আমার বাসার কাছেই রায়েরবাজার। রায়েরবাজার মানেই অনেকের কাছেই বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। সারা বছর এ জায়গাটা অরক্ষিত থাকে। ১৪ ডিসেম্বর ভোর থে🧜কে মানুষের ঢল নামে এখানে। কারণ, এখানেই হত্যা করা হয়েছিল আমাদের দেশের সূর্যসন্তানদের। আমি মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করেই ওদিক দিয়ে হেঁটে আসি। অন্ধকারে ডুবে থাকে স্মৃতিসৌধ। কখনো আলো জ্বালিয়ে অনেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চানাচুর, পিঠা বিক্রি করে। কাছে গেলে মনে হবে এটা পাহারা দিতে কারও মনোযোগ নেই। পাহারায় যারা আছে তারা হয়তো এখানের কাজ থেকে অন্য কাজকে বেশি গুরুত্ব দেন। ওখানে নেশাখোররা আড্ডা দেয়, এমন কথা আশপাশের লোকের মুখ থেকে শুনে রাতে ভেতরে যাই না। তবু স্মৃতিসৌধের দিকে ফিরে তাকাতে যেসব বুদ্ধিজীবীর ছবি মুখস্থ হয়ে গেছে, তাদের মুখগুলো ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে প্রত্যক্ষদর্শীদের কত স্মৃতি। সেই সব স্মৃতিচারণা শুনতে শুনতে আমার ভেতরে স্থির একটা চিত্রকল্প দাঁড়িয়ে গেছে। রায়েরবাজার মনে করতেই চোখের গহিনে ভেসে ওঠে একটা ছবি। খালের মতো স্থির জলাভূমি। পাশে ইটের স্তূপ। তার মধ্যে পাশে পড়ে আছে হাত বাঁধা চোখ বাঁধা অনেক মানুষ। এঁরা ছিলেন দেশের সূর্যসন্তান। অসম মেধাবী এসব মানুষকে এখানে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। সবার পোশাকে বোঝা যায় বাসায় যেভাবে ছিলেনℱ তাকে সেভাবে তুলে আনা হয়েছে। সেই সব সূর্যসন্তানদের পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে আরেকটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে, সেটা হলো এসব সূর্যসন্তানের বেশ আগে থেকেই লক্ষ্য করা হতো।
মূল ঘটনার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সঙ্গে একসঙ্গেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন চলাকালে খুঁজে খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ২৫ মার্চের রাতেই হত্যা করা হয়। তবে পরিকল্পিত হত্যার ব্যাপক অংশটি ঘটে যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে। যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত আধা সামরিক বাহিনী আল বদর ও আল শামস বাহিনী একটি তালিকা তৈরি করে, যেখানে এই সব স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ কাজের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। রাও ফরমান আলীর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও গবেষক মহিউদ্দিন সাহেব তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। রাও ফরমান আলী বুদ্ধিজীবী ও গণহত্যার কথা একদম অস্বীকার করেছেন বলে একাধিক পুস্তকেও প্রকাশ হয়েছে। তবে আইয়ুব শাসনামলের তথ্🦩যসচিব আলতাফ গওহরের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে ফরমান আলীর তালিকায় তার বন্ধু কবি সানাউল হকের নাম ছিল। আলতাফ গওহরের অনুরোধক্রমে রাও ফরমান আলী তার ডায়েরির তালিকা থেকে সানাউল হকের নাম কেটে দেন। এ ছাড়া আল বদরদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন বলে তার ডায়েরিতে একটি নোট পাওয়া যায়।
এ ছাড়া তার ডায়েরিতে হেইট ও ডুসপিক নামে দুজন মার্কিন নাগরিকের কথ෴া পাওয়া যায়। এদের নামের পাশে ইউএসএ ও ডিজিআইএস লেখা ছিল। এর মধ্যে হেইট ১৯৫৩ সাল থেকে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীতে যুক্ত ছিলেন এবং ডুসপিক ছিলেন সিআইএ এজেন্ট। এ কারণে সন্দেহ করা হয়ে থাকে, পুরো ঘটনার পরিকল্পনায় সিআইএর ভূমিকা ছিল। (উইকিপিডিয়া)
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ থেকে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেওয়া হতে থাকে। তাদের আল বদর বা পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী তুলে নেওয়ার সময় ওই পরিবারগুলো জেনেছিল কারা তাদের ধরিয়ে দিল। আবার এমন হয়েছে ধরে নেওয়ার পরে কোনো আল বদর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে হয়তো তার পরিবার গিয়েছে, অমনি ওই ব্যক্তি বলেছে, ওরা কেন নিয়ে গেল জানি না, তবে বাসায় যান ফিরে আসবে। আর ফিরে আসেনি। দেশবরেণ্য চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরীর বাসার নিচে থাকতেন মাওলানা মান্নান। সব সময় তার দরজা খোলা থাকত। কিন্তু ডা. আলীম চৌধুরীকে যেদিন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন দরজা বন্ধ ছিল। শত করাঘাতেও দরজা খোলেনি। শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেনকে ১০ ডিসেম্বর রাত সဣাড়ে তিনটায় ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসররা। তাকে পাঞ্জাবি পরার সুযোগও দেওয়া হয়নি। দেশের সূর্য সন্তানদের অনেকের লাশ পাওয়া গিয়েছিল রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। তাদের লাশ দেখে একান্ত কাছের লোক ছাড়া শনাক্ত করা সম্ভব ছিল না। মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখকসহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরেরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। সেদিন প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্যান্য আরও অনেক স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের ওপর বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের নৃশংসভাবে রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়।
বুদ্ধিজীবী হত্যায় এদেশীয় দালালদের ভুমিকা ছিল সবচেয়ে বড়। এ বাহিনীর সদস্যরা বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে যেত নির্যাতন ক্যাম্পে। যেখানে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হতো। সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত করে আনন্দ পেত আল বদর নামের নব্য ড্রাকুলারা। একটি জাতিকে অন্ধ করে দেওয়ার জন্য প♑াকিস্তানি জানোয়াররা সিদ্ধান্ত নেয় জাতিকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করে দেওয়ার।
তবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকে শুধু ঢাকা থেকে দেখা হয়। কিন্তু এটা হয়েছিল সারা দেশে। বিশেষত ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় নিরীহ জনগণের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের সময় থেকেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ। পাকিস্তানি সেনারা তাদের অপারেশন সার্চলাইট কর্মসূচির আওতায় চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে ২৫ মার্চ রাতেই হত্যা করা হয়। তবে বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের বেশ কয়েক দিন আগে বিশেষত ঢাকা শহর ভয়াবহ রূপ নেয়। ১৪ ডিসেম্বর রাতে ঢাকায় দুই শর বেশি বুদ্ধিজীবীকে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয় এবং জানা যায় ওই রাতে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতেই হত্যা করা হয় প্রায় দুই হাজার মানুষকে। বেশির ভাগ সময় তারা শহরে জারিকৃত কারফিউর সুযোগে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যেত✤। তাঁদের ওপর চলত নির্মম দৈহিক নির্যাতন। তারপর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেয়নেটের আঘাতে তাঁদের দেহ ক্ষতিবিক্ষত করে হত্যা করা হতো। ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান বধ্যভূমি ছিল আলেকদি, কালাপানি, জল্লাদখানা, রাইনখোলা, মিরপুর বাংলা কলেজের পশ্চাৎভাগ, হরিরামপুর গোরস্তান, মিরপুরের শিয়ালবাড়ী, মোহাম্মদপুর থানার পূর্ব প্রান্ত ও রায়েরবাজার। এসব জায়গায় বুদ্ধিজীবীদের বহুসংখ্যক মৃতদেহ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা এবং পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় ক্ষতবিক্ষত এই লাশগুলোর অধিকাংশেরই দেহ ফুলে উঠেছিল। তাঁদের বুকে মাথায় ও পিঠে ছিল বুলেটের আঘাত এবং সারা দেহে বেয়নেটের ক্ষতচিহ্ন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন। এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষে এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। আর তাকে তালিকা প্রস্তুতিতে সহযোগিতা ও হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের পেছনে ছিল মূলত এদেশীয় দালালেরা। মুক্তিযুদ্ধের বইপত্র যে কথা বলে তা হলো বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিল বদর বাহিনীর চৌধুরী মঈনুদ্দীন (অপারেশন ইনচার্জ) ও আশরাফুজ্জামান খান (প্রধান জল্লাদ)। ১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করা হয়, যার দুটি পৃষ্ঠায় প্রায় ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কোয়ার্টার নম্বরসহ লেখা ছিল। তার গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিনের দেওয়া সাক্ষ্য অনুযায়ী রায়েরবাজারের বিল ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ী বধ্যভূমি থেকে বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর গলিত লাশ পাওয়া যায়, যাদের সে নিজ হাতে গুলি করে মেরেছিল। আর চৌধুরী মঈনুদ্দীন ’৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিল। বুদ্ধিজীবীদের গতিবিধি দেখার জন্য তাকে পূর্বদেশ পত্রিকায় চাকরি দেওয়া হয়েছিল। যে কারণে সে অবজারভার ভবন থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম ঠিকানা রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমেদকে পৌঁছে দিত। এ ছাড়া আরও ছিলেন এ বি এম খালেক মজুমদার (শহীদুল্লা কায়সারের হত্যাকারী), মাওলানা আবদুল মান্নান (ডা. আলীম চৌধুরীর হত্যাকারী), আবদুল কাদের মোল্লা (কবি মেহেরুন্নেসার হত্যাকারী) প্রমুখ। চট্টগ্রামে প্রধান হত্যাকারী ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার দুই ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াস কাদের চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বধ্যভূমির একটি বর্ণনা শুনলে শরীর হিম হয়ে আসে ‘পাশে দুটো লাশ, তার একটির হৃৎপিণ্ড কে যেন ছিঁড়ে নিয়েছে। সেই হৃৎপিণ্ড ছেঁড়া মানুষটিই হলো ড. রাব্বী। ড. রাব্বীর লাশটা তখনো তাজা। জল্লাদ বাহিনী বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা তুলে নিয়েছে। তারা জানত যে তিনি চিকিৎসক ছিলেন। তাই তার হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে ফেলেছে।’
এমনি আরও অজস্র রোমহর্ষ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। এইඣ ঘাতক দালালচক্র দেশের সঙ্গে♋, স্বজনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নিজেদের তৈরি করে নিয়েছে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম জায়গায়। জাতিকে মেধাশূন্য করার যে প্রক্রিয়া একাত্তরের ঘাতকচক্র শুরু করেছিল, তাদের উত্তরসূরিরাও একই উদ্দেশ্যে এই দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে নানা ভুল তথ্য, ভুল ইতিহাস পরিবেশন করে যাচ্ছে, যাতে করে এ দেশের মানুষ ও প্রজন্মের পর প্রজন্ম একটা বিভ্রান্ত জাতিতে পরিণত হয়। এই ঘাতক দালালদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল ও এই রক্তাক্ত ইতিহাস পাঠ্যক্রমে বিস্তারিতভাবে সংযোজন করা না হলে জাতির সামনে আরও ভয়াবহ সময় আসবে, এতে কোনো ভুল নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক