বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট শিল্পী নাজমা আক্তার। বিমূর্ত চিত্রশিল♛্পে যে কয়জন নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী আছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি এই দেশের সবুজ-শ্যামল পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠেছেন সত্য। তবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন অবশ্য কেটেছে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়েও। ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনেক সংকটকে আত্মস্থ করে, তিনি গড়ে তুলেছেন প্রেমদীপ্ত এক জীবনবোধ। এরই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর বিমূর্ততায় (মৃণাল ঘোষ: পৃ-৮)। সমাজের অন্য দশজন মানুষের মতো শিল্পী নাজমা আক্তারের জীবনযাত্রা সহজসরল নয়। প্রত্যেক শিল্পীর জীবনের মতো তাঁর জীবনেও আছে নানা সমস্যা-সংকট-প্রেম-আবেগ। তাঁর জীবন ও সৃজনে তাই সেসবের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়।
শিল্পী নাজমা আক্তার ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের শিয়ালকোর্টে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ললিতকলা বিভাগ থেকে চিত্রকলায় স্নাতকোত্তর উপাধি অর্জন করেন। আর তাঁর শিক্ষা প্রাচ্যরীতিতে। প্রাতিষ💜্ঠানিক পড়ালেখা সমাপ্ত করে তিনি কিছুদিন প্রাচ্যরীতিতেই অবয়বী ছবি আঁকেন। ক্রমাগত রূপান্তরের মাধ্যমেই তিনি পরিপূর্ণ বিমূর্ততায় পৌঁছেন। তাঁর এই রূপায়ন বা বিমূর্তায়ন পদ্ধতিকে সমালোচকরা বলেন প্রতিচ্ছাꦜয়াবাদী বিমূর্ততা অথবা ইম্প্রেশনিস্ট এবস্ট্রাকশন।
শিল্পী নাজ🔜মা আক্তারের বাবা আবদুল জব্বার সেনাবাহিনীতে চাকুরি করতেন—সে সূত্রে তাঁরা পাকিস্তানের শিয়ালকোর্টে থাকতেন। তাই নাজমার জন্ম শিয়ালকোর্🉐টে। তাঁরা বাংলাদেশের মানুষ ও বাঙালি। নাজমা আক্তার একজন বাঙালি শিল্পী। একজন শিল্পীর শিল্পের প্রকাশ ঘটে তাঁর দেশ ও কালের প্রেক্ষাপটে। নাজমা’র ক্ষেত্রে একথা একটু বেশি করেই সত্য (মৃণাল ঘোষ : পৃ. ৫০)।
তিনি ১৯৭৭ সালে জুলাই মাসে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭৭ সাল থেকে ১🥀৯৮৩ সাল এই পাঁচ বছর ঢাকা আর্ট কলেজে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষায় ব্যস্ত সময় কাটান। তৃতীয় বর্ষে শিক্ষার্থীদের বিষয় নির্বাচন করে নিজেদেরღ পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন বিভাগে ভাগ হয়ে যেতে হয়। তিনি বাছাই করলেন ওরিয়েন্টাল স্টাইল অর্থাৎ প্রাচ্যরীতি। তাঁর মধ্যে দেশাত্মবোধ ছিল। তাই তো তিনি স্নাতক পর্যায়ে বেছে নিয়েছিলেন প্রাচ্যরীতি।
তিনি ১৯৮০ সালে স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন । আর সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মেধাবী ছাত্র জনাব মীজানুর রহমꦫানের সাথে নাজমা আক্তারের বিয়ে হয়। তখন তাঁরা দু’জনই শিক্ষার্থী। তাই বিয়েটা হয় একেইবারেই অনাড়ম্বরভাবে। ১৯৮৩ সালে বিএফএ ফাইনাল পরীক্ষায় নাজমা আক্তার দ্বিতীয় বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে তিনি মা হলেন। ১৯৮৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। বাচ্চার বয়স যখন মাত্র ছয় মাস তখন তিনি রাজশাহীতে তাঁর স্বামীর কাছে চলে যান। সেখানে গিয়েও তাঁর কোন ধরনের শান্তির দেখা মিলল না। কারণ স্বামী তখন খুবই ব্যস্ত। এমনকি স্ত্রী-সন্তানের দিকে থাকানোর সময় পান না। এমন ধরনের একাকিত্ব নাজমা আক্তারকে পীড়া দেয়।
১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর স্বামী রাজশাহী থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদান করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও স্বামী ব্যস্ত থাকেন। নিজের পড়ালেখা ও পেশা নিয়ে ব্যস্ত🌠 থাকেন। এমন অবস্থা নাজমার জন্য কষ্টকর হয়ে উঠেছিলো। ফলে যথাসময়ে এমএফএ ফাইনাল পরীক্ষায় আর অংশ নেয়া হলো না। এক বছর পিছিয়ে গেলেন। ১৯৯১ সাল। সেই দুঃসময়ে তাঁর বাবা মারা যান। একই বছরের নভেম্বর মাসে মৃত কন্যাসন্তানের জন্ম। এই বছরই এমএফএ পাস করেন। তবে মনের মধ্যে কষ্ট বাড়তে থাকে। কষ্ট ও হতাশা দিন দিন বেড়েই চলে। এই কষ্ট কি শিল্পীর নিয়তি?
আমাদের শিল্পী নাজমা আক্তারের ছবি প্রধানত প্রকৃতিভিত্তিক। প্রকৃতির স্পন্দনটুকুকে তিনি বিমূর্তের দিকে নিয়ে গেছেন (মৃণাল ঘোষ : ৯৪)। নাজমা’র জীবন এক ধরনের সংগ্রামের জীবন। জীবনের অভিজ্ঞতা শিল্পীর কর্মের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। শিল্পীর অন্তর্দাহ ও যন্ত্রণা তাঁর তুলিতে দেখা যায়। আমরা শিল্পী নাজমার ব্যক্তিজীবনে দেখতে পাই বিয়ের পর তাঁর স্বামী ব্যস্ত থেকেছেন নিজের কাজ নিয়ে, নিজের পড়াশুনা ও প্রতিষ্ঠা নিয়ে। তাঁর মা যেমন চাননি, নাজমা আর্ট কাল🦂েজে ভর্তি হোক, তেমনি তাঁর স্বামীরও সমর্থন ছিলো না শিল্পকলায় তাঁর স্নাতকোত্তর শিক্ষার প্রতি। ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে যখন চিঠি এসেছিলো স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তির তারিখ জানিয়ে, সে চিঠি স্বামী তাঁকে দিতে ভুলে গেছেন। নাজমার ছবি আঁকার প্রতিও তাঁর কোনো আগ্রহ ও মনোযোগ ছিল না। অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন (মৃণাল ঘোষ : ৯২)।
শিল্পী নাজমার প্রকাশ ভাবনা ও আঙ্গিকের একটি বৈশিষ্ট্য হল প্রাচ্যচেতনাকে আধুনিকতা♎বাদী বিমূর্তায়নের দিকে নিয়ে যাওয়া। অনেক শিল্পীই যাঁরা পরবর্তীকালে বিমূর্ততা অবলম্বন করেছেন, তাঁরা অবয়বকে বিশ্লিষ্ট ও রূপান্তরিত করেই নিরাবয়বের দিকে গেছেন। আমাদের শিল্পী নাজমাও তাঁর ছবিতে এ কাজটিই করেছেন। স্বদেশ চেতনা-আশ্রিত আধুনিকতা থেকে তিনি আধুনিকতাবাদী মননে পৌঁছতে চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নারীকে শিল্পী হিসেবে আধুনিকতাবাদী, প্রতিবাদী ও প্রগতিবাদী হতে কতটুকু সহায়তা করে তা শিল্পী নাজমা আক্তারের সংগ্রামী জীবনকাহিনি থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। এদেশে নারীর চলার পথে প্রতি পদে পদে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান।
মৃণাল ঘোষ একজন উৎকৃষ্ট ও অভিজ্ঞ চিত্রসমালোক। তিনি শিল্পী নাজমা আক্তারে জীবন ও সৃজন নিয়ে অনেক সাধনা ও গবেষণা করছেন, সেটা তাঁর রচনার প্রতি দৃষ্টি ও মনোযোগ দিলেই উপলদ্ধি করা যায়। শিল্পী নাজমা আক্তার🎶 ১৯৮০ দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত। শিল্পীতে নিয়ে লিখতে গিয়ে মৃণাল ঘোষ লিখেছেন:
“১৯৮০-এর দশকের ছবির যে বৈশিষ্ট্য তা হলো এ♎ পর্বের অনেক শিল্পীর কাজই ১৯৬০-এর ভাবধারার প্রসারণ। নাজমার ক্ষেত্রেও তাই। একবিংশ শতকে পৌঁছে তিনি নিজেকে পাল্টে দেন। বিমূর্তের দিকে গেছেন।” (🍷পৃ.১০৬)
নাজমা আক্তার শুধু একজন শিল্পীই নয়, তিনি একজন লেখক এবং সমালোচক, মানে চিত্রসমালোচকও । তাইতো তিনি বলেন: কে কোনভাবে কাজ করবেন তা সেই শিল্পীর মানসিক গঠনের উপর নির্ভর করে। যারা অন্তর্মুখী তাঁরা ধীরে ধীরে নিবিড় শ্রম ও নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কাজ করতে ভালবাসেন। যাঁদের মনন ও চেতনা একটু বহির্মুখী, তাঁরা হয়তো পছন্দ করেন দ্রুত কাজ করতে (উদ্ধৃত, পৃ. ৯৫)। আর শিল্পী নাজমা আক্তারের ছবি নিয়ে গবেষণা ও আলোচনা করতে গিয়ে মৃণাল ঘোষও নাজমার জীবনের ও কর্মের নানা দিক পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। তাই তিনি শিল্পী নাজমা আক্তারের ছব⭕ির সমালোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন:
“নাজমা একের পর এক এঁকে গেছেন বিমূর্ত ছবি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বিমূর্তের ভিতর মূর্তের সংকেত থেকেছে কিছু। সেই সংকেত দিয়েই তিনি ছবিটিতে বাস্তবের ইঙ্গিত এনেছেন। নাজমা কখনোই ছবিতে আত্ম-নিরপেক্ষ, দেশকাল-নিরপেক্ষ বিমূর্তের জন্য ছবি আঁকেননি। সব ছবিতেই তিনি নিজের ভেতরের আনন্দ, বিষাদ ও অভিপ্সাকে অভিব্যক্ত করতে চ🔥েয়েছেন। আর সেই অভিব্যক্তিকে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছেন দেশ-কালের সঙ্গে।” (পৃ. ১১২)
চিত্রসমালোচক হিসেবে জনাব মৃণাল ঘোষের দক্ষতা ও উদারতা দুটাই সমানে সমান। তিনি শিল্পী নাজমা আক্তারের ছবি ও জীবনের নানা দিক বিবিধ উপায়ে বিচারবিবেচনা করার যথাসাধ্য প্রয়াস চালিয়েছেন। তাই তিনি উদারভাবে বলেছেন—যে কোনো ছবিতেই অনেক রহস্য থেকে যায়, যার সবটা সব সময় ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই আমরা দেখতে পাই জনাব মৃণাল ঘোষ শিল্পী নাজমা আক্তারের ছবি সম্পর্কে স🧸মকালীন অন্য সমালোচকরা কী ভাবছেন, কী বলছেন এবং কী লিখছেন তাও পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। এটাকে আমরা বলতে পারি মৃণাল ঘোষের যুক্তির পক্ষে অন্যান্য সমালোচকের মতামত পাঠকসমাজের সামনে উপস্থাপন করা। বিশিষ্ট শিল্পী সামসুল ওয়ারেস শিল্পী নাজমা আক্তারের ছবি সম্পর্কে লিখেছেন:
“নাজমা’র চিত্রকলা থেকে বোঝা যায় রং, স্পেস ও ফর্মের ব্যঞ্জনায় শুধু চাক্ষুষ নান্দনিক আনন্দ নয় বরং মানুষের অভিজ্🐎ঞতার সীমা অতিক্রান্ত হয়ে অনাবিল আনন্দঘন সুখানুভূতি সৃষ্টি করাই নাজমার উদ্দেশ্য।” (পৃ. ১২২)
চিত্রসমালোচক&nbs𒅌p; আরিফ বুলবনও শিল্পী নাজমা আক্তারের ছবি সম্পর্কে লিখেছেন:
Najma is a passionate Painter whose Primary aim is to express her inner world through art. Her soul is always in search of a space where emerald green, azure, crimson and yellow come toౠgether to represent great affliction and ecstasy. (পৃ. ১২৪)।
চিত্রসমালোচক মৃণাল ঘোষ নিজের মতামত ও অন্যান্য সমালোচকের মতামত একসাথে, একস্থানে জড়ো করে শিল্পী নাজমাকে তুলে ধরার🌳 চেষ্টা করছেন। ফলে তাঁর রচিত ‘নাজমা আক্তার-এর ছবি: মূর্তের অমূর্তꦦ রূপ’ শিল্পরসিক ও সমালোচকদের চেতনা ও ভাবনাকে অধিকতর সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হবে।
লেখক মৃণাল ঘোষ আর যা-ই হোক না কেন, তিনি আশাবাদী মানুষ। হাজার সমস্যার মধ্যে আশা ও সম্ভাবনার আলো দেখতে পান। শিল্পী নাজমা আক্তারকে নিয়েও বেশ আশাপ্রদ মতামত তুলে ধরছেন। তিনি দীর্ঘ আলোচনায় শেষে আমাদের জানা𒅌ন: “২০০৬ থেকে যে ক’টি একক প্রদর্শনী হয়েছে দেশে এবং বিদেশে তা তাঁকে যথেষ্ট সম্মান ও প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে। নিজের সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নিমগ্ন হতে পারছেন শিল্পী। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন। ঝড়ঝঞ্ঝা শান্ত হয়েছে অনেক। তাই স্বতঃস্ফূর্ততা এসেছে ছবিতে। দেখতে পান আলোর হাতছানি (পৃ..১৪২)।
মৃণাল ঘোষের লেখা অত্যন্ত সাবলীল, গতিশীল ও উপস্থাপন অত্যন্ত চমৎকার। শিল্পকর্মের এমন চমৎকার আলোচনা ও সমালোচনা শিল্পরসিকদের এমনকি শিল্পসাহিত্যের সাধারণ পাঠকসমাজকেও অনায়াসে আকৃষ্ট করবে। এই বইটি পাাঠের স🌄াথে সাথে সচেতন পাঠকসমাজ সহজেই বুঝতে পারবেন মৃণাল ঘোষ কত আন্তরিকতা ও সাধনায় শিল্পী নাজমা আক্তারের জীবন ও সৃজন নিয়ে গবেষণা করেছেন। আন্তরিক গবেষণা যে কতটা নান্দনিক হতে পারে এই বই তারই প্রমাণ। শিল্পী নাজমার ছবি সম্পর্কে মৃণাল ঘোষ বইটির শেষে বলেন: “কবিতার অন্তর্মুখী মুগ্ধতা তাঁর ছবির বৈশিষ্ট্য।”
বইয়ের নাম: নাজমা আক্তার-এর ছবি: মূর্তের অমূর্ত রূপﷺ
লেখক: মৃণাল ঘোষ
প্রকাশনী: মেরিট ফেয়ার প্রকাশন, ঢাকা,
প্রকাশ: ২০১৯
প্রচ্ছদ : নাজমা আক্তার
মূল্য: ১৫০০ টাকা