নারীর পার্সপ⭕েক্টিভ থেকে নারীকে দেখা, তাকে বিশ্লেষণ করা, তার মনস্তত্ত্বের, তার কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। আর পুরুষের পার্সপেক্টিভ থেকে নারীকে বিশ্লেষণ আরেক রকম। কিন্তু এই দুই জায়গা থেকেই সত্যিকারের নারীর যে রূপ, মনস্তত্ত্ব বোঝার ক্ষমতা যিনি রাখেন, তিনি পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। সারা বাংলায়, পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে, হয়তো সারা পৃথিবীতেও এই কঠিন জায়গাতে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার এবং সেখান থেকে ওই মানসিকতাগুলোকে বিশ্লেষণের ক্ষমতা যে কয়জন রাখেন, তাদের মধ্যে ঋতুপর্ণ সেরা। বাঙালি হিসেবে এই দাবি আমি সাহস নিয়েই করতে পারি। করতে চাই। ঋতুপর্ণের সিনেমা, “ সব চরিত্র কাল্পনিক” আর অজয় দেবগন, ঐশ্বরিয়া রায়ের মতো অভিনয়শিল্পীদের তাদের অভিনয়জীবনের অন্যতম সেরা কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া “রেইনকোট” সিনেমাতে এই চিন্তার জায়গাটা আমরা দৃশ্যে আর শব্দে দেখতে আর শুনতে পাই। যেটা আগে হয়তো আসেনি এভাবে। দেখার পর একটা গভীর ভাবনা আপনাআপনি ভর করে নিজের ওপর। সেটা যদি কেউ সত্যি পুরোটা মনোযোগ দ♕িয়ে দেখে তার এড়ানোর কোনো উপায়ই নেই। এই বোধ অন্য সব সিনেমা থেকে কেউ পাবে না। আর এই জায়গাটাকে একেবারে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে “চিত্রাঙ্গদা” সিনেমা। যেটা ইচ্ছেপূরণের গল্প। দোটানায় থাকা মানুষের গল্প। আশপাশের কঠিন অবুঝ জায়গার গল্প। ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার বা হতে না দেওয়ার বা হতে চাওয়ার পথে বাধা পেরোনের যুদ্ধের গল্প। যে বোধের পরিচয় খুবই কম মানুষেরই আছে। সেটাও পর্দায় দর্শকের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখেন একজন ঋতুপর্ণ ঘোষ। আর কেউ পারেন না। সহজে পারেন না। আর করতেও চান না।
দুই.
না বলা কথা বা না বলতে পারা কথাকে ইমেজ দিয়ে বলতে চাওয়ার ইচ্ছাকে ইমেজে ফুটিয়ে তোলার দারুণ ক্ষমতা দেখি আমরা ‘রেইনকোট’ সিনেমাতে। আর এই “হবে হবে, হচ্ছে হচ্ছে” মুহূর্তগুলো দর্শক হিসেবে আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। আমাদের মধ্যেও একই রকম অনুক্ত কিছু প্রকাশ করার তাড়না তৈর🎃ি করে। দর্শক আর নিজের মধ্যে থাকেন না। সে নিজেও অপ্রকাশের যন্ত্রণাতে আক্রান্ত হয়ে অস্থিরতায় ভোগেন। চরিত্র দুইটা জানে না যে তারা কী জানে না বা আরেকজন জানে কি না। কিন্তু দর্শক সেটা কিছুটা জেনে নিজেই আরও অস্বস্তিতে ভুগতে থাকেন। হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে এটা মাইলফলক একটা সিনেমা। হিন্দি সিনেমা যখন পথ হারায়, তখন এই রকম সিনেমা আবার শৈল্পিক সিনেমার তাড়ন তৈরি করে নির্মাতাদের মধ্যে। দর্শকের মধ্যেও তৈরি করে নতুন পিপাসা। ৫০ বছরও পূর্ণ হলো না ঋতুপর্ণ ঘোষের। চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। অপূরণীয় ক্ষতি। কম করে হলেও আরও ১০টা ভালো চলচ্চিত্র তো আশাই করতে পারতাম। এই দুঃখ পূরণ হওয়ার নয়। ১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্টে জন্ম তার। ২০১৩-তেই চলে গেলেন। তার প্রতিটা সিনেমাই দেখতে ইচ্ছা করে। দেখে শেষ করা পর্যন্ত মন সরে না। রেশ থেকে যায় সিনেমার পরেও।
তিন.
ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে হিন্দি আর বাংলাতে এত সিনেমা-নাটক হয়েছে কিন্তু ঋতুপর্ণের ‘সত্যান্বেষী’, যেটা ২০১৩-তে নির্মিত। ওনার সর্বশেষ কাজ। সেটা যদি না হতো বাঙালি এই ব্যোমকেশকে কি দেখত। এত বেশি পরিচিত, কাছের, সত্যিকারের একজন ব্যোমকেশকে দেখলাম মনে হয়। বাকি সব এক পাল্লায়, আর এটা আরেক পাল্লায় সমানতালে লড়াই করার মতো একটা চলচ্চিত্র। ব্যোমকেশকে এত চিন্তাশীল, অটল চরিত্রে আর কেউ রূপায়ণ করতে পারেননি। এই গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল ঋতুপর্ণের। এটার নির্মাণেও সেই ছাপ। এটা চাইলেও কেউ নকল করতে পারবে না। আমাদের আবার দেখতে হবে সেই ব্যোমকেশকেই, যাকে দেখে আমরা অভ্যস্ত। সঙ্গে গোয়েন্দা টাইপ মিউজিক দিয়ে সে♌টাকে হালাল করার চেষ্টা, যেটা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে! গোয়েন্দা সিনেমাতে এই সিনেমা বাংলাতে আলাদা হিসেবেই থাকবে।
চার.
‘লাস্ট লিয়ার’ সিনেমাতে যাকে দরকার তাকেই নিলেন, অভিতাভ বচ্চন। একজন জাঁদরেল অভিনয়শিল্পীর জীবনসায়াহ্নে বসে নিজের সঙ্গে হিসাব-নিকাশ। নিজের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। সবার মধ্যে নিজের একাকিত্বের খোঁজ পাওয়ার ভয়, অভিজ্ঞতার গল্প। অমিতাভ বচ্চন তার স্মৃতিচারণায় বলেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ একমাত্র পরিচালক, যিনি বচ্চন পরিবারের সবার সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি এক টুইটে লেখেন, ঋতুপর্ণ ছিলেন এক সংবেদনশীল শিল্পমনস্ক নরম মনের মানুষ। চলচ্চিত্র নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল বলেন, ঋতুপর্ণের মৃত্যু একটা “বিরাট ট্র্যাজেডি”।“বাড়িওয়ালি&rd💯quo; সিনেমাতে অভিনয় করা, অভিনেত্রী কিরণ খের ঋতুপর্ণের শিশুসুলভ প্রাণোচ্ছ্লতার কথা স্মরণ করে বলেন, “চলচ্চিত্র জগৎ অশিক্ষিত লোকে ভর্তি। সেখানে ঋতুপর্ণ ছিলেন একজন শিক্ষিত মানুষ। তার নিজস্ব একটা লাইব্রেরি ছিল এবং তিনি ধর্মকর্ম করার মতো করে পড়াশোনা করতেন। তার জ্ঞানের কোনো তুলনা নেই। ঋতুপর্ণ তার জীবন এবং কাজকে এক করে, চলচ্চিত্র নি𒊎র্মাণকে সাধনা এবং জীবনযাপনের অংশ করেছিলেন।
পাঁচ.
একজন কবি, তার মানসিকতা এবং সেটাকে পর্দায় এনেছিলেন সত্যিকারভাবে, “সব চরিত্র কাল্পনিক” সিনেমাতে। ঋতুপর্ণ যে সারাক্ষণ তার আশপাশের মানুষ, অনুষ্ঠান, সভা, আলাপ— সবকিছু গভীরভাবে পর﷽্যবেক্ষণ করেন, তার আরেকটা নমুনা এই সিনেমাতে আমরা পাই। আর আমরা কোনো পক্ষ নিতে পারি না, আমরা জীবন দেখি। জীবনকে না বোঝার যন্ত্রণা দেখি। সিদ্ধান্তহীনতায় আক্রান্ত মানুষদের দেখি। মানুষ হিসেবে আমাদের অসহায়ত্বের জায়গাটা পর্দায় দেখি। আমার মনে পড়ে, যেদিন আমি সিনেমাটা দেখেছিলাম, সেদিন স্বপ্নে আমার প্রিয় মানুষকে নিয়ে আমার প্রিয় জায়গাতে ঘুরে বেড়িয়েছি। ঘুম থেকে উঠেও সেই অনুভূতিটা সচল ছিল। ভালো সিনেমা কিন্তু মেডিটেশনেরও কাজ করে, এই সিনেমা দেখে সেটা আবার উপলব্ধি হলো। সিনেমাতে নিজেদের দেখা পাই। নিজেদের ডিরেক্টরস পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখার সুযোগ পাই।
বাংলার যে কয়জন পরিচালকের সিনেমা প্রজন্মের পর প্রজন্ম খুঁজে খুঁজে আবার দেখবে, বারবার দেখবে, দেখার প্রয়োজন বোধ করবে, নিজেকে প্রকাশের ভাষার খোঁজে, অব্যক্ত কথা ইমেজে বলার তাড়নায়, তাদের মধ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষ থাকবেন। আগামী ৩০ বছর তো অবশ্যই থাকবেন, যারা এখনো সিনেমাকে শিল্পের জায়গাতে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে মনে করেন, তারা☂ সেই য⛦াত্রাতে ইতিমধ্যেই আছেন, ঋতুপর্ণের সঙ্গে, তার সিনেমাগুলোকে নিয়ে।
যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তিনি গেছেন, যে কথা তিনি প্রকাশ ক💎রতে চেয়েছেন, সে কথা আমরা🐟 যত বেশি বুঝতে পারব, তার আত্মা তত বেশি শান্তি পাবেন বলেই আমার বিশ্বাস। আমরা ওনার আত্মাকে আরও শান্তিতে থাকতে দিতে চাই।