শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) আধুনিক বাংলা কবিতায় প্রাগ্রসর চিন্তার কবি। প্রভাববিস্তারী কবি। বিষয়বৈচিত্র্যে নতুনত্ব, গভীরতা, মিথ-পুরাণের ব্যবহার এবং শৈল্পিক পরিমিতিবোধের কারণে তাঁর কবিতা অনন্য মর্যাদায় স্ফূর্তি পায়। আবার তাঁর কবিꦆতায় স্বাজাত্যবোধ, নাগরিক জীবনের চালচিত্র, ঐতিহ্য অন্বেষা এবং যুগচেতনাও দুল্যমান। দেশভাগ-পরবর্তী সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রগতিশীলতার প্রভাব তার কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রাকরণিক পরিচর্যার ক্ষেত্রেও তিনি ধ্যানী ঋষি। মূলত শামসুর রহমান &l🍌squo;সময়ের অভিঘাত’কে ধারণ ও উপজীব্য করে প্রচুর কবিতা লিখেছেন। এভাবে আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে শামসুর রহমান হয়ে উঠেছেন অনিবার্য।
শুরুর দিকে শামসুর রাহমান কবিতাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যখন পಌ্রথম কবিতা লিখতে শুরু করি, তখন চতুর্দিকে কড়া পাহারা বসিয়ে দিয়েছিলাম, যাতে আমার কাব্যে রাজনীতির অনুপ্রবেশ না ঘটে।’ অথচ পরবর্তীকালে তিনি রাজনীতি থেকে, গণসংগ্রাম থেকে সংগ্রহ করেছেন তাঁর কবিতার উপাদান। তাঁর কবিতা সামাজিক দায় পরিগ্রহ করে বেড়ে উঠছে। তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন ভাষা নিয়ে রাজনীতি। ‘প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে উপলব্ধি করেছেন সে বেদনার যাতনা। মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি, মৌলিক অধিকার আর সহজভাবে চলতে থাকা জীবনে আছড়ে-পড়া অনাকাঙ্ক্ষিত অভিঘাত ঘা দিয়েছে কবির কোমল হৃদয়ে; তিনি প্রায়-দিশেহারা হয়েছেন মাতৃভাষার চরম দুর্দশার সময়꧒ে।’ তিনি ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতার মাধ্যমে নিজের ভাবনার কথা প্রকাশ করেছেন এভাবে—
‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
উনিশ শো’ বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।’
একইভাবে ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন উপজীব্য করে লেখেন ‘আসাদের শার্ট’। শামসুর রাহমানের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অনন্য মাত্রা পেয়েছে। ১৯৭১ সালে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে বাঙালি জাতি আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সেখানে ছিল না কোনো ধর্মের প্রণোদনা। শামসুর রাহমানের কবিতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা ক্রিয়াশীল ছিল। ‘তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/ সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,/ সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর’, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা। ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায়ও তিনি নজরুল আর রবীন্দ্রনাথকে স্বাধীনতার স্বপ্ন-সাধের মধ্যে একাকার করে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘অজর কবিতা’কে যেমন তিনি স্বাধীনতার সমার্থক মনে করেছেন, তেমনি নজরুলের ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাস’কেও কবি স্বাধীনতা হিসেবে অনুভব করেছেন। শামসুর রাহমান বিশ্বাস করতেন, ‘ভাষার স্বাধীনতা আর কবিতার ඣমুౠক্তিই মানবজীবনের সকল ব্যাপ্তি-প্রাপ্তির মূল উৎসভ‚মি’; আর এই চেতনার চিন্তাভাষ্য তিনি ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় সাজিয়েছেন।
‘স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।’
কবি স্বাধীনতাকে নানা চিত্রকল্পে নামাঙ্কিত করতে চেয়েছেন এই কবিতায়। ‘বীরত্বযুক্ততা, রাজনৈতিক সম্পৃক্তি, গ্রাম্য-অনুষঙ্গ, পাখির গান-ঘর-বাগানের আশ্রয়-আকর্ষণ আর স্বস্তিতে সৃজনলেপনের কবিতাখাতার প্রসঙ্গাদি স্থান পেয়েছে তাঁর কল্পনারাজিতে।’ কবিকে আবিষ্কার করা যায় গণতন্ত্রমনা হিসেবে। এ ছাড়া একনায়কতন্ত্𓃲র, স্বৈরশাসন, সামরিক শাসন, মৌলবাদ ও প্রগতিবিরোধী সব রকমের মতাদর্শের ঘোরবিরোধী রূপে। ভাষা📖-গণতন্ত্র ও দেশমাতৃকার প্রতি সতত শ্রদ্ধাশীল কবি দেশের নানান অসংগতির বিরুদ্ধের কবিতা লিখেছেন। যে দেশের আপামর জনগণ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে নিজস্ব ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি, জাতিসত্তা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের আশায়, সে দেশে গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম ও অধিকার হরণের প্রতিবাদে কবি লিখেছেন—
‘ভোরবেলা ঘন
কুয়াশার তাঁবুতে আচ্ছন্ন চোখ কিছুটা আটকে গেলে তার
মনে হয় যেন সে উঠেছে জেগে সুদূর বিদেশে
যেখানে এখন কেউ কারো চেনা নয়, কেউ কারো
ভাষা ব্যবহার আদৌ বোঝে না; দেখে সে
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ,
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।’
১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। এরপর পর্যায়ক্রমে ৬৭ কবিতাগ্রন্থসহ অন্যান্য রচনা প্রকাশিত হয়। কবির উল্🐲লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থের মধ্যে আছে, ‘রৌদ্র করোটিতে’ (১৯৬৩), ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ (১৯৬৭), ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ (১৯৬৮), ‘নিজ বাসভূমে🔯’ (১৯৭০), ‘বন্দি শিবির থেকে’ (১৯৭২), ‘দুঃসময়ের মুখোমুখি’ (১৯৭৩), ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ (১৯৭৪), ‘আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি’ (১৯৭৪), ‘এক ধরনের অহংকার’ (১৯৭৫), ‘আমি অনাহারী’ (১৯৭৬), ‘শূন্যতায় তুমি শোকসভা’ (১৯৭৭), ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে’ (১৯৭৭), ‘প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে’ (১৯৭৮), ‘ইকারুসের আকাশ’ (১৯৮২), সনেটগ্রন্থ ‘মাতাল ঋত্বিক’ (১৯৮২), ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ (১৯৮৩), ‘কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি’ (১৯৮৩), ‘নরকের ছায়া’ (১৯৮৩), ‘আমার কোন তাড়া নেই’ (১৯৮৪)।
শামসুর রাহমানের কবিতায় শুধু জাতীয়তাবোধই নয়, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি এবং ব্যক্তির একান্ত বিষয়ও উঠে এসেছে। কবির ‘দুঃখ’ কবিতার পঙ্ক্তিতে ব্যক্তিগত দুঃখের নিপুণ বর্ণনা রয়েছে। রয়েছে অনন্ত বেদনার গভীর আয়োজন। তাঁর কবিতায় অতীতের ঘটনাপুঞ্জের স্মৃতির সঙ্গে উপস্থিতকালের বিভিন্ন ঘটনার সংঘর্ষে সৃষ্ট অভিঘাতের বর্ণনা রয়েছে। সে বর্ণনা মিথ-ইতিহাস-ঐতিহ্য আশ্রয়ী। শামসুর রাহমান সময়ের প্রধান অসুখ রাজনৈতিক সংকটকে অন্যদের চেয়ে ভিন্নতর রূপে শনাক্ত করতে পেরেছেন। সে চিত্র তিনি এঁকেছেন মিথ-ইতিহাস-ঐতিহ্যের মিথস্ক্রিয়ায়। প্রেম, প্রকৃতি, দেশ, রাজনীতি, আন্তর্জাতিকতা ইত্যাকার অনুষঙ্গে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে কল্পনা-বাস্তবের যুগ্ম-স্বাক্ষর। শামসুর রাহমানকে নিয়ে হুমায়ুন আজাদের উপলব্ধিও যথার্থ ‘আধুনিক কবি শামসুর রাহমান আত্মপ্রকাশে তিরিশের উত্তরসূরি আধুনিক কবি ও কবিতাকে অক্ষুণ্ন রেখেছেন। শামসুর রাহমান তো পঞ্চাশের কাব্যপ্রতিভা তাই তাঁর স্বাতন্ত্র্য অবশ্যম্ভাবী। তিরিশের কবিতার কাব্যপ্রতিভার মধ্যে শামসুর রাহমান তার সঙ্গে গেঁথেছেন বাস্তবতা ও অব্যবহিত প্রতিবেশ ও সময়। শামসুর রাহমান সমকালে বিস্তৃত ও বাস্তবতাকে ধারণ করেছেন। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে জাতীয় চেতনার প্রতিটি দ্রোহ, উন্মাতাল, আবহ, উত্তাপ, গণমুক্তির মুখর শব্দমালা। শামসুর রাহমানের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি বাস্তব প্রতিবেশকে ব্যাপক বিস্তৃত বা🐲স্তবতাকে তাঁর কবিতায় ধারণ করেছেন নিজ স্বভাবে। তাই তো তিনি বাংলাদেশের একমাত্র প্রধান কবি রূপে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন।’
সর্বোপরি বলা যেতে পারে, শামসুর রাহমানের কবিতায় রাজনৈতিক অনুষঙ্গ অতিমাত্রায় উপস্থিত থাকলেও শিল্পকুশলতা বিঘ্নিত হয়নি। কবিতার শব্দ প্রয়োগ, ছন্দবৈচিত্র্য এবং অলংকারনৈপুণ্যে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। দেশীℱয় শিল্পনন্দনের পাশাপাশি তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে ইউরোপীয় দর্শন ও নন্দনতত্ত্ব। সবকিছু মিলিয়ে বাঙালির স্বদেশচেতনার মর্মমূলে শামসুর রাহমানের কবিতার শিকড় প্রোথিত। তাঁর কবিতা পাঠকের মানসলোকে অত্যন্ত প্রভাববিস্তারী এবং আমাদের জাতীয় জীবন থেকে শুরু ꧋করে ব্যক্তিগত জীবনেও অশেষ অনুপ্রেরণার উৎস।