ইতিহাস দেখায়, এই ভূখণ্ডের মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়েছে, ভাষার অধিকারের জন্য লড়েছে, শিক্ষার অধিকারের জন্য লড়েছে। ইতিহাস মানে পুরনো দিনের কথা। কিন্তু ইতিহাস মানেই পুরনো নয়। কোনো কোনো ইতিহাস বর্তমানকে সজীব রাখে, আর ভবিষ্যতের স্বপ্নকে জাগিয়ে রাখে। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তার🐈া ইতিহাসের কোনো কোনো ঘটনাকে ভুলিয়ে রাখতে চান। তেমনি এক চাপা পড়া ইতিহাস ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬২। কিন্তু যারা শিক্ষার অধিকারকে সকল মানুষের অধিকার মনে করেন, শিক্ষার মাধ্যমে যুক্তিবাদী মানুষ তৈরি হবে সেটা আশা করেন, শিক্ষাকে ব্যবসা-বাণিজ্যের পণ্যের মতো দেখতে চান না, তাদের পক্ষে ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগের সচিব এস এম শরীফকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিশন গঠন করে। এস এম শরীফ ছিলেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আইয়ুবের প্রাক্তন শিক্ষক। ১১ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিশনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬ জন এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৪ জন সদস্য ছিলেন।
কমিশনের পক্ষ থেকে ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট প্রেসিডেন্টের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন পেশ এবং ১৯৬০ সালের ৮ জানুয়ারি চূড়ান্ত প্রতি💎বেদন পেশ করা করা হয়। শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে।
এদিকে ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই সারা পূর্ব পা🌟কিস্তানে আইয়ুবের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠে। শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ এই আন্দোলনে আরও 💛উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়।
শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শোষক ও শোষিতের স্বার্থ এক নয় তাই শোষক ও শোষিতের দ্বন্দ্ব অনিবার্য। ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা এবং চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের প্রণীত নীতি এবং আইনের মধ্য দিয়ে। ফলে শিক্ষা নীতিও বহিঃপ্রকাশ ঘটায় শাসক শ্রেণির ইচ্ছার। শরীফ কমিশনের রিপোর্টের মধ্য দিয়েও তার প্রকাশ স্পষ্ট হয়েছিল। যেমন সেখানে অল্প কথায় মূল ভাবের প্রকাশ পেয়েছিল এইভাবে যে, শিক্ষা সস্তায় পাওয়া যাবে না। শিল্পে বিনিয়োগকে যে দৃষ্টিতে দেখা হয় শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগকেও তেমনিভাবে দেখতে হবে। অবৈতনিক শিক্ষার ধারণা অবাস্তব। উর্দুকে মুষ্টিমেয় লোকের পরিবর্তে জনগণের ভাষায় পরিণত করতে হবে। পাকিস্তানের জন্য অভিন্ন বর্ণমালা হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রবর্তন করার সুপারিশ করা অথবা নিদেন পক্ষে রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব সেখানে ছিল। ফলে অন্য আর কী বিষয় সেখানে ছিল তা বিবেচনার চাইতে কমিশনের মূল দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পেরেই 🌸ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
একদিকে শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করা ও ধনীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজে লাগানো এবং বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নতুন আঘাত—এই দুই কারণে ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। শিক্ষার আন্দোলন আর গণতান্ত্রিক আন্দোলন এক সূত্রে গাথা হয়ে পড়ে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সারা পূর্ব বাংলায় ছাত্র ধর্মঘট আহবান করা হয়। সফল ধর্মঘটের সময় ছাত্র মিছিল যখন হাইকোর্ট পার হয়ে আবদুল গনি রোডে প্রবেশ করছিলো তখন মিছিলে গুলি করে। গুলিতে নিহত হন বাবুল (একজন কর্মচারী), মোস্তফা (বাসের কন্ডাক্টর), ওয়াজিউল্লাহ (গৃহ ভৃত্য, হাসপাতালে মারা🔯 যান)। আহত অসংখ্য। শিক্ষার আন্দোলনে শ্রমজীবীদের ছাত্রদের সঙ্গে সামিল হওয়া এবং জীবন দেওয়ার মধ্য দিয়ে আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে।
এরপর আন্দোলন সংগ্রামের পথে দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু শিক্ষা এখনও জনগণের অধিকার হতে পারেনি। শিক্ষা এখন শুধু ব্যয়বহুল পণ্য শুধু নয়, মানুষের মধ্যে বিভক্তি তৈরির অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা বাণিজ্য লাভজনক, শিক্ষার ব্যয় অসহনীয়, ধনীদের জন্য মানসম্পন্ন আর সাধারণ মানুষের মানহীন শিক্ষা, বেসরকারি ও বাণিজ্যকরণ প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত, সাম্প্রদায়িকীকরণ শিক্ষার মর্মবস্তুকে শেষ করে দিচ্ছে, টাকা যার শিক্ষা তার এই নীতিতে শিক্ষা ব্যবস্থা চলছে। স্বাধীনতার পর ৯টি শিক্ষা কমিশন হয়েছে। কিন্তু সব কমিশনই ꧟শরীফ কমিশনের ভুতকে কাঁধে নিয়ে চলছে।
শিক্ষা হলো জীবন এবং জগতকে জানার মাধ্যম। প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে মানুষ প্রকৃতির নিয়ম জানছে আর সমাজ থেকে শিখছে সমাজের নিয়ম। এইসব নিয়মের নির্যাস থেকে গড়ে ওঠে শিক্ষা।𒅌 পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন, অংক, জীব বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ভাষা সবই তো মানুষের সংগ্রাম আর সাধনার ফল। এ থেকে কোনো মানুষকে বঞ্চিত করা যাবে না। শিক্ষা পণ্য নয়, শিক্ষা মানবজাতির সম্পদ। শিক্ষার ভিত্তি হবে বিজ্ঞান আর শিক্ষার অধিকার হবে গণতান্ত্রিক—এই চেতনা নিয়ে যারা লড়বেন তাদের কাছে ১৭ সেপ্টেম্বর এক অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস।
লেখক : রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট।