• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৪, ১২ ভাদ্র ১৪৩১, ২২ সফর ১৪৪৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Songbad Prokash

ইনস্টাগ্রাম

টুইটার


লিংকডইন

পিন্টারেস্ট

গুগল নিউজ


জন্মশতবর্ষ

মা ও স্ত্রীর বয়ানে অন্য এক ওয়ালীউল্লাহ্‌


ফয়সাল আহমেদ
প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২২, ০২:৩৫ পিএম
মা ও স্ত্রীর বয়ানে অন্য এক ওয়ালীউল্লাহ্‌

বাংলা সাহিত্যের আধুনিককালের অন্যতম শক্তিশালী কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌। অল্প কয়েকটি রচনা দিয়েই যিনি নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে নিয়ে গেছেন। খ্যাতিমান এই লেখক জন্মেছিলেন চট্টগ্রামের ষোলশহরে, ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট। যদিও তাঁর আরও একটি জন্ম তারিখ প্রচলিত রয়েছে। তাঁর ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেটে উল্লেখ আছে জন্ম ১৯২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর । তারিখটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক বসিয়ে দিয়েছিলেন, এমনটাই শোনা যায়। একই ঘটনা তাঁর অগ্রজ সৈয়দ নসর🧜ুল্লার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। মা নাসিম আরা খাতুন, বাবা সৈয়দ আহমাদউল্লাহ। নাসিম আরা খাতুন ২৭ বছর বয়সে ১৯৩০ সালে মারা যান। তখন ওয়ালীউল্লাহর বয়স মাত্র ৮ বছর। এর দুই বছর পর বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। শৈশব ও কৈশোরে পিতার সরকারি চাকরির সূত্রে দেশের নানা প্রান্তে থেকেছেন, দেখেছেন। লেখালেখির পাশাপাশি ছবি আঁকার ঝোঁক ছিল তাঁর। করেছেন সরকারি উচ্চপদে চাকরি, ছিলেন সাংবাদিকও। তাঁর বাবা এবং বড় ভাইও সরকারের উচ্চপদে চাকরি করেছেন। বড় ভাই সৈয়দ নসরুল্লা ছিলেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের জুডিশিয়াল ক্যাডারের কর্মকর্তা। আর বাবা সৈয়দ আহমাদউল্লাহকে খান বাহাদুর উপাধি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। সে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রও পাঠায় তারা। কিন্তু তাদের ওই প্রস্তাব ফ༺িরিয়ে দেন তিনি। যদিও সে সময় ওই খেতাবের জন্য অনেকে তদবির করতেন।

কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ৪৯ বছরের স্বল্পতম জীবনে পেশাগত কারণে নানা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। বিচিত্র তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা। এই সময়ে একাধিক নারীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সুদর্শন এই লেখকের জীবনে প্রেম যে আসেনি, তা বলা যাবে না। আর এ কথা বললে কেউ হয়তো বিশ্বাসও করবে না। ফরাসি নারী আন-মারির সঙ্গে পরিচয়ের পর প্রেম, আর প্রেম থেকে সে সম্পর্ক বিয়েতে গড়ায়। আন-মারি তখন ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তারও আগে রেডিও পাকিস্তানের করাচি কেন্দ্রে কাজ করার সময় উর্দু ভাষার নারী লেখক কুররাতুলআইন হায়দারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। যদিও সে সম্পর্ক বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। তবে বিয়ের পর ওয়ালীউল্লাহ আন-মারিতেই আবদ্ধ ছিলেন। 
আট বছর বয়সে মা নাসিম আরা খাতুন ไমারা গেলেও বিমাতার (পিতার দ্বিতীয় স্ত্রী) সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে তাঁর বিমাতার অভিমত- ‘ওয়ালী ছিল অন্য রকম ছেলে । আর দশটি ছেলের মতো নয়। খুবই শান্তশিষ্ট। অকারণে বাড়ির বাইরে ঘোরাফেরা করত না। ঘরে অগোছালো কোনো কিছু সে পছন্দ করত না। বাবুর্চি ও কাজের লোক খাবারের টেবিল ঠিকমতো না সাজালে ওয়ালী বিরক্ত হতো। নিজে ঠিক করে সাজাত🌟। ছোট (বৈমাত্রেয়) ভাইবোনদের সঙ্গে ওর বয়সের ব্যবধান ছিল ১০-১২ বছরের। খুবই ভালোবাসত ওদের। কারও অসুখবিসুখ হলে রাত জেগে তার শুশ্রূষা করত। যখন স্কুলে পড়ত, মফস্বলে আমরা থাকতাম। গ্রামের দিকে সেকালে যাত্রা-থিয়েটার হতো। ওয়ালী যেতে চাইত তা দেখতে। আমার অনুমতি চেয়ে বলত, আম্মা, আমি যাই। সারা রাতের ব্যাপার। বলতাম, যাও। ওর বাবার অর্ডারলি চাপরাশি বা বাগানের মালিদের কাউকে সঙ্গে নিতে বলতাম । ও বলত, কী দরকার, আম্মা। লোকটার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে নিয়ে সেখানে বসিয়ে রাখা ঠিক না। কিছু হবে না। আমি যাই। সঙ্গে বন্ধুরা আছে। কাজের লোকদের খুবই দয়া করত। আমরা তখন উত্তরবঙ্গে ছিলাম। মারাত্মক শীত সেখানে। ওরা অফিসারদের ছেলেরা অবস্থাপন্ন লোকদের বাড়ি থেকে শীতের কাপড় কুড়িয়ে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করত। সবশেষ ১৯৭০-এর জানুয়ারিতে বউ-বাচ্চাদের নিয়ে দেশে আসে। আমি ছিলাম করটিয়া। আমার সঙ্গে দেখা করতে যায়। গিয়েই বলে, আম্মা, শীতের পিঠা খেতে এলাম। দুই-তিন দিন ছিল আমার কাছে।’

লেখকপুত্র সম্পর্কে তাঁর মায়ের মন্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা অন্য এক ওয়ালীউল্লাহর সন্ধান পাই। যেখানে দেখা যায় ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একজন মানবি🔯ক, উদার, 🎶দায়িত্বশীল ও প্রগতিমনস্ক মানুষ।

ফরাসি নারী আন-মারি তিবোর সঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম দেখা হয় অস্ট্রেলিয়ায়। সিডনিতে ক্রিসমাসের এক অনুষ্ঠানে তাঁদের মধ্যে প্রথম আলাপ। ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করা আন🅘-মারির সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর পরিচয় করিয়ে দেন সৈয়দ নাজমুদ্দিন হাশেম। নাজমুদ্দিন তখন অস্ট্রেলিয়ার ব্রডকাস্টিং করেপোরেশনে চাকরি করেন।

ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে প্রথম দিনের সাক্ষাৎ বিষয়ে আন-মারি বলেন, ‘আমাদের পরিচয় অস্ট্রেলিয়ায়। আমি ছিলাম একজন ফুলব্রাইট স্কলার। মাস্টার্স করেছি ইংরেজি সাহিত্যে। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলাম প্রথম চাকরি নিয়ে। অনেক মানুষের মধ্যে চোখে পড়ার মতো মানুষ ছিলেন ওয়ালী। ছয় ফুটের বেশি দীর্ঘ। ফরসা। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। নিখুঁত ইংরেজি উচ্চারণ। ক্রিসমাস পার্টিতে ওয়ালী চুপচাপই ছিলেন। ভিড় থেকে দূরে এক কোনায়। ওয়ালী ছিলেন ধূমপায়ী। দামি সিগারেট খেতেন। আমি একজন ফরাসি এবং ইংরেজির ছাত্রী শুনে ওয়ালী যেন একটু বেশিই আগ্রহ দেখান। আমার বয়স তখন ২৩। ওয়ালীর ৩১। ফরাসি সাহিত্য নিয়ে আমাকে প্রথম প্রশ্ন করেন। লক্ষ করি, ফরাসি সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর পড়াশোনা যথেষ্ট। কয়েক সপ্তাহ পর ওয়ালী একদিন ওঁর ফ্ল্যাটে এক ছোট পার্টিতে আমাকে দাওয়াত দেন। আমি মনে হয় কিছুটা ‘শাই— লাজুক প্রকৃতির ছিলাম। তাই ও আমার সঙ্গে এমন আচরণ করেন, যেন আমার শাইনেসটা কেটে যায়। আমরা খুব তাড়াতাড়ি ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হই। একটু বেশিই তাড়াতাড়ি। বেড়াতে যেতে লাগলাম। সমুদ্রতীরে। বনভূমিতে। অস্ট্রেলিয়ার নিসর্গ আমাদের দুজনেরই ভালো লেগেছিল। তবে একজন তরুণ হিসেবে ওয়ালী ছিলেন অসম্ভব সংযমী। তাঁর পরিমিতিবোধ ছিল অতুলনীয়। তাঁর সেলফ-কন্ট্রোল ও জেন্টলনেস—অসামান্য পারসোনালিটি আমাকে মুগ্ধ করে। ওঁর সঙ্গে কথা বলায় ছিল আনন্দ। বিচিত্র বিষয়ে ওয়🅺ালীর ছিল আগ্রহ ও প্রচুর পড়াশোনা। ছিল একটি বিশ্লেষণী মন। কোনো বইয়ের কোনো থিসিসকেই তিনি বিচার-বিশ্লেষণ না করে মেনে নিতেন না। আমি ওঁর চিন্তাধারায় প্রভাবিত হতে লাগলাম। হয়তো অবচেতনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, যদিও আমরা কেউই তা প্রকাশ করিনি।’

আন-মারি বলেন, ওয়ালীর সৌন্দর্যবোধের (aesthetic sense-এর) কোনো তুলনা হয় না। শুধু নিজের বাড়িঘর নয়, তাঁর অফিসটিও তিনি তাঁর পছন্দমতো পরিপাটি করে সাজাতেন। যেমন-তেমন কোনো ছবি তিনি দেয়ালে টাঙাতে দিতেন না। অফিসের চেয়ার, টেবিল, কার্পেট প্রভৃতি পছন্দ না হলে সরিয়ে ফেলতেন। নতুন কিনে আনতেন। ওঁর শিল্পীসত্তারꦚ প্রকাশ ঘটত সব ক্ষেত্রে। তিন✱ি হাসতে হাসতে বলেন, আমার ও ছেলেমেয়ের পোশাকের ডিজাইন পর্যন্ত ওয়ালী করে দিয়েছেন।

ইউনেসকোতে কাজ করে ওয়ালী সুখীই ছিলেন। তবে তাঁর ইচ্ছা ছিল, যা অনেকবার বলেছেন, শুধু লিখেই যদি জীবিকা অর্জন করতে পারতেন। যদিও তিনি জানতেন, তা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে পাঠকের সংখ্যা সীমিত। তা ছাড়া বলতেন, পাকিস্তানে প্রকাশকেরা লেখকদের ঠকিয়ে থাকেন। রয়্যালটি ঠিকমতো পরিশোধ করেন না। চুক্তিপত্রের শর্তগুলো মানেন না।
আন-মারি বলেন, “আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতাম। শুধু সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস নয়; সমসাময়িক বিষয়ও। ইন্ডিয়ার পার্টিশন নিয়েও কথা হয়েছে। বহুবার। আমরা দুজন এবং অন্যদের নিয়ে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পটভূমি ওয়ালী ব্যাখ্যা করতেন। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের মূল কারণ নিয়ে কথা বলতেন। ধর্মীয় সংকীর্ণতা, হিন্দুদের বর্ণপ্রথা, মুসলমানদের অনগ্রসরতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অগ্রসর হিন্দু নেতাদের নির্মম স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সব আলোচনায় আসত। কলকাতার কলেজ-জীবনে একবার পিকনিকে গিয়েছিলেন। দলে তাঁরা মাত্র দুজন ছিলেন মুসলমান, হিন্দু ছাত্ররাই রান্নাবান্না করেন। তাঁদের দূরে দূরে রাখা হয়। খাবারের সময় তাঁদের দূরে আলাদা বসতে হয়েছিল। রেলস্টেশনের দুই প্রান্তে পানির কল থাকত দুটি। মুসলমানদের একদিকে। হিন্দুদের অন্য দিকে। হিন্দুদের হোটেল আলাদা, মুসলমানদের আলাদা। হিন্দুদের মধ্যে উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণের ভেদাভেদ। মুসলমানের মধ্যে অভিজাত ও নিচুজাত। মুসলমানরা একদিকে ভারতবর্ষে সংখ্যালঘু, তার ওপর অনগ্রসর। তারা স্বশাসিত ভূখণ্ডের জন্য সংগ্রাম করে। সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ছিল ওঁর কাছে অসহনীয়। ধর্মের নামে 🌟যারা শোষণ করে, মানুষকে প্রতারিত করে, তাদের প্রতি ছিল ওয়ালীর গভীর অসন্তোষ। অস্ট্রেলিয়াতেই আমাকে বলেছেন, আমি ওদের আঘাত করে লিখতে চাই। ওই শ্রেণিটিকে সংশোধন করা দরকার। যদিও কাজটি খুবই কঠিন। জানি না, কে করবে। মুসলমান সমাজে নেতৃত্বের অভাব। বাঙালি মুসলমান সমাজের আনন্দ-বেদনা সম্পর্কে ওয়ালী অবগত ছিলেন। অনেক লেখকের মতো তাদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব চিত্র নয়, কারণ তা তাঁর ভাষায় হবে রিপোর্টাজ, তিনি তাদের ইতিহাস, অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে তাঁর লেখায় তুলে ধরতে চাইতেন। মুসলমানদের দৃষ্টিকোণ থেকে ওয়ালী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকে দেখেছেন। ক্রুসেড ও রেনেসাঁ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছিল। তিনি মনে করতেন, ঔপনিবেশিকতার নাগপাশ থেকে যখন তাঁর দেশের মানুষ মুক্তি পাবে এবং সেখানে যে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে, তা হবে সমাজতান্ত্রিক। তিনি ছিলেন আশাবাদী মানুষ, নৈরাশ্যবাদকে তিনি অপছন্দ করতেন, কারণ তা মানুষকে প্রাণহীন করে।

আন-মারির কথায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রাষ্ট্র💜, ব্যক্তি-সমাজ-ধর্ম ও রাজনৈতিক চিন্তা সম্পর্কে ধারণা আমাদের কাছে স্পস্ট হয়ে ওঠে। বহুল পঠিত কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জন্মশতবর্ষে আমাদের নতুন করে তাঁর লেখার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চ🍌িন্তা ও আদর্শিক অবস্থানের বিষয় নিয়েও আলোচনা করতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে লালসালু ও কাঁদো নদী কাঁদোর অন্য এক ওয়ালীউল্লাহকে।

তথ্যঋণ: স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রথমা, ঢাকা।

Link copied!