• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Songbad Prokash

ইনস্টাগ্রাম

টুইটার


লিংকডইন

পিন্টারেস্ট

গুগল নিউজ


মন্ত্রীর রেল লাইনচ্যুত!


প্রভাষ আমিন
প্রকাশিত: মে ১১, ২০২২, ০৩:০২ পিএম
মন্ত্রীর রেল লাইনচ্যুত!

এরপর যদি কেউ রেলপথ মন্ত্রণালয়কে কুফা মন্ত্রণালয় বলেন, তাকে খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না। রেলপথ সবচেয়ে বেশি মনোযোগ ও গুরুত্ব পেয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। আগে রেলপথ ছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আলাদা করে রেলপথ মন্ত্রণালয় করা হয়। শুধু আলাদা মন্ত্রণালয় নয়, বিপুল বিনিয়োগে চেষ্টা হয় রেলপথকে বদলে দেওয়ার। পদ্মা সেতুতে রেললাইন যুক্ত হচ্ছে। ঢাকা থেকে সরাসরি ট্রেনে কক্সবাজার যাওয়ার স্বপ্নও বাস্তবায়নের পথে। কিন্তু রেলের লোকসানের বোঝা কমেনি, কমেনি অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও। আলাদা রেলপথ মন্ত্রণালয় করা হলেও শুরুতে তার দায়িত্ব ছিল যোগাযোগমন্ত্রীর কাঁধেই। রেলপথ মন্ত্রণালয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী হন জাঁদরেল রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কিন্তু এই রেলেই বিসর্জনে গেছে তার সারা জীবনের সব অর্জন। দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে তাকে ছাড়তে হয়েছিল রেলপথ। এরপর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান মুজিবুল হক। সারা জীবন রাজনীতির পেছনে সময় দিতে গিয়ে মুজিবুল হক বিয়ে করার ফুরসত 🐽পাননি। তিনি ছিলেন চিরকুমার সভার আদর্শ। কিন্তু রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে তিনি নিজের জীবনকেও লাইনে তুলে নেন। মন্ত্রী থাকার সময়ে ৬৭ বছর বয়সে বিয়ে করেন তিনি। ৬৯ বছর বয়সে প্রথম কন্যাসন্তানের পিতা হন। আর ৭১ বছর বয়সে হন যমজ পুত্রের পিতা। মন্ত্রিত্ব না থাকলেও মুজিবুল হক বর্তমানে স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে সুখেই আছেন। অভিযোগ আছে, মুজিবুল হকের স্ত্রী রেলওয়েকে বেছে নিয়েছিলেন নিজেদের ভাগ্য বদলানোর উপায় হিসেবে।

বর্তমান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনও ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে। টানা তিনবারের সাংসদ নুরুল ইসলাম সুজন পেশায় আইনজীবী। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের রাতে স্ত্রী বিয়োগ ঘটে তার। এই শোক সামলেও নির্বাচনে জিতে আসেন তিনি। দায়িত্ব পান রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। বছরখানেক আগে তিনি অ্যাডভোকেট শাম্মী আক্তারকে বিয়ে করেন। এখন এই নতুন বউয়ের এক ট𓃲েলিফোনে রেলমন্ত্রীর রেল লাইনচ্যুত হওয়ার দশা। শ্বশুরকুলের তিন আত্মীয় আর তার স্ত্রী মিলে যখন মন্ত্রীর সারা জীবনের অর্জনের ভিত নড়বড়ে করে দিচ্ছিলেন, মন্ত্রী তখন পঞ্চগড়ের বাড়িতে গহন ঘুমের ঘোরে মগন ছিলেন। মন্ত্রী জানার আগেই সারা দেশ জেনে যায় তার স্ত্রী এবং আত্মীয়দের দাপটের খবর।

বাংলাদেশে আমাদের প্রবণতাই হলো, অস্বীকার করা। রেলমন্ত্রীও শুরুতে তাই করেছেন। দাবি করেছেন, আত্মীয় পরিচয় দেওয়া কাউকে তিনি চেনেনই না। কিন্তু মন্ত্রীর স্ত্রীর ফুফাতো বোন সব ফাঁস করে দিলে পুরো পরিস্থিতি লেজেগোবরে হয়ে যায়। মন্ত্রীর স্ত্রীর ফুফাতো বোন দাবি করেছেন, পুরো ঘটনার সময় মন্ত্রীর স্ত্রী তার সঙ্গেই ছিলেন। সেই ফুফাতো বোনের ছেলে প্রান্তই এ ঘটনার নাটের গুরু। মন্ত্রী শুরুতে সাংবাদিকদের কাছে অস্বীকার করলেও সেই ‘আপা’কে ফোন করে বলেছেন, তিনি যেন কিছু মনে না করেন। সেই আপা কিছু মনে করেননি, তবে সাংবাদিকদের কাছে খোলা মনে সব বলে দিয়েছেন। তাই অস্বীকার করেও পার পাননি মন্ত্রী। এক দিনের মধ্যেই সব স্বীকার করতে হয়। স্ত্রীর আচরণে নিজে বিব্রত হয়েছেন এবং তার স্ত্রীর এটা করা ঠিক হয়নি বলেও মেনে নেন তিনি। শুধু নামে নয়, কাজেও সুজন রেলমন্ত্রী। রাজনীতিবিদ বা মন্ত্রী হিসেবে তার বিরুদ্ধে এত দিন কোনো অভিযোগ ছিল না। শাম্মী আক্তার এখন এক প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছেন। সত্য-মিথ্যা নানান গুজবে সয়লাব ফেসবুক। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন নাকি শাম্মী আক্তারের ষষ্ঠ স্বামী। আর তিনি যে ষষ্ঠ স্বামী, সেটা নাকি মন্ত্রী জানতেন না। এখন জানা যাচ্ছে, মন্ত্রী নিজে সুজন হলেও তার স্ত্রী ততটা ‘সুজন’ নন। এবারের ফোনকল সারা দেশকে নাড়িয়ে দিলেও এ ধরনের ঘটনা নাকি প্রায়ই ঘটে। মন্ত্রী🎶র স্ত্রী নেতৃত্বে রেলকে ঘিড়ে একটা অসাধু চক্র গড়ে উঠেছে বলেও সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে।

খবর যা বেরিয়েছে, তাতে রেলমন্ত্রীর শ্বশুরকুলের তিন আত্মীয় বিনা টিকিটে রেলের এসি কেবিনে চড়ে বসেছিলেন। টিটিই শফিকুল ইসলাম তাদের জরিমানা করে এসি কেবিন থেকে শোভন শ্রেণিতে পাঠিয়ে দেন। তাতেই উত্তপ্ত হয়ে যায় পরিস্থিতি। সেই ট্রেন ঢাকা পৌঁছার আগেই মধ্যরাতে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর ফোনে বরখাস্ত হয়ে যান সেই টিটিই। রেলমন্ত্রীর আত্মীয়দের অভিযোগ, টিটিই তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। এখানে অনেকগুলো অভিযোগ, প্রথম অভিযোগ, রেলমন্ত্রীর তিন আত্মীয়ের বিনা টিকিটে রেলে চড়া। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। টিটিই সেই শাস্তি তাদের দিয়েছেন। টিটিইর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বিনা টিকিটের যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। বিষয়টি তদন্ত হচ্ছে। তবে আমি এ অভিযোগ অবিশ্বাস করিনি। শুধু রেলওয়ে নয়, বাংলাদেশের সরকারি সেবা খাত মানেই হয়রানির অনন্ত উৎস। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাধারণ মানুষকে মানুষই মনে করেন না।꧋ পাসপোর্ট বলেন, এনআইডি বলেন, বিআরটিএ বলেন, রাজউক বলেন, বিদ্যুৎ অফিস বলেন, তিতাস বলেন, হাসপাতাল বলেন, বিমান বলেন, রেল বলেন; সবখানেই ভোগান্তির হাটবাজার। সাধারণ মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কারণে কাউকে বরখাস্ত করতে হলে প্রতিদিন হাজার হাজার কর্মচারীকে বরখাস্ত করতে হবে। তবে টিটিই শফিকুল কোনো সাধারণ মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেননি, করেছেন মন্ত্রীর আত্মীয়দের সঙ্গে, তা-ও আবার নতুন শ্বশুরকুলের আত্মীয়। তাই বেচারা ফেঁসে গিয়েছিলের। তবে সবচেয়ে বড় ব্যত্যয়টা ঘটিয়েছেন মন্ত্রীর স্ত্রী। তিনি মধ্যরাতে ফোন করে তাৎক্ষণিকভাবে টিটিইকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেন এবং মন্ত্রীর অজান্তে তা কার্যকরও হয়ে যায়। প্রশ্ন উঠেছে, রেল মন্ত্রণালয় চালায় কে? মন্ত্রী না মন্ত্রীর স্ত্রী? মন্ত্রী দাবি করেছেন, কোনো অভিযোগ থাকলে তার স্ত্রীর উচিত ছিল তাকে ফোন করে জানানো। সরাসরি রেল কর্মকর্তাকে ফোন করে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলাটা বেআইনি। এটাকে ক্ষমতার অপব্যবহার বলা যাবে না। কারণ, রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর তো কোনো নির্বাহী ক্ষমতাই নেই। কাগজে-কলমে মন্ত্রী-এমপির স্ত্রীদের কোনো ক্ষমতা না থাকলেও আড়ালে-আবডালে মিসেস মন্ত্রী-এমপিদের অনেক দাপটের কথা শুনি। তবে রেলমন্ত্রীর স্ত্রী সেই আড়ালটা সরিয়ে দিলেন। রেলমন্ত্রীকে ঘুমে রেখে তার স্ত্রীর সারা দেশকে জাগিয়ে দেওয়ার ঘটনা দেখে আমার খালি একটা কবিতার লাইন মনে পড়ছে—রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রাণী।

মন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশে বরখাস্ত হওয়ার এক দিনের মধ্যে আবার মন্ত্রীর নির্দেশে কাজে যোগ দিয়েছেন আলোচিত টিটিই শফিকুল ইসলাম। এটা দেখে ক্ষমতা নিয়ে রেলসংক্রান্ত একটা গল্প মনে পড়ে গেল। সেই গল্পটি দিয়ে শেষ করছি লেখাটি। নতুন বিয়ে করা বউ নিয়ে রেলের গার্ড এসেছেন অফিসে। গার্ড ব্যস্ত স্ত্রীকে তার ক্ষমতা দেখাতে। একপর্যায়ে গার্ড দেখলেন একটি ট্রেন আসছে। হাতের লাল পতাকা দেখিয়ে গার্ড ট্রেনটি থামিয়ে দিলেন। স্ত্রী তো স্বাম🐻ীর ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ। কিন্তু বিনা কারণে ট্রেন থামানোয় স্টেশন মাস্টার আবার গার্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন। হতাশ স্ত্রী বললেন, এই তোমার ক্ষমতা? গার্ড বললেন🅰, আমি আমার ক্ষমতা দেখিয়েছি। স্টেশন মাস্টার তার ক্ষমতা দেখিয়েছেন।

আসলে সমস্যা হলো আমরা সবাই দায়িত্বকে ক্ষমত🐈া হিসেবে ভুল করি। আর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করি। আর সীমা লঙ্ঘনকারীকে যে কেউই পছন🍰্দ করেন না, এ ঘটনায় সেটি আবার প্রমাণিত হলো।

Link copied!