্জলের মামাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়া। তিনি বলেন, ফুফুর পরিবারে ওরা দুই ভাই ছাড়া আর কেউ ছিল না। রাতে শিক্ষার্থীরা তোফাজ্জলকে বেধম মারধর করার সময় আমার বাবার (ওর মামা) নম্বরꦬে এক শিক্ষার্থী ফোন করে ৩৫ হাজার টাকা দাবি করেন। তোফাজ্জল কোনো অপরাধ করলে তাকে থানায় দিয়ে দিতে বলেন বাবা। এর কিছু সময় পর আরেকটি নম্বর থেকে তার ভাবির কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়।

তানিয়া বলেন, বরিশাল বিএম কলেজ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পর তোফাজ্জল মানসিক সমস্যার কারণে ন𝐆তুন জীবন শুরু করতে পারেনি। ২০১৫ সা൩লে ওর মা বিউটি বেগমের মৃত্যু হয়। এর আগে ওর বাবা আবদুর রহমান সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সর্বশেষ গত বছর তোফাজ্জলের বড় ভাই পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) নাসির হোসেন ক্যানসারে মারা যান।

মারধর করার বিষয়টি জানতে পেরে ওই নম্বরে ফোন করে তোফাজ্জল মানসিক ﷺঅসুস্থতার কথাও বলি। ꦓকিন্তু ওরা বলে, এত ফোন নম্বর মনে রাখতে পারে, সে কিসের পাগল! পরিবারের এমন পরিস্থিতিতে কেউ সুস্থ থাকতে পারে–আপনারাই বলেন? তোফাজ্জল তাদের মোবাইল ফোন চুরি করেছে বলে জানান শিক্ষার্থীরা। তাহলে পুলিশে দিয়ে দিতে পারত, তা না করে আমার ভাইকে এভাবে মেরে ফেলল।

ওড়নায় মুখ লুকিয়ে তানিয়া বলেন, তোফাজ্জল টিএসসি ও হাকিম চত্বর এলাকায় ঘোরাফেরা করত। যে যা দিত, সেটাই খেত। হয়তো রাতে অন🦩ুষ্ঠান দেখে ওখানে খেতে গেছে। কিন্তু কত নিষ্ঠুর হলে একজনকে ভাত খাওয়ানোর পর পিটিয়ে মেরে ফেলে? তোরা মেরেই যখন ফেলবি,🐎 তখন ভাত কেন খাওয়াইলি? আমরা এ ঘটনায় হত্যা মামলা করব। এ ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।

ঘটনার যেভাবে সূত্রপাত
‘স্বাধীনতা ২.০’ উপলক্ষে ফজলুল হক মুসলিম হলে কয়েক দিন ধরে স্পোর্টস টুর্নামেন্ট চলছিল। বুধবার সকালে ক্রিকেট খেলা চলাকালে ছয়টি ফোন চুরি হয়েছে বলে শিক্ষার্থীদের তরফ থেকে দাবি করা হয়। রাতে ফুটবল খেলা চলছিল হলের মাঠে। রাত পৌনে ৮টার দিকে তোফাজ্জলকে চোর সন্দেহে এফএইচ হলের 🐓মূল ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে যায় ২৫ থেকে ৩০ শিক্ষার্থী। সিসিটিভি ফুটেজে তখন সময় ৭টা ৪৭ মিনিট। মূল ভবনে ঢোকার গেটের পাশেই অতিথি কক্ষ। সেখানে প্রথম দফা তাকে মারধর করা𓆉 হয়।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলের এক ছাত্র বলেন, তাকে চড়-থাপ্পড়ের পা🦩শাপাশি স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানো হয়। কিছুক্ষণ পর হলের এক হাউস টিউটর সেখানে গিয়ে মারধর করতে নিষেধ করেন। শিক্ষার্থীরা তখন মারবে না জানিয়ে তোফাজ্জলকে ক্যান্টিনে খাবার খাওয়াতে নিয়ে যায়। মূল ভবন থেকে বের হয়ে একটু সামনেই হলের ক্যান্টিন। তখন রাত প্রায় ৯টা। ক্যান্টিনে খাবার খাওয়ানোর যে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে তাতে দেখা যায়, ‘কয়েকজন জিজ্ঞেস করে খাবার কেমন? তখন তোফাজ্জল বলেন খাবার ভালো।’

ক্যান্টিনে খাবার খাইয়ে তাকে নে🌊ওয়া হয় এক্সটেনশন ভবনের অতিথি কক্ষে। সেখ♏ানে তাকে দ্বিতীয় দফা মারধর করে ফের মূল ভবনের অতিথি কক্ষে নেওয়া হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী সূত্রে জানা যায়, তোফাজ্জলকে সবচেয়ে বেশি মারধর করে হল ছাত্রলীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপসম্পাদক ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০꧃১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র জালাল আহমেদ, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের ২০২০-২১ বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সুমন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ফিরোজ, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আব্দুস সামাদ, ফার্মাসি বিভাগের মোহাম্মদ ইয়ামুজ জামান এবং পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ২০২১-২২ শিক্꧂ষাবর্ষের মোত্তাকিন সাকিন। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে জালাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিগুলোতে সক্রিয় ছিল।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, চোর ধরা পড়েছে এমন খবর পেয়ে এক্সটেনশন ভবনে গিয়ে দেখি, তাঁকে পেটানো হচ্ছে। তারা জানান, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের সুমন তোফাজ্জলকে চোখ বন্ধ করে মেরেছে। এমনকি মারতে মারতে তো𝔍ফাজ্জল পড়ে যান। পরে তোফাজ্জলকে পানি খাওয়ানো হলে তিনি একটু স্বাভাবিক হয়ে উঠে বসেন। এরপর আবার পেটানো হয়। এ সময় ফিরোজ বেশি মেরেছে। এরপর আসে জালাল আহমেদ। জালাল বলতে থাকে, ‘মার, ইচ্ছামতো মার; মাইরা ফেলিস না একবারে’। এ সময় গ্যাসলাইট দিয়ে পায়ে আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরে সুমন এসে তোফাজ্জলের ভ্রু ও চুল কেটে দেয়।

আট বছর আগে বাবা, ৫ বছর আগে মাকে হারান তোফাজ্জল। এরপর দেখা দেয় মানসিক সমস্যা। তখন তার দেখাশোনা করতেন বড় ভাই। গত রোজায় এই তাকেও হারান তোফাজ্জল।

প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও বলেন, পরিচিত কয়েকজনের ফোন নম্বর বলে তোফাজ্জল। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে অপর পাশ থেকে ছাত্রদের বলা হয়, তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন। তবে ফোন নম্বর মু🥃খস্থ বলতে পারায় শিক্ষার্থীরা তাদের কথা বিশ্বাস করে না। তারা তাদের মোবাইল ফেরত চায়, একই সঙ্গে চলতে থাকে মারধর। একপর্যায়ে অতিথি কক্ষে আবাসিক শিক্ষকরা আসেন। শিক্ষকরা থাকলেও তাদের কথা শোনেননি অভিযুক্তরা। এর মধ্যে মারধরে তোফাজ্জলের পা থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে। পরে তাঁর পায়ে লাল কাপড় বেঁধে দেওয়া হয়।

শিক্ষার্থীরা বলেন, তোফাজ্জলের হাতের ওপর স্টাম্প রেখে জালালসহ আরেকজন পা দিয়ে চাপ দিতে থাকে। তবে প্রায় অচেতন তোফাজ্জল কমই প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিলেন। এর পর তাঁর বিশেষ অঙཧ্গেও আঘাত করা হয়।

আরেক শিক্ষার্থী বলেন, অনেক বাগ্‌বিতণ্ডার পর কয়েক শিক্ষার্থীসহ তোফাজ𝓰্জলকে প্রক্টরিয়াল টিমের গাড়িতে শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়। সিসিটিভি ফুটেজের সময় অনুযায়ী তখন রাত ১০টা ৪৭ মিনিট।

শাহবাগ থানা থেকে তোফাজ্জলকে রাত ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের 🍨জরুরি বিভাগে পাঠানো হয়। তোফাজ্জলকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। ঢামেকের মৃত্যু সনদে ১২টা ৪৫ মিনিট মৃত্যু রেকর্ড দেখা🦩নো হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রক্টরিয়াল মোবাইল টিমের এক সদস্য বলেন, হল থেকে খবর পাওয়ার পর আমাদের বিকেলের টিম রাত আনুমানিক ৯টার দিকে সেখানে যায়। তারা জানতে পেরে𒀰ছে, ৭টা-৮টা🏅র দিকে সেই লোকটাকে শিক্ষার্থীরা আটক করে। বিকেল টিমের ডিউটি শেষ হওয়ার পর আমরা রাতের টিম রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে হলটির গেস্টরুমে যাই। গিয়ে দেখি, লোকটা মার খেয়ে সেখানে পড়ে আছে।

এ রকম একজন মানসিক রোগীকে আমরা কী ভয়ংকর হিংস্রতায় হত্যা করলাম, তা-ও আবার প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কষ্টমাখা জীবন শেষ হলো বর্বরতায়।

Link copied!