• ঢাকা
  • শনিবার, ০৯ নভেম্বর, ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১,

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Songbad Prokash

ইনস্টাগ্রাম

টুইটার


লিংকডইন

পিন্টারেস্ট

গুগল নিউজ


গল্প

জোছনারাতের বাঁশিওয়ালা


অভিনু কিবরিয়া ইসলাম
প্রকাশিত: জুন ১৬, ২০২৪, ০২:৫১ পিএম
জোছনারাতের বাঁশিওয়ালা

‘ওটাই ছিল রফিকের শেষ কথা।’

বলতে বলতে চোখের কোণে পানি জমা হয় শরীফের। ছোটবেলার বন্ধুকে দাফন করে আসতে না আসতেই উৎসুক এলাকাবাসীর একটার পর একটা প্রশ্নের জবাব দিতে হয় তাকে। রফিকের এলাক💖াতে প্রত্যাবর্তন এবং তার তিনদিনের মাথায় আকস্মিক মৃত্যু এলাকার সবার কাছে এক বিপণ্ণ সময়ের স্মৃতি ফেরত নিয়ে আসে। লাপাত্তা হওয়ার সাথে সাথে রফিকের দুই দশক আগের চেহারা যেমন ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো সবার মনে, তেমনি সেই স্মৃতিগুলোর ওপরও জমে ছিলো দীর্ঘ বিস্মৃতির ধুলো। রফিক এলো যেন এক স্মৃতির সুনামি নিয়ে, যে সুনামিতে সাগরের তলদেশে হারিয়ে যাওয়া নগরী যেন আবার উঠে এলো ডাঙায়। মাস্টারপাড়ার মানুষেরা ফের সেই হারিয়ে ফেলা নগরীর মাটি খুঁড়ে হারিয়ে যাওয়া সময়ের ফসিলে অতীত খুঁজতে থাকলো। রফিক ও আরো অনেকের হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে যে রহস্যের কুলকিনারা আর কখনো করা যাবে না বলে ভেবেছিলো মাস্টারপাড়ার লোকজন, আজ তারা পুরনো স্মৃতি খুঁড়⭕ে আবারো সেই রহস্যের সুলুকসন্ধান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রফিকের হঠাৎ ফিরে আসা এবং ফিরে আসতে না আসতেই মৃত্যু পারলো না সেই রহস্যের কোন সমাধান দিতে। 

দিন তিনেক আগে রফিককে হঠাৎ দেখা যায় মাস্টারপাড়ার মুন্সির দোকানের কোণায় পড়ে থাকতে। ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় মুসল্লিরা প্রথমে কুয়াশা ও অন্ধকারে রফিককে দেখতে পারেননি। নামাজ শেষে ফেরার পথে যখন একটু একটু আলো কুয়াশা ভেদ করে নরোম মাটিকে স্পর্শ করেছে, তখনই আলমের প্রৌঢ় পিতা হাফিজসাহেব প্রথম রফিককে খেয়াল করেন। মুখভর্তি দাঁড়ি, এলোমেলো বড় চুল, জিন্স প্যান্ট ও হাফ সোয়েটার পরা শীর্ণকায় রফিককে চেনার উপায় ছিলো না। হাফিজসাহেব অন্যান্য মুসল্লিদের ডেকে যখন রফিকের কাছে যান, তখন রফিকের হুঁশ ছিলো না, মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছিল, গায়ে বেশ জ্বর ছিলো। চোখে মুখে পানি দেওয়ার পর রফিকের কিছুটা চেতনা ফিরলেও, কিছুক্ষণ পর সে আবার 🥂বেঘোরে প্রলাপ বকতে থাকে। ‘মরে নাই, মরে নাই, আবার আসবে, আবার আসবে’, ‘বারবার ফিরে ফিরে আসে ইতিহাস’, ‘কিছুই আগের মত নাই, থাকবে না’ এই ধরনের অর্থহীন কিছু কথা রফিকের মুখে শোনা যায়।

বৃহস্পতিবার ভোর ছটার দিকে প্রায় অচেতন রফিককে গোল হয়ে ঘিরে থাকা মানুষজনের মধ্যে কেউ একজন রফিকের প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দেখে পকেটে হাজার দুয়েক টাকা, কিছু এটিএম কার্ড আর জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে উদ্ধার হয় অর্ধমৃত লোকটার নাম, আরশাদ হোসেন। নাম যাই লেখা থাকুক, জটলার মধ্যে থাকা হাফিজ সাহেব, কিংবা আয়নালউদ্দিন, কিংবা রহমত আলীর মতো ষাটোর্ধ্ব মানুষেরা ঠিকঠাক জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবিটা দেখলে তখনই বুঝতে পারতেন, লোকটা আসলে আরশাদ হোসেন বা আর কেউ না, তাদের এলাকার হারিয়ে যাওয়াಌ রফিক, রফিকুল ইসলাম। শেষমেশ হাফিজ সাহেব পকেট থেকে ফোন বের করে তার ছেলে আলমকে ফোন করে ঘুম থেকে ওঠান। ঘুম থেকে বিরক্ত হয়ে উঠে আলম তাদের বাসার দারোয়ান কাম কেয়ারটেকার রমিজ মিয়াকে পাঠিয়ে দেয় কি হয়েছে দেখতে। রমিজ মিয়া মুন্সির দোকানের কাছে এলে, হাফিজ সাহেব একটা ভ্যান ডেকে রফিককে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।

রফিক যেদিন মারা যায় তার আগের দিন জানা যায়, যাকে রমিজ মিয়া হাসপাতালে দিয়ে এসেছিলো, সে আসলে মাস্টারপাড়ার হারিয়ে যাওয়া রফিক। শনিবার সন্ধ্যায় খবর পেয়েই শরীফ তার ওষুধের দোকান থেকে দৌড়ে হাসপাতালে যায়। হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারে, রফিকের আর বাঁচবে না, ওর ক্যানসার। রফিকের বেঁচে থাকা একমাত্র ফুপু, ফুপাতো, চাচাতো ভাইবোনরা𒊎 হাসপাতালেই ছিলো। রফিকের ফেরত আসার খবর তাদেরও বিশ্বাস হতে চায়নি, ভীষণ অসুস্থ রফিককে তারা একদিনের জন্যই ফেরত পেয়েছিলো। অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই রফিক শনিবার রাতে একবারে চলে যায়। শুক্রবার খবর পেয়ে রফিকের 🍎আত্মীয় স্বজনেরা রফিকের জন্য কেবিনের ব্যবস্থা করেছিলো। একটু জ্বর কমলেই রফিক খুব স্পষ্টভাবে তার মেডিকেল কন্ডিশন ডাক্তারদের বলেছিলো। ডাক্তাররা বলছিলো, এই রোগীকে হাসপাতালে রেখে লাভ নেই। রফিকের আত্মীয়স্বজনেরা তাকে বাসায় নেয়া ঠিক হবে কিনা এই তর্কের দ্রুত সমাধান করে অবশেষে তাকে কেবিনে রাখারই সিদ্ধান্ত নেয়।

শুক্রবার বিকেল থেকেই রফিকের গায়ের জ্🃏বর কিছুটা কমেছিলো, একগাদা সিডেটিভ আর পেইনকিলারের প্রভাবে যতটুকু সচেতন থাকা যায়, ততটুকু সচেতন ছিলো, এমনকি চাচার বাসা থেকে আসা মুরগির স্যুপও খেয়েছিলো। স্বজনদের পরিচিতিপর্ব শেষ হলে অসংখ্য ব্যক্ত ও অব্যক্ত প্রশ্নের মুখে রফিক কিছুই বলে না। শনিবার বিকেলে সে তার চাচাতো ভাই সবুজকে বলে শরীফকে খবর দিতে। শরীফ হাসপাতালে আসার পরেই সবাইকে কেবিন 🌳থেকে বের করে দিয়ে শরীফের সাথে মিনিট দশেক কথা বলে রফিক। রাত সাড়ে দশটার দিকে রফিক বলে, ‘আমি এবার ঘুমাবো, তুই যা।’

ঘুমের মধ্যেই রফিক চলে যায় শেষবারের মতো।

‘ওটাই ছিলো রফিকের শেষ কথা।’ শরীফ আবারো উৎসুক মাস্টারপাড়াবাসীকে বলে।
২. 
বছর সাতেক আগে যখন ফরহাদ মাস্টার, ওরফে ফরহাদ বাঁশিওয়ালার মৃত্যুসংবাদ শোনা গিয়েছিলো, তখন শেষবারের মত মাস্টারপাড়াবাসী এমন স্মৃতিকাতর হয়েছিলো। ফরহাদ বাঁশিওয়ালার মৃত্যুর সাথে সাথে সেই বিপণ্ণ অধ্যায়কেও মাটিচা🐠পা দিতে তারা অনেকটাই পেরেছিলো বটে। মাস্টারপাড়াবাসী ভেবে পায় না, এই বিষণ্ণ অতীত কী করে এতদিন তারা ভুলে ছিলো?

মাস্টারপাড়া😼বাসীর মনে পড়ে যায়, সিকি শতাব্দী আগে পলাশবাড়ির মাস্টারপাড়ার সরকারি কলেজে চাকরি নিয়ে আসা ফরহাদ হোসেনের মুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রনেতা ফরহাদ সবকিছু ছেড়ে কেন এই পলাশবাড়িতে একটা সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করতে এসেছিলেন সে গল্পটা মাস্টারপাড়ার কারো কখনো শোনা হয়নি। পলাশবাড়িতে এসেই ফরহাদ অতি দ্রুতই তার ছাত্রদের কাছে তো বটেই, এলাকার কম বয়েসি কিশোর তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। ফরহাদ চমৎকার বাঁশি বাজাতো। অবশ্য জোছনারাত ছাড়া সে কখনো শত অনুরোধেও বাঁশিতে সুর তুলতো না। প্রতি জোছনায় তার বাড়ির উঠোনে বাঁশিতে অদ্ভুত সুর বাজত, আসর জমে উঠত দ্রুতই। ফরহাদের বাঁশি সব বয়সের মানুষকে কমবেশি কাছে টানলেও, কম বয়েসি ছেলে মেয়েদের ওপর তার প্রভাব ছিলো সবচেয়ে বেশি। বিশেষত মাস্টারপাড়ার ১৬ থেকে ২২ বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা তার অন্ধভক্ত হয়ে উঠেছিলো। যে বয়েসটা স্বপ্ন দেখার বয়স, যে বয়সটাতে কিশোর কিশোরীরা তরুণ তরুণী হয়ে উঠতে শুরু করে, সে বয়সে এই বাঁশি যেন জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করতো। ওই বয়সের যে তার বাঁশি শুনেছে, যে জোছনারাতে বাসায় বসে থাকতে পারত না, এসে জড়ো হতো ফরহাদ মাস্টারের উঠোনে।

মাস্টারপাড়াবাসীরা এখনো ভাবলে অবাক হয়, দুই যুগ আগে, ফরহাদ কীকরে তার কম বয়েসি ভক্তদের নিয়ে একের পর এক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলতে পেরেছিলো। শুধু মাস্টারপাড়া নয়, গোটা পলাশবাড়িতেই মহল্লায় মহল্লায় ফরহাদের কাজ ছড়িয়ে গিয়েছিলো। কম বয়েসি ছেলে মেয়েদের সংগঠিত করে ফরহাদ পলাশবাড়ির এলাকায় এলাকায় লাইব্রেরি, বয়স্কদের রাত্রিকালীন স্কুল, সংগীত একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলো। শেষদিকে প্রতিদিন মুষ্ঠিভিক্ষা করে নিয়ে এসে এলাকায় এলাকায় একেবারে প্রান্তিক মানুষের জন্য একবেলা খাবারের ব্যবস্থাও করেছিলো ফরহাদ। তার জাদুতে মাস্টারপাড়ায় বখাটে ছেলেরা বদলে গেল, তারা সন্ধ্যায় ফরহাদ মাস্টারের বাড়ির উঠোনে এসে গল্প শুনতো আর বই পড়তো। এক বছরের মধ্যেই পলাশবাড়িতে মেয়েদের বাল্যবিবাহ কমে গেল, স্কুল থেকে ড্রপআউট কমে গেল, এমনকি চুরি-ডাকাতিও আশ্চর্যজনকভাবে কমে গেল। আটানব্বইয়ের বন্যায় ফরহাদ তার দলবল নিয়ে যেভাবে রিলিফের কাজ করলো, শুকনো রুটি ও স্যালাইন বানানোর ব্যবস্থা করলেন কলেজভবনে, তা শুধু মাস্টারপাড়াবাসী কেন, গোটা পলাশবাড়ির কেউ কখনোই ভুলতে পারেনি। 
ফরহাদের এই কাজগুলোকে কেউ যে সন্দেহের চোখে দেখেনি এমন নয়। বিশেষত এলাকার বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রথমে ফরহাদের পূর্বপরিচয় জেনে তাকে দলভুক্ত করার চেষ্টা চালায়। সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে এলাকার প্রভাবশালী রাজনীতিবিদরা কিছুটা সময় তার কাজে উৎসাহও দিতে থাকে। নিজেদের সুনাম রক্ষার্থে ফরহাদের গড়ে তোলা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তারা পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে যখন ফরহাদের ছেলে মেয়েরা যখন হাটের ইজারাদারদের বিরুদ্ধে সাধারণ বিক্রেতাদের আন্দোলন করতে সাহায্য করে, কিংবা গ্রামের মহাজনের অধিক সুদে ঋণের বিরুদ্ধে কথা ব🥂লে, অথবা ক্ষেতমজুরদের মজুরি বাড়ানোর দাবিতে সংগঠিত করে, অথবা বিভিন্ন অফিসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পোস্টার মারে, তখন ফরহাদের নামে বাজারে বাজারে বিভিন্ন গল্প ছড়িয়ে পড়ে। ‘ফরহাদের উঠোনে অনৈতিক-অসামাজিক কাজ হয়’, ‘ফরহাদ গোপনে ড্রাগের ব্যবসা করে, ড্রাগ খাইয়ে ছেলে মেয়েদের বশ করেছে’, ‘ফরহাদ নাস্তিক, আল্লাহ-খোদা মানেনা’, এমনকী ‘ফরহাদ কালো জাদু জানে’, এইসব গালগল্প পলাশবাড়ির বিভিন্ন বাজারে, চায়ের দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। সে গল্পে বিশ্বাস করে হোক কিংবা মহল্লার প্রভাবশালীদের চাপে হোক, বহু অভিভাবক ছেলেমেয়েদের ফরহাদের সঙ্গ ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু জোছনা রাত হলে ফরহাদ উঠোনে বাঁশি বাজাতেন, সেই ছেলেমেয়েদের আর আটকে রাখা যেত না।  

গালগল্প ছড়িয়ে খুব একটা লাভ না হওয়ায় একসময় প্রভাবশালীরা চেষ্টা তদবির করে ফরহাদের পলাশবাড়ি থেকে বদলির ব্যবস্থা করলো। কিন্তু ফরহাদ পলাশবাড়ি ছেড়ে গেলো না, চাকরিই ছেড়ে দিলো। ফরহাদের ওপর হামলার চেষ্টা হলো, মামলা হলো গোটাতিনেক, ফরহাদের ছেলেমেয়েদের তৈরি করা লাইব্রেরিতে আগুন দেওয়া হলো। ফরহাদ দম༺লো না, উল্টো তার কাছে আরো ছেলে মেয়ে আসতে শুরু করলো। প্রথমদিকে ফরহাদের এই তৎপরতায় মাস্টারপাড়াবাসী খুশি হলেও একসময়ে তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাস করতে শুরু করে, ফরহাদ আসলেই কালাজাদু জানে!

৩.
একুশ বছর আগে পলাশবাড়ির মেয়র নির্বাচনের কথাও মাস্টারপাড়াবাসীর মনে পড়ে যায়। বড় বড় দলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা ভেবেছিলো, ফরহাদ বোধহয় নিজেই নির্বাচন করবে। শোনা যায়, বড় দুই দলই নাকি তলে তলে ফরহাদের কাছে গিয়েছিলো তাদের নমিন🌌েশনে নির্বাচন করার জন্য। ফরহাদ নাকি বলেছিলো, আমি আধপাগলা বংশীবাদক, টিউশনি করে খাই, আমার জন্য নির্বাচন না।

কিন্তু ফরহাদ শেষপর্যন্ত নির্বাচন করেছিলো। না, সে নিজে দাঁড়ায় নাই। পলাশবাড়ির এক কৃষকনেতা আরজ আলী, যার বাড়ি মাস্টারপাড়াতেই, দীর্ঘদিন ধরে বামপন্থী রাজনীতি করতো, ফরহাদ তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আরজ আলী পারিবারিকভাবে অবস্থাপন্ন হলেও, নিজে সংসার করেনি, ম্যাট্রিকের পর আর পড়াশোনাও করেনি। পলাশবাড়িতে আশির দশকের শেষদিকে বড় কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলো। ফরহাদের উঠানে তার ছিলো নিয়মিত যাতায়াত। ফরহাদের ভক্ত ছেলেমেয়েদের সে তার আন্দোলনের গল্প শোনাতো। হাটের আন🦩্দোলনে হাটুরে আর অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে সেও লড়েছিলো, এমনকি সে আন্দোলনের সময় তিনদিন জেলও খেটেছিলো। ফরহাদ আরজ আলীকে নির্বাচনে দাঁড় করালো।

মাস্টারপাড়াবাসী এখনো ভাবলে অবাক হয়, বড় বড় দলগুলোর প্রভাবশালী নেতাদের হারিয়ে সে বছর আরজ আলী কীভাবে মেয়র হয়ে গেল! ফরহাদের ছেলে মেয়েরা নির্বাচনে রাতদিন পরিশ্রম কর🌼ে আরজ আলীকে জিতিয়ে আনে। পলাশবাড়ির লোকজন ভাবে, এ𒐪বার পলাশবাড়ির চেহারা বদলে যাবে। সবচেয়ে খুশি হয় প্রান্তিক মানুষেরা। মাস্টারপাড়াবাসীর মনে পড়ে, সেবার নির্বাচনের পর তিনদিন ধরে মাস্টারপাড়ায় উৎসব হয়েছিলো। তৃতীয় দিন জোছনা উঠেছিলো। ফরহাদের বাঁশি শুনতে মাস্টারপাড়ায় সেদিন যেন গোটা পলাশবাড়ির লোকেরা উপস্থিত হয়েছিলো।

পলাশবাড়ির সাধারণ মানুষের মোহভঙ্গ হতে বেশিদিন লাগলো না। আরজ আলী মেয়র হবার পর অল্প কিছুদিনের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিলো। আরজ আলী লোকজনকে বোঝালো, ক্ষমতাসীন দলে না গেলে সরকারি বরাদ্দ ঠিকঠাক পাওয়া যাবে না, আর তা না পাওয়া গেলে পলাশবাড়ির উন্নয়ন করা সম্ভব না। 💃সে নামমাত্র দলে নাম লেখাচ্ছে, যাতে সে তার প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে পারে। তাকে যেন সময় দেয়া হয়।

আরজ আলী নির্বাচিত হওয়ার পর যেসকল লোকজন গর্তে ঢুকেছিলো, তারা আবার গর্ত থেকে বের হওয়া শুরু করলো। মেয়র অফিসে আগের মতই কমিশন নেওয়া শুরু হলো, সরকারি বরাদ্দের টাকা আগের মতই লোপাট হতে থাকলো। নির্বাচনের আগে ফরহাদের সাথে আরজ আলীর কিছু অলিখিত চুক্তি হয়েছিলো। পলাশবাড়ির জন্য অনেক স্বপ্ন ছিলো বাঁশিওয়ালার, লোকজনকে ওয়াদা করেছিলো আরজ আলী জিতলে পলাশবাড়ির খোলনলচে বদলে যাবে। শোনা যায় পাঁচ বছরের একটা পরিকল্পনা করে নির্বাচনের পরপরই আরজ আলীকে দিয়েছিলো ফরহাদ। আরজ আলী বলেছিলো, দ্রুতই এগুলো বাস্তবায়ন করবে সে। অথচ বছর বিশেক আগের এক বর্ষায় ফরহাদ আরজ আলীর সাথে দেখা করতে মেয়র অফিসে গেলে, তাকে দেখা না দিয়ে কর্মচারী দিয়ে বের করে দিলো আরজ আলী।

সেই দিনের পর পলাশবাড়ি আর আগের মতো থাকলো না। কদিনের মধ্যেই বন্যা এসে পলাশবাড়ির নিম্নাঞ্চল তলিয়ে দিলো। এক অজানা ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হলো অনেকে, মারাও গেলো বেশ কয়েকজন। ফরহাদ তার কর্মীবাহিনী নিয়ে রিলিফের কাজে নামত𓃲ে চাইলে তাক🅷ে নানাভাবে হয়রানি করা হলো। ত্রাণের জন্য লোকজন মেয়র অফিস ঘেরাও করতে আসলে পুলিশ হামলা করলো, গুলিতে মারা গেলো তিনজন। পলাশবাড়ির সকল দুর্যোগের জন্য দায়ী করা হলো ফরহাদকে। প্রথমদিকে মাস্টারপাড়ার কয়েকটা ছেলেমেয়েকে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ। ফরহাদ তাদেও ছাড়িয়ে আনলো।

শেষমেশ বছর বিশেক আগে জুলাই মাসের শে▨ষ বৃহস্পতিবারে পুলিশ ফরহাদকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেলো। তল্ꦏলাশির নামে তার বাসার জিনিসপত্র ভাঙচুর করা হলো, ফরহাদের বাঁশি ভেঙে কয়েক টুকরো করা হলো। মাস্টারপাড়াবাসী সহসা আবিষ্কার করে, রফিকও তো ফিরে এলো জুলাই মাসের শেষ বৃহস্পতিবারে!

৪.
তিন দিনের মাথায় ফরহাদ বাঁশিওয়ালার জামিন হয়েছিলো। শনিবারের সে রাত্রিতে মেঘ ছিলো না আকাশে, ছিলো ভরা জোছনা। সন্ধ্যা ঘনাতেই ফরহাদ তার উঠোনে বসে একটা নতুন কেনা বাঁশি বাজাতে শুরু করেছিলো। সেই বাঁশি শুনতে একে একে বা😼সা থেকে জোর করে বের হয়ে এসেছিলো ৩৭ জন কম বয়সী ছেলেমেয়ে। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত ফরহাদের বাঁশি শোনা গিয়ജেছিলো। কেউ বলে রাত দশটা, কেউ বলে রাত এগারোটা পর্যন্ত বাঁশি বাজিয়েছিলো ফরহাদ।

সেই দিনের পর ফরহাদ আর তার সাথে ৩৭ জনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাস্টারপাড়ার প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকে কম বয়সী ছেলেমেয়েরা এক রাতের মধ্যে উধাও হয়ে গিয়েছিলো। মাস্টারপাড়াবাসীর এখনো বিশ্বাস হয় না, এতগুꦫলো ছেলে মেয়ে কীভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। পলাশবাড়ির এই উধাও হওয়ার ঘটনা দেশে বিদেশে খবরে এসেছিলো। মাস্টারপাড়াবাসী প্রথমে ভেবেছিলো এদের পুলিশ বোধহয় থানায় নিয়ে গেছে। কিন্তু থানা, হাসপাতাল, মর্গ কোথাও ফরহাদ কিংবা ৩৭ জন ছেলেমেয়ের কারো খোঁজ পাওয়া গেলো না। সারা দেশে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিলো। পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনী তন্ন তন্ন করে ওদের খুঁজেছিলো, আর বাঁশিওয়ালার খোঁজ কেউ দিতে পারলে ১০ লক্ষ টাকা পুরস্কারের ঘোষণাও দিয়েছিলো। কিছুতেই কিছু হলো না।

এরপর মাস্টারপাড়াবাসীর কাছে কয়েকদিন পর পর উড়ো খবর আসতে থাকে। কেউ বলে বাঁশিওয়ালা ছেলেমেয়েদের নিয়ে পাহাড়ে চলে গেছে, কেউ বলে সুন্দরবনে দেখা গেছে বাঁশিওয়ালাকে। আবার🉐 কেউ বলে বঙ্গোপসাগরে এক জাহাজে চেপে বাঁশিওয়ালা তার দলবল নিয়ে ডাকাতি করে বেড়ায়। আরো কিছুদিন পর জানা যায় বাঁশিওয়ালারা আর দেশে নেই। কেউ বলে তাদের ভারতে দেখা গেছে, কেউ বলে বার্মায়।

প্রথম কয়েক বছর ৩৭ জন ছেলেমেয়ের বাসায় জুলাই মাসের প্রথম জোছনা রাতে সবুজ খামে চিঠি আসতো। ছেলেমেয়রা শুধু দুলাইন লিখতো, ‘আমরা ভালো আছি, ফিরে আসবো বিপ্লবের পর’। একই লেখা অথচ হাতের লেখা ভিন্ন, প্রতিটি হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়ে নিজ হাতে লিখে পরিবারকে এই চিঠি পাঠাতো। গোয়েন্দারা গলদঘর্ম হয়ে গিয়েছিলো এই চিঠি কীভাবে আসে তা খুঁজতে। তারপরও কীভাবে যেন প্রথম ৫ বছর নিয়ম করে বাসায় চিঠি চলে যেত। পাঁচ বছর পর তা বন্ধ হয়ে যায়।
   
পলাশবাড়ি থেকে ছেলেমেয়েরা হারিয়ে যাওয়ার পর💖 দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছেলে মেয়েদের হারিয়ে যাওয়ার খবর আসতে থাকে, যদিও মাস্টারপাড়ার মতো একসাথে এতজন আর কোথাও হারিয়ে যায়নি। যারা হারিয়ে যায়,💧 তারা সকলে ১৬ থেকে ২২ বছর বয়সী, তারা সবাই জোছনা রাতে হারিয়ে যায় এবং তাদের বাসাতেও সবুজ খামে চিঠি আসে।

বছর দশেক আগে শোনা গেল বাঁশিওয়ালা সরকারের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় হয়ে উঠেছে এক নম্বর। বাঁশিওয়ালার নেতৃত্বে নাকি এক বিশাল বাহিনী তৈরি হয়েছে, যারা গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে বিপ্লবের নেশায়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাঁশিওয়ালার নামে পোস্টার করছে, চিকা মারছে। প্রায়শই মিছিল মিটিং হচ্ছে বাঁশিওয়ালার নামে, অন্যদিকে কৃষকেরা, শ্রমিকেরা এখানে ওখানে বিদ্রোহ করছে। আবার সরকারি কাগজে বের হচ্ছে বাঁশিওয়ালার নেতৃত্বে লোমহর্ষক ব্যাঙ্ক ডাকাতির গল্প, এমনকী মানুষ খুনের গল্প। মাস্টারপাড়াবাসী এসব ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না, আবার অবিশ্বাস করার জোরও পায় না। 
বাঁশিওয়ালার বিপ্লব বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম যাই বলা হোক না কেন, তা বেশিদিন টেকেনি। বছর সাতেক আগে গোটা দেশের সাথে মাস্টারপাড়াবাসীও টিভি-রেডিও-খবরের কাগজে শোনে ‘ক্রসফায়ারে’ বাঁশিওয়ালার মৃত্যুর খবর। বাঁশিওয়ালার মৃত্যুর খবর সরকার দিনের পর দিন তাদের বিশাল সাফল্য বলে প্রচার করতে থাকে। টকশোতে সরকারি দলের লোকজন দম্ভ ভরে বলতে থাকে, ‘ক꧑োথায় আজ সেই বাঁশিওয়ালা?’ খবরের কাগজে বাঁশিওয়ালার ছবি দেখে অবশ্য মাস্টারপাড়াবাসীরা চুল-দাঁড়িওয়ালা ফরহাদ বাঁশিওয়ালাকে পুরোপুরি চিনে উঠতে পারে না।

৫.
দুই দশক আগে মাস্টারপাড়া থেকে হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের সংখ্যা ৩৮ হত🦩ো, যদি না শরীফের পরিবার সেসময় ঢাকায় না চলে যেত। ঢাকায় থেকেই শরীফ শুনেছ♉িলো রফিকদের হারিয়ে যাওয়ার খবর। রফিকরা হারিয়ে যাওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই শরীফের বাবা মারা যায় রোড অ্যাক্সিডেন্টে। এরপর বহুবছর সংগ্রাম করে ঢাকায় টিকে ছিলো শরীফেরা, কিন্তু করোনাকালে শেষমেষ শরীফকে মাস্টারপাড়াতেই ফিরে আসতে হয়।

শরীফ বহুদিন বাঁশিওয়ালার খোঁজ করেছিꦚলো😼। ঢাকায় বাঁশিওয়ালার নামে হওয়া ছাত্রদের মিছিলেও সে বেশ কয়েকবার গিয়েছে। সে ভেবেছিলো বাঁশিওয়ালা একদিন তাকেও নিয়ে যাবে। কিন্তু বয়স বিশের কোটা পার হয়ে যাবার পর, মা ও ছোট ভাইবোনদের দিকে তাকিয়ে বাঁশিওয়ালার ভূত মাথা থেকে তাড়িয়েছিলো শরীফ।

এই শনিবার রফিক ঠিকই তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো তাকে। দশ মিনিট আলাদা করে রফিকের কেবিনে থাকলেও, রফিক কেবল শুধু ছেলেবেলার স্মৃতিচারণাই করেছে। রফিকুল ইসলাম থেকে রফিক কীভাবে আরশাদ হোসেন হয়ে উঠলো, সে গল্পটা রফিক তাকে বলেনি, শরীফও জোর করেনি।
রাত সাড়ে দশটার দিকে রফিক বলে, ‘আমি এবার ঘুমাবো, তুই যা।’
শরীফ যখন প্রায় দরজার কাছে চলে গেছে, তখন রফিক বলে ওঠে, ‘শরীফ শোন, যেকথা বলতে তোকে ডেকেছি...’
শরীফ পেছন ফিরে তাকায়, রফিক প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে,
‘বাঁশিওয়ালা কিন্তু সত্যি সত্যিই মরে নাই, আবার ফিরে আসবে। রেডি থাকিস।’
শরীফ একথা কাউকে বলেনি। রফিক কি সত্যি বলেছে না সিডেটিভের প্রভাবে🎀 প্রলাপ বকেছে তা জানে না শরীফ। অথচ কী মনে করে হাটবারে একটা বাঁশি কিনে সে উঠানে বসে জোছনারাতের অপেক্ষা করতে থাকে।  

(হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা লোককথা থেকে অনুপ্রাণিত)

Link copied!