• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Songbad Prokash

ইনস্টাগ্রাম

টুইটার


লিংকডইন

পিন্টারেস্ট

গুগল নিউজ


আমাজন রক্ষায় ৮ দেশের উদ্যোগে বাকিরাও যোগ দিক


শিল্পী নাজনীন
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩, ১২:৪৬ পিএম
আমাজন রক্ষায় ৮ দেশের উদ্যোগে বাকিরাও যোগ দিক

পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম হলো আমাজন রেইনফরেস𝓰্ট, যাকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়। কারণ, পৃথিবীর প্রায় ২০ শতাংশ অক্সিজেনের জোগান আসে এই আমাজন বন থেকে। মানুষ একমুহূর্তও যে অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে না, সেই অক্সিজেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটির জোগান দিয়ে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে পৃথিবীকে মানুষের জন্য বাসোপযোগী রাখার কাজটি নীরবে পালন করে যাচ্ছে বলে আমাজন পৃথিবীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত এই বনের আমাজন নাম হওয়ার পেছনে আছে পুরোনো এক যুদ্ধের পটভূমি। প্রাচীনকালে ফ্রান্সিস ডি অরেলানা গোত্রের সঙ্গে টেপিউসসহ আরও কয়েকটি গোত্রের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তখনকার রীতি অনুযায়ী ওরেলানা গ্রোত্রের নারীরাই টেপিউসসহ অন্যান্য গোত্রের পুরুষদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। গ্রিক পুরাণের এমাজোনাস থেকেই ওরেলানার গণকরা এই যুদ্ধের নাম দিয়েছিল আমাজোনাস। এই যুদ্ধের নামকরণ থেকে পরবর্তীকালে পুরো বনের আর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম হয়ে যায় 🌟আমাজন। আমাজন বন যেমন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন তেমনি আমাজন নদীটিও আয়তনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী এবং পৃথিবীর অধিকাংশ নদীর উৎপত্তিস্থল। এই নদীর অববাহিকাসহ পুরো অঞ্চলকে আমাজন বেসিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

পুরো পৃথিবীটাকে একটি মানবদেহ হিসেবে কল্পনা করলে আমাজনকে তার ফুসফুস ভেবে নেওয়া সহজ হয়। ফুসফুস ছাড়া যেমন মানবদেহকে কল্পনা করা যায় না, তেমনি আমাজন ছাড়া পৃথিবীর অস্তিত্বও হু🔯মকির মুখে পড়বে। সে কারণেই আমাজনকে পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবে তুলনা করে তার গুরুত্ব বোঝানো হয়। পৃথিবীর যে ২০ শতাংশ অক্সিজেন আমাজন থেকে আসে, যদি কোনো কারণে আমাজনের বিলুপ্তি ঘটে তাহলে সমগ্র প্রাণিকূলসহ পৃথিবীতে যত অক্🎀সিজেনের ব্যবহার হচ্ছে, তার থেকে ২০ শতাংশ ঘাটতি দেখা দেবে। আমাজন বন বিলুপ্ত হলে বাকি বনাঞ্চল পৃথিবীতে পরিমিতভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করতে ব্যর্থ হবে; ফলে প্রাণিকূলকে যেমন চরম দুর্ভোগে পড়তে হবে তেমনি জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়বে। এ ছাড়া অক্সিজেনের বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে প্রাণিকূলের বিলুপ্তি পর্যন্ত ঘটতে পারে, পৃথিবীর আবহাওয়া উষ্ণ হয়ে ওজোন স্তরের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।

আমাজন বনটিতে পৃথিবীর কোনো দেশের একক মালিকানা নেই। দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটা♓রজুড়ে বিস্তৃত এই বনটির বিস্তৃতি প্রায় নয়টি দেশজুড়ে। এই বনের প্রায় ৬০ শতাংশ পড়েছে ব্রাজিলের মধ্যে, ১৩ শতাংশের মতো আছে পেরুর মধ্যে আর বাকি অংশের মালিকানা আছে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানার মধ্যে অবস্থিত। ঘন বন হলেও এই বনের জলবায়ু বেশ আর্দ্র। দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় ৪০ শতাংশ জুড়ে আছে এই আমাজন বন। পুরো পৃথিবীর রেইনফরেস্টের অর্ধেকটা এই আমাজনেই অবস্থিত। আমাজনে ঘনবর্ষণ হয়। আমাজনের এই ঘনবর্ষনের প্রধান কারণ, এখানকার অগণিত গাছপালা। এখানে প্রায় ১৬ হাজার প্রজাতির ৩৯০ বিলিয়ন গাছগাছালি রয়েছে, যা পুরো পৃথিবীতে অক্সিজেন সরবরাহসহ পৃথিবীর উপরিভাগের ওজোন স্তর ঠিক রাখতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে চলেছে। এই ওজোন স্তরের কারণেই আমরা সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা পাই। তা না হলে সরাসরি সূর্যের আলো প্রাণিকূলের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলত।

আমাজন বনের ৪৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড়, ৪২৮ প্রজাতির উভচর, ৩৭৮ প্রজাতির সরিসৃপ এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। এ ছাড়া আমাজন নদীতে ৩ হাজার প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী আছে, যারা পৃথিবীর সৌন্দর্য বৃদ্ধিসহ পরিবেশের ভারসাম্য ও একটি সুশৃঙ্খল পন্থায় খাদ্যসংস্থান ঠিক রেখে চলেছে। আমাজনের বিলুপ্তির ফলে এসব প্রাণীরও বিলুপ্তি ঘটবে, সঙ্গে পৃথিবী তার সৌন্দ✱র্য হারাবে।

এই বনে ৩০০-এর বেশি উপজাতি বাস করে। তারা বেশ🌱ির ভাগ ব্রাজিলীয়। বাকিরা পর্তুগিজ, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষায় কথা বলে। এ ছাড়া এদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু আছে যাযাবর। এদের বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। আমাজন বন ধ্বংসের ফলে তারাও বিলুপ্ত♑ হয়ে যাবে।

এত সব তথ্য-উপাত্ত সত্ত্বেও পৃথিবীর মানুষের অবিমৃষ্যকারিতায় দিনের পর দিন উজাড় হཧতে শুরু করেছিল আমাজন বন। তাদের স্বার্থপরতা আর লোভের শিকার হয়ে প্রতিবছর আশঙ্কাজনক হারে ধ্বংস হচ্ছিল এই বনের প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান। হুমকির মুখে পড়ছিল এখানকার জীববৈচিত্র্য। তবে আশার কথা হলো, আমাজনের মালিকানা দক্ষিণ আমেরিকার যে আটটি দেশের, তারা এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়িয়েছে, উদ্যোগ নিয়েছে এ বন রক্ষার।

এ ছাড়া সম্প্রতি ব্রাজিলের পরিবেশমন্ত্রী মেরিনা সিলভা আমাজন দিবস উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আগস্ট মাসে, বিশ্বের বৃহত্তম রেইনফরেস্টের ব্রাজিলের অংশে আমরা বন উজাড়ের ক্ষেত্রে ꦏ৬৬ দশমিক ১১ শতাংশ হ্রাস করতে পেরেছি।’

উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্ট মাস আমাজনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়টায় 🅠সাধারণত শুষ্ক আবহাওয়া থাকার কারণে বন উজাড় হয়। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা ইনস্টিটিউট আইএনপিইর স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ অনুসারে, ব্রাজিলিয়ান আমাজনে বন উজাড়ের ফল𓄧ে ১ হাজার ৬৬১ বর্গকিলোমিটার এলাকা ২০২২ সালের আগস্টে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তখন সময়টা ছিল ডানপন্থী জইর বলসোনারোর মেয়াদের শেষ বছর। বলসোনারো (২০১৯-২০২২) শক্তিশালী কৃষিব্যবসা শিল্পের সহযোগী। বন ধ্বংসের জন্য তাকে অনেকটাই দায়ী করা হয়। তিনি আমাজন বন উজাড় বৃদ্ধির পেছনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা বলেছেন, ‘যদি আমরা বন এবং এর জনগণকে রক্ꦐষা না করি, আমরা বিশ্বকে কার্বন নির্গমনের নৃশংসতা বৃদ্ধির জন্য নিন্দা না করি তাহলে কেবল জলবায়ু পরিবর্তন বাড়তেই থাকবে।’

ক্ষমতায় আসার আগে বন রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন লুলা দা সিলভা। গবেষকরা বলছেন, সেই অঙ্গীকারের মূল চাবিকাঠি হলো আদিবাসী সংরক্ষণাগার যাদেরকে বন উজাড়ের বিরুদ্ধে বাধা হিসেবে দেখা হয꧟়।

এপ্রিল মাসে লুলার সরকার ছয়টি নতুন আদিবাসী অঞ্চলকে স্বীকৃতি দিয়ে আদিবাসীদের জমি দখল এবং এর সম্পদের একচেটিয়া ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে ডিক্রি জারি করেছে। বছরের শেষ নাগাদ আরও ছয়টি সীমানা নির্ধারণ করা হতে পারে বলে মঙ্গলবারের ঘোষণায় বলা হয়েছে। ব্রাজিলের আদিবাসীবিষয়ক সংস্থার মতে, দেশটিতে 🦩প্রায় ৮০০টি রিজার্ভ রয়েছে, তবে তাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আনুষ্ঠানিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। বলসোনারোর অধীনে কোনো নতুন রিজার্ভ সীমাবদ্ধ করা হয়নি।

১৯৮৮ সালে ব্রাজিলের সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার সময় আইনটি বর্তমানে শুধু আদিবাসী সম্প্রদায়ের মাধ্যমে দখলকৃত পৈতৃক অঞ্চলগুলোকেই স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু আদিবাসী নেতারা বলছেন, নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলো সেই সময়ে আর দখল করা হয়নি। কারণ, সম্প্༒রদায়গুলোকে তাদের থেকে বহিষ্কার করা হয়ে🍃ছিল, বিশেষ করে ১৯৬০ থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত সামরিক একনায়কত্বের সময়। আদিবাসী রিজার্ভ ব্রাজিলের ভূখণ্ডের আমাজনের ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ দখল করে আছে।

সে কারণেই আমাজনের গুরুত্ব অনুধাবন করে সম্প্রতি দক্ষিণ আমেরিকার আটটি দেশ এই বন রক্ষায় একজোট হয়েছে। ব্রাজিলের পারা রাজ্যের রাজধানী ও আমাজন নদীর উৎসমুখে অবিস্থিত বেলেম শহরে আয়োজিত এক শীর🐻্ষ সম্মেলনে আমাজন অঞ্চলের আট দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত এই বৃহত্তম বনকে উজাড় হওয়ার হাত থেকে রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদন থেকে সম্প্রতি এ তথ্য জানা গেছে। দেশগুলো একত্রে প্রায় ১০ হাজার শব্দের একটি রোডম্যাপ বাস্তবায়নের ঘোষণায় সই করেছে। এই ঘোষণা অনুসারে দেশগুলো টেকসই উন্নয়নের প্রচার এবং উজাড়করণ ও আমাজন নির্মূলকরণে জড়িত সংঘবদ্ধ অপরাধীদে📖র বিরুদ্ধে একত্রে লড়বে।

জোটের নাম দেওয়া হয়েছে আমাজন কো-অপারেশন ট্রিটি অর্গানাইজেশন (অ্যাকটো)। গত ৫ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার জোটের শীর্ষ সম্মেলনে ওই রোডম্যাপ গ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হয়। আয়োজক দেশ ব্রাজিল এই রোডম্যাপকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেইনফরেস্টকে বাঁচ🔯াতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বাফার হিসেবে কাজ করা এই বনের ধ্বংস রোধে ‘নতুন ও উচ্চাভিলাষী অংশীদারত্বমূলক এজেন্ডা’ বলে অভিহিত করেছে।

কিন্তু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা ২০৩০ সালের মধ্যে অবৈধভাবে বন উ꧑জাড় করার জন্য ব্রাজিলের যে প্রতিশ্রুতি, নতুন তেল অনুসন্ধান বন্ধ করার জন্য কলম্বিয়ার যে অঙ্গীকার এবং বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মূল দাবির বিষয়ে একমত হতে ব্যর্থ হয়েছে। তার বদলে চুক্তিতে বলা হয়েছে, এসব সমস্যা সদস্য দেশ নিজ নিজ দায়িত্বে দেখভাল করবে।

ব্রাজিলের পরিবেশগত অবস্থানের উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করা দেশটির প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা আমাজনের উজাড় বন্ধ করার লক্ষ্যে একটি সাধারণ নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই অঞ্চলকে একত্র করার জন্য 🍎সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন। দুই দিনের শীর্ষ সম্মেলনে লুলা আমাজন রক্ষায় সম্মিলিত উদ্যোগের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের যুগের ไচ্যালেঞ্জ এবং সেগুলো থেকে উদ্ভূত সুযোগগুলো আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজে লাগাতে হবে।’

পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত এই আমাজন রক্ষায় আরও ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করুক পৃথিবীর মানুষ, রক্ষা পাক পৃথিবীর জীববৈচিত্রর্য, সবুজ-শ্যামল হোক পৃথিবীর বুক, রক✅্ষা পাক ওজোন স্তর। সর্বোপরি সুন্দর, বাসযোগ্য হোক পৃথিবী—এটাই বিশ্ববাস𒀰ীর প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষক ও কথাশিল্পী।

Link copied!