জাহাজ থেকে নামার সময় ক্যাপ্টেন বলেছিল, তিন দিন পর নোঙর উঠবে, তার আগ অবধি ছুটি। তোমার ইচ্ছেমতো সময় কাটাও।
এই শহরটায় আগে কখনো আসিনি। মালবাহী জাহাজে চেপে পৃথিবীর কোথায় না যাইনি! এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা সব একাধিকবার করে গেছি। সমুদ্র আছে, বন্দর আছে আর সেখানে আমার পা পড়েনি, এটা অসম্ভব। কিন্তু এখানে প্রথমবার! খুব ছোট শহর। জনসংখ্যা হাজার পঞ্চাশের মতো। জাহাজ থেকে দেখছিলাম শহরটা পাহাড় দিয়ে ঘেরা।
জাহাজঘাটায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে বন্দর এলাকা ছাড়িয়ে লোকালয়ে ঢুকলাম। রাস্তাঘাট ফাঁকা। কখনোসখনো দু-একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে। বেশির ভাগই মালবাহী লরি। গাড়ি চলার শব্দ ছাড়া আর বিশেষ কোনো শব্দ নেই। মাথার ওপর নীল আকাশ দূষণহীনতার জানান দেয়।
একটা সরাইখানা দেখে তাতে ঢুকে পড়লাম। বেশির ভাগ লরিচালক আর জাহাজিরা এখানকার খদ্দের। জাহাজে করে বন্দরে যে মালপত্র আসে, তা লরি বা ট্রলারে করে নানা প্রান্তে ছড়িয়ে যায়। সেসব ড্রাইভার গাড়ি লোড করতে দিয়ে আশপাশের বিভিন্ন সরাইখানায় আসে সময় কাটাতে, বিশ্রাম করতে আর খানাপিনা মৌজ মস্তি করতে।
সরাইখানার বসার জায়গাগুলো আমাদের দেশের রোডসাইড ধাবাগুলোর মতো। ছোট ছোট তক্তাপোষে আধশোয়া হয়ে সব শুয়ে বসে আছে। খানিক বসার পর বুঝলাম কেউ অর্ডার নেবে না,নিজেকে গিয়ে বলতে হবে। কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,এখন কি খাবার পাওয়া যাবে। কাউন্টারের লোকটা আমার দিকে না তাকিয়ে মেনু লেখা বোর্ডটা দেখিয়ে দিল। আমি খাবার অর্ডার করে এসে বসলাম।
আমার পাশের তক্তাপোষে একটি লোক একমনে বসে খাচ্ছিল। আমি জাহাজি লোক। মাসের পর মাস জলে থাকি। একই লোকের মুখ আর জল দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তাই জাহাজ বন্দরে ভিড়লেই নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে মুখিয়ে থাকি। গায়ে পড়ে আলাপ করে বকবক করে যাই।
লোকটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। লোকটা ঠোঁটটা একবার নাড়িয়ে আবার খেতে মন দিল। ওর ঠোঁট নাড়ানোটা হাসা কি না, বুঝতে পারলাম না। আমি হাল না ছেড়ে বললাম,আপনি কি এই শহরের বাসিন্দা?
লোকটা একবার হু বলে আবার খেতে লাগল। বারবার চেষ্টা করেও আলাপ জমাতে পারলাম না। কারণ, ও হু-হাঁ করেই সব কথা চালাতে লাগল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি ড্রাইভার?
সে ঘাড় নাড়িয়ে না বলল।
জানতে চাইলাম,তাহলে? কী করেন?
এবার লোকটা খাওয়া থামিয়ে একটু বিরক্ত হয়ে বলল,সাপ্লায়ার।
আমার মনে হলো আর কথা না বাড়ানোই ভালো। কে জানে কিসের সাপ্লায়ার ও!
সারা দিন ঘুরে বুঝতে পারলাম শহরটি মোটেই মিশুকে নয়। সবাই নিজের নিজের কাজে মগ্ন। আড্ডা-গল্প এসব এখানে অচল!
সন্ধেবেলায় আমার এক জাহাজি বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। আগে আমরা একই জাহাজে ছিলাম। কয়েক মাস আগে ও অন্য একটা জাহাজে যোগ দেয়। আমরা দুজনে একসঙ্গে অনেক ভালো সময় কাটিয়েছি। অনেক রঙিন রাতে আমরা মদ নারী ভাগ করে খেয়েছি। আবার পরস্পরের সমস্যাও ভাগ করে নিয়েছি। এই শহরে ও আগেও এসেছে। ওর শরণে এলে কিছু লাভ হতে পারে—এই আশায় ওকে মদ খাবার আমন্ত্রণ করলাম। ও সানন্দে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করল।
আমরা দুজনে গিয়ে বসলাম বন্দরের এক ভাটিখানায়। কর্মসূত্রে আমি বহু দেশ দেখেছি। এবং সেখানকার সব বন্দরের চরিত্রগুলো কমবেশি একরকম। বিশেষত ভাটিখানার। প্রচুর মারকুটে, ঝগড়াটে লোকদের আনাগোনা হয়। ঘরগুলো ধোঁয়ায় আবছা থাকে। কড়া তামাক আর মদের গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে হই-হট্টগোল, উচ্চস্বরে আড্ডা—এটাই যেকোনো জাহাজি ঠেকের চরিত্র। পৃথিবীর সব দেশেই তাই। কিন্তু এখানে ঢুকে আজব বনে গেলাম! অন্য দৃশ্যগুলো কমবেশি একরকম হলেও কোলাহল, আওয়াজ প্রায় নেই! সবাই নিজের মতো বসে খাওয়াদাওয়া করছে। ঘরগুলো ধোঁয়ায় ধোঁয়াশা। তামাক আর মদের মিশ্র গন্ধ ধোঁয়ায় মিশে আছে। কিন্তু কোনো আওয়াজ নেই,ঝগড়া নেই,কথা-কাটাকাটি বা হাসির কোনো শব্দ নেই! কখনোসখনো গ্লাসের টুংটাং শব্দ মাত্র।
এ কেমন দেশ! এখানকার মানুষজন কি কথা বলতে শেখেনি! কিছুই কি বক্তব্য নেই এদের? রাগ-হাসি-কান্না কোনো রিঅ্যাকশন নেই! কারোর সম্বন্ধে কারোর কোনো অভিযোগ নেই! প্রেম নেই! শোক নেই!
আমি ও আমার বন্ধু মদ খেতে শুরু করলাম। সঙ্গে সুগন্ধি তামাক। খেতে খেতে আমরা নিজেদের মধ্যে উচ্চস্বরে কথা বলছিলাম এবং সেটা আশপাশের লোক শুনতে পেলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছিল না! আমাদের কথোপকথনে তারা বিরক্তিও প্রকাশ করছে না! আমি আমার বন্ধুকে সেটা বলতে ও বলল, আমাদের কথায় ওরা যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছে,কিন্তু তা প্রকাশ করবে না বা তা নিয়ে ওরা ভাবিতও হচ্ছে না। ওরা এ রকম। এদের মস্তিষ্ক বরফের মতো শীতল। শীতলতা এদের মস্তিষ্ককে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। তা-ও এখানে যাদের দেখছ, তাদের প্রায় বেশির ভাগই ভিনদেশি ড্রাইভার বা জাহাজি।
দূরের একটা টেবিল দেখিয়ে বন্ধু বলল,ওখানে দেখো,যারা বসে আছে তারা এখানকার পুরোনো বাসিন্দা।
আমি ওদের দিকে চেয়ে দেখলাম। তারা সবাই ন্যাড়ামুণ্ডু এবং মাথাগুলো অস্বাভাবিক রকমের ছোট! মাথা নোয়ালে দূর থেকে মুণ্ডুহীন মনে হচ্ছে! এঁরা কারা? এঁরা কি সব অন্য গ্রহের বাসিন্দা?
আমাদের নেশা জমে উঠছে ক্রমশ। জাহাজিসুলভ মানসিকতায় রঙিন হয়ে উঠছি আমি। কত দিন ঘরছাড়া। বউ-বাচ্চা থেকে দূরে। বন্ধুকে বললাম,এখানে বেশ্যালয় নেই?
সে হেসে বলল, এখানে সব আছে,শুধু শব্দ নেই। তুমি যাবে?
বললাম, আমার শুধু একটা শরীর দরকার,শব্দে কিবা কাজ।
বন্ধু আবার হেসে বলল,ভেবে দেখো।
বললাম,ভাবার কিছু নেই।
আমরা দুজনে ভাটিখানার পেছন দিকে চলে গেলাম। একটা লম্বা করিডর চলে গেছে কাঠের বাড়িটার। দুদিকে সব ভেজানো দরজা। বন্ধু বলল,এগুলোর যেকোনো একটায় ঢুকে পড়ো। যেগুলো পর্দা ফেলা,সেগুলোতে কাস্টমার আছে ঢুকো না। যেগুলোর পর্দা গুটিয়ে রাখা, সেগুলোতে ঢুকতে পারো।
আমি বললাম,কিন্তু কার ঘরে ঢুকছি,কেমন দেখতে,বয়স কত,রেট কত এসব?
বন্ধু বলল, পছন্দের সুযোগ নেই। আর যার ঘরেই ঢোকো না কেন ফারাক কি হবে! দেখতে আর বয়স এখানে সবার উনিশ-বিশ। রেটও সবার এক। যাও ঢুকে পড়ো,হয়ে গেলে আবার ভাটিখানায় যেখানে খাচ্ছিলাম সেখানে চলে এসো,অপেক্ষা করব।
একটা আধো অন্ধকার ঘরে ঢুকে পড়লাম আমি। ঘরে কম পাওয়ারের নীলচে আলো জ্বলছে। একটা লোহার খাট। পাশে লোহার টেবিল। তাতে জলের গ্লাস আর অ্যাশট্রে। আলনায় দু-একটা মেয়েলি পোশাক। একটা বড় লোহার আলমারি। মামুলি ঘর। আমি সারা পৃথিবীর অসংখ্য বেশ্যালয়ে গেছি। সেসবের সঙ্গে এর কোনো তফাত নেই।
খাটে একজন শুয়ে। খোলা কাঁধ চোখে পড়ল। চাদরের ভেতর থেকে একটা নগ্ন হাত বেরিয়ে এসে আমাকে কাছে আসার ইশারা করল! আমি পোশাক ছেড়ে বিছানায় উঠে পড়লাম।
কম আলো আর নেশাতুর চোখে আমার সবকিছু ঝাপসা লাগছে। কিন্তু শরীর ফুটছে কামের প্রাবল্যে। আমি মেয়েটার পায়ের দিক থেকে চাদরের ভেতর ঢুকে পড়লাম। নরম নিটোল পা-দুখানি খেতে খেতে ওপরের দিকে চললাম। ভারি ছটফটানো নিশ্বাসের ঘনঘন শব্দে আমার কাম প্রবল হয়ে উঠল। যোনিতে মুখ দিতেই মেয়েটার সারা শরীর কাটা পাঁঠার মতো ছটফটিয়ে উঠল। এসব আমার পরিচিত মুহূর্ত। পৃথিবীর সব মেয়ের মতোই এর আচরণ। এ দেশে জাহাজ থেকে নামার পর এই প্রথম যেন একটা চেনা কিছু পেলাম।
ওর দিঘল নাভিতে চুমু খেয়ে আমি ওর করোলায় এসে নোঙর করলাম। আমার শরীর ওর শরীরে প্রবেশ করে গেছে সানন্দে। মেয়েটাও তালে তাল মিলিয়ে পাছা দোলাচ্ছে। সঙ্গমে এ মেয়ে খুবই পটু বোঝা যাচ্ছে। খাটটা লোহার না হলে ভেঙেই যেত বোধ হয়। শুধু কোনো শীৎকার নেই। সে তো জেনেই ঢুকেছি,কী করা যাবে!
আমি সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত হয়ে শেষ পাতে পান খাবার মতো ওর গালে চুমু খতে মাথা তুললাম। কিন্তু কোথায় গাল! সেটা তো খুঁজে পাচ্ছি না! নেশাটা বোধ হয় মাথায় চেপে গেছে। আমি একটানে মেয়েটার শরীর থেকে চাদরটা সরিয়ে নিলাম। এক নগ্ন নিরাবরণ শরীর বেরিয়ে এলো চাদরের ভেতর থেকে, যা আমি এতক্ষণ রমণ করলাম। কিন্তু মুহূর্তে আমার নেশা কেটে গেল। মেয়েটার ঘাড়ের ওপর থেকে আর কিছু নেই! কিন্তু,ও তো মৃত নয়! আমি আতঙ্কগ্রস্তের মতো লাফ মেরে বিছানা থেকে ছিটকে নেমে কোনোমতে পোশাক গায়ে চড়িয়ে দৌড় মারলাম।
ভাটিখানায় আমার সেই বন্ধু বসে বসে ম♐দ খাচ্ছে। আমি তার কাছে গিয়ে উত্তেজিতভাবে সবটা বললাম। ও বলল,শান্ত হও, এই শহরের বেশ্যারা মাথাহীন।