পঞ্চাশ বছরের তরুণ বাংলাদেশ। 💦ছুটছে। দৌড়াচ্ছে। পড়ছে। আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। এর মাঝে সময়, সমাজ, মানুষ কত পাল্টে গেছে! রক্তস্নাত-যুদ্ধবিধ্💫বস্ত সেদিনের সেই দেশটা আজ উন্নয়নশীল দেশের সরণি খুঁজে পেয়েছে।
কিন্তু বাঙালির ফুটবল? সে যꦡে পথহারা! কোন দিকে যাচ্ছে আমাদের ফুটবল। গত পঞ্চাশ ব💞ছরে যেটুকু এগোনোর কথা ছিল, তা কি এগিয়েছে? সোজাসাপ্টা উত্তর: ‘না’। ফুটবল নিয়ে বিশ্বের অন্যরা যেখানে অবিরাম দৌড়াচ্ছে আমরা সেখানে উইদআউট বলও পিছিয়ে যাচ্ছি। দেখেশুনে অনেকের মন্তব্য, ফুটবল খেলাটা বাঙালির কম্ম নয়। অথচ একটা প্রজন্ম জানেই না, এই দেশটার জন্মের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ফুটবল।
কোন দেশের মুক্তিযুদ্ধে ফুটবলাররা বল পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, এমন নজির বিশ্বে নেই বললে চলে। কিন্তু আমাদের আছে। যুদ্ধকালে ব🍎িশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের নামটাকে তুলে ধরতে সেই সময়ের তারকা ফুটবলাররা শরণার্থী জীবনকে বেছে নিয়েছ🅠িলেন। দেশ ছাড়া, শিকড় ছেঁড়া, নোঙর হারা সেই জীবনে তারা ভারতের মাঠে মাঠে ফুটবল খেললেন ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ নামে।
পাকিস্তানের দুঃশাসন-শোষণ, রক্ত, বিদ্রোহ এসবের মধ্যে পাক খেতে খেতে ফুটবলাররাও ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। সেদিনের লড়াইয়ে তারা জয়ী হয়ে ফিরেছিলেন। আজ মাঠে বাঙালির সেই লড়াকু মেজাজটা কোথায়? কেন ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে এ দেশের ফুটবল! এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকের অনেক ব্যাখ্যা। অনেক যুক্তি। কারও প্রশ্ন বাঙালির শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে। কারও ব্যাখ্যা, দ🐎েশের ফুটবল অবকাঠামো, পরিকাঠামো ঠিক নেই। কেউ বলছেন তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশ ফুটবলে আধুনিকতার কোনো ছোঁয়াই লাগেনি। তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন পেশাদাররা লোক ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত না হলে, ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। কেউ দ্রুত উপসংহারে পৌঁছে যাচ্ছেন এই বলে: ফুটবল থেকে ফুটবলান্ত প্রাণ সংগঠকরা বিতাড়িত হয়ে গেছেন। তাই ফুটবল আলাদা ভবন, মাঠ পেলেও তার বাস বস্তিতে!
কিন্তু দীর্ঘ সাতাশ বছরের প্রবাসজীবন কাটিয়ে মাসখানেকের জন্য দেশে ফেরা এক সাবেক কিংবদন্তি দেশের ফুটবলের এই পারসেপশনজনিত বস্তিবাস কাটিয়ে ওঠার জন্য যা বললেন, তা হলো ‘সম্মান’। অভিমানের অব্যক্ত ক্ষত বুকে নিয়েই বললেন: ‘ফুটবলারদের এখন মানুষ খুব একটা সম্মান করে বলে মনে হয় না! ফুটবলাররাই নিজেদের সম্মানটা হারিয়েছে। সাধারণ মানুষের দোষ দিয়ে লাভ কী! বাবা-মায়েরা যখন দেখেন ফুটবল খেলে সম্মান নেই, তখন তারা কেন তাদের বাচ্চাকে ফুটবলে পাঠাবেন?’ ভদ্রলোক মুক্তিযুদ্ধের সময় বল পায়ে লড়াই করেছেন। স্বাধীনতার পর জাতীয় দলের হয়ে বিদেশের মাটিতে প্রথম গোল করেছেন। সত্তর দশকে ঢাকার মাঠ কাঁপিয়েছেন। অসামান্য স্কিল আর অদম্যꦅ বন্য সাহস দিয়ে ফুটবলানুরাগীদের হৃদয় জয় করেছেন। তিনি এনায়েতুর রহমান। দেশের ফুটবল-সমাজ যাকে চেনে ‘এনায়েত’ নামে।
আমেরিকা-কানাডার দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষে দেশে ফিরে দেখছেন, কত বদলে গেছে দেশ। কতটা অচেনা তার প্রিয় ঢাকা শহর আর ঢাকা স্টেডিয়ಞাম। কত বড় বড় হাইরাইজ বিল্ডিং। কত ফাইভ স্টার হোটেল। ঢাকার রাস্তায় কত বিএমডব্লিউ, মারসেডিজ। যানজট আর মানবজটে গতিহীন ঢাকার রাস্তা। সেই সঙ্গে গতিহারা দেশের ফুটবল। কিন্তু সেই শহর আর সেই শহরের ফুটবলপ্রেমীরা তাঁকে নিয়ে ঠিকই নস্টালজিক। তার টিমমেট, সাংবাদিক, সমর্থকরা সংবর্ধনা আর স্মৃতিচারণার আয়োজন করছেন। তাকে ঘিরে চলছে ঘরোয়া ফুটবল আড্ডা। কিছু সময়ের জন্য হলেও অভিমানের অব্যক্ত যন্ত্রণাকে ছুড়ে ফেলছেন তিনি স্মৃতির উঠোনে। কত স্মৃতির কথা বললেন সেদিন গুলশানের এক রেস্টুরেন্টে ‘মহাপাগল’ নামে ব্যতিক্রমধর্মী মোহামেডান সমর্থকদের দেওয়া সংবর্ধনায় দাঁড়িয়ে। শ্রোতার আর বক্তার আসনে থাকা অন্যরাও হয়ে পড়লেন স্মৃতিকাতর।
অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকলে হয়তো আরও অনেক কিছু জানা যেত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের ফুটবল নিয়ে। উঠতি ফুটবলারদের জন্য এনায়েতকে নিয়ে একটা মোটিভেশনাল টক আয়োজন করা যেতে পারত। পারলে ভালো হতো। ফুটবলার হয়ে ফুটবল পায়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ꦯলড়াই জেতা অ্যাচিভার তিনিও। একটা দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নিজের নাম জড়িয়ে রাখতে পারা মানে আগুনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা অ্যাচিভার। ফুটবলেও তার অর্জন কিছু ছিল বলেই এখনো মানুষের ভালোবাসায় এভাবে সিক্ত হচ্ছেন দেশে ফিরে। তিনি নিজেও নস্টালজিয়ার কামড় টের পাচ্ছেন।
নস্টালজিয়া আর বাস্তবতা ভিন্ন, সেটা তার বুঝতেও বেশি সময় লাগেনি। দেশের ফুটবল কর্তারা এখনো স্বাভাবিক সংকীর্ণ♔তা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তাই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেই ফেললেন: ‘মোহামেডান সমর্থকরা আমাকে এত দিন পরেও যেভাবে সম্মান জানাল তাতে আমি অভিভূত। কিন্তু খানিকটা বিস্মিত, যে ক্লাবে আমি কখনো খেলিনি সেই আবাহনীর, আমার সময়ের প্রায় সব ফুটবলার, কর্মকর্তারা ফোন 𓆏করে খোঁজখবর নিয়েছেন। কিন্তু মোহামেডানের কোনো কর্তার একটা ফোনও পাইনি!’ বিস্ময় জড়ান একটা আক্ষেপই ঝরল এনায়েতের কথায়!
অবশ্য তার ফুটবল ক্যারিয়ার যখন অস্তরাগে, সেই সময় তিনি মোহামেডানে খেলেছেন বছর দেড়েক। কিন🐬্তু মোহামেডানে খেলা সেই স্মৃতিগুলো এখনো জ্বলজ্বলে তার মনে। প্রসঙ্গটা তিনি নিজেই টানলেন। উনিশ শ আটাত্তরে মোহামেডান-আবাহনী নিয়ে যখন গৃহযুদ্ধ, সেই সময় তিনি যোগ দিয়েছিলেন মোহামেডানে। তখন মোহামেডানের অধিনায়ক শামসুল আলম মঞ্জু। আর আবাহনী অধিনায়ক তার বড় ভাই মনোয়ার হোসেন নান্নু। মঞ্জুর অধিনায়কত্বে খেলেছিলেন এনায়েত। এত বছর পরেও অনুজপ্রতিম মঞ্জুকে বারবার সম্বোধন করলেন, ‘মাই ক্যাপ্টেন’ বলে!
ফুটবলাররা নিজেদের সম্মান দিতে ভুলে গেছেন, পরোক্ষভাবে সেটাই জানিয়ে গেলেন এনায়েত। অনুষ্ঠান শেষে ওয়ান টু ওয়ান আরও অনেক ফুটবলীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই স্কিলফুল ফুটবলার। দেশের ফুটবল-সমাজ যেখানে বারবার প্রশ্ন তুলে বিতর্ক ছড়ান, কে বড় তারকা, এনায়েত নাকি সালাউদ্দিন, সেই বিতর্কের ঢাকনা▨ খুলে দেওয়ার পর সেখান থেকে অনেক কিছু বের হলো, কিন্তু, না ল🅺েখার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ থাকায় পাঠকের জন্য সেটা ঢেকেই রাখতে হচ্ছে।
তবে দেশের ফুটবলে আবাহনী, মোহামেডানের বড় বড় তারকা ডিফেন্ডারের সামনে পড়তে হয়েছে এনায়েতকে। কাকে নিয়ে একটু বেশি ভাবতে হয়েছে তাকে, এই প্রশ্নের উত্তরটা তার সেই ট্রেডমার্ক পাওয়ার প্যাক্ট শটের মতো বেরিয়ে এলো একটা নাম—টুটুল। দেওয়ান শফিউ🎉ল আলম টুটুল। কেন? তার ব্যাখ্যা: ‘ওর গতি আর ক্ষিপ্রতা নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়েছে।’ কিন্তু আপনার ক্যাপ্টেন? ‘হ্যাঁ যদি রাইট ব্যাক হিসেবে আমাকে টুটুল আর মঞ্জুর মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিতে বলেন, আমি মঞ্জুকে বেছে নেব। ওর ডিফেন্স এবং অ্যাটাক দুটোই ছিল দারুণ। তাছাড়া ওভারল্যাপ শব্দটার সঙ্গে এ দেশের ফুটবল যখন পরিচিত নয়, মঞ্জু তখন ওই কাজটা করে দেখিয়েছে।’ পাশে থাকা এনায়েতুর রহমানের ক্যাপ্টেন নিজেই বললেন, ‘শোনেন আমি ডিফেন্স সামলে অ্যাটাকে গিয়েছি। কারণ, আমার বিশ্বাস ছিল আক্রমণ থেকে আমি দ্রুত আমার জায়গায় ফিরতে পারব। ওটাকে ওভার ল্যাপিং বলে সেটা জানলাম ওভার ল্যাপ করে খেলার পরে। সে সময়মতো আজকের মতো বিদেশি খেলা টিভিতে দেখার এবং শোনার সুযোগ❀ ছিল না!’
বুঝলাম মঞ্জুরা টিভিতে আধুনিক ফুটবল দেখার সুযোগ পাননি। কম্পিউটার সফটওয়্যার দিয়ে নিজের এবং অন্যের পারফরম্যান্স কাটাছেঁড়ার সুযোগও তাদের ছিল না। অন্তরাত্মার কাছ থেকে একটা ন൲ির্দেশ তারা পেতেন। ‘ডু দ্য বেস্ট। বি দ্য বেস্ট।’ তাই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ ফুটবলের সেরা একাদশ গড়তে গেলে, এনায়েত, মঞ্জুদের নাম আপনি সরিয়ে রাখতে পারবেন না।
তবে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশের ক্রীড়াঙ্গন শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্ম🅘রণ করবে সেই সব ফুটবলযোদ্ধাদের। কিন্তু তারপর? তাই মুক্তিযুদ্ধ আর ফুটবল মিলে তৈরি হোক এক স্থাপত্য, তৈরি হোক আমাদের গর্বের মিনার, যা শতাব্দীর পর 💃শতাব্দী মনে করাবে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ে ছিল ফুটবলও।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট