• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Songbad Prokash

ইনস্টাগ্রাম

টুইটার


লিংকডইন

পিন্টারেস্ট

গুগল নিউজ


ব্যথাতুর চারুকৃতি

সুরঞ্জনা ভট্টাচার্য্যের প্রথম একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী


আলম খোরশেদ
প্রকাশিত: মে ৫, ২০২৪, ০৫:০৫ পিএম
সুরঞ্জনা ভট্টাচার্য্যের প্রথম একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী
সুরঞ্জনা ভট্টাচার্য্য ও তার শিল্পকর্ম

চিত্রকলায় কোলাজ একটি প্রাচীন ও জনপ্রিয় মাধ্যম, যা মূলত করা হয় কাগজ আর আঠা দিয়ে। অঁরি মাতিসের বিখ্যাত কাগজকাটা কোলাজসমূহ এই মাধ্যমের জনপ্রিয়তম দৃষ্টান্ত। কেউ কেউ কাপড় কেটেও আঠার সাহায্যে ক্যানভাসের গায়ে সেঁটে দিয়ে এটা করে থাকেন। যেমন চট্টগ্রামের শিল্পী কানিজ ফাতিমা জেসমিন। এবার একজনকে আমরা দেখতে পেলাম 🍌কাপড় কেটে, নিজহাতে সেগুলোকে ক্যানভাসের গায়ে সীবন তথা সেলাই করে নতুন এক শিল্পকর্ম তৈরী করতে, যার নাম তিনি দিয়েছেন, ‍‍`সীবিত কোলাজ‍‍`। তিনি এই বাংলাদেশেরই মেয়ে সুরঞ্জনা ভট্টাচার্য্য, ছোটবেলায় মা-মাসীদের কাছে তো বটেই, এমনকি পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে বিদ্যালয়েও সেলাই শিখেছিলেন খুব যত্ন করে। এছাড়া দীর্ঘদিন সুলেখক ও ভাষাবিদ জীবনসঙ্গী শিশির ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে প্যারিস, মন্ট্রিয়ল, টোকিও থাকার সুবাদে বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের বহুবিধ শিল্পকর্ম দেখার মাধ্যমে একধরনের নিজস্ব শিল্পদর্শনের চোখ ও শিল্পসৃষ্টির বোধও তৈরি হয়ে যায় তাঁর মধ্যে। সেসব অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানকে আত্মস্থ করে তিনি ন🍌িজেই অতঃপর এই ‍‍`সীবিত কোলাজ‍‍` মাধ্যমে মন ও মননের মাধুরী মিশিয়ে শিল্পসৃষ্টির সাধনায় নিজেকে আমর্ম ন্যস্ত করেন।

তবে এ কাজটি তিনি নিছক শখের বশে শুরু করেননি, করেছেন নিজের অস্তিত্বের তাড়নায়। কেননা বেশ কিছুকাল আগে তিনি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, এতে করে তাঁর বাম হাতটি প্রায় অচল হয়ে পড়ে এবং তিনি এক তীব্র, তীক্ষ্ণ, বিরামহীন ব্যথার গভীরে নিমজ্জিত হন। এমন এক নিরাময়হীন, সুতীব্র ব্যথার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্🌟যই মূলত ব্যতিক্রমী এই শিল্পসৃষ্টির কাজে নিজেকে নিঃশর্তে সঁপে দেন তিনি। তাঁর সেই ব্যক্তিগত শিল্প সংগ্রাম ও সাধনারই ফসল, প্রায় অর্ধশত শিল্পকর্ম দিয়ে আয়োজিত হয়েছে সুরঞ্জনার প্রথম শিল্পকর্ম প্র🐻দর্শনী, ‍‍`ব্যথাতুর চারুকৃতি‍‍`, যার শুভ উদ্বোধন হল গত উনিশে এপ্রিল ঢাকা অলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ‍‍`লা গ্যালারি‍‍` প্রদর্শশালায়।

সুরঞ্জনার শিল্পকর্মসমূহে প্রথাসিদ্ধ রংতুলির পরিবর্তে সুঁইসুতো আর কাপড়ের ফালির প্রয়োগের কারণে সেগুলোকে স্রেফ কারু কিংবা ফলিত শিল্প ভাবলে ভুল হবে, কেননা একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় সেগুলো আদতে বিশুদ্ধ শিল্পেরই প্রতিনিধি। সুরঞ্জনার প্রায় প্রতিটি কাজেই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে একধরনের ব্যক্তিগত বোধের ব্যঞ্জনা, বিবিধ অর্থের দ্যোতনা, নিদেনপক্ষে একটি আখ্যান কিংবা গল্পের আভাস পাই আমরা; সেইসঙ্গে, শাশ্বত শিল্পভাষার অনিবার্য অনুষঙ্গ ইঙ্গিতধর্মিতা, রূপক, প্রতীক ও বিমূর্তায়নের প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। যেমন ধরা যাক, ‘অমানিশায় বিদ্যু꧂চ্চমক’ সিরিজটির কথা, যেখানে ঘনকালো পটভূমিতে লাল, সবুজ ও হলুদরঙা চারটি তীক্ষ্ণ বিজলিসম রেখা পুরো ক্যানভাসকে যেন বিদীর্ণ করে দেয়, যা বলাই বাহুল্য শিল্পীর সুতীব্র শারীরিক ব্যথা ও বেদনারই প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হয়। তারচেয়েও বড় কথা, একটু দূর থেকে দেখলেই এগুলোকে মনে হয় বুঝি আর পাঁচজন শিল্পীর মতো রংতুলিতেই আঁকা চারটি বিশুদ্ধ বিমূর্ত ও মিনিমালিস্ট ঘরানার ছবি, এমনই সূক্ষ্ম ও সুদক্ষ সুরঞ্জনার সেলাই ও কাপড় কর্তনের হাত।

সেলাই প্রসঙ্গে বলি, সুরঞ্জনা তাঁর এই শিল্পকর্মগুলো নির্ম𒁃াণের সময় সেলাইয়ের নানাবিধ পদ্ধতি ও প্রকরণ প্রয়োগ করেছেন, যেমন রানফোঁড়, লিকফোঁড়, কাঁথাফোড় ইত্যাদি, এবং সেটি তিনি নির্বাচন করেছেন তাঁর মূল উপাদান তথা কাপড়ের প্রকার ও প্রকৃতি অনুযায়ী। তিনি এমনকি প্রতিটি শিল্পকর্মের নিচে যে শিল্পীর স্বাক্ষর ব্যবহার করেছেন সেটিও সেলাইয়ের মাধ্যমেই লেখা/অঁকা হয়েছে এবং সেই স্বাক্ষরটি নিজেও একটি স্বতন্ত্র ক্যালিগ্রাফি-শিল্প হয়ে উঠেছে অক্ষরবিন্যাস ও সর্পরূপী আকৃতির কারণে। আমরা জানি চিকিৎসাশাস্ত্র, অসুখ, ঔষধ, উপশম ইত্যাদির সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবেই এই সর্প প্রতীকের একটি সর্বজনীন সংযোগ রয়েছে। সুরঞ্জনা সেটিকেই খুব বুদ্ধিদীপ্ত ও শিল্পিতভাবে ব্যবহার করেছেন তাঁর শিল্পকর্মে। সাপের ব্যবহার তাঁর ‘সর্পিল যন্ত্রণা’ শীর্ষক আরও একটি সিরিজেও দেখা যায়, যেখানে সাদাকালো চক্রাকার সর্পিল আকৃতির কতগুলো বস্তু যেন কাউকে পেঁচিয়ে ধরছে আর তার মুখের ভেতর থেকে ক্ষণে ক্ষণে বেরিয়ে আসছে লাল কর্তিত জিহ্বা, যা স্পষ্টতই শিল্পীর অসহনীয় দৈহিক যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। এই সিরিজের একটি  কাজে শিল্পী কিছুটা আঙ্গিকগত নিরীক্ষারও প্রয়াস পান, রিলিফের কৌশল প্রয়োগ করে সাপের দেহকাঠামোটিকে আরেকটু উচ্চকিত করে তোলার প্রচেষ্টায়।

প্রদর্শনীতে শিল্পীর দুই ধরনের কোলাজকর্ম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে: সিনথেটিক (সংশ্লেষণাত্মক) ও অ্যানালাইটিক (বিশ্লেষণাত্মক)। এরমধ্যে ‘দাদা (কিংবা দিদির) জামা’ শিরোনামের একটি কাজের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়। এটি একটি অ্যানালাইটিক কো🥂লাজের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত, যেখানে একটি পোশাককে আমরা ছিন্নভিন্ন চেহারায়, টুকরো টুকরো হয়ে ক্যানভাসের এদিকসেদিক ছড়িয়ে থাকতে দেখি, যার ভেতর🏅 দিয়ে একধরনের বিখণ্ডীকরণ কিংবা দ্বিখণ্ডীকরণের আবহ তৈরি হয়। তারই মাঝখানে এক জায়গায় শিল্পী খুব বুদ্ধিদীপ্তভাবে এই পোশাকেরই নামলিপিটি, যেখানে ইংরেজিতে ছোট্ট করে লেখা DIVIDED, সেটি সেঁটে দেন, যা তাঁর এই শিল্পকর্মের অন্তর্লীন বার্তাাটিকেই বুঝি আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়। এছাড়া এর শিরোনামে যে দাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবসঞ্চারী শিল্প আন্দোলন দাদাবাদ এর জনক, ফরাসি চিত্রশিল্পী ‘দাদা’র প্রতি সুরঞ্জনার ব্যক্তিগত শৈল্পিক শ্রদ্ধার্ঘ্য, কেননা আমরা জানি এই দাদাগোষ্ঠীর শিল্পীরাই সর্বপ্রথম তাঁদের শিল্পকর্মে কোলাজরীতির প্রয়োগ করেন।

এসবের বাইরে বক্তব্য কিংবা বর্ণনাধর্মী অআরও বেশকিছু ছবি নজরকাড়া ছবি রয়েছে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: বাউলিয়ানা, চক্রব্যুহ, গিলোটিনের ভয়াবহতা, শিকড় কাঁদে শিশির-কণার জন্যে …., পুরুষ ও প্🧔রকৃতি সঙ্গমে একটি নদীর জন্ম, ব্যথার সপুষ্প ছত্রাক, পারমাণবিত বিস্ফোরণের বহুদিন পর প্রথম যখন ফুল ফোটে, আকাশগঙ্গা ছায়াপথ ইত্যাদি। আমরা শিল্পীর আশু সুস্থতা ও সক্রিয়, সৃজনশীল জীবনের প্রত্যাশী।

 

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!