লেবাননে সংঘাত বন্ধের লক্ষ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ। এরপরও দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। তাদের দাবি—হিজবুল্লাহ যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ এনেছে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠনটি। দুটো বড় পশ্চিমা রাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি বড় মাইলফলক বলেই বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু এখনও মধ্যপ্রাচ্য সেই শান্ত পরিস্থিতিতে পৌঁছায়নি। নেতানিয়াহু এখন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সব ধরনের তুরুপের তাস হারাতে শুরু করেছেন। তারপরও বিষয়টিকে অত সহজে ইসরায়েল কোণঠাসা—এমন রায় দেওয়া যাচ্ছে না। বরং বিষয়টি আরও জটিল। মধ্যপ্রাচ্যে সংকট শুধু লেবানন নয়, বরং এখন স💞িরিয়া এবং গাজাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই সংকটের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অভিবাসী সংকট এবং গণহত্যা। আরও রয়েছে পশ্চিমা সম্প্রদায়ের ওপর বৃহত্তর চাপের বিষয়। আন্তর্জাতিক আইনের বিষয়ে যে বিভিন্ন মওতবাদ রয়েছে তা নিয়েও রয়েছে একাধিক মন্তব্য। এসব বিষয় বিবেচনা করেই আমাদের এগুতে হবে।
ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে দক্ষিণ লেবাননের লিতানি নদীর উত্তরাঞ্চলে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, এই নদীর দক্ষিণাঞ্চল থেকে অনুমোদিত সব সামরিক অবকাঠামো স🦋রিয়ে নিতে হবে। তবে উত্তরের সামরিক কাঠামোর বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। ফলে সেখানে হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগারে হামলাকে চুক্তির লঙ্ঘন বলে মনে করছে সংগঠনটি।
এর আগে দক্ষিণ লেবাননের পাঁচটি গ্রামে ট্যাংক হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে দুজন আহত হন। গ্রামগুলো ইসরায়েল–লেবানন সীমান্ত থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে। চুক্তি অনুযায়ী, এই এলাকা🌱গুলোতেও যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। ত🅰বে চুক্তির পরও সেখানে যেতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। চুক্তির পর দক্ষিণ লেবাননে আরও হামলা চালানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। দেশটির চিফ অব জেনারেল স্টাফ হেরজি হালেভি বলেছেন, ‘চুক্তির কোনো বিচ্যুতি হলে গুলি চালিয়ে জবাব দেওয়া হবে।’ আর চুক্তি লঙ্ঘন হলে তীব্র লড়াইয়ের জন্য সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এখানেই শেষ নয়। লেবাননের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ যদিও তাদের নাগরিকদের নিজ আবাসস্থলে ফেরার নিশ্চয়তা দিয়েছেন, ইসরায়েল এখনও তা করেনি। বরং দক্ষিণ লেবাননের দশটি গ্রামে বাসিন্দাদের না যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ৬০ দিনের ব্লু লাইন ও অস্ত্রবিরতি আদতে কী অবস্থায় রয়েছে তা বোঝাও কঠিন হয়ে পড়েছে। পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যে বিষয়টি এখনও যুদ্ধাবস্থাই রয়ে গেছে।
বিগত এক বা দেড় বছরে ইসরায়েলের বর্বরতার স্বাক্ষর আমরা পেয়েছি। গাজায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি বোমা বিস্ফোরণের দায় বর্তাচ্ছে তাদের ওপর। গাজায় সুনিপুণভাবে জাতিগত নিধন চালানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা প্রতিনিয়ত যে দৃশ্য দেখতে পাই তা বাস্তবিকই অস্বাভাবিক। নেতানিয়াহু প্রথম কোনো পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নেতা হলেন, যার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। একই সঙ্গে তার সরকারের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও হামাস নেতা মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আইসিসির তিন সদস্যের বিচারক প্যানেল বলেন, তাদের কাছে বিশ্বাস করার মতো কারণ আছে, নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট গাজায় ক্ষুধাকে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধ করেছেন। সেই সঙ্গে হত্যা, নির্যাতন ও অন্যান্য অমানবিক মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন। প্যানেল আরও বলেন, গাজায় বেসামরিক মানুষের ওপর ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যে পরিণত করা হয়েছে। হামাস নেতা দেইফের বিরুদ্ধে হত্যা, নির্যাতন ও জিম্মি করার অভিযোগ আনা হয়। লেবানন ও গাজায় আমরা ইসরায়েলের হামলার একটি বড় প্যাটার্ন লক্ষ্য করবো। উত্তর গাজা পরিপূর্ণভাবে জনশূণ্য করার লক্ষ্যেই তারা হামলার পর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে দেশটি থেকে ইতোমধ্য🅺ে কিছু দিকনির্দেশনাও এসেছে। যেহেতু হামাস ইরানের স♈রাসরি প্রক্সি না তাই এক্ষেত্রে ইরান এদিকে মনোযোগ দেয়নি। অন্যদিকে লেবাননের অবস্থা তারা পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।
লেবানন পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের জন্য টিপিং পয়েন্ট একাধিক কারণে। কারণ লেবাননের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই ভঙ্গুর। তার ওপর ইসরায়েল লেবাননের সবচেয়ে দুর্বল খাতটিকেই সম্ভবত টার্গেট করেছে। দেশটির বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতের ওপর যে হ𒉰ারে হামলা হয়েছে তা সত্যিই ভয়াবহ। হাসপাতাল ও হাসপাতালকর্মীদের ওপর নির্বিচারে হামলা করা হয়েছে। হামলা করা হয়েছে উদ্ধারকর্মীদের ওপরও। গাজায়ও আমরা দেখেছি উত্তর গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালের ডিরেক্টর কদিন 💎আগে আহত হয়েছেন। ফলে ইসরায়েলের হামলার মধ্যে আন্তর্জাতিক আইনকে মানার কোনো প্রবণতাই নেই। বরং রয়েছে তাদের অজুহাত। কখনও হামাসকে আশ্রয় দেওয়ার আবার কখনও হিজবুল্লাহর বোমা বহন করছে অ্যাম্বুলেন্স এসব বলে হামলা। আর ইসরায়েলি কারাগারে কয়েদিদের ওপর নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের বিষয়টি তো রয়েছেই। ইসরায়েলের এই অভিযানগুলো মোডাস অপারেন্ডি নামেই অভিহিত। মোডাস অপারেন্ডিতে বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি অত পাত্তা পায় না।
আমরা দেখছি, যুদ্ধবিরতির প্রথমদিনের বিরাট একটি সময় ইসরায়েল আকাশপথে বোমা হামলায় পার করেছে। লেবাননে বিচ্ছিন্ন এই হামলায় তাদের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন চূড়ান্ত। অথচ পশ্চিমা বিশ্ব এবারও হিজবুল্লাহর ওপর দায় প্রথমে চাপিয়ে দিলো﷽। যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স এক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যে ভূমিকไা রেখেছে তার প্রতি কোনো সম্মান ইসরায়েল না দেখালেও পশ্চিমা বিশ্ব সেদিকে ব্লাইন্ড সাইট রেখেছে। এমনটি হওয়ার কথা ছিলো না।
আঞ্চলিক সমঝোতা ও শান্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ইসরায়েল বরাবরই বিশ্বাসঘাতক বলে পরিচিত। ২০০৬ সালেও লেবাননের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তারা এমনটি করেছে। এবারও তারা একই কাজ করে চলেছে। এমনটি কেন🍷 করছে ইসরায়েল? প্রশ্নটির উত্তর এতক্ষণে না বোঝার কারণ নেই। ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যে আরও বড় পরিসরে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করাই তাদের লক্ষ্য। কারণ ইরান পশ্চিমা বিশ্ব তো বটেই, ইসরায়েলের জন্যও একটি বড় সমস্যা। অন্যদিকে ইরানের লক্ষ্য এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ। এই নিয়ন্ত্রণ আদায়ের জন্য তাদের প্রক্সি তারা চালু রেখেছে। এক্ষেত্রে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে তারা অনেক গুরুত্ব দেয় এমনটি বলা যাবে না। ভূরাজনৈতিক মারপ্যাঁচের হিসেবে সিরিয়া এবং লেবাননে তাদের প্রক্সিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য সংকট ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করেছে। এদিকে নেতানিয়াহু বেশ চাপে আছেন। ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতা নেওয়ার পর ইসরায়েলকে সহায়তা দেবে এটুকু নিশ্চিত হবে। কিন্তু শুধু নেতানিয়াহুকে রাজনৈতিক চাপে না ফেলার ডেমোক্র্যাটিক প্রক্রিয়া থেকে তাকে হয়তো কিছুটা দূরে সরতে দেখা যাবে। ইরানের সঙ্গে বড় পরিসরে যুদ্ধ বাঁধলে এর ভয়াবহতা সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রও তা চায় না। কিন্তু নেতানিয়াহুকে এখন বেপরোয়া হতেইꦕ দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা অত বড় কিছু না হলেও নেতানিয়াহুর জন্য ভয়াবহ শমন। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড আভাস দিয়েছে তারা নিজ দেশে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। ৭টি ইউরোপীয় দেশও স্পষ্ট জানিয়েছে তারা গ্রেপ্তার করবে নেতানিয়াহুকে। নেতানিয়াহুর হাতের অপশন শুধু কমছে। তবে তার বর্বরতা কমছে না।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী