গত শুক্রবার দুপুরে হঠাৎ আমার স্ত্রী মুক্তি বললো, “চলো সিনেমা দেখতে যাই।” আগের সপ্তাহে ‘দিন দ্যা ডে’ দেখেছি। তাই সেটা বাদ দিয়ে অন্য সিনেমা দেখবো। ‘হাওয়া’র টিকিট যে হাওয়া হয়ে গেছে সেটা আগেই জেনেছি। চঞ্চল চৌধুরী নিজে প্রথম দিন কোথায় সিনেমা দেখবেন, আগের দিনও তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ছিলেন তিনি। কারণ টিকিট পাচ্ছিলেন না। খবꦯরে দেখলাম ‘হাওয়া’র অভিনেত্রী নাজিফা তুষি প্রথম দিন সিনেমা দেখেছেন সিঁড়িতে বসে। তাই ‘হাওয়া’ দেখার চেষ্টা করলাম না। ভাবলাম তিন সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়া ‘পরাণ’ দেখা যাবে নিশ্চয়ই। আমাদের সহকর্মী, যার বাসা বসুন্ধরা সিটির পেছনে, তাকে বললাম যেন গিয়ে আমার জন্য দুটি টিকিট কেটে রাখে। তিনি গিয়ে জানালেন, পরাণ তো পরাণ, কোনো সিনেমারই কোনো টিকিট নেই।
এরপর আমাদের ছেলে প্রসূনের দ্বারস্থ হলাম। ওরা দেখি প্রায়ই অনলাইনে টিকিট কেটে দল বেঁধে ইংরেজি সিনেমা দেখতে যায়। প্রসূন অনলাইনে বসুন্ধরা, সীমান্ত স্কয়ার, বিজয় স্মরণী, সনি, যমুনা—সব ট্রাই করে বললো, “আজ ঢাকায় কোনো টিকিট নেই।” এরপর আমার আরেক সহকর্মীকে অনুরোধ করলাম দুটি টিকিটের জন্য। চেষ্টা করে তিনিও ব্যর্থ হলেন। শেষে উত্তরার দিকে রওয়ানা হলাম ঘুরতে। অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর সেই সহকর্মী ফোন করলেন, “আপনারা কোথায়? সাড়ে ৭টায় সীমান্ত স্কয়ারে যেতে পারবেন?” ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একটু ঝুঁকি আছে। তবুও মুক্তি বললো, “লেটস ট্রাই।” গাড়ি ঘুরিয়ে, ছুটির দিনের জ্যাম ঠেলে ঠিক ৭টা ২৯ মিনিটে সীমান্ত স্কয়ারে সিনেপ্লেক্সে ঢুকতে পারলাম। এত হাঙ্গামা করে সিনেমা দেখার বয়স পেরিয়ে এসেছি অনেক আগেই। তবুও এই হাঙ্গামাটা আমার জন্য দারুণ এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা হয়ে রইল। আশির দশকে মারামারি করে,꧟ ব্ল্যাকারের কাছ থেকে চড়া দামে টিকিট কেটে গরমে ঘেমে সিনেমা দেখার উত্তেজনাটা যেন ফিরে এলো। কয়েক দিন আগে এক আলোচনায় বলছিলাম, একসময় বাংলাদেশে ‘সিনেমার টিকিট ব্ল্যাকার’ বলে একটা পেশা ছিল। সিনেমা হলের সামনে গেলেই শোনা যেত, ‘এই ডিসি ডিসি’। হলের সামনে ঝুলানো থাকতো ‘হাউসফুল’ লেখা বোর্ড। এখন আবার বাংলাদেশে সেই দিন ফিরে এসেছে। টিকিট নিয়ে মারামারি, হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। জানি না বাংলাদেশে আবার ‘সিনেমার টিকিট ব্ল্যাকার’ পেশা ফিরে আসার সময় হয়েছে কিনা? হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। পুরো বিষয়টাই আমার জন্য দারুণ এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা।
আমাদের ছেলেবেলায় সিনেমা ছিল বিনোদনের প্রধান উৎস। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নবিত্তের মানুষও হলে গিয়ে ꦚসিনেমা দেখতেন। সপরিবারে সিনেমা দেখতে যাওয়ার যে উৎসবমুখর আনন্দ, তার তুলনা কিছুতেই নেই। সত্তরের দশকে চট্টগ্রামে সপরিবারে সিনেমা দেখতে যাওয়ার স্মৃতি এখনও আনন্দ দেয় আমাকে। তবে আমার মাথায় সিনেমার পোকাটা ঢুকে কলেজে ওঠার পর। আশির দশকে কুমিল্লায় পাঁচটি সিনেমা হল ছিল। আর আমি সপ্তাহে পাঁচটি সিনেমাই দেখতাম। পরীক্ষা থাকলে একদিনে একাধিক সিনেমাও দেখে ফেলতাম। আব্বা গুনে গুনে টাকা দিতেন, তারপরও সিনেমা দেখার টাকা কিভাবে ম্যানেজ করতাম, সেটা এখনও হিসাব মেলাতে পারি না। খোঁজ নিয়ে জানলাম, কুমিল্লায় এখন কোনো সিনেমা হল চালু নেই। কুমিল্লার মতো একটি ঐতিহ্যবাহী পুরোনো শহরে একটিও সিনেমা হল নেই, এটা অবিশ্বাস্য! ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য গভীর বেদনার। প্রতিটি হলের সাথে জড়িয়ে আছে আমার কত আনন্দ-বেদনার স্মৃতি। তবে শুধু কুমিল্লা নয়, দেশের অন্তত ৩০ জেলায় এখন কোনো সিনেমা হল নেই। নব্বইয়ের দশকেও দেশে হাজার দেড়েক সিনেমা হল ছিল। এ সংখ্যা কমতে কমতে এখন ৬০-এর ঘরে নেমে এসেছে। সিনেমা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনায় অনেকেই মন্তব্য করছেন, “আমার জেলায় তো সিনেমা হল নেই, আমি এই সিনেমা কিভাবে দেখব?”
বাংলাদেশের সিনেমার ধ্বংসের জন্য সিনেমা সংশ্লিষ্ট লোকেরাই দায়ী। নব্বইয়ের দশকে কাঁচা টাকার লোভে অশ্লীলতা আমদানি করে সিনেমাকে নিষিদ্ধ বিনোদন বানিয়ে ফেলা হয়, মধ্যবিত্তের সপরিবারে সিনেমায় যাওয়ার সংস্কৃতিটা ফুরিয়ে যায় তখনই। স্টার সিনেপ্লেক্স এসে মধ্যবিত্তদের আবার হলে ফিরিয়ে আনে। তারা সিনেমা দেখার সংস্কৃতিটায় আভিজাত্যের প্রলেপ দেয়। ব্ল্যাকারের উৎপাত নেই, ঝালমুড়ির বদলে পপকর্ন, কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলের টুংটাং, সম্মোহনীর বদলে ওয়ানটাইম গ্লাসের সফিসটিক্যাসি। এখন আর সিনেমা হলে সিটি বাজে না। ভদ্রলোকেরা নিঃশব্দে সিনেমা দেখেন। বাংলাদেশের সিনেমা🅺কে হল থেকে সিনেপ্লেক্সের আভিজাত্য উন্নীত করা, মধ্যবিত্তকে সিনেমা হলে ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব অবশ্যই স্টার সিনেপ্লেক্সের। তবে আমার কথা যদি বলেন, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সিনেপ্লেক্সে পিনপতন নীরবতায় পপকর্ন খেতে খেতে সিনেমা দেখাটা অতটা রোমাঞ্♌চকর নয়, যতটা ছিল আশির দশকে। মারামারি করে ব্ল্যাকে টিকিট কাটা, কখনো কখনো থার্ড ক্লাশে ঘামে ভিজে যাওয়া, বিরতির সময় কোল্ড ড্রিংসের টুংটাং শব্দ যে ঝঙ্কার তুলতো হৃদয়ে, তার তুলনা কিছুতে পাই না। সিনেপ্লেক্স তবু কোরামিন দিয়ে সিনেমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু গোটা দশেক সিনেপ্লেক্স আর গোটা পঞ্চাশেক সিনেমা হল দিয়ে একটা দেশের সিনেমা শিল্প বাঁচতে পারে না। আবার ২/৩ বছর পরপর দুয়েকটা হিট ছবি দিয়ে সিনেপ্লেক্স বা সিনেমা হল টিকবে না।
তাহলে সমাধান কী? সিনেমা হল এবং সিনেমা শিল্প বাঁচানোর উপায় কী? অনেকে সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। খুব ভালো। কিন্তু দেশজুড়ে সিনেপ্লেক্স গড়ে তুলে সেখানে আপনি দেখাবেন কী? ভালো সিনেমা কোথায়? বিদেশি সিনেমা দেখিয়েই যদি হল-সিনেপ্লেক্সকে টিকে থাকতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের সিনেমা তো টিকবে না। অভিযোগের প্রথম তীর দর্শকদের দিকে। দর্শকরা যান না বলে সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার হল কমে যাচ্ছে বলে ভালো সিনেমা বানানো হচ্ছে না। আমার বিবেচনায় সমস্যাটায় ভালো সিনেমার অভাবের, দোষ দর্শকের নয়। বাংলাদেশের দর্শক সিনেমা দেখেꦺ না, এই অভিযোগ সত্যি নয়। সিনেপ্লক্সে ইংরেজি সিনেমার টিকিটের জন্য তরুণেরা ভোররাত থেকে লাইন ধরে। অত দূর যাওয়ার দরকার নেই। নেটফ্লিক্স আর হইচই-এর কত সাবস্ক্রাইবার আছে দেশে, সেটা হিসাব করুন। তারা যদি পয়সা দিয়ে নেটফ্রিক্স সাবস্ক্রাইব করতে পারে, বিদেশি সিনেমার টিকিটের জন্য ভোররাতে লাইন দিতে পারে, তাহলে তারা হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখে না কেন? দেখে না, কারণ দেখার মতো সিনেমা তৈরি হয় না।
মূল সমস্যা ভালো সিনেমার জোগানে। আর যারা সিনেমা বানান, তাদের অভিযোগ, মূল সঙ্কট পুঁজির। যেহেতু সিনেমা হিট করে না, তাই কেউ এখানে বি𝓡নিয়োগ করে না। আর টাকা নেই বলে ভালো সিনেমা বানানো যাচ্ছে না। আমি এই যুক্তির সাথে একমত। হলিউড-বলিউডে শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সিনেমা বানানো হয়, লাভ হয় তার কয়েক গুণ। আমাদের এখন যা অবস্থা, সিনেমা সুপারহিট হলেও গোটা পঞ্চাশেক হলে দেখিয়ে পুঁজি তুলে আনাই কঠিন। তারপরও আমি মনে করি, আসল সঙ্কট সিনেমা হল বা বিনিয়োগে নয়, সঙ্কট ভাবনায়। কম বাজেটেও ভালো সিনেমা বানানো সম্ভব। কিন্তু কন্টেন্টে সেই চমক কোথায়? আপনি ভালো সিনেমা বানালে দর্শক অবশ্যই হলে যাবে। আর দর্শক গেলে হলের সংখ্যাও বাড়বে। এটা তো ব্যবসা। লাভ হলে বিনিয়োগ আসবেই। তবে সবার আগে ভালো সিনেমা বানাতে হবে। যারা সিনেমা আন্দোলন করেন, তারা বুকে হাত দিয়ে বলুন, আপনাদের কাছে কয়টা মৌলিক চিত্রনাট্য আছে, যেটা আপনি টাকার অভাবে বানাতে পারেননি? দর্শকদের দোষ না দিয়ে নিজেরা আগে ভালো সিনেমা বানান।
একসময় বাংলাদেশে সিনেমার প্রাণকেন্দ্র ছিল এফডিসি। নব্বইয়ের দশকে বিকল্পধারার সিনেমার ধারাটি সামনে আসে। তবে এফিডিসিই ছিল মূলধারা। এখ𒁃ন আরেকটি ধারা তৈরি হয়েছে। টেলিভিশন বা ওটিটিতে হাত পাকিয়ে আসা মেধাবী প্রজন্ম। বাংলাদেশে এখন যারা সিনেমা আন্দোলন করেন বা সিনেমার জন্য মায়াকান্না কাঁদেন, তারা সবাই এফডিসি থেকে দূরে। এফডিসিকে যেন কিছু তৃতীয় শ্রেণির মাস্তানের কাছে লিজ দেওয়া হয়েছে। তারা সেখানে নানা সংগঠন করে, গ্রুপিং করে, বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কার করে, নির্বাচন করে, মারামারি করে; শুধু সিনেমাটা করে না। তাই এফডিসি সিনেমার মূলধারা থেকে সরে গেছে অনেক দূরে। তৃতীয় যে ধারাটির কথা বললাম, সেটিই এখন বাংলা সিনেমার মূলধারা হয়ে উঠেছে।
বাংলা সিনেমা নিয়ে সাম্প্রতিক ক্রেজ আমাকে আশাবাদী কর💝েছে। গত ঈদে মুক্তি পাওয়া অন্তত দুটি ছবি প্রচলিত মানদণ্ডে সুপারহিট। ‘দিন দ্যা ডে’ আর ‘পরাণে’র ক্রেজ কাটার আগেই ‘হাওয়া’ যেন ঝড় তুলেছে। কোন ছবি কেমন, সেই রিভিউতে আমি যাচ্ছি না; দর্শক হলে ফিরেছে সেটাই হলো আশার কথা। ছবি হিট হয় মানুষের মুখে মুখে। একজন ছবি দেখে এসে আরেকজনকে দেখতে বলে অথবা না করে। তাই যত প্রচারই করুন, ছবি খারাপ হলে হিট হওয়ার কোনো চান্স নেই। তবে প্রচারণারও একটা গুরুত্ব আছে। আগে সিনেমা মুক্তি পেলে পত্রিকায় পাতায় বিশাল বিজ্ঞাপন, পাড়ায় পাড়ায় বিজ্ঞাপন, মানুষের মুখে মুখে সিনেমার গান। মুখে মুখেই প্রচার হয়ে যেত। ‘হাওয়া’ টিম প্রচারণা দারুণভাবে করেছে। মুক্তির আগে টিকিট হাওয়া, মানুষের মুখে মুখে ‘সাদা সাদা কালা কালা’।
বাংলাদেশে চঞ্চল চৌধুরী, আফরান নিশো, মোশাররফ করিমদের মতো অসাধারণ অভিনেতা আছেন। আজমেরী হক বাঁধন তো ঝড় তুলেছেন আন্ত🎃র্জাতিক অঙ্গনে। বিদ্যা সিনহা মিমও অন্যরূপে ধরা দিয়েছেন সিনেমাপ্রেমীদের চোখে। অল্প দিনে জাত চিনিয়েছেন নাসিরউদ্দিন খান,&nbsဣp;শরীফুল রাজ, নাজিফা তুষিরাও। এখন তাদের কাছ থেকে কাজ বের করে নেওয়ার মতো নির্মাতা লাগবে। ভালো সিনেমায় বিনিয়োগ করার মতো উদ্যোক্তা লাগবে। ছবি নির্মাণের ধারাটা বজায় থাকলে ভালো সিনেমা হবে, খারাপ সিনেমা হবে, কমার্শিয়াল সিনেমা হবে, আর্ট ফিল্ম হবে।
মানুষ হলে ফিরেছে এটা দারুণ খবর। এখন হলে ফেরা দর্শকদের ধরে রাখতে হবে। আমরা এখনও জানি না ‘হাওয়া’র পর কী? 🏅বছরে একটা দুইটা ‘পরাণ’ বা ‘হাওয়া’ দিয়ে যেমন সিনেমা শিল্প বাঁচবে না, আবার ৫০/৬০টা সিনেমা হল দিয়েও সিনেমার লগ্নি উঠে আসবে না। তাই ভালো সিনেমা বানাতে হবে, হলের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। ছবি সুপারহিট হলো, কিন্তু প্রযোজকের টাকা উঠে এলো না, তখন সেই প্রযোজক আর ছবি বানাবেন না। তাই সিনেমা শিল্পকে বাঁচাতে ভালো সিনেমা বানাতে হবে, হলের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং দর্শকদের হলে গিয়ে সিনেমা দেখার অভ্যাসটা বজায় রাখতে হবে। টিভি পর্দায় নেটফ্লিক্সের সিনেমা দেখা আর হলের বড় পর্দায় সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা কিন্তু একদম আলাদা।
‘পরাণ’&🧔nbsp;বা ‘হಞাওয়া’ বাংলা সিনেমায় দিন বদলের যে হাওয়া বইয়ে দিয়েছে, তা যেন ভবিষ্যতে ঝড় হয়, সাইক্লোন হয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট