নতুন কারিকুলাম প্রসঙ্গে প্রায় সবাই একটি ব♔্যাপারে একমত হতে পেরেছেন, আমাদের দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও মানসম্পন্ন শিক্ষক প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন মানসম্পন্ন স্কুল। কারিকুলাম সফল করতে হলে আমাদের যে মানসম্পন্ন ও সচেতন অভিভাবকও দরকার, সেটা হয়তো কেউ সেভাবে ভে✃বে দেখেননি। আজ অভিভাবকরাই সন্তানের শেখার, ব্রেইন স্টর্মিং ও পারদর্শিতা অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা।
নতুন কারিকুলাম আসার আগের কথা একটু মনে করার চেষ্টা করি। পুরোনো দিনগুলোতে মাত্র প💟ঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাগুলোতেও দেদারসে প্রশ্নফাঁস হতো। নিশ্চয়ই সেসব প্রশ্নফাঁসে শিক্ষক জাতীয় ব্যক্তিরাই সংশ্লিষ্ট থাকতেন। কিন্তু শিক্ষকদের কী দায় ছিল, প্রশ্নফাঁসের ঝুঁকি নেওয়ার? পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই প্রশ্ন ফাঁসের মতো জটিল দুর্নীতিগুলো বোঝে না! কোথাও না কোথাও প্রশ্নগুলো꧋র জন্য যথেষ্ঠ চাহিদা ছিল। এ কথা এখন আর খোলাসা করে বলার দরকার নেই যে এই চাহিদা কাদের মধ্যে ছিল। বুদ্ধিমান পাঠকেরা ইতোমধ্যেই টের পেয়ে গেছেন, প্রশ্নগুলো অভিভাবকেরাই তাদের সন্তানের মঙ্গলের (?) জন্য সংগ্রহ করতেন। শুধু পঞ্চম শ্রেণির প্রশ্নই নয়, একেবারে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নও কেনাবেচা হতো লাখ লাখ টাকায়। একজন শিক্ষার্থীর নিশ্চয়ই লাখ লাখ টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই। তাহলে এ প্রশ্নগুলো কারা কিনত, সেটাও ভেবে দেখবেন একটু।
সন্তানের একটু ভালো রেজাল্টের জন্য অভিভাবকেরা কত কষ্টই না করতে পারেন, সেসবের দু একটা উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। বিগত বছরগুলোর পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ডাল-ভাত হয়ে পড়েছিল। আর পাবলিক পরীক্ষার দিনে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে অভিভাবকেরা ভিড় জমাতেন কোচিং সেন্টারগুলোতে। বিজ্ঞান বিষয়ের পরীক্ষার দিনগুলোতে বুয়েট, ঢাবির হলগুলোতে অভিভাবকেরা ঝাঁক ঝাঁক মশার মতো জমায়েত হতেন, এসব প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করার জন্য। আপনারা জানেন, বুয়েট, মেডিকেল, ঢাবির শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি করে হাতখরচের টাকা আয় করে থাকেন এবং টিউশনির জন্য অভিভাবক মহলে এ শিক্ষার্থীদের চাহিদা তুঙ্গে। তাহলে বুঝতেই পারছেন, আমাদের অভিভাব🧸কেরা তাদের সন্তানের মঙ্গল (?) কামনায় কত কষ্টই না করতে পারেন! প্রশ্নফাঁস ও পরীক্ষার আগেই সেসব প্রশ্ন উত্তর সংগ্রহ করে সন্তানের হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে না পারলে যেন তারা ভালো অভিভাবকই নন। এক সময়ে অভিভাবকেরাই পরীক্ষার হলে নিজ সন্তানকে নকল সরবরাহ করতেন, সেদিন তো আজ আর নেই। তাই পরীক্ষার হলে শিক্ষক যদি কড়া গার্ড দেন, আর সন্তান দেখাদেখি করে পরীক্ষা দিতে না পারে, সেজন্য পথেই সেই শিক্ষককে আক্রমণ করে বসতে পারেন। সে উদাহরণও রয়েছে। এ অবস্থায়, ছাপোষা বানিয়ে রাখা শিক্ষকদের আর কী-ই𓄧 বা করার থাকে?
নতুন কারিকুলাম আসার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকেরা এর বিরুদ্♌ধে উঠে পড়ে লেগেছেন। কারিকুলাম নতুন হলে কী হবে, অভিভাবকেরা তো সেই পুরোনো মানসিকতার ধারক-বাহকই রয়ে গেছেন। সন্তানের রেজাল্ট নিয়ে অভিভাবকদের প্রতিযোগিতা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ম্যাচের চেয়েও উত্তেজনাকর। অভিভাবকদের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার ভাইরাস সংক্রমিত হয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। সন্তানের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি করে নিজে বীরত্বের স্বাদ নেওয়া অভিভাবকেরা শিক্ষা ব্যাপারটিকেই এখন প্রতিযোগিতার পর্যায়ে নামিয়ে ফেলেছেন। কেউ আর শিক্ষাকে প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না। না শিক্ষার্থী, না অভিভাবক, এমন কি শিক্ষকেরাও নন। যেন সারাক্ষণ একটা রেস হচ্ছে, আর সে ইঁদুর দৌড়ে জিততেই হবে। গ্রেডিং সিস্টেম চালু হলেও ওই প্রতিযোগিতার কোনো হেরফের হয়নি। এ প্লাস পাওয়ার পরেও একটা কাল্পনিক স্বর্ণালি এ প্লাসের উদ্ভব হয়েছে অভিভাবকদের মস্তিষ্ক থেকে। চাইলে তারা প্লাটিনামীয় এ প্লাসেরও জন্ম দিয়ে দিতে পারেন। এ ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনার জন্য সরাসরি নম্বর পদ্ধতি নতুন কারিকুলামে রাখা হয়নি। ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজের মাধ্যমের তাদের মূল্যায়ন করে, পরে সূত্রে সেসব মান বসিয়ে, হিসাব করে তাদের চূড়ান্ত পারদর্শিতার স্তর নির্ণয় করা হবে। অভিভাবকেরা প্রথমেই ক্ষেপে উঠলেন, ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ দিয়ে কেন মূল্যায়ন হচ্ছে, এতে তো আগের মতো প্রেস্টিজ ইস্যু নিয়ে অভিভাবক মহলে প্রতিযোগিতা করা যাবে না! এখন অসচেতন অভিভাবকদের কাছে এ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় হয়ে উঠেছে ত্রিভুজ সংগ্রহের প্রতিযোগিতা। নতুন বোতলে পুরোনো সেই পানীয়ই তারা পান করতে চাইছেন। এখানে পরিবর্তন আসবে কীভাবে?
যে অভিভাবকেরা এক কালে প্রশ্নফাঁস করতেন, পরীক্ষার আগে প্রশ্ন নিয়ে কোচিং সেন্টারগুলোতে উত্তর সংগ্রহের জন্য ভিড় জমাতেন, সেই অভিভাবকেরা এখন ত্রিভুজ পাওয়ার প্রতিযোগিতা তৈরি করছেন। আর সেজন্য শিক্ষার্থীদের জন্য দেওয়া বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট বা কাজ নিজেরা করে দিচ্ছেন! সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ ছিল, তাদের পরিচিত তিনটি যানবাহনের ছবি বা মডেল তৈরি করার। এটি স্কুলেই সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেওয়া ছিল। অনেক স্কুলের সময় ও ব্যবস্থাপনা সীমাবদ্ধতার কারণে হয়তো বিকল্প হিসেবে বাসা থেকে কিছু প্রাথমিক কাজ করে নিয়ে আসার কথা বলা হয়। আর তাতেই অভিভাবকেরা এসব মডেল নিজেরা তৈরি করে দিচ্ছেন। এক অভিভাবক স্বনামখ্যাত একটি দোকান থেকে একটি যানের রেপ্লিকা কিনে এনে সন্তানকে ধরিয়ে দিয়েছেন, প্রেজ༒েন্টেশনের জন্য! এতে তিনি সন্তানের কী উপকার বা মঙ্গল করছেন, তিনিই জানেন। আবার গর্ব করে এসব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে নতুন কারিকুলামের বিষোদগার করেছেন।
একজন অসচেতন অভিভাবক হিসেবে ওই ব্যক্তির জানার কথা নয়, শিক্ষার্থীদের এসব যানবাহনের মডেল বা ছবি আঁকার কী মানে হয়। কারণ, অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, এরোনোটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা নেভাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ধারণা অসচেতন অভিভাবকদের থাকে না। হালের ক্রেজ টেসলা গাড়ির কথাও সেই অভিভাবক জানেন না , নিশ্চিত করেই বলা যায়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ যুগে, নতুন যুগের নতুন যানবাহন নিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার, ব্রেইম স্টর্মিংয়ের সুযোগটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই অভিভাবকদের অসচেতনতার জন্য। অনেক অভিভাবক অভিযোগ করেন, শিক্ষার্থীরা সব চ্যাট জিপিটি দিয়েই লিখিয়ে নিচ্ছে। প্রশ্ন থাকবে, অভিভাবকদের কাছে, ঘরে তাহলে অভিভাবক হিসেবে কী তদারকি করেন? নতুন যুগে প্রযুক🐭্তি থেকে কেউই দূরে থাকতে পারে না। কিন্তু তাই বলে প্লেজারিজম হচ্ছে কিনা, শিক্ষার্থী হুবহু কপি পেস্ট করে দিচ্ছেন কিনা, এটাও কি ঘরে ঘরে এসে শিক্ষকদের দেখা সম্ভব? নতুন কারিকুলাম যেখানে শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতার ওপর ভিত্তি করে, শিক্ষার্থীর নিজে শেখার ওপর ভিত্তি করে করা, সেখানে এমন অভিভাবক থাকলে, তা কীভাবে সম্ভব? অভিভাবক নিজেই আজ সন্তানের শেখার, ব্রেইন স্টর্মিংয়ের ও পরাদর্শিতা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।
নতুন কারিকুলাম নিয়ে নানান সময়ে অভিভাবকরা এত বেশি নেতিবাচকতা ছড়াচ্ছেন, এর বাজে প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপরেও। শিক্ষার্থীরা নতুন কিছু করতে চায়, তারা জানতে চায়। কিন্তু অভিভাবকরা যখন নেতিবাচক কথা বলেন, শিক্ষার্থীরা তখন দ্বিধান্বিত হ🌳য়ে পড়ে। কারিকুলাম নিয়ে তাদের মনে অহেতুক ভীতি তৈরি করে দিচ্ছেন, অভিভাবকেরা।