আমরা জানি ১৯৮৩ সালে মৃণাল সেন কল্লোল গোষ্ঠীর বিখ্যাত লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্রের ততোধিক বিখ্যাত গল্প ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ অবলম্বনে হিন্দি ভাষায় তাঁর চব্বিশতম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র ‘খণ্ডহর’ ন🤪ির্মাণ করেন। অনেকেই হয়তো অবগত আছেন, এই একই গল্প নিয়ে স্বনামধন্য সাহিত্যিক পূর্ণেন্দু পত্রীও ‘স্বপ্ন নিয়ে’ নামে আরেকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন এর প্রায় দুই দশক আগে, ১৯৬৫ সালে। স্বভাবতই মৃণালের এই ছবি নিয়ে দর্শক-সমালোচকদের মনে 🎶একধরনের আগ্রহ ও কৌতূহল কাজ করেছিল।
চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পর প্রশংসার পাশাপাশি সংগত কারণে কিছু সমালোচনাও হয়েছিল তার। সেটি ছবির গল্প ও তার অন্তর্নিহিত বিষয়ভাবনা, বিশেষ করে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রবীক্ষার বিবর্তনকে ঘিরে। বাংলায় খণ্ডহর শব্দের অর্থ ধ্বংসাবশেষ এবং বাস্তবিকই একটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি ও সেখানে আশ্রিত ধ্বংসপ্রায় একটি পরিবারের ব্যক্তিগত পরিসরের গল্পই বলেন মৃণাল সেন তাঁর এই ব্যতিক্রমী, ভিন্নধর্মী ছবিতে। এর অন্তর্গত উপজীব্যটিকে মৃণাল সেন নিজেই ব্যাখ্যা করেন এই বলে যে, "Khandhar is the story of a journey, a brief encounter and consequently of complex relationships of betrayal and fidelity, escape and involvement inextricably entwined, of ruthlessness and of compassion- all amidst the ruins replete with sensuality." (খণ্ডহর একটি অভিযাত্রার গল্প; ক্ষণিকের সাক্ষাৎ এবং তার পরিণতিতে গড়ে ওঠা আনুগত্য ও প্রতারণা, আকর্ষণ ও পলায়ন, মায়া ও নির্মমতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো এক জটিল সম্পর্কের আখ্যান, যার সবটাই সংঘটিত হয় আশ্লেষাময় এক ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে।)
আসলে মৃণাল সেন বলতে আমাদের মানসপটে তাৎক্ষণিকভাবে যে একজন প্রতিবাদী, বিক্ষুব্ধ, সময় ও সমাজমনস্ক মার্কসবাদী শিল্পীর প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে এই ছবির প্রকৃত মর্মবস্তুর বিশেষ সাদৃশ্য খুঁজে না পাওয়াতেই সম্ভবত এই সমালোচনা ও হতাশা অনেকের। যদিও ‘খণ্ডহর’ বানানোর বেশ কবছর আগে থেকেই আমরা জানি মৃণাল সেন নিজেকে ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করেছিলেন। বস্তুত কালের ক্রমানুসারে ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭০), ‘এক আধুরি কাহানি’ (১৯৭১)🦋, ‘কোলকাতা ৭১’ (১৯৭২), ‘পদাতিক’ (১৯৭৩), ‘কোরাস’ (১৯৭৪), ‘মৃগয়া (১৯৭৬), ‘ওকা উরি কথা’ (১৯৭৭), ‘পরশুরাম’ (১৯৭৮) ইত্যাদি চলচ্চিত্রে সর্বহারা শ্রেণির মুখপাত্র, ক্রুদ্ধ ও উচ্চকণ্ঠ মৃণাল সেনকে দেখে দেখে আমরা একপ্𒉰রকার অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই ‘পরশুরাম’ এর মুক্তির ঠিক পরের বছরেই ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯) এর মতো ভিন্নধর্মী এবং প্রায় অন্তর্মুখী একটি ছবির দেখা পেয়ে আমরা কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়ি।
তবে সত্যি বলতে কি, এই ছবিটি থেকেই মূলত মৃণাল সেন একটু একটু করে পাল্টে নিচ্ছিলেন নিজেকে। তাঁর এই একাধারে বৌদ্ধিক ও শৈল্পিক বিবর্তনটুকু অব্যাহত থাকে ‘আকালের সন্ধানে’ (১৯৮০), ‘চালচিত্র’ (১৯৮১🍸) ও ‘খারিজ’ (১৯৮২) অবধি এবং তার একপ্রকার যৌক্তিক পরিণতি পায় যে ছবিটিতে, সেটিই এই ‘খণ্ডহর’। এতকাল যে ধরনের সমাজবোধ ও শ্রেণিচেতনানির্ভর প্রত্যক্ষ বক্তব্যসমৃদ্ধ সরব ছবি🦹 নির্মাণে অভ্যস্ত ছিলেন মৃণাল সেন, তা থেকে সরে এসে এখানে এমন এক বিষয় ও চিত্রভাষার আশ্রয় নেন তিনি, যা ব্যক্তির মনোজগৎ, ক্ষয়িষ্ণু সমাজের মূল্যবোধ ও মনস্তত্ত্ববিষয়ে অনুসন্ধানে আগ্রহী ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল। এই সব বোধ ও ভাবনার প্রকাশে মৃণাল সেন তাঁর ‘খণ্ডহর’ ছবিটিতে এমনই নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং এতটাই অন্তর্মুখী অন্বেষণে নিমগ্ন থাকেন যে, কেউ কেউ তাঁর বিরুদ্ধে রীতিমতো পথভ্রষ্ট হওয়ার অভিযোগও তুলেছিলেন তখন।
কিন্তু মৃণাল সেন সম্ভবত ততদিনে তাঁর আরাধ্য পথটি খুঁজে পেয়ে গছেন, তাই নিজের কাছে সৎ ও বিশ্বস্ত থেকে সেই সব অভিযোগের জবাবও দেন অকুণ্ঠচিত্তে। তিনি একেবারে খোলাখুলিভাবেই জানান, "একের মধ্যে সমষ্টির ইচ্ছাপূরণ আর নয়, একের মধ্যে একেরই সংশয় ও সংকটের কথা বলা উচিত। এবং একের সংকটের মধ্য দিয়েই সমাজের আত্মিক সংকটের কথা বলা। ১৯৭৯ সাল থেকেই আমি তা করতে চেষ্টা করেছি, বলছি একান্ত আপন কথা, আপন সংশয়, সংকট ও স্ববিরোধিতার কথা এবং সেই সবকিছুর আড়ালে এক নতুন উপলব্ধির কথা, যে উপলব্ধির মধ্যে ইঙ্গিত পাই বিশ্বাসের, প্রত্যয়ের, এককের এবং সমষ্টির।” ১৯৭৯ সাল অর্থাৎ ‘একদিন প্রতিদিন’ নির্মাণের বছর থেকেই তিনি বৃহত্তর সমাজের মৌল একক যে ব্যক্তিমানুষ, তার দিকেই তাঁর কলম ও ক্যামেরার অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে থাকেন। তিনি সেই ব্যক্তির সংকট, সংগ্রাম, স্বপ্ন, প্রেম, বিশ্বাস, আশা ও হতাশা, জয় ও পরাজয়, সর্বোপরি অনুভব ও উপলব্ধির ভেতর দি🐻য়েই সমাজের সামষ্টিক পরিস্থিতিকে বুঝতে, তাকে সম্যক ব্যাখ্যা করতে এবং তা থেকে সম্ভাব্য উত্তরণের পথনির্দেশ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন।
তাঁর সেই শৈল্পিক প্রয়াসটুকু অবশ্য ‘খণ্ডহর’ এ এসেই থেমে যায়নি, তা অব্যাহত থাকে এর অব্যবহিত পরের ছবি ‘জেনেসিস’ (১৯৮৬) হয়ে এরও প্রায় পাঁচ বছর পরে নির্মিত ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৯১) চলচ্চিত্রটিতেও। ১৯৯০ সাল নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আকস্মিক পতনের পর, বিশ্বময় সাম্যবাদী চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের মনে যে সর্বব্যাপী শূন্যতা ও হতাশা নেমে এসেছিল, তারই আলোকে তিনি নির্মাণ করেছিলেন এই অন্তর্ময়, আত্মবীক্ষণ ও আত্মসমালোচনার চলচ্চিত্রটি। এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ নারীর বয়ানে তিনি দেশকাল, সমাজ-সংস্কৃতি ও ইতিহাস-রাজনীতির যে নির্মোহ, নৈর্ব্যক্তিক ও একইসঙ্গে প্রবলভাবে সংবেদী ও সংরক্ত ব্যাখ্যা হা🐓জির করেছিলেন, তা জীবন ও জগৎকে বোঝার জন্য, মানবমনের ভেতর ও বাহিরকে জানার জন্য এখনো সমান জরুরি ও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। তাঁর দ্বিতীয় সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘অন্তরীণ’ (১৯৯৩) এ বুঝি মৃণাল সেনের এই নতুন নিরীক্ষাটুকুই আরও সাহসী মাত্রা পায়, যেটি মূলত এক জোড়া অচেনা মানবমানবীর স্বতঃস্ফূর্ত টেলিফোন কথোপকথনের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় এবং যার ভেতর দিয়ে তিনি মানবের এই অমোঘ একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতার হাহাকারকেই আসলে দৃশ্যমান করে তুলতে চেয়েছিলেন।
‘জেনেসিস’, ‘খণ্ডহর’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘অন্তরীণ’ এর মতো চলচ্চিত্রসমূহ ত✅াই সেই অর্থে স্রেফ অ-মৃণালীয় কয়েকটি বিচ্ছিন্ন প্রয়াসমাত্র নয়, তা বরং একজন চিরঅনুসন্ধিৎসু, সৎ🔯, চিন্তাশীল ও সতত চলিষ্ণু শিল্পীর সমষ্টি থেকে একার কাছে, চিৎকার থেকে নৈঃশব্দ্যের কাছে, শ্লোগান থেকে মন্ত্রের কাছে ফেরার সাহসী শিল্পযাত্রারই এক সুচিন্তিত চিত্ররূপ।