একাত্তর একবারই এসেছিল। কিন্তু এর মহোত্তম স্পৃহা ফিরে ফিরে আসে বারবার। নদীর স্রোত যেমন মুছে দেয় কূলের জড়তা। একটি জাতিকে নিরাপদ, সুরক্ষিত ও সার্বভৌম রাখতে একাত্তর যেন এক রাত জাগা অতন্দ্র গেরিলা। ꦦএকাত্তরের জনযুদ্ধ যুগে যুগে কালে কালে অবিস্মৃত। জনপদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে আলোড়িত করার বাতিঘর এই একাত্তর। এ শুধু কোনো সংখ্যা নয়। নয় কোনো নির্দিষ্ট সাল মাত্র। অবিনাশী ১৯৭১ আমাদের জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে তীব্র দাগ বসানো এক প্রহর। এ ক্ষণ থেকে আজকের দিন পর্যন্ত অশ্রু ঝরে, রক্ত ঝরে, হাহাকার দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হয়।
কিন্তু বেদনা পর্বই কি শুধু একাত্তরের একমাত্র পরিচয়? নিঃসন্দেহে তা নয়। ১৯৭১ সাল অনিঃশেষ এর বহুমাত্রিকতায়। এতে যুক্ত গর্ব ভরা উল্লাস আর মাথা উঁচু করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রেরণা। জাতির ভাগ্যাকাশের নক্ষত্র হয়ে পথ দেখাꦛনো এক পর্বের নাম একাত্তর।
সেই অসমাপ্ত জনযুদ্ধের আঁচ থেকে আমরা কোনো দিন বিযুক্ত হতে পারব না। জাতিরাষ্ট্রের জন্মলগ্নের ক্ষণ থেকে আজকের দিন পর্যন্ত একাত্তর নিয়ে শিল্প, সাহিত্য আঙিনা উচ্চকিত। সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধ অগণন কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্রস💃হ শিল্পের সকল মাধ্যমে বিরাজিত। কিন্তু ‘সকল’ আর ‘কেউ কেউ’য়ের মধ্যে তফাৎ থাকে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম রচিত অবিনশ্বর সৃষ্টি ‘একাত্তরের দিনগুলি’র অনন্যতা এখানেই। ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা শহীদ রুমীর মা এই জা🦩হানারা ইমাম। আমাদের জনপদে তাকে নতুন করে পরিচিত করার কিছু নেই। তার লিখিত এই বই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ভাবনায় যেন ভর কেন্দ্র হয়ে ভাস্বর। ছেলে, স্বামী হারানোর ব্যক্তিগত বেদনা ছাপিয়ে শহীদ জননীর এই সৃষ্টি যুদ্ধরত একটি জাতির মনোজগতের প্রামাণ্য দলিল হয়ে স্বতন্ত্র। শহীদ জননীর আরও সাহিত্য কর্ম আছে। কিন্তু শুধু ‘একাত্তরের দিনগুলি’ জন্য তিনি মা হয়ে উপাস্য একটি জাতির।
এই কীর্তিমতী নারী জাহানারা ইমামের জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ মে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের সুন্দরপুর গ্রামের এক রক্ষণশ🅰ীল বাঙালি মুসলমান পরিবারে তার আবির্ভাব। ১৯৪৪ সালে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে♈। এখান থেকে বিএ পাস করেন ১৯৪৭ সালে। বিখ্যাত স্থপতি শরিফুল আলম ইমাম তার স্বামী। দেশবিভাগের পর পরিবারের সঙ্গে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৬০ সালে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৬১ সালে এমএ পড়াকালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে ছয় মাস যুক্তরাষ্ট্রে পাঠ নেন তিনি। সেখান থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ১৯৬৫ সালে বাংলায় এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় জাহানারা ইমামের অসামান্য🥂 সৃষ্টি ‘একাত্তরের দিনগুলি’। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ এই বই সম্পর্কে লিখেছেন,
“ . . .যদিও এই গল্প তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত গল্প। জননীর তীব্র শোক ও বেদনার গল্প। নিজের গল্প দূর থেকে দেখতে পারেন তাঁরাই, যারা বড় শিল্পী। গভীর আবেগকে সংযত করবার জন্য প্রয়োজন হয় একটি পাষাণ হৃদয়ের। সত্যিকার শিল্পীদের হৃদয় হয় পাথরের, নয়তো এত দুঃখকে তাঁরা কোথায় ধারণ করবেন? জাহানারা ইমাম হৃদয়কে পাথর করে লিখলেন তাঁর ডায়েরি। কী অসম্ভব আন্তরিকতা সঙ্গেই না তাঁর গল্প বলে গেছেন। সেই গল্প তাঁর একার থাকেনি। কোন এক অলৌকিক উপায়ে হয়ে গেছে আমাদের সবার গল্প। . . . ”
: হুমায়ূন আহমেদ, বিচিত্রা
‘একাত্তরের দিনগুলি’ এক শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মুক্তিযুদ্ধ আখ্যান। কিন্তু সৃষ্টি গুণে এটি সব শ্রেণির মানুষের। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার চাপিয়ে দেওয়া গণহত্যার বিবরণ আর শহরের বিভীষিকা পরিস্থিতির এক নিখুঁত বর্ণনা সমন্বিত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য পর্ব ঢাকার গেরিলা🤪 যুদ্ধ চলচ্চিত্র ছাপিয়ে যেন মূর্ত হয়েছে এ সাহিত্যে। বাদ যায়নি গণহত্যার পক্ষ নেওয়া মাতৃভূমির সঙ্গে বেঈমানি করা ঘাতক গোষ্ঠীর পরিচয় উন্মোচনে। বেদনা যেমন আছে তীব্র হয়ে এ বইয়ে, তেমনি প্রতিরোধের সাহস যোগানোর সামর্থ্য জোগায় ‘একাত্তরের দিনগুলি’।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিল্প সাহিত্য এখন যেমন হচ্ছে, নিশ্চিত ভাবে বলা যা💫য়, ভবিষ্যতেও তা হবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তাতে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ চিরকাল অনতিক্রম্য হয়েই থাকবে। এই বই শিশুর জন্য, কিশোরের জন্য, তরুণের জন্য, প্রবীণের জন্য। সব বিভেদের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে এ বই সর্বজনের হয়েছে। এই বইয়ের প্রকাশিত পুনর্মুদ্রণ তালিকার দীর্ঘ সারি তাই প্রমাণ করে। জনযুদ্ধের বহু দিক নিয়ে অনেক সৃষ্টিমানের অনেক সৃষ্টি আছে। কিন্তু ‘একাত্তরের দিনগুলি’কে উল্লেখ করা যায় এক জরাহীন হিরণ্ময় সৃষ্টি রূপে। শহীদরা ঘুমান না। তারা প্রতিটি জুলুমের বিরুদ্ধে সদাজাগ্রত প্রতিরোধ শক্তি হয়ে আমাদের পাশেই থাকেন। একটি মলাট বন্দি বই হয়েও জীবিত প্রাণময় এক সৃষ্টির বিরল নমুনা এই ‘একাত্তরের꧒ দিনগুলি’।