সম্প্রতি জাতিসংঘের এক আর্থিক প্🐬রতিবেদনে প্রকাশ্যে বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের বিকল্পের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা ও একতরফা সিদ্ধান্তের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র ইউরোপও আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। ইউরোপের পরিবর্তনপন্থী অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা পৃথিবীর জনসংখ্যার ৪ শতাংশ; কিন্তু কভিড-১৯-এ মৃত্যুবরণকারীদের মোট ২৫ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এ অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ অনুসরণ ইউরোপের জন্য বোকামি ছাড়া কিছু নয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক দেশ আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে সোনা বা বিশেষ অঙ্কন অধিকার বা এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইট—আইএমএফের অ্যাকাউন্টের একক) বিবেচনা করছে। দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহার করার জন্য বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাও এখন লক্ষণীয়। বিশ্লেষকেরা এই পরিস্থিতিকে একবিংশ শতকের মুদ্রাযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন।
অর্থবিত্ত ও সমরাস্ত্রে শক্তিশালী দেশগুলো এই মুদ্রাযুꦚদ্ধে শুরু করলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেকটা বাধ্য হয়ে এই পথে হাঁটছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাঁচাতে বিলাসপণ্য আমদানিসহ বিদেশ ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপের পাশাপাশি আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা সম্প্রতি বৈদেশিক লেনদেনে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রা মার্কিন ডলারের বিকল্প অনুসন্ধানে উদ্যোগী হয়েছেন। তারা বলছেন, দ্বিপক্ষীয় মুদ্রা বিনিময় (কারেন্সি সোয়াপ) নিয়ে বাংলাদেশ কাজ করছে। যেহেতু বাংলাদেশ রাশিয়া, চীন ও ভারত থেকে খাদ্য, জ্বালানি ও শিল্প কাঁচামাল আমদানি বেশি করে, সেহেতু প্রাথমিকভাবে ভারতীয় মুদ্রা রুপি, চীনের মুদ্রা রেনমিনবি এবং রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে লেনদেন হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেনের জন্য ডলার, ইউরো, রুপি এবং আরএমবির ব্যবহার অনুমোদন করেছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনে বাংলাদেশ সরকারের এই পরিকল্পনা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিবাচক। ডলারের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারলে বছরে অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব। তবে বাংলাদেশকে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে—বাণিজ্য লেনদেনে বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থার প্রবর্তনে অংশীদার পক্ষগুলোর লেনদেনে কম খরচ, বিনিময় হারের ঝুঁকি হ্রাস এবং নিজস্ব মুদ্রায় আন্তর্জাতিক ঋণ জারি করার সক্ষমতা অর্জন ও বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে সাশ্রয়ের মতো অনেক সুবিধার পাশাপাশি কিছু সমস্যায়ও রয়েছে। যেমন আর্থিক ব্যবস্থাপনায় জটিলতা সৃষ্টি, পোর্টফোলিও কার্যকলাপে অস্থিরতা বৃদ্ধি এবং বৃহৎ পরিবর্❀তনের আশঙ্কায় পুঁজিপ্রবাহের শোষণ করার ক্ষমতাসৃষ্ট চাপ মোকাবিলা করা। এ ছাড়া যেহেতু এখানে ব্যবসায়ীরা তাদের পছন্দের মুদ্রা বেছে নিতে স্বাধীন, তাই তারা তাদের বাণিজ্য বন্দোবস্তে একটি নির্দিষ্ট মুদ্রার পক্ষে অপরিবর্তনযোগ্য মুদ্রার সাথে বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারেন। আরেকটি বড় সমস্যা হলো—অংশীদারদের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি বা বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থেকে উদ্ভূত মুদ্রার বহিঃপ্রবাহ এবং আন্তঃপ্রবাহের ভারসাম্যহীনতাসৃষ্ট জটিলতা। কারণ, বাণিজ্যিক হিসাবে ক্রমাগত ঘাটতি দেখা দিলে অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে সমন্বয়মূলক ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে পুরো প্রক্রিয়াটি চাপের মধ্যে পড়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে।
বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইউক্রেইনে আক্রমণের জেরে রাশিয়াকে সুইফট থেকে বাদ দেওয়ায় বিপদে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন সম্ভব না হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অবরোধের প্রতিশোধ নিতে রাশিয়া ডলারের পরিবর্তে রুবল দিয়ে তার তেল ও গ্যাস কিনতে বাধ্য করেছে ইউরোপের দেশগুলোকে। একইসঙ্গ💟ে দেশটি চীনের মুদ্রা ইউয়ান দিয়ে রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের পাশ্ববর্তী ভারতও আমিরাতের দিরহাম, চীনের ইউয়া💃ন, হকংয়ের ডলার দিয়ে রাশিয়া থেকে জ্বালানি কিনছে। গত এপ্রিলে ইসরায়েল প্রথমবারের মতো দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে চীনা মুদ্রা রেনমিনবি যোগ করেছে। দেশটি নতুন কৌশল হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান ও কানাডিয়ান ডলার ও জাপানের ইয়েনের রিজার্ভও বাড়িয়েছে। বৈশ্বিকভাবে চীন, রাশিয়া, জাপানের মতো কিছু অর্থনীতি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংস্থা আসিয়ান মার্কিন ডলারের বিকল্প অনুসন্ধান ও নিজস্ব মুদ্রাকে আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য অনেক দিন ধরেই জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যা ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর মুদ্রাযুদ্ধে রূপ নিয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বৃত্ত অর্থনীতির যুগ শেষ হলে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্দেশে বিশ্বের অর্থনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেশটি ডলার ছাপানোর বিপরীতে স্বর্ণমান তুলে দিয়ে নির্বিচারে ডলার ছাপানো শুরু করে এবং তা সস্তায় ছড়িয়ে দেয় বিশ্বময়। এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও অনুগত দেশগুলো মার্কিন ডলারের গভীর ম্যারপ্যাঁচে বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি করে বিশাল এক আর্থিকীকরণ𒈔কৃত পুঁজি, যার উৎপাদনশীল বিনিয়োগে কোনো আগ্রহ নেই; তার আগ্রহ হলো—পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সৃষ্ট উদ্বৃত্তের পুনঃচক্রীকরণ-পুনঃআবর্তিকীকরণ।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, মার্কিন ডলার এখনো প্রভাবশালী হলেও কিছু লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক রিজার্ভের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, জাপানি ইয়েন ও ইউরো প্রাধান্য পেলেও এখন তা কমছে। ১৯৯৯ সালে বৈদেশিক রিজার্ভের ৯৮ শতাংশ এসব মুদ্রায় থাকলেও ২০২১ সালে তা ৯২ শতাংশে নেমে এসেছে। নতুন মুদ্রা হিসেবে যোগ দিয়েছে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার ডলার। আইএমএফের ২০২২ সালের প্রথম প্রান্তিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশের কাছে প্রায় ২২৫ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান এবং ২৮৭ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার রয়েছে। রাশিয়া ও চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে উদীয়মান অর্থনীতির জোট ব্রিকস দেশগুলো গত ২৩ জুন চীনের বেইজিংয়ে তাদের ১৪তম শীর্ষ সম্মেলনে নতুন একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা প্রচলনের পরিকল্পনার কথা জানায়। ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহী তুরস্ক, মিসর, সৌদি আরব ও আর্জেন্টিনা। বিশ্লেকেরা বলছেন, ব্রিকস মুদ্রা মার্কিন ডলার ও আইএমএফের এসডিআর মুদ্রার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো শক্তি অর্জন করতে পারে। কেননা, ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে রাশিয়ান ফেডারেশন এবং ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ৩৮ শতাংশ বেড়ে ৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত নমিন্যাল জিডিপি সাড়ে ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ বৈশ্বিক অর্থনীতির ২৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১২ ট্রিলিয়ন ডলার (বৈশ্বিক রিজার্ভের ৪০ শতাংশ)। রপ্তানি বাণিজ্য ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং আমদানি বাণিজ্য দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৯৭ ট্রিলিয়ন ডলার। ফলে একটি শক্তিশালী রিজার্ভ মুদ্রা তৈরির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে ব্রিকসের। এ ছাড়া বিটকয়েনসহ ক্রিপ্টো কারেন্সি নামের মুদ্রাগ🌠ুলো বৈধতা পেলে ভার্চুয়াল মুদ্রা বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে নতুন রাজা হিসেবে কোনো একদিন ডলারের স্থলাভিষিক্ত হয়ে উঠতে পারে।
ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য মার্কিন ডলারকে পাশ কাটিয়ে অন্য দেশের সঙ্গে আন্তঃমুদ্রায় লেনদেনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত আর্থিকীকরণকৃত বিশ্ববাণিজ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়ার আশঙ্কা। বাংলাদেশ রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে রুবল ও ইউয়ানে বাণিজ্য লেনদেন করলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই ভালো চোখে দেখবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ২৬ শতাংশ এবং আমদানির সাড়ে ৩ শতাংশ হয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। ডলারের দাম বাড়ায় রপ্তানি করে ভালো আয় হচ্ছে এবং আমদানি কম হওয়ায় কিছুটা সাশ্রয় হচ্ছে। অন্যদিকে মোট আমদানির সাড়ে ১৪ শতাংশ এবং রপ্তানির ৩ শতাংশ হয় ভারতের সঙ্গে। এসব লেনদেন সম্পন্ন হয় ডলারে। ফলে আমদানি বেশি হয় বলে খরচ বেশি হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যে টাকা ও রুপি ব্যবহার করলে বেশ সাশ্রয় হবে। কেননা, ডলারের বিপরীতে রুপির দরপতন টাকার চেয়ে বেশি হয়েছে। কিন্তু ভারতে রপ্তানি কম বলে রুপির জোগান কম। এক্ষেত্রে টাকা রুপির বিনিময়ে জোর দিতে হবে। দেশের মোট রপ্তানির ৫৬ শতাংশ এবং আমদানির ৮ শতাংশ হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে। ইউরোর দাম কমায় রপ্তানি আয় কম হবে। আমদানি ব্যয়ও কমবে। কিন্তু ইউরোপ থেকে আমদানি কম। ফলে রপ্তানি করে পাওয়া ইউরো ব্যবহারের ক্ষেত্রও কম। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি খুব ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি