হুমায়ূন আহমেদ ব্যতিক্রমী এক সাহিত্যস্রষ্টা। গল্প, উপন্যাস ও নাটকে তার এ সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, 🌳গীতিকার ও নির্মাতা। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনকও বটে। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি সমাদৃত। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য টেলিভিশন ধারাবাহিক এবং টেলিফিল্ম রচনা করতে শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে তার প্রথম টিভি কাহিনিচিত্র ‘প্রথম প্রহর’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এটি তাকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে। পরবর্তী সময়ে তিনি বহু এক পর্বের নাটক নির্মাণ করেছেন। সব নাটকেই তিনি ঈর্ষণীয় সাফল্যের দেখা পান। তার মৃত্যুর পরেও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে।
তার ধারাবাহিক নাটকসমূহ হলো—‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘অয়োময়’, ‘আজ রবিবার’, ‘সবুজ সাথী’, ‘উড়ে যায় বকপক্ষী♔’, ‘এই মেঘ এই রৌদ্র’, ‘কালা কইতর’, ‘চন্দ্র কারিগর’, ‘সবুজ ছায়া’, ‘সেদিন চৈত্র মাস’, ‘জোছনার ফুল’ ও ‘শুক্লপক্ষ’। তার এক পর্বের নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘অচিন রাগিণী’, ‘অনুসন্ধান’, ‘অন্তরার বাবা’, ‘অপরাহ্ণ’, ‘অতঃপর শুভ বিবাহ’, ‘আজ জরীর বিয়ে’, ‘আমরা তিনজন’, ‘আংটি’, ‘ইবলিশ’, ‘একটি অলৌকিক ভ্রমণকাহিনি’, ‘এই বর্ষায়’, ‘এনায়েত আলীর ছাগল’, ‘মহান চৈনিক চিকিৎসক ওয়াং পি’, ‘ওপেনটি বায়োস্কোপ’, ‘কনে দেখা’, ‘খোয়াবনগর’, ‘গৃহসুখ প্রাইভেট লিমিটেড’, ‘গুপ্তবিদ্যা’, ‘চেরাগের দৈত্য’, ‘চোর’, ‘চৈত্রদিনের গান’, ‘চন্দ্রগ্রহণ’, ‘ছেলে দেখা’, ‘জিন্দা কব্বর’, ‘জহির কারিগর’, ‘জল তরঙ্গ’, ‘তারা তিনজন’, ‘চার দুকোনে চার’, ‘নিম ফুল’, ‘নীতু তোমাকে ভালোবাসি’, ‘পাপ’, ‘পুষ্পকথা’, ‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল’, ‘বুয়া বিলাস’, ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’, ‘মফিজ মিয়ার চরিত্র’, ‘যমুনার জল দেখতে কালো’, ‘রুমালী’, ‘শওকত সাহেবের গাড়ি কেনা’, ‘সবাই গেছে বনে’, ‘স্বর্ণ কলস’, ‘হাবলঙ্গের বাজার’, ‘হিমু’, ‘দ্বিতীয়জন’ প্রভৃতি।
তার সৃষ্ট প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত। সেসব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রভাবিত করছে মানুষকে। তার নাটকের সেই চরিত্রগুলো প্রভাব ফেলেছে বাস্তব জীবনেও। টেলিভিশনের জন্য হুমায়ূন আহমেদের প্রথম কাজ হলো টেলিভিশন নাটক ‘প্রথম প্রহর’। এটি ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। নাটকটি পরিচালনা করেন নওয়াজিশ আলী খান। একমাত্র টেলিভিশন হিসেবে তখন হুমায়ূন আহমেদের নাটক দিয়ে দর্শক টানতে সক্ষম হয়েছিল বিটিভি। যার উদাহরণ ‘কোথাও কেউ নেই’। তিনি বহু টেলিভিশন নাটক লিখেছেন। এমনকি নিজেও নির্দেশনা দিয়েছেন অনেক নাটকের। তার সাড়া জাগানো নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘অয়োময়’ও ‘আজ রবিবার’ ইত্যাদি। এই ধারাবাহিক নাটকগুলোর বাইরেও বহু খণ্ড নাটক নির্মাণ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার নাটকগুলো আলাদা গল্পের, আলাদা ধাচের, আলাদ💦া স্বাদের। সেই স্বাদকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে তার নাটকে উপস্থাপিত ‘গৃহকর্মী’ চরিত্রগুলো।
তার প্রতিটি নাটকে এক বা একাধিক গৃহকর্মীর সন্ধান মেলে। যারা নাটকের কাহিনিতে নিজের উপস্থিতি সগৌরবে জানান দেন। গল্পের ভিত্তিকে মজবুত করে তোলেন। নাটক্যার ও নির্মাতা হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদ তার গৃহকর্মীকে মর্যাদাপূর্ণ আসন দিয়েছেন। কেননা, গৃহকর্মীরা আমাদের পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। অনেক পরিবারের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গেও জড়িয়ে থাকেন তারা। গ্রাম কিংবা শহরে গৃহকর্মীদের ভূমিকা অপরিসীম। গণমা𒀰ধ্যমে গৃহকর্মী নির্যাতনের অনেক খবর চোখে পড়ে আমাদের। বাস্তবেও ঘটে এমন অনেক ঘটনা। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের নাটক𝓰ে গৃহকর্মী নির্যাতনের কোনো ঘটনা চোখে পড়ে না। বরং গৃহকর্মীরাই কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণ করেন গৃহকর্তাকে। তা-ও পুরোপুরি ইতিবাচকভাবে। গৃহকর্মীরাও যেন পরিবারের সদস্য হয়ে যান অনায়াসে। কোথাও নেতিবাচক কিছু চোখে পড়লেও সমাধান করেন ঠান্ডা মাথায়।
গৃহকর্মী কোনো নেতিবাচক চরিত্র বা ধারণা নয়; এ কথা কেবল হুমায়ূন আহমেদের নাটকেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। কখনো কখনো গৃহকর্মীর কাছে নানাবিধ পরামর্শ নিতে দেখা যায় গৃহকর্তাকে। কোনো কোনো চরিত্রকে শিল্পী, দার্শনিক, জ্ঞানী হিসেবেও উপস্থাপন করেছেন তিনি। তাদের খাবার, পোশাক, বসবাসের স্থান উন্নত মানের। তাদের জীবনযাপনও পরিবারের অন্যদের মতো স্বাভাবিক করে ফুটিয়ে তুলেছেন। কোনো কোনো নাটকে গৃহকর্মীদের নিয়ে বিদেশ ভ্রমণের কাহিনিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হুমায়ূন আহমেদ মূলত তার নাটকের মধ্য দিয়ে এই শ্রেণির মানুষকে যথ🉐াযথ মর্যাদা দিতে চেষ্টা করেছেন। এই ক্ষেত্রে তার শ্রেণিচেতনা দর্শককে মোহিত করেছে। সংবেদনশীল মানুষ হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদের চিন্তাচেতনাকে উচ্চকিত করেছে। এর মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করার প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। তার মতো করে আর কেউ গৃহকর্মীদের এমনভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই। শুধু তা-ই নয়, অনেক ছোট ছোট চরিত্রও তার গল্পে বিশাল প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে।
হুমায়ূন আহমেদের গৃহকর্মীরা কাহিনির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। কখনো কখনো তাদের প্রধান চরিত্রও মনে হতে পারে। কিংবা প্রধান চরিত্র না হলেও প্রধান চরিত্রের ছায়াসঙ্গী হ👍িসেবে পুরোটা সময় ক্যামেরায় দেখা যায়। বেশির ভাগ নাটকে গৃহকর্মীদের কমেডিয়ান হিসেবে উপস্থিত করা হলেও তার নাটকে কমেডিয়ান হিসেবে গৃহকর্মী পাওয়া কঠিন। তাদের সংলাপ ও কার্যকলাপে হাস্যরস থাকলেও চরিত্রের ভাড়ামি তাদের মধ্যে নেই। এসব সংলাপ ও কার্যকলাপেও শিক্ষামূলক উপাদান উপস্থিত ছিল। যা দর্শককে ভাবাতে পারছে। তার গৃহকর্মীরা অন্যায় বা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন না। ন্যায়-নিষ্ঠার সঙ্গেই পরিবারের সবকিছু দেখভাল করেন। পরিবারের কল্যাণচিন্তা তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে।
তিনি গৃহকর্মীর ধরন নিয়ে ‘বুয়া বিলাস’ নামে একটি নাটক নির্মাণ করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের ‘বুয়া বিলাস’ একটি হাস্যরসাত্মক নাটক। হাস্যরসাত্মক হলেও এ নাটকের শিক্ষা গভীরভাবে ভাবতে সাহায্য করে। এ নাটকের প্রধান চরিত্র ‘সকিনা বিবি’। তার ছোট একটি মেয়েও তার সঙ্গী। এ নাটকে গৃহকর্মী চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন মনিরা মিঠু। নাটকের দৃশ্যই শুরু হয়েছে তাকে দিয়ে। গৃহকর্মী হলেও তিনি সব সময় সত্য কথা বলেন। তার মেয়ে যে বিভিন্ন বাসায় গেলে ছোটোখাটো চুরি করে, তা অকপটে স্বীকার করেছেন। এ নাটকে গৃহকর্মীর সংলাপ এমন🔯—‘কিছু দোয়া-কালাম পড়েছিলাম। আপনাকে একটা ফুঁ দেই?’ এই নাটকে সকিনা বিবি বিভিন্ন রূপে হাজির হন। তিনি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেন। বাড়িতে বাড়িতে কাজ করার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। আবার একজন গৃহকর্মী হিসেবে দুর্ভোগের কথাও তুলে ধরেন। এক বাড়িতে তাকে তিন দিন আটকে রাখা হয়। গৃহকর্তা বাসায় নেই বলে সেখানে খাবারও নেই। পরে তিনি পাগল সেজে গৃহকর্তাকে বিপদে ফেলেন। শিক্ষা দেন। অন্যদিকে সকিনা বিবির মতো গৃহকর্মীর পরামর্শ নিয়ে কবিতা লেখেন এক কবি। এক পর্যায়ে কবি বি🐟ষপান করতে চান। গৃহকর্মী বিষপানের সুবিধার্থে চা বানিয়ে দেন। পরে অবশ্য গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার পরামর্শ দেন। অন্য অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে গৃহকর্মী জানান, কীভাবে চরিত্রহীন গৃহকর্তাকে কৌশলে সাজা দিয়েছেন। পরে এক নায়কের বাসায় কাজ করতে গিয়ে ইন্টারভিউ হিসেবে ফোন রিসিভ করে কথা বলতে হয়। নায়কের সাহায্যে তিনি অভিনয় করেও ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
‘গৃহসুখ প্রাইভেট লিমিটেড’ নাটকে গৃহকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বারো-চৌদ্দজ🦄ন গৃহকর্মী তাদের প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে পরীক্ষাও নেওয়া হয়। পরীক্ষা শেষে এক গৃহকর্মী জানতে চান, ‘আমরা যারা ফেল করেছি, তারা এখন কী করবে?’ অপরদিকে ‘সবাই গেছে বনে’ নাটকে গৃহকর্মী পাহারা দেয় ওই বাড়ির বিবাহযোগ্য মেয়েকে। মেয়েটি যেন পালিয়ে যেতে না পারে, সে দায়িত্ব পরে গৃহকর্মীর ওপরে। এমনকি ‘রুপালি রাত্রি’ নাটকে দুই গৃহকর্মীকে নিয়ে বিদেশে যান গৃহকর্তা। বিদেশের মাটিতেই শুটিং হয় নাটকটির। বিদেশের মাটিতে তাদের সাজ-পোশাক ভিন্ন আমেজ তৈরি করে। ভেদাভেদ ভুলে সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারে তারা। এছাড়া ‘আজ꧙ রবিবার’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘বহুব্রীহি’, ‘নীতু তোমাকে ভালোবাসি’ নাটকেও গৃহকর্মীর সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
এর বাইরেও বিভিন্ন নাটকে গৃহকর্মীদের বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। তিনি ছোট চরিত্রকেও বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। আবার গুরুত্বহীন চরিত্রকেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন। `কোথাও কেউ নেই` নাটকের ‘কুত্তাওয়ালী’র বাড়ির দারোয়ানের ভূমিকাকেও সংলাপের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ফলে তার গৃহকর্মীরা বিশেষ কারণে সবিশেষ হয়ে ওঠেন। তারা সমহিমায় হাজির হন পর্দায়। প্রভাব বিস্তার করেন কাহিনিতে। এসব চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রথিতযশা অভিনয়শিল্পীরা। মনিরা মিঠু, শামীমা নাজনীন, শব♑নম পারভিন, ডা. এজাজুল ইসলাম, ফারুক আহমেদরা—এসব চরিত্রে সাবলীল অভিনয় করে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। এসব চরিত্র থেকে শেখার আছে উভয়েরই। শিখতে𒉰 পারেন গৃহকর্মীরা। শিখতে পারেন গৃহকর্তারাও।
হাস্যরসাত্মক এসব চরিত্রের মাধ্যমে সিরিয়াস বার্তাও তিনি দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, এভাবেই হয়তো মানবিক সমাজ গড়ে উঠবে। ভেদাভেদ দূর হয়ে যাবে। শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। হুমায়ূন🦂 আহমেদ কোনো কিছুই উদ্দেশ্য ছাড়া উপস্থাপন করেননি। প্রতিটি চরিত্রের পেছনে তার গভীর দর্শন ফুটে উঠেছে। রাস্তার ফুচকাওয়ালা, বাদামওয়ালা, রিকশাওয়ালারাও তার নাটকে ইতিবাচক বার্তা তুলে ধরেছেন। পরিবারের বিশেষ একটি শ্রেণি যেহেতু গৃহকর্মী, তাই তাদের মাধ্যমেও পরিবারের অসংগতি তুলে ধরেছেন। এ কারণেই নাট্যজগতে বিশেষভাবে স্থান দখল করে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা টিভি নাটকে এখনো তাকে অতিক্রম করার মতো নাট্যকার বা নির্মাতা উঠে আসতে পারেননি। তার নাটকগুলো এখনো বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারের শীর্ষে রয়েছে। এখনো মানুষের মুখে মুখে তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো।
লেখক : কবি, কথাশিল্পী।