অসাধারণ প্রতিভাধর সাম্যবাদী কথা সাহিত্যিক সোমেন চন্দ। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে গাজীপুর জেলার আশুলিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। পৈত্রিক নিবাস নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার বালিয়া গ্রামে। তার মূল নাম সৌমেন্দ্র কুমার চন্দ। বাবার নাম নরেন্দ্র কুমার চন্দ। মায়ের নাম হিরণ বালা। তিন বছর বয়সে মাকে হারান। বাবা ছিলেন একজন ভাবুক প্রকৃতির মানুষ। সংসারের প্রতি ছিলেন উদাসীন।
নরেন্দ্র কুমার যৌবনে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি ঢাকা মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিম্ন বেতনের একজন কর্মচারী ছিলেন। দরিদ্র পিতার সংসারে সোমেন চন্দ বেড়ে ওঠেন। সোমেন চন্দের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকা শহꦍরে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি পোগেজ স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ঐ স্কুল থেকেই ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে মেট্💦রিক পাশ করেন। এরপর ঢাকা মিডফোর্ড মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। আর্থিক অনটন ও অসুস্থতার কারণে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দেন। এখানেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে সোমেনের বয়স ১৭ বছর। ঠাটারী বাজারের বাসা ছেড়ে দক্ষিণ মৈশুন্ডিতে লাল মোহন সাহা স্ট্রিটের ভাড়া বাড়িতে আসার পর সৌমেনের জীবনে আসে নতুন মাত্রাꦕ। ১৯৩৮ সালে ঢাকায় আন্দামান ফেরত বিপ্লবী সতীশ পাক💞ড়াশীর সাথে পরিচয় সোমেনের ভেতর বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটে। সোমেন চন্দ আত্যন্তিক ভাবে জড়িয়ে পড়েন সাহিত্য সংস্কৃতির আন্দোলনে। প্রগতি পাঠাগারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে সাহিত্য পাঠে গভীর মনযোগী হয়ে ওঠেন।
১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে তরুণ সাহিত্যিক বয়সে সকলের চেয়ে ছোট হওয়া স্বত্বেও সোমেন চন্দকে ‘প্রগতি পাঠাগার’ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়। রণেশ দাশগুপ্তই ছিলেন ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘের শাখা গঠনের মূল স্থপতি। ১৯৩৯ সালে রণেশ দাশগুপ্ত, সোমেন চন্দ, কিরণ শংকর সেনগুপ্ত, অমৃত কুমার দত্ত, জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত, সতীশ পাকড়াশীকে নিয়ে ঢাকা জেলা প্রগ🐎তি লেখক সংঘের সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৪০ সালের মাঝামাঝি সময়ে গেন্ডারিয়া হাইস্কুল মাঠে এক সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’ উদ্বোধন করা হয়। সম্মেলনে সভাপতি ছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ কাজী আবদুল ওদুদ। সম্মেলনে রণেশ দাশগুপ্তকে সংগঠনের সম্পাদক এবং সোমেন চন্দকে সহসম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অ্যাসেম্বলি হলে অনুষ্ঠিত হয় প্রগতি লেখক সংঘের বার্ষিক প্🌺রীতি সম্মেলন। ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে সদরঘাটের ব্যাপ্টিস্ট মিশন হলে প্রগতি লেখক সংঘের ঢাকা জেলা শাখার দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে চিন্তাবিদ কাজী আব্দুল ওদুদের সভাপতিত্বে সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন সম্পাদক রণেশ দাশগুপ্ꦍত। এই সম্মেলনে সোমেন চন্দকে সম্পাদক এবং অচ্যুত গোস্বামীকে সহসম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। আমৃত্যু সোমেন চন্দ প্রগতি লেখক সংঘের ঢাকা জেলা কমিটির সম্পাদক ছিলেন।
১৯৪০ সালের শেষ দিকে ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক সংঘের প্রকাশনা ‘ক্রান্তি’ রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সোমেন চন্দ। ‘ক্রান্তি’ একবারই মাত্র বেরিয়েছে। ১৯৪০ সনে ফেব্রুয়ারি মাসে সদরঘাটের নিকটবর্তী ব্যাপ্টিস্ট মিশন হলে সপ্তাহব্যাপী চিত্র প্রদর্শনীর সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সবচেয়ে পরিশ্রমী সংগঠক সোমেন চন্দই মুখ্য ভূমিকা পালন করে💛ন।
সোমেন চন্দের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় অল্পদিনের মধ্যেই ‘ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’ এবং ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’ যৌথভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী জনমত গড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী সোমেন চন্দকে হত্যার জন্য ফ্যাসিস্ট শক্তি টার্গেট করে। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ঢাকার সূত্রাপুরে সেবাশ্রম মাঠে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সমাবেশে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় আততায়ীরা প্রকাশ্যে রাজপথে রড ও ভোজালির আঘাতে লক্ষ্মীবাজারের কাছে সোমেন চন্দকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। এসময় সোমেন চন্দ ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক সংঘ এবং ইস্টবেঙ্গল রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক ছিলেন।
সোমেন চন্দের নির্মম হত্যাকাণ্ড এই উপমহাদেশের প্রগতিশীল শিল্পী-সা✤হিত্যিক তথা সংস্কৃতিকর্মীদের আলোড়িত ও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। হত্যাকারীদের ধিক্কার জানিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদ সভা।
একুশ বাইশ বছরের দুই তরুণ মার্ক্সবাদী সাহিত্যিক, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেওয়া মাত্র চলে গেলেন। বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য মারা গেলেন যক্ষ্মারোগে। আর সোমেনকে মিছিলের সামনে থেকে টেনে বের করে ধরে নিয়ে হত্যা করে কয়েকজন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মী। ১৯৪২ সনের ৮ মার্চ ২১ বছর ৯ মাস বয়সে দক্ষ সংগঠক, অসাধারণ প্রতিভাবান কথা সাহিত্যিক সোমেন চন্দকে নির্মম ভাবে হত্যার পরে সুকান্ত ভট্টাচার্য, সোমেন চন্দ স্মরণে লিখলেন তার বিখ্যাত ‘ছুরি’ কবিতা—
বিদেশী চর ছুরিকা তোলে দেশের হৃদবৃন্তে
সংস্কৃতির শত্রুদের পেরেছি তাই চিনতে।
শিল্পীদের রক্ত স্রোতে এসেছে চৈতন্য
গুপ্তঘাতী শত্রুদের করি না আজ গণ্য