• ঢাকা
  • রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Songbad Prokash

ইনস্টাগ্রাম

টুইটার


লিংকডইন

পিন্টারেস্ট

গুগল নিউজ


সেলিনা হোসেনের কথাসাহিত্য


শাহনাজ পারভীন
প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২২, ০২:৩৫ পিএম
সেলিনা হোসেনের কথাসাহিত্য

কত পথ হেঁটে হেঁটে সেলিনা হোসেন একজন—

মেঘে ঢাকা নীলাকাশ, পাখি ডাকা ভোর হওয়া মন।

সুখপাখি, বুনোপাখি, রাধাচূড়া, সোনালু সেগুন—

সবকিছু মেখে নিয়ে সাহসের সোনামাখা গুণ।

আমরা জানি, সাহিত্যের আরশিতে প্রতিবিম্বিত হয় একটি জাতি তথা একটি রাষ্ট্রের জীবনপ্রণালি। প্রতিফলিত হয় সে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও  সাংস্কৃতিক পটভূমি। জীবন মানেই তো সাহিত্য আবার সাহিত্য মানেই তো জীবন। সাহিত্যের একনিষ্ঠ সংজ্ঞা প্রায় অপ্রতুল। দেশ-কাল ভেদে এর সংজ্ঞা পাল্টায়। তবে ‘সাহিত্য’ শব্দটি ‘সহিত’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। সহ💧িত অর্থ সংযুক্ত, সমন্বিত, হিতকর, সঙ্গে, সাথে। জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ শিল্পসমন্বিত বাক্যবিন্যাসই সাহিত্য। সাহিত্য শব্দটি ‘সম্মিলন’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সম্মিলন হলো মনে-মনে, আত্মায়-আত্মায়, হৃদয়ে-হৃদয়ে মিলন। সাহিত্য শব্দটির সঙ্গে হিত, কল্যাণ, মঙ্গলও সম্পর্কযুক্ত। সাহিত্য মানবজীবনের দর্পণস্বরূপ। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আস্থা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং  ইতিহাস-ঐতিহ্য সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় শৈল্পিক সৌন্দর্যে। সাহিত্যের আরেক নাম জীবন-সমালোচনা (criticism of life)। জীবন-সত্যের বিশ্লেষণই এতে অঙ্গীকৃত। মানুষের আবেগ ও মননের (emotion and intellect) মাধ্যমে জীবনের সত্য, জীবনাতীতের সত্য ভাষার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সাহিত্যে উদ্ভাসিত হয়। সত্য যখন শব্দশিল্পের পরশে সুন্দর হয়ে প্রকাশিত হয়, তখন তা যুগ যুগ ধরে সংবেদনশীল (sensitive) হয়ে মানুষের মনে রস-আবেদন সৃষ্টি করে। মানবমনের এ ধরনের পবিত্র আনন্দ সৃষ্টি করা সাহিত্যের কাজ। এ জন্য মানবমনে সাহিত্যের প্রভাব খুব প্রবল, তার শক্তি বিপুল।

সাহিত্য যেখান থেকেই জন্মলাভ করুক না কেন, তার অবয়বে থাকে তার জন্মস্থান, যুগ এবং পারিপার্শ্বিকতার ছোঁয়া। তাই সাহিত্যে যেকোনো মুক্তিকামী জাতির কথা যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি স্পষ্ট হয় মুক্তিযুদ্ধের কথা। মুক্তিযুদ্ধের শৈল্পিক প্রভাব পড়ে সাহিত্যের ওপর। সাহিত্য বহতা নদীর মতো অস্থিতিশীল। নদীর মতো সাহিত্যেরও রয়েছে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা। যদিও রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘সৃষ্টির ন্যায় সাহিত্যই সাহিত্যের উদ্দেশ্য।’ রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিকে অস্বীকার করা যায় না। তবু আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও লক্ষ করি। একটু লক্ষ করলেই আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়, উদ্দেশ্যও অনেক সময় মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করে। তাই আমরা সাহিত্যের গবেষণায় দেখতে পাই, সাহিত্যের অনেকটা অবয়ব জুড়ে আছে প্রকৃতি, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম এবং এর বꦗড় একটা অংশ জুড়ে আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। যদিও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের যাত্রা সত্তরের দশক থেকে, তবু আমাদের সাহিত্যে এর গতি স্বতন্ত্র।

কথাসাহিত্যে সেলিনা হোসেন আমাদের আলোচ্য বিষয়। কিন্তু কেন য♚েন মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ, ভাষা-আন্দোলনের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলেই সেলিনা হোসেন সেখানে আবশ্যিক অনুষঙ্গের মাধ্যমে শত রঙে রঙিন হয়ে সাহিত্যের ক্যানভাসে স্বমহিমায় উদ্ভাꦅসিত হন।

আমাদের উপন্যাসে বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। রামুরাইদের বাঁকা তরবারি এবং চন্দ্রমল্লিকা ফুল জাপানিদের কৃষ্টি। রাশানদের গর্ব তাদের বিপ্লব এবং আমাদের গর্ব হচ্ছে একুশ-মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্ববিখ্যাত রাশান ঔপন্যাসিক তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস এবং এরেন বুর্গের ফল অব প্যারি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। দুটো উপন্যাসই মহৎ এবং কালজয়ী সৃষ্টি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে নিয়ে বিশ্বসাহিত্যের অসংখ্য গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রচণ্ড সম্ভাবনার দুয়ারেও ঔপন্যাসিকগণ পদচারণে শাশ্বত পদক্ষেপ রেখেছেন। তাঁদের ছিল অস🐎ীম সাহস আর শক্তি। তাই তো সেদিন আমরা পেয়েছিলাম জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে, আবু ইসহাকের সূর্যদীঘল বাড়ী, শওকত ওসমানের জননী। এগুলো ছিল গ্রামীণ জীবনভিত্তিক রচনা। আমাদের সাহিত্য নাগরিক উপন্যাসে ঋদ্ধ হয় আবুল ফজলের জীবনপথের যাত্রী, আবু রুশদের সামনে নতুন দিন, রশীদ করিমের উত্তম পুরুষ, প্রসন্ন পাষাণ, আমার যত গ্লানির মাধ্যমে।

পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশ উপন্যাসে সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে, যা নানা পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্যে সৃষ্টিশীলতায় আজও প্রবহমান। বাংলাদেশে উপন্যাসের পালাবদলের যে ধারা, তা লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের উপন্যাসের অধিকাংশই সময়ের🎉 সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এই সময়ের স্রোত বেয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধ, সৃষ্টি হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসসমূহের মধ্যে শহীদ আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত, শওকত আলীর যাত্রা, শওকত ওসমানের নেকড়ে অরণ্য, জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি, রশীদ হায়দারের খাঁচায় অন্ধ কথামালা, সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড, গায়ত্রী সন্ধ্যা, ত্রয়ী, কাকতাড়ুয়া, মাহবুবুল হকের জীবন আমার বোন, রিজিয়া রহমানের বং থেকে বাংলা, রাবেয়া খাতুনের মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, শাহিদা খাতুনের যুদ্ধে যুদ্ধে নয় মাস, জোবাইদা গুলশান আরার সুবাস ফেরেনি, হাসনাত আবদুল হাইয়ের নি🥂খোঁজ, রফিকুন্নবীর পিস্তল, আন্দালিব রাশদীর সুসময়, মঈনুল আহসান সাবেরের সতের বছর পর, রশীদ হায়দারের নদী ও বাতাসের খেলা, হুমায়ূন আহমেদের নন্দিত নরকে, নির্বাসন, জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প এবং ইমদাদুল হক মিলনের কালো ঘোড়া, পরাধীনতা উল্লেখযোগ্য। বাংলা উপন্যাসের এই বিশেষ ধারাটি মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফল। ১৯৪৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের উপন্যাসে যে ধারা প্রবহমান, তা নবদিগন্তে সৃষ্টিশীলতায় উৎসারিত।

মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ এবং অনন্য শিল্পঘনিষ্ঠ কর্ণধার সেলিনা হোসেন (১৪ জু﷽ন, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ) 🔯রাজশাহীতে তাঁর পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলার হাজিরপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা এ কে মোশারফ হোসেন, মা মরিয়ম-উন-নিসার নয় সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে করতোয়া ও পদ্মাবিধৌত নদী-অববাহিকা রাজশাহী শহরে।১ দুই নদীর মাতোয়ারা স্রোত তাঁকে উদার বানিয়েছে। জীবন শিখিয়েছে।

‘রাজশাহীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর🎐 ডিগ্রি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা যেমন ছিল, ততোধিক আগ্রহ ছিল সাহিত্যে। ১৯৬৯ সালে ছোটগল্প বিষয়ে প্রবন্ধ রচনার জন্য সেলিনা হোসেন ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক লাভ করেন। জীবনের নানা মাত্রিকতায় তিনি অনুধাবন করেছেন সমাজ, 🔴রাষ্ট্র ও পরিবেশকে।’২

সেলিনা হোসেন। এক বাংলাদেশের নাম। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল সম্ভবত ২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর। ঢাকায় একটি নারী নেতৃত্বের অনুষ্ঠানে তিনি উদ্বোধক ও প্রধান অতিথি ছিলেন। সেখানে আমি বিশেষ অতিথি ছিলাম। বলা যায় প্রধান অতিথি হিসেবে তাঁর নামটি দেখেই আমি সুদূর যশোর থেকে ঢাকার এই অনুষ্ঠানে ছুটে আসি। তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখব বলে। সেই অনুষ্ঠানে আমি আমার নির্ধারিত বক্তব্য শেষে আমার লেখা ‘নারী’ কবিতাটি আবৃত্তি করি। তিনি আমার কবিতা শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে আদর করে বলেছিলেন—‘শাহনাজ, কবি, আমি তোমাকে ঈর্ষা করি।’ আমি লজ্জায় আনত মুখে জিজ্ঞেস করি, ‘কেন আপা?’ তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি উপন্যাস লেখো, গদ্য লেখো আবার চমৎকার কবিতা লেখো এবং ততোধিক সুন্দর আবৃত্তি করো। আমি কবিতা লিখতে পারি না।’ এটুকু বলে তিনি স্বভাবসুলভ হাসিতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন চারপাশ। তাঁর হাসির রেশ এখনো আমার কানে বাজে। আমি অনুপ্রাণিত হই। ঋদ্ধ হই। সেলিনা হোসেনেরဣ সঙ্গে আমার প্রথম সেই পরিচয়। তাঁর প্রতি আমার বিশেষ কৃতজ্ঞতা তৈরি হয়।

দীর্ঘ সময় শেষে ২০১৭ সালে আমার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ পরিবার পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত বাইশটি ছোটগল্পের সমাহার একাত্তরের আগুন সময় সেলিনা হোসেনকে উৎসর্গ করি। সেটি আমার আনন্দ। আমার ভালো লাগা। তাতে তাঁর কিছুই এসে যায় না। আমি তাঁর পাঠক দীর্ঘ সময় থেকে। তাঁর ꧙প্রথম উপন্যাস জলোচ্ছ্বাস (১৯৭২) থেকে൩ শুরু করে হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬), মগ্ন চৈতন্যে শিস (১৯৭৯), যাপিত জীবন (১৯৮১), নীল ময়ূরের যৌবন (১৯৮২), পদশব্দ (১৯৮২), পোকামাকড়ের ঘর বসতি (১৯৮৬), নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি (১৯৮৭), ক্ষরণ (১৯৮৮), কাঁটাতারে প্রজাপতি (১৯৮৯), গায়ত্রী সন্ধ্যা (১৯৯৪), দীপান্বিতা (১৯৯৭), যুদ্ধ (১৯৯৮), একটি উপন্যাসের সন্ধানে (১৯৯৯), যমুনা নদীর মুশায়রাসহ (২০১১) অসংখ্য লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছে। এছাড়া কিছু গদ্য স্বদেশ পরবাসী (প্রথম প্রকাশ ১৯৮৫, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯৩), একাত্তরের ঢাকা (১৯৮৯) এবং নির্বাচিত গল্প মতিজানের মেয়েরাসহ (১৯৯৫) প্রতিনিয়ত তাঁকে পড়া হয়। পড়ছি দৈনিক পত্রপত্রিকায়। দেশ এবং দেশের বাইরের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়।

প্রিয় পত্রিকা সমধারার ‘সেলিনা হোসেন মূল্যায়ন সংখ্যা’র জন্য পত্রিকাটির সম্পাদক কবি সালেক নাসিরউদ্দিন আমাকে একটি প্রবন্ধ লিখতে আমন্ত্রণ জানালে আমি সেলিনা হোসেনকে নিয়ে একটি গল্প লেখার কথা বলি। তিনি বিষয়টিকে ‘হাস্যকর’ বলে আমাকে প্রবন্ধ লিখতে বলেন। তবে ভবিষ্যতে আমার ইচ্ছে আছে আমি তাঁকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখব। কারণ, একজন কবি বা সাহিত্যিক একটি বিশেষ সময়ের মানুষ মাত্র নন। তাঁরা সময়কে অতিক্রম করেন। মুঠোয় ধারণ করেন সময়ের ঝিনুক। তাঁদের জীবন ও সময় সাহিত্যেরই বিষয়। যে কারণে তিনি কবি মির্জা গালিবকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন যমুনা নদীরꦆ মুশায়রা। এই উপন্যাসটি লেখার জন্য তিনি ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। তিনি বহুবার দিল্লিতে গিয়েছেন। প্রথমে ১৯৯৬ সালে তিনি কবি গালিবের জন্মস্থান আগ্রায় যান। ২০০০ সালের এপ্রিলে তিনি আবার দিল্লিতে যান। ফাউন্ডেশন অব সার্ক রাইটার্স অ্যান্ড লিটারেচার-আয়োজিত সার্ক লেখক সম্মেলনে গিয়ে তিনি কবি গালিবের কবর দেখতে যান। সেখানে গালিবের কবরটি অযত্ন-অবহেলায় দেখে তাঁর মন খারাপ হয়ে যায়। কবরের পাশের লাইব্রেরি থেকে তিনি কিছু অনুল্লেখযোগ্য বই কিনে ফিরে আসেন। তারপর থেকেই তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে কবি মির্জা গালিবকে নিয়ে রচিত বিভিন্ন ভাষার নানা বই-পুস্তক সংগ্রহ এবং তা আত্মস্থ করেন। তিনি লিখেছেন, ‘অধ্যাপক আবু সয়ীদ আইয়ুব, লেখক গৌরী আইয়ুব, কবি গুলজার, গবেষক পবনকুমার ভার্মা, কবি শঙ্খ ঘোষ, কবি সৈয়দ শামসুল হক সকলের সঙ্গে এক হয়ে কবি গালিবকে বুঝতে চেয়েছি।’৩ এর দীর্ঘ উৎসর্গপত্র এবং নাতিদীর্ঘ ভূমিকা দেখলেই বুঝতে পারি, তিনি কতটা ঋদ্ধ হয়ে কবি মির্জা গালিবকে নিয়ে লিখেছেন।

তিনি নিজের জন্ম ও সাহিত্য-সাধনা, জীবন-পটভূমি সম্পর্কে সহজ স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। ‘১৪ জুন, ২০১৭। একাত্তর বছরে পা দিলাম। জন্মগ্রহণ করেছিলাম সাতচল্লিশ সালে। বড় হয়ে জেনেছি দেশভাগ হয়েছে। পাকিস্তান নামের একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। এই অর্থে আমি দেশভাগ দেখেছি। ভাষা  আন্দোলন বুঝিনি। বাহান্নর সেই সময়ে নিজের ভাষায় কথ🎀া বলেছি। কিন্তু মাতৃভাষার মর্যাদা বোঝার বয়স ছিল না। মহান মুক্তিযুদ্ধের একাত্তর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। একাত্তর আমার জীবনের একটি সংখ্যা বা শব্দ ম෴াত্র নয়। শব্দটি আমার অস্তিত্বের একটি অংশ। এ কারণে একাত্তর বয়সের সূচনার জন্মদিন আমি ভিন্নমাত্রায় দেখছি।’৪

তাঁর নিজের আত্মো𒁏পলব্ধিমূলক লেখা থেকেই বোঝা যায় তিনি একাত্তরকে-মুক্তিযুদ্ধকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে নিজের জীবনের একটি অধ্যায় করে নিয়েছেন। তাঁর সর্বাধিক মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রয়েছে।

সেলিনা হোসেনের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে চল্লিশটি উপন্যাস, সাতটি গল্পগ্রন্থ এবং চারটি প্রবন্ধগ্রন্থ।৫ তাঁর রচনা দুই বাংলার  সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বল আলোক বিচ্ছুরণে বিভাসিত। তাঁর গ্রন্থসমূহ ইংরেজি, ফরাসি, জাপানি, কোরিয়ান, ফিনিশি, আরবি, মালয়ালম, স্প্যানিশ, রুশ, মালেসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, রবীন্দ্র মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ডসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিলিট-প্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁর লেখা সম্পর্কে অধ্যাপক বিশꦐ্বজিৎ ঘোষ লিখেছেন : ‘ইতিহাসের গভীরে সন্ধানী আলো ফেলে ঔপন্যাসিক প্রতিবেদন সৃষ্টিতে তাঁর সৃষ্টি কিংবদন্তিতুল্য। বস্ত্তত ইতিহাসের আধারেই তিনি সন্ধান করেন বর্তমানকে। শিল্পিত করার নানামাত্রিক শিল্প-উপকরণ। সমকালীন জীবন ও সংগ্রামকে সাহিত্যের শব্দস্রোতে ধারণ করাই সেলিনা হোসেনের শিল্প অভিযাত্রার মৌল অন্বিষ্ট। এ ক্ষেত্রে শ্রেণি-অবস্থান এবং শ্রেণিসংগ্রাম চেতনা প্রায়শই শিল্পিতা পায় তাঁর ঔপন্যাসিক বয়ানে, তাঁর শিল্প আখ্যানে। কেবল  শ্রেণিচেতনা নয়, ঐতিহ্যস্মরণও তাঁর কথাসাহিত্যের একটি সাধারণ লক্ষণ।’৬

সেলিনা হোসেন আপাদমস্তক কথাসাহিত্যিক। উপন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন ঐতিহাসিক উপাদান। এসব ঐতিহাসিক উপাদান নিয়ে তিনি সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে সাহিত্য নির্মাণ করেছেন। ইতিহাসকে ভেঙে নতুন সাহিত্য সৃষ্টির ধারায় তিনি রেখেছেন পꦑ্রাতিস্বিক প্রতিভার স্বাক্ষর। তাঁর উপন্যাসে রাজনৈতিক সময়, আন্দোলন, নারীর শাশ্বত দৃষ্টি, সনাতন আদর্শ বজায় থাকে মেধার উজ্জ্বলতায়। তিনি স্বদেশ ও স্বজাতির ঐতিহ্যের প্রতি দৃঢ়। কোনো অবস্থাতেই তিনি নিজস্ব ঐতিহ্যকে, ন♈িজস্ব উত্তরাধিকারকে, মুক্তিকামী বাঙালির সংগ্রামকে ছোট করে দেখেননি। তাঁর রচনায় মুক্তিকামী মানুষ উত্তরাধিকার খুঁজে পেয়েছে নির্ভাবনায়, উচ্চতায়।

তাঁর রচনায় স্বাধীন ভূখণ্ড, স্বায়ত্তশাসিত-বৈষম্যহীন সমাজ ও জাতীয় আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়গুলো উন্মোচিত হয় সাবলীল সংগ্রামমুখর আকাঙক্ষায়। তিনি তাঁর নিজস্ব ভাবনায় ইতিহাসকে সমকালীন ভাবনার সঙ্গে একত্রিত করে ইতিহাসের কঙ্কালেই নির্মাণ করেছেন সমকালের জীবনালেখ্য। ইতিহাস ও শিল্পের রসায়নে তিনি  একীভূত। ‘ইতিহাসের সাথে সমকালীন মানবভাগ্য নির্ধারণ করতে যেয়ে সেলিনা হোসেন অদ্ভুত এক নিরাসক্তিতে, উভয়ের যে আনুপাতিক সম্পর্ক নির্মাণ করেন, বাংলা উপন্যাসের ধারায় তা এক স্বতন্ত্র অ♒ধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। তাঁর উপন্যাস পাঠ করলে বিস্মৃত হতে হয় কোনটা ইতিহাস আর কোনটা কল্পনা।’৭

তাঁর উপন্যাস যে শুধু ইতিহাস এবং রাজনীতিনির্ভর তা কিন্তু নয়, তাঁর উপন্যাসে জীবন ও সমাজ বাস্তবতার চমৎকার যোগসূত্র দেখতে পাই। ‘জীবন যেখানে যেমন’ সেলিনা হোসেন এই আদর্শে বিশ্বাসী। তাই তাঁর লেখনীতে শিল্পমানের চেয়ে জীবনের রূঢ় বাস্তবতা  চমৎকারভাবে 🧜প্রাণ সঞ্চার করে। ইতিহাস এবং বাস্তব জীবনের পরতে পরতে যে মায়াবী জীবন, সংগ্রাম, উষ্ণতা, প্রেম, বিরহ, রিরংসা, ক্লেদ, ধ্বংস, ক্ষয়, মৃত্যু, সৃষ্টি, স্বপ্ন– এগুলোকে তাঁর উপন্যাসে উপজীব্💃য করেছেন চরম পারঙ্গমতায়, যা সত্যি অনন্য। এই মৌলিকত্বই বাংলা সাহিত্যে তাঁকে অনন্য করেছে, অন্য এক উচ্চতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাঁর দুটি উপন্যাস– যাপিত জীবন (১৯৮১) এবং নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি (১৯৮৭)। যাপিত জীবন উপন্যাসে সমকালীন রাজনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বস্ত্তরূপের সাফল্য নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করা হলেও এ-উপন্যাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাণপ্রবাহী সুর অনুরণিত হয়েছে। এ উপন্যাস উনিশশো সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্নর একুশ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কে ধারণ করেছে। সেলিনা হোসেন সময়ের ইতিহাসকে চরিত্রের মধ্যে প্রবিষ্ট করান নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায়, সাবলীলভাবে। সেখানে ‘সময়’ই চরিত্র। সোহরাব হোসেন, মারুফ ও তার স্ত্রী সুমনা, জাফর, আঞ্জুম প্রতিটি🍨 চরিত্র পারিবারিক জীবনের দৈনন্দিনতার ভেতরে নিজস্ব মূল্যবোধ ও রুচির চর্চা করতে গিয়ে ইতিহাসকে নিজেদের জীবনে জড়িয়ে ফেলেছেন ওতপ্রোতভাবে। সেখানে রাষ্ট্রের সংগ্রামের সঙ্গে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের সম্পৃক্ততা রয়েছে। চরিত্রগুলো সমস্ত ঘটনার সাক্ষী হয়ে চলন্ত জীবনপঞ্জিতে নড়াচড়🍨া করে, সমস্ত ঘটনার কেন্দ্রিক চরিত্র হয়ে যায়। এখানেই সেলিনা হোসেনের মুন্শিয়ানা। যাপিত জীবন উপন্যাস প্রসঙ্গে প্রথমা রায় মণ্ডলের মন্তব্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য : ‘নতুন দেশে জীবন যাপন শুরু হয় নতুন অস্তিত্বে। ব্যক্তিগত ভালোবাসা ও স্বদেশপ্রেমে একাকার হয়ে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে; সঙ্গে আসে সমকালীন-আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত। উপন্যাসের সূচনায় যে ভয় ভীতির চিত্র উদ্ভাসিত হয় তা থেকে বেরিয়ে আসবার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি।’৮

নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনিতে মধ্যবর্তী শ্রেণির প্রস্ত্ততিকাল এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবে তাদের উত্থানের সাফল্য দেখানো হয়েছে। ঐতিহাসিক চরিত্র ‘সোমেন চন্দ’ বিকাশের মধ্য দিয়ে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। এ উপন্যাসে ঢাকার আন্দোলনের পটভূমিতে ভাষা-আন্দোলনে প্রগতিশীল মধ্যবিত্তের যে-ভূমিকা, তা দেখানো হয়েছে। এ-উপন্যাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে থেকে শুরু করে ১৯৫৩ সালে জেলখানায় বসে মুনীর চৌধুরীর কবর নাটক লেখা পর্যন্ত বিসত্মৃত। নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনির কেন্দ্রীয় চরিত্র মুনিম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রনেতা। আসাদ, সালাম, রাহাত, বেণু, নীলা, রেণু এঁরা উপন্যাসের মূল কাহিনির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় সহায়ক চরিত্র হিসেবে কাজ করেছে। মাত্র তিন দিনের ঘটনাপ্রবাহে আমরা দেখতে পাই একুশের চেতনা কীভাবে তিমিরবিনাশী আয়োজনে প্রগতিশীল ছাত্রদের আগামীর পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। তিন দিনের কাহিনিতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষক গোষ্ঠীর নিপীড়ন, দমননীতি, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শোষকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও দমননীতির পাশাপাশি মুক্তিকামী বাঙালির অপ্রতিরোধ্য সাহসিকতা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি বাঙালির চেতনাকামী ঐতিহ্য কীভাবে উত্তরাধিকার খুঁজে পেয়েছে, তা বিধৃত হয়েছে। এ উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ঢাকাকে কেন্দ্র করে। এখানে ꧂রাজনীতি ও ইতিহাসের পাশাপাশি ব্যক্তিগত অনুভব, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পথ এক প্রেমময় আবহের মধ্যে পূর্ণতা পেয়েছে। এখানেই সেলিনা হোসেনের সার্থকতা।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তাঁর চারটি উপন্যাস– হাঙর নদী গ্রেনেড, গায়ত্রী সন্ধ্যা, ত্রয়ী ও কাকতাড়ুয়া। চারটি উপন্যাসের মধ্যে কাকতাড়ুয়া কিশোর উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের জাগরণটাকেই তিনি ধরতে চেয়েছেন, দেখিয়েছেন। হাঙর নদী গ্রেনেড তাঁর প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এ উপন্যাস লিখতে তিনি সমকালিক স্থানে বারবার সশরীর গিয়েছেন। তথ্য-উপাত্ত গ্রহণ করেছেন। উপন্যাসটি নিয়ে বাংলাদেশে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সফল চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। উপন্যাসটি হলদী গাঁয়ের মানুষের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ততা, সলীমের যুদ্ধে যাওয়া, কলিমের আহত হওয়া, বোবা রইসের অদম্য প্রতিরোধের তীব্রতায় আবর্তিত হয়। এ উপন্যাসে প্রধান শক্তি বুড়ির মাতৃত্ব। দেশপ্রেমের কাছে পরাজিত হয় সে-মাতৃত্ব। মাতৃত্বকে অতিক্রম করে বোবা সন্তান রইসেﷺর হাতে যুদ্ধে ব্যবহৃত এলএমজি তুলে দিয়েছে। মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচানোর জন্য নিজের সন্তানকে নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে ঠেলে দিয়েছে। হলদী গাঁয়ে বুড়ির পরিবারসহ সাধারণ অধিবাসীর যে-স্বাধীন দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য ত্যাগ, তা অতি নিখুঁত চিত্রে তিনি তুলে এনেছেন। এখানে বুড়ি শুধু তাঁর সন্তানের মা নন, বরং সকল বীর মুক্তিযোদ্ধার মা, শহীদ জননী।

গায়ত্রী সন্ধ্যা উপন্যাসের কাহিনি সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে শুরু হয়ে পঁচাত্তরের স্বাধীন বাংলাদেশের সিভিল শাসকের পতন পর্যন্ত বিস্তৃতি পেয়েছে। তেইশ বছরের পাকিস্তানি শাসকের নিগড় থেকে মুক্তির প্রক্রিয়া, তার কার্যকরণ সূত্র, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম, তার রাজনৈতিক নেতা, নেতৃত্বের ইতিহাসবিদ্ধ হওয়া উপন্যাসের অন্তপ্রবাহের চরিত্র উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে। স্বাধীন দেশের দুরূহ পুনর্গঠন, দুর্ভিক্ষ, অব্যবস্থাপ𒅌নার সুযোগে অপশক্তির হাতে দেশনায়ক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু; সব মিলিয়ে সিভিল শাসনের অপমৃত্যুর মধ্য দিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটেছে। কাকতাড়ুয়া উপন্যাসে বুধা নামে এক অনাথ কিশোরকে কেন্দ্র করে এক যথার্থ কাহিনি গড়ে উঠেছে, যা পুরো বাংলাদেশের চিত্র। যেখানে যুবক, বৃদ্ধ, কিশোর কেউ এই মহতি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে বাদ যায়নি। তাঁর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলোতে দেখিয়েছেন যেমনভাবে একজন পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা তাঁর সর্বস্ব দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, তেমনি একজন নারী মুক্তিযোদ্ধাও তাঁর সর্বস্ব দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধ করেছে একজন কিশোরও।

সেলিনা হোসেনের যমুনা নদীর মুশায়রা কবি মির্জা গালিবকে নিয়ে লেখা ভিন্নধর্মী এক বৃহৎ পরিসরের উপন্যাস। ৩৯৯ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটিতে তিনি কবি মির্জা গালিবকে নানান বৈচ💫িত্র্যে উপস্থাপন করেছেন। মির্জা গালিব উপমহাদেশের একজন শক্তিশালী কবি। তাঁর জীবন নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর। ইতিহাসের ক্রান্তিকালে এই কবিকে নিয়ে রচিত যমুনা নদীর মুশায়রা পাঠকের এক অন্য ধরনের তৃষ্ণা মিটিয়েছে। বলা যায়, এই উপন্যাস পড়তে পড়তেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেলিনা হোসেনকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখব। সে জন্যই তাঁর লেখাগুলো আমি 🌌নিরন্তর পড়ে চলেছি। আশা করছি খুব শিগগির আমি এ-কাজটিতে হাতে দিতে পারব।

যমুনা নদীর মুশায়রা উপন্যাসে সেলিনা হোসেন ইতিহাসের সঙ্গে সাহিত্যের যথার্থ মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। সাহিত্যের সেই শিল্পকে, যে-শিল্পকাহিনির ভেতর মানুষের আবেগের জায়গার শক্ত বাঁধুনি, তা অত্যন্ত পারঙ্গমতার সঙ্গে এঁকেছেন। মির্জা গালিবকে নিয়ে নানা ধরনের পুস্তক রচিত হয়েছে। তাঁকে নিয়ে পৃথিবীর নানা সৃজনশীল মানুষ রচনা করেছেন তাঁদের কাব্য, কথাশিল্প। কারণ তাঁর জীবনদর্শনꦛের নানা দিক আকৃষ্ট করেছে নানাজনকে নানাভাবে।

আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেছেন, ‘গালিব উর্দু ভাষার দুরূহতম কবি।’ তিনি গালিবের উদ্ধৃতি দিয়েছেন ধর্ম সম্পর্কে। গালিব বলেছেন,ꦉ ‘আমি একেশ্বরবাদী, সর্বপ্রকার আচার অনুষ্ঠান বর্জন করাই আমার নীতি। ধর্ম সম্প্রদায়গুলো লুপ্ত হলে সত্য ধর্মের উপাদান হয়ে যাবে।’৯ গালিবের অনুপুঙ্খ নানা বিবরণে একজন অসাধারণ শক্তিশালী কবির মানসদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে এ-উপন্যাসে। বিষয়বৈচিত্র্যের জন্য পাঠকের আকাঙক্ষা নানা মাত্রিকতায় পূর্ণতা পেয়েছে। এ-উপন্যাসের শেষে তিনি যেসব গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন, সেসব গ্রন্থের কয়েকটিতে গালিবের কবিতার সরাসরি অনুবাদ আছে। এ সম্পর্কে সেলিনা হোসেন লিখেছেন, ‘উপন্যাসের শেষে যেসব গ্রন্থের উল্লেখ করেছি সেসব গ্রন্থের কয়েকটিতে গালিবের কবিতার অনুবাদ আছে। সেখান থেকে আমি কবিতাগুলো সংগ্রহ করে এই উপন্যাসে ব্যবহার করেছি। আবু সয়ীদ আইয়ুবসহ সকল অনুবাদকের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’১০ এ-উপন্যাসে সেলিনা হোসেন অধ্যায়ভিত্তিক উপশিরোনামের মাধ্যমে উপন্যাসটিকে পাঠকের সামনে আরও সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করেছেন।

শৈশবের নদী, শহরের বর্ষা-বসন্ত, কুঠুরি ও বারান্দা, পথের যাত্রায় দিনের সূচনা, ঘোড়ার খুরের শব্দ, মৃত্যুর মুশায়রা, তবু অসীম আকাশ, দিনের শে🐟ষ ছায়া, শেষ হয়ে যায় বসন্তের দিন– এই নয়টি উপশিরোনামের মাধ্যমে তিনি উপন্যাসের বিভিন্ন সময় এবং ঘটনা উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসটি ১৭৯৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১৮৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিসত্মৃতি পেয়েছে। শুরুটা খুব চমৎকার। রজব হুসেন জং। তাঁর একধরনের গর্ববোধ আছে, যেটি জাহির করেন তাঁর চার স্ত্রীর ওপর, যিনি দিনের শুরুতে সেদিনের তারিখটা মাথায় রাখেন। লিখে রাখেন। দিনের প্রথম সূর্যরশ্মিতে যমুনা নদীর পাড় ধরে হেঁটে যেতে ভালোবাসেন। তাজমহলের ছায়াবুকে আগ্রাবাসীর ভালোবাসায় যার দিনের শুরু। দিনের শুরু, সারাটা দিন, মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ, সূর্যাস্ত এবং শেষ পর্যন্ত জীবনের শেষ পর্যন্ত  সেলিনা হোসেন কি গভীর মমতায়, ভালোবাসায়, হিসাবে, রাজনৈতিক দর্শন, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ, ক্লেদ, সামাজিকতা, পারিবারিক জীবন, দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-দারিদ্র্য, প্রাচুর্য, বেহিসেবি জীবনকে তিনি চিত্রের পর চিত্র, রঙের ওপর রঙের পরত দিয়ে যেন পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা ছবꦿি এঁকেছেন। উপন্যাসটি পড়া শুরু করলে ক্রমান্বিক পড়ে যেতে হয়। একটিবারও দম ফেলার ফুরসত থাকে না পাঠকের। কি অপূর্ব রচনাশৈলী!

কবির জীবনের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ  লিখেছেন। কবির শেষ শয়ানে স্নিগ্ধ জানাজায় যোগ দিতে এসেছেন শোকার্ত মানুষ। কিন্তু তাদের হৃদয়ে স্নিগ্ধতার স্পর্শ নেই। ‘তখন শিয়া সম্প্রদায়ের একজন বললেন, মির্জা সাহেব শিয়া ছিলেন। তাই শিয়া প্রথা অনুসারে তাঁর দাফন করতে চাই। নওয়াব জিয়াউদ্দিন খান দৃঢ় ক🎀ণ্ঠে বললেন, আমার চেয়ে বেশি আর তাঁকে কে চেনে? আমার কিশোর বয়স থেকে আমি তাঁকে চিনি। তিনি সুন্নী মুসলমান ছিলেন। তাঁর শেষ কাজ সুন্নী মতে হবে।’১১ এ থেকেই বোঝা যায় মির্জা গালিবের জীবন বৈচিত্র্যময় ছিল এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি মানুষের ভালোবাষায় রঞ্জিত হয়েছেন। তাঁর শেষ ‘শের’-এ তিন𒅌ি লিখেছেন—

বন্ধু, তোমাদের পুষ্পোদ্যানে আমি

এক আগাছা

যদি চলে যাই

দুঃখ পেয়ো না।

সাইপ্রাস ও সুগন্ধী ফুল

তোমরা, আমি নই।

যদি ভালোবাসা নাও থাকে

তবু বাহবা দিও উচ্চকণ্ঠে,

যে কবিতা তোমাদের দিলাম

তার শেষ পারিশ্রমিক

দিতে ভুলো না।

জানি ভুলে যাবে

বন্ধুজন আনন্দ সমাবেশে

হয়ত পড়বে মনে কোনওদিন

কোনও কবিতার মজলিসে।

বাংলা কথাসাহিত্যে সেলিনা হোসেন প্রকৃতভাবে একটি নিজস্ব কণ্ঠস্বর তৈরি করেছেন নিজ পারঙ্গমতায়। সাহিত্যিক হিসেবে তিনি কখনো নিজের সামাজিক দায়বদ্ধতাকে ভুলে যাননি, উপেক্ষা করেননি। তাই আমরা তাঁর রচনায় সামাজিক অঙ্গীকার, পরিবর্তনের দায়ꦇবদ্ধতা, প্রগতিশীল মানসিকতা এবং শিল্পের সহনশীলতা, নারীর ব্যক্তিক এবং একই সঙ্গে ব্যক্তিত্বের গভীর স্বাধীনতা উপভোগ করি নান্দনিকতায়। তাঁর শৈল্পিক চেতনায় সব সময় ইতিহাসের দায়বদ্ধতা জড়িয়ে থাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ। ইতিহাসের সঙ্গে সময়কে উপভোগ্য করে সাহিত্যিক পথচলাকে নির্মাণ করেছেন ঐতিহাসিক মানদণ্ড। তাই সেলিনা হোসেন সর্বক্ষণ আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে পরিণত হয়েছেন। তাঁর সর্বাঙ্গীন পথচলা হোক মধুর।

 

তথ্যসূত্র

১. ‘সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ’, অনন্ত পৃথ্বীরাজ, আল মুজাহিদী-সম্পাদিত নতুন মাত্রা, নভেম্বর-ডিসেম্ব♒র ২০১৭, পৃ ১৯।

২. ‘বহুমাত্রিক কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন’, কামরুল ইসলাম, বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ কর্তৃক প্🦩রকাশিত সেলিনা হো𓂃সেনের ৭০তম জন্মবার্ষিকী পত্রিকা, প্রকাশকাল ১৪ জুন, ২০১৭।

৩. যমুনা নদীর মুশায়রা, সেলিনা হোসেন।

৪. ‘ফিরে দেখা আপন ভুবন’, সেলিনা হোসেন, প্রাগুক্ত।

৫. সেলিনা হোসেনের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথোপকথন।

৬. ‘সেলিনা মঙ্গল’, বিশ্বজিৎ ঘোষ, ওই।

৭. বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাস, (১৯৪৭-২✱০০০), শহীদ ইকবাল, ঢাকা ২০১৪, আহমদ পাবলিশি♋ং, পৃ ১৫৫।

৮. ‘সেলিনা হোসেন ও বাংলা সাহিত্য’, প্রথ൩মা রায় মণ্ডল, সঞ্জীব কুমার বসু-সম্পাদিত সাহ🌃িত্য ও সংস্কৃতি, বৈশাখ, আষাঢ় ও শ্রাবণ, আশ্বিন সংখ্যা, কলকাতা ১৪০৫, পৃ. ২৮২।

৯. গালিবের গজল থেকে, আবু সয়ীদ আইয়ুব, দে’জ পাবল�🍸�িশিং, কলকাতা ৭০০০৭৩, প্রথম প্রকাশ ১ জানুয়ারি, ১৯৭৬।

১০. যমুনা নদীর মুশায়রা, সেলিনা হোসেন, পꦍ্রাগুক্ত, পৃ ৩৯৮-৩৯৯।

১১. ওই, পৃ ৩৯৮।

Link copied!