• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Songbad Prokash

ইনস্টাগ্রাম

টুইটার


লিংকডইন

পিন্টারেস্ট

গুগল নিউজ


গতিমুখ হারানো গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন ও কিছু কথা


রহমান মুফিজ
প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২৩, ০৯:০০ এএম
গতিমুখ হারানো গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন ও কিছু কথা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বিনোদনসর্বস্ব বাণিজ্যিক থিয়েটারের বিপরীতে সমাজমনস্ক সচেতন রাজনৈতিক থিয়েটার পরিচালনার মধ্য দিয়ে মূলত ভারতবর্ষে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সূচনা করে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (আইপিটিএ)। গণনাট্য সংঘ ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্ট🐽ির কালচারাল ফ্রন্ট। বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় সমাজ ও তার সঙ্কটকে নতুন করে দেখা এবং সর্বব্যাপী সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে সমাজতা🔥ন্ত্রিক বিপ্লবের অনুবর্তী করার লক্ষেই ছিল মূলত গণনাট্যসংঘের তৎপরতা। মানবমুক্তির লড়াইয়ে সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গকে হাতিয়ার করে একটা মতাদর্শিক লড়াই পরিচালনা, একটা সর্বব্যাপী সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে যে যাত্রা গণনাট্যসংঘ শুরু করেছিল তার প্রভাবে গোটা ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল পেয়েছিল নতুন চোখ। চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, নাট্যকলা, সঙ্গীত, নৃত্য, কবিতা, উপন্যাস শিল্পের সর্বত্র তার যুগপৎ প্রভাব লক্ষণীয়। এর ফলে প্রাত্যহিক শিল্প-যাপনেও সমাজমনস্কতার সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে সেখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। গণনাট্য সংঘের সাংস্কৃতিক প্রভাব অনুমান করতে হলে আমরা ৫০ ও ৬০-এর দশকের ভারতীয় চলচ্চিত্রগুলোর দিকে নজর বোলাতে পারি। নজর বোলাতে পারি সে সময়ের সঙ্গীত ও সাহিত্যের দিকেও।

‘গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন’ মানে শুধুমাত্র ‘থিয়েটার আন্দোলন’ ভাববার সুযোগ নেই। থিয়েটার এমন এক মাধ্যম, যেখানে সব ধরনের কলা বা আর্টের সন্নিবেশ থাকে। ফলে থিয়েটারের বিকাশ বা উন্নয়ন মানেই অন্যান্য শিল্পেরও উন্নয়ন। মূলত কলাভিত্তিক সমগ্র সাংস্কৃতিক তৎপরতার নেতৃত্বে থাকে থিয়েটার বা মঞ্চনাটক। সব থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাবেশ ও তৎপরতাও ঘটে থিয়েটারেই। গণনাট্যসংঘ গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সে সময় পশ্চিমবঙ্গের ম𓂃ধ্যবিত্ত শ্রেণির মাঝে যে রুচি, শিল্পবোধ, সমাজমনস্কতা, র♍াজনীতি সচেতনতা এবং বুদ্ধিবৃত্তির শক্তিশালী আবহ তৈরি করেছিল তার ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আজকের পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক আবহ।

ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে যে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বাংলাদেশে সে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ গোটা পৃথিবীকে একটা অখণ্ডতার বা আন্তর্জাতিকতার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। সে🉐 দৃষ্টিভঙ্গির ওপর দাঁড়িয়েছে ভারতের ‘গ্রুপ থিয়েটার’ আন্দোলন। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রভাববিস্তারী চেতনা ছিল জাতীয়তাবাদ। ফলে এখানকার গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন গোটাটাই প্রভাবিত হয়েছে জাতীয়তাবাদী চিন্তা দ্বারা। সে জাতীয়তাবাদ ধীরে ধীরে পর্যবসিত হয়েছে স্থূল জাতীয়তাবাদে। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বরং, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সর্ব-জাতিক মুক্তি, শোষণ-বৈষম্যহীন, সেক্যুলার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল সাধারণ মানুষ। এ স্বপ্ন তো মানুষ একদিনে দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ২৩ বছরের যে লড়াই-সংগ্রাম তার গতিমুখই সে স্বপ্ন নির্ধারণ করে দেয়। ২৩ বছরের সে লড়াই সংগ্রামে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব ছিল এ দেশের প্রগতিশীল ও বামপন্থীদের হাতে। কিন্তু বামপন্থীরা জাতীয়তাবাদের হাত থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনকে আরও উচ্চতর চেতনা বা সর্ব-জাতিক মুক্তি, শোষিত মানুষ বা শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতার দিকে ঘোরাতে পারেননি। ফলে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন আখেরে যে চরিত্র পাওয়ার কথা ছিল তা পায়নি। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত এ দেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন  গণমানুষের মুক্তির লক্ষে সমাজতন্ত্র অভিমুখী নাট্য তৎপরতা প্রদর্শন করলেও এখন গণমুক্তির আন্দোলন এমন কি গণতন্ত্রের আন্দোলনেও তারা অনুপস্থিত। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় পর্যন্তও গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের কর্মীদের কদাচিৎ শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলতে শোনা গেছে। কিন্তু এখন সচেতনভাবে শ্রেণিসংগ্রামকে এড়িয়ে চলেন তারা। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের কর্মীদের কাছে এখন ‘মানবমুক্তির’ সংজ্ঞা নেই, ‘শোষণমুক্তির’ সংজ্ঞা নেই, ‘শ্রেণিসংগ্রামের’ আলোচনা নেই। বিপ্লবমুখী বা আমূল পরিবর্তনাকাঙ্ক্ষী নাট্য আন্দোলনের কথা তো দিল্লিদূর।

১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদে শোষণবিরোধী নাটক করতে গিয়ে কংগ্রেস গুন্ডাদের হাতে খুন হয়ে যাওয়া তরুণ সফদার হাশমীর নামই শোনেননি আমাদের এই সময়ের থিয়েটার কর্মীরা। এ নামটি অন্তত ৯০-এর দশকেও 🍬নাট্যকর্মীদের মুখে মুখে শুনতাম আর দেখতাম একই আদর্শের শহীদ নাট্যকর্মী সফদার হাশমীর প্রতি কী অসীম দরদ তারা অনুভব করতেন!

মুক্তিযুদ্ধপ𝔍রবর্তী সময়ে এ দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে বিকশিত হওয়া গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন এবং তার কর্মীরা কমবেশি সবাই স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সংগঠক-কর্মী ছিলেন। ওই সময়ই মূলত তাদের নাট্য আন্দোলনে সম্পৃক্তি ও গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের কাল। সেসব প্রজন্মের ছিল বামপন্থী শিক্ষা, রাজনৈতিক সচেতনতা ও সক্রিয়তা। রাজনৈতিক পরম্পরা মেনে পরের প্রজন্মের হাতে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন লক্ষাভিমুখীনতা লাভ করার কথা থাকলেও তা ঘটেনি। উপরন্তু ধীরে ধীরে লক্ষ্যচ্যুত ‘গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন’ গোটা সাংস্কৃতিক বলয় থেকে অপস্মৃতপ্রায় হয়ে গেলো। আন্দোলন নয়, শুধু রয়ে গেলো কিছু নাটক ও ব্যক্তির নাম। এর কারণ হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন, ৯০ দশকের শুরুতে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে। সে পতনের জের ধরে এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন বড় ধরনের বিপর্যয় নিয়ে আসে বামপন্থী আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক বলয়ে। অভিঘাত হিসেবে দেখা গেলো- দীর্ঘদিন বামপন্থী জৌলুসের ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া সেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা রাতারাতি ভোল পাল্টে ‘পুঁজিবাদের’ খেদমতগার হয়ে গেলো; রাষ্ট্রের উচ্ছিষ্ট ভোগের জন্য মরিয়া হয়ে গেলো। দলবাজ, দলকানায় পরিণত হলেন কেউ কেউ। শোষণমুক্তির শপথে সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ে প্রাণবাজি রাখার জন্য আসা তরুণ-প্রাণ নাট্যকর্মীদের অধিকাংশই রাতারাতি মুক্তবাজার অর্থনীতি, ভোগবাদ, জাতীয়তাবাদী শ্রেষ্ঠত্ব, উন্নয়নের নাটক, শিল্পের জন্য শিল্প-চেতনা ও এনজিও তৎপরতায় গা ভাসিয়ে দিল।  তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে দীর্ঘ বামপন্থী সক্রিয়তা, পঠনপাঠন, মতাদর্শিক চর্চা কি তবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো? নাকি সমস্যা নিহিত ছিল মধ্যবিত্তের চরিত্রের মধ্যে?

গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন তো মূলত মধ্যবিত্তের মধ্যে সাংস্কৃতিক জাগরণ তৈরির প্রয়াসে মধ্যবিত্তেরই আরেক উচ্চতর সাংস্কৃতিক যাত্রা। তবে কি সত্যিকার অর্থেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, সারাবিশ্বে সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনা ‘নিঃশেষ’ (?) হয়ে যাওয়ার মধ্যে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের স্তিমিতির কারণ নিহিত? এ স্থুল বাহানাকে অনেকেই মূল সমস্যা বলে অভিহিত করতে খুব আরাম বোধ করেন। সোভিয়েতের পতন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলন এবং বামপন্থীদের হাতে গড়ে ওঠা বৃহত্তর সাংস্কৃতিক বলয়ে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। সে ধাক্কা এ দেশের জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক বিকাশ বা উচ্চতর সাংস্কৃতিক রুচি গঠনের কর্মসূচিকেও স্তব্ধ করে দিয়েছে। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ার সঙ্গে এ দেশের চলচ্চিত্র, টেলিভিশন নাটক, সঙ্গীত, নৃত্যকলা এমন কি ক্ষেত্রবিশেষে সাহিত্য ও চিত্রকলার মতো প্রধান প্রধান শিল্পও গতি হারিয়েছে, মান হারিয়েছে, রুচি ও জনআগ্রহ হারিয়েছে। ফলে গণমানুষের পক্ষে উচ্চতর সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে ওঠার পরিবর্তে সর্বব্যাপী এক ধরনের অশ্লীল মধ্যমেধার যজ্ঞ ও ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগের প্রবণতাই দৃশ্যমান হতে শুরু করল। সোভিয়েতের পতন, কমিউনিস্ট আন্দোলন বা বামপন্থী রাজনীতির দুর্বলতার দোহাই দিয়ে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের গতিমুখ পাল্টে যাওয়াকে হয়তো জাস্টিফাই করা যাবে, কিন্তু জাতীয় সংস্কৃতির ক্রমঃদারিদ্রাভিমুখতাকে জাস্টিফাই করা হবে কীভাবে? শ্রেণিসচেতন বামপন্থী চিন্তার প্রভাবপূর্ণ সাংস্কৃতিক আন্দোলন গ্রুপ থিয়েটারকে একটা স্থুল জাতীয়তাবাদী চরিত্র দিয়ে কাদের স্বার্থে লড়াইবিমুখ, নতজানু, শক্তিহীন ও একটা বিশেষ গোষ্ঠীর সুবিধালাভের ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে—এ প্রশ্ন অনেক দিন ধরেই উঠছ💟ে। কিন্তু উত্তর দিচ্ছে না কেউ।

বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের হাল-হকিকতের কথা লিখতে গেলে সঙ্গত কারণেই গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের কথা এসে পড়বে। কেন না গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনই  এ দেশের নাট্যচর্চা ও আন্দোলনকে একটা রাজনৈতিক অভিমুখ দিয়েছিল। সে রাজনৈতিক অভিমুখ পাল্টে দেওয়া হলো রাতারাতি। কারা এ অভিমুখ পাল্টে দিল? প্রশ্নের আঙুল উঠবে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের দিকে। স্বৈরাচারবিরোধী উত্তাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন নামে এ ফেডারেটিভ বডি যাত্রা শুরু করেছিল। সারাদেশের সিংহভাগ নাট্যদল এর সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে সে সংখ্যা সাড়ে তিনশ’র মতো। নাট্যকর্মীদের স্বার্থরক্ষা, নাট্যচর্চার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত নাটক উপযোগী মঞ্চ নির্মাণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণে চাপ সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ ও নাট্য-প্রণোদনা প্রদানের মধ্য দিয়ে শিক্ষিত-সচেতন নাট্যকর্মী গড়ে তোলা- সর্বোপরি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের লক্ষে ব্যাপকভিত্তিক নাট্য আন্দোলন গড়ে তোলাই এ ফেডারেটিভ বডির লক্ষ ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই সংগঠনটা অনেকটা ‘ঘটিই ডুবে না নামে তালপুকুর’ হয়ে গেছে। যে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সমগ্র তৎপরতার অভিমুখ ছিল মানুষের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াই সে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এখন স্রেফ ক্ষমতাবলয়ের অন্ধ তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে💎 নিজেদের ‘বিপ্লবী’ চরিত্রকে জলাঞ্জলি দিয়ে এনজিওবাদী তৎপরতায় আগ্রহী হয়ে পড়েছে তারা। এর মধ্য দিয়ে কেন্দ্রের শীর্ষনেতাদের চরিত্র যেমন কলুষিত হয়েছে তেমনি প্রান্তিক পর্যায়ের নাট্য সংগঠন ও কর্মীদেরও প্রতিশ্রুতিশীল চরিত্রকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। প্রান্তের দল ও কর্মীরা ফেডারেশনে কেবল সংখ্যা হিসেবেই মূল্যায়িত হচ্ছে। এ সংখ্যাকে বিক্রি করে কেন্দ্রের শীর্ষব্যক্তিরা নাট্য আন্দোলনের ‘কর্তৃপক্ষে’ পরিণত হয়েছে। তারা সে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতার আশ্রয়-প্রশ্রয় লাভ, সরকারি সুবিধাভোগের দরজাকে অবারিত করে চলেছে।

সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের কমিটি নিয়ে বেশ একটা ঝুটঝামেলা চলছে। এ সংগঠনের পদ দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন বাঘা বাঘা নাট্যব্যক্তিত্বরা। দুই গ্রুপের লোকজন একে অপরের নামে নানা কুৎসা ও অপপ্রচার করতেও ছাড়ছেন না। একে অপরের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশও করছেন তারা। সেরকম একটা গ্রুপের সভায় সম্প্রতি দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। এই ভেবে সে সভায় গিয়েছিলাম যে, অভিমুখ হারিয়ে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন নামের সংগঠনটা তো রীতিমতো মরা লাশে পরিণত হয়েছে। এর কোনো বাস্তব উপযোগিতা তো আর নেই। তবুও এত বাঘা বাঘা নাট্যব্যক্তিত্ব কেন এমনജ উঠেপড়ে লেগেছেন ফেডারেশন দখল নেওয়ার জন্য? খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলাম বক্তাদের কথাবার্তা। সব বক্তাই বলে গেছেন— লিয়াকত আলী লাকী কেন এতদিন ধরে ফেডারেশনের চেয়ারম্যান পদ আঁকড়ে থাকবেন? তাদের দাবি বর্তমান কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ, অবৈধ। তাই অবিলম্বে নির্বাচন দিতে হবে। নতুন কমিটি গঠন করতে হবে। কেউ বলেছেন, প্রচুর অর্থ তছরুপ হয়েছে, তার হিসাব দিতে হবে। অপরপক্ষে এক সভায় লাকী সাহেব তো প্রতিবাদী নাট্যকর্মী ও নাট্যব্যক্তিত্বদের নাট্যকর্মী শব্দটা ব্যবহারের যোগ্যতা নেই বলে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তিনি তাদেরকে (প্রতিবাদকারীদের) হিসেব করে কথা বলার নসিহত করেছেন!

তো লাকী সাহেব যে যথাযথ যোগ্য লোক তা স্পষ্ট হয়েছে টানা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকা এবং প্রায় আট বছর ধরে গ্রুপ থিয়𝐆েটার ফেডারেশনের মতো সংগঠনের চেয়ারম্যান থাকার মধ্য দিয়ে। গত এক যুগে সাংস্কৃতিক বলয়ে তাঁর বিকল্প তো কেউ হয়ে উঠলো না-- সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। সরকারও বুঝতে পারছে লাকী সাহেব ছাড়া শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্ষম ও বিশ্বস্ত লোক আর নেই। একই ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রীয় পদ এবং প্রেসার গ্রুপের শীর্ষপদ একই সময়ে ধারণ করেন তখন তিনি তো নিজেকে গোটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ‘কর্তৃপক্ষ’ভাবতেই পারেন। সেখান থেকে অন্যান্য শীর্ষ সাংস্কৃতিকব্যক্তিদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন, সবার কাছ থেকে যোগ্যতার সার্টিফিকেট চাইবেন সেটাই তো স্বাভাবিক।

প্রসঙ্গক্রমে বলি- লাকী সাহেবকে বারবার শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক বানানোয় আমরা অনেকে সরকারকে দুষেছি। আমরা ভেবেছিলাম, লাকী সাহেবের চেয়ে দক্ষ, অভিজ্ঞ, ত্যাগী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আছেন। তাদেরকে সরকার চোখে দেখছে না কেন? তবে ওইদিনের প্রতিবাদ সমাবেশে গিয়ে আমাদের অনেকের সে ভ্রম লুপ্ত হয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে, লাকী সাহেব যা প্রতিবাদকারীরাও তা। তফাৎ শুধু এই -- লাকী সাহেবের গ্রুপ সরাসরি পদধারী সুবিধাভোগী আর প্রতিবাদকারীরা পদহীন সুবিধাভ🍸োগী।

ওইদিনের প্রতিবাদী নাট্যকর্মীদের অনেকের বক্তব্য ছিল—শিল্পকলার মতো একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান থেকে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মতো সংগঠনের চেয়ারম্যান পদে বহাল থাকাটা অন্যায্য। এ আলাপটা যৌক্তিক বটে। কিন্তু তাঁরা আরও যৌক্তিক ও গুরুত্বপূর্ণ আলাপ তুলতে পারতেন। বলতে পারতেন অভিমুখ হারানো গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনকে তার অভিমুখে ফেরাতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় গণতন্ত্র, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষে আন্দোলন পরিচালনায় গোটা সাংস্কৃতিক বলয়কে নেতৃত্ব দিতে হবে ফেডারেশনকে। বলতে পারতেন হৃত গৌরব পুনরোদ্ধার করে নতুন বাস্তবতায় একটা সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ইশতেহার নির্মাণ করবে ফেডারেশন। কিন্তু তারা এর কিছুই বললেন না (যদিও এসব আমাদের দূরাশা)। উপরন্তু লাকী সাহেবকে হটিয়ে গ্রুপ থিয়েটারের কর্তৃত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক বলয়ের নিয়ন্তা হওয়া, নিপীড়নবাদী রাষ্ট্র ও ক্ষমতাকাঠামোকে টিকিয়ে রাখা, ক্ষমতাসীনদের স্বৈরাচারী মনোবৃত্তির প্রতি নিরঙ্কুশ দাসত্ব ঘোষণার প্রচ্ছন্ন প্রবণতাই দৃশ্যমান হলো সবার বক্তৃতায়। তো অনেক আম নাট্যকর্মীদের প্রশ্ন- লাকী 🍌সাহেব খারাপ কি? তিনি পদ আঁকড়ে আছেন, সংগঠনের মধ্যকার গণতন্ত্র রহিত হয়ে আছে-- এই তো অভিযোগ তার বিরুদ্ধে? এ তো সরকারের নীতিরই প্রতিফলন। সরকারপন্থী একজন খাস খাদেমের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাটা বোকামো নয়? অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন লাকী সাহেবের বিরোধিতাকারীরা আপনার ভাল কিসে? গোটা দেশেই তো গণতন্ত্র রহিত হয়ে আছে। স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট কায়দায় গদি আঁকড়ে আছে একটা দল, একজন ব্যক্তি। এর বিরুদ্ধে গত এক যুগে এঁদের কাউকেই সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। অথচ নিজেদের ফেডারেটিভ বডির গণতন্ত্রহীনতা, শীর্ষনেতার স্বেচ্চাচারিতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন, এটা দ্বিচারিতা নয়? শঠতা নয়? তাঁরা যে চিন্তা ও কাজে সৎ তার প্রমাণ তো কেউ দেখল না।

তো এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সামগ্রিক নাট্য আন্দোলনের প্রবণতা। কেন্দ্রে তো নয়ই প্রান্তিক পর্যায়েও কোনো নাট্যদলকে দেখা যাচ্ছে না যারা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করছে, ক্ষমতাকাঠামোর বুজরুকিকে চ্যালেঞ্জ করছে। যদি তা না হয়, তাহলে বলতে হবে এ দেশে নাট্য আন্দোলন বিশেষ করে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন বলতে আদতে কিছু নেই। মোটাদাগে যা আছে তা ক্ষমতার সুবিধাভোগী একটা লুম্পেনপ্রবৃত্তির সাংস্কৃতিক ভৃত্যশ্রেণি। এদের হাতিয়ার চেতনার জজবা, ক্ষমতার প্রশ্রয় আর উপযোগিতা হারানো মোড়লিপনা। তো এই হতাশাব্যঞ্জক বাস্তবতায় আশা জাগাচ্ছে সুবিধাভোগী নাট্য কপটতার বাইরে কিছু তরুণ তাজা প্রাণের নিরবচ্ছিন্ন শ্রমে গড়ে ওঠা বেশ কিছু নাট্যদল, যারা প্রকৃত অর্থেই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে, প্রকৃত অর্থেই সমাজের পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষায় একের পর এক প্রযোজনা নির্মাণ করে চলেছে। তারা যদিও সংখ্যায় অল্প। তারা সর্বদা নাট্যমোড়লদের দ্বারা নিগৃহীত, অবহেলিতও বটে। ত🦄বে তারা চেষ্টা করছে মেরুদণ্ড সোজা করে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলার। চেষ্টা করছে প্রকৃত অর্থেই গণমানুষের আকাঙ্꧂ক্ষাকে ধারণ করে নতুন দিনের নাট্য আন্দোলন গড়ে তোলার।

বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের হাল-হকিকত লেখার জন্য যেতে হবে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত সেইসব তরুণ-প্রাণ নাট্যকর্মী ও নাট্যদলগুলোর কাছে যারা এখনো মেরুদণ্ড বিক্রি করে দেয়নি। বদ বুড়োদের পায়ে 🐭সঁপে দেয়নি নিজেদের কপাল। সেইসব দল ও নাট্যকর্মীদের জন্য প্রণাম রেখে গেলাম। যথেষ্ট সময় সুযোগ হলে একদিন তাঁদের নাম ও তৎপরতার বিশদ বিবরণ তুলে ধরার প্রয়াস চালাবো।

লেখক : কবি, সংস্কৃতিকর্মী।

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!