সঙ্গদোষে লোহা ভাসে, অর্থাৎ যাদের সাথে মেলামেশা করবে, ওদের ভালো খারাপ সব কিছুই তোমার মধ্যেও প্রতিফলিত হবে। আশি সালে যখন কেবল ব্যান্ড করা শুরু করলাম, তখন আমরা হার্ড রক করতাম এবং শুধুই ইংরেজি গান করতাম। রক ছাড়া পপ গানের কথা বলাতো দূরে থাক, স্বপ্নেও দেখতে অ্যালাউড ছিলাম না। কেউ ম্যাডোনা শুনেছে জানতে পারলে বন্ধুরা তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হতো। বন্ধুদের মনোভাবে এমন একটা ব্যাপার ছিলো যে বাংলা গান করা বা শোনা 🍨মহাপাপ এবং হিন্দি শুনলেতো জাতই থাকবে না। আস্তে আস্তে আমার মধ্যেও ঐ প্রভাব চইলা আসলো, ভাবতে শুরু করলাম পৃথিবীতে একমাত্র হার্ড রকই হলো শুদ্ধ এবং উচ্চ মার্গীও সংগীত। আর বাকী সব নিম্ন পর্যায়ের সংগীত।
ওদের সাথে মেশার আগে আমি কারপেন্টার, অ্যাবা, অ্যাল স্টুয়ার্ট, সায়মন এন্ড গারফাংকেল, ফ্র্যাঙ্ক সিনাট্রা, বনিএম, বিটলস, এলভিস প্রিসলি, এলটোন জন, বিজিস ইত্যাদি শুনতাম। ওদের সাথে মেশার সময় ওইগুলি শোনাও বন্ধ করে দিলাম সংগীত ধর্ম নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে। ওই সময়টায় বাংলাদেশের বেশীরভাগ ব্যান্ড ইংরেজ💙ি গান গাইত। বিষয়টা এমনভাবে তখন উপস্থাপিত এবং চর্চা হতো যে ব্যান্ড মানেই ইংরেজি গানের সমারোহ। যেসব ব্যানꦆ্ড ইংরেজি গান ভালো গাইতে পারতো না, তাদের প্রতি ইংরেজি ভালো গাওয়া ব্যান্ডদের এক ধরনের তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি ছিল। নিজেদের যে বাংলা গান থাকতে পারে, এরকম চিন্তা তখনও কোনো ব্যান্ডের মাথায় আসেনি। শুধু গান নয়, এই ইংরেজি ব্যান্ডগুলির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কথা বার্তাও ইংরেজিতে বলতো।
এরপর ১৯৮০ সালের শুরুতে গানের অ্যালবাম ক্যাসেট আকারে প্রথম প্রকাশ পেলো। বাংলাদেশের প্রথম ক্যাসেট অ্যালবামের গায়ক ছিল সোয়েব, দ্বিতীয় অ্যালবামটা ওই ১৯৮০ সালেই কম্পোজ ও প্রোডিউস করেছিলাম আমি এবং গান গেয়েছিলো জুলফিকার এবং বন্যা। ১৯৮২ সালে সোলস ব্যান্ড হিসেবে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম প্রকাশ করে। অ্যালবামের নাম ছিল সুপার সোলস এবং ওটা ছিল ওদের প্রথম অ্যালবাম। এই অ্যালবামের প্রতিটা গানই বাংলা ছিল। পরবর্তীকালে মাইলস ক্যাসেট প্রকাশ করলো এবং সবকটা গান ইংরেজিতে গাইল। ওদের ইংরেজিতে ক্যাসেট বের করতে দেখে আমি যে ব্যান্ডে ছিলাম তাদের ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখা আরও বেড়ে গেলো। আমাদের ঐ ইংরেজি ব্যান্ড নিয়ে যতগুলি শো করেছি সেই সময়, সবই মোটামুটি ফ্লপ, কারণ আমরা সব জায়গায় হার্ড রক গাইতাম। হাজারিবাগের ঢাকাইয়া বিয়ে কিংবা আজিমপুর কলোনির মাঠে🥀, যেখানে পাড়ার ছেলেদের সাথে আশেপাশের ৩২ মহল্লার আপামর সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণের ভিড়, সেইখানে স্মোক অন দ্য ওয়াটার গাওয়ার কারণে মানুষ ক্ষেপে গিয়ে যে আমাদের গায়ে গরম ওয়াটার ঢেলে দেয়নি সেটা ছিল আমাদের ভাগ্য। প্রতিটা ফ্লপ শো শেষে অডিয়েন্সদের মনে মনে আমরা তাবৎ গালাগালি করতাম আর ভাবতাম ‘শালারা খ্যাত, রক শোনে না, যতসব বনিয়েমের দল’। নিজেদের দোষটা চোখেই দেখতে পেতাম না এবং বুঝতেও পারতাম না যে কোথায় কী গাইতে হবে।
তখন এক ধরনের মাথাখালি মিনিংলেস ভুয়া ইগো নিয়ে๊ বুক ফুলিয়ে ঘুরতাম আর ভাবতাম ‘বাংলাদেশে সব চাইতে স্ট্যান্ডার্ড মিউজিক করি আমরা’। হায়রে বোকা মন আমাদের। মিউজিকে আবার সবচাইতে বেশী আর সবচাইতে কম কাকে বলে? কোনটা স্ট্যান্ডার্ড? কে বানিয়েছে ঐ স্ট্যান্ডার্ড? বাক না মোজার্ট না ওস্তাদ বাড়ে গোলাম আলী? প্রকৃতপক্ষে এইসব স্ট্যান্ডার্ডের বিষয়গুলি মানুষের নিজেদের মনগড়া কথা ছাড়া কিছু নয়। যদি ঐ ধরনের কোনো স্ট্যান্ডার্ড থাকতো যে শুধু ইংরেজি গানই গান, আর বাকী সব আবর্জনা, তাহলে♉ লালন ফকিরের গান কিংবা হাসন রাজার গান কিংবা কিংবা রবীন্দ্র সঙ্গীত কিংবা নজরুল গীতি কিংবা শাহ্ আব্দুল করিমের গানগুলো অনেকেই শুনত না এবং এসব গান কোটি কোটি মানুষের মন জয় করতে পারতো না। তখনকার সেই ‘ইংরেজি গানই ভালো গান, বাকী সব লোয়ার স্ট্যান্ডার্ড’ বিষয়টা একটা ঔপনিবেশিক মনোভাব ছাড়া আর কিছু ছিল না।
যত বয়স বাড়তে থাকলো একটা বিষয় ততই পরিষ্কার হয়ে আসতে থাকলো যে আমরা আসলে সংগীতের সাগরে সামান্য খড়কুটাও নই, তাই অযথা বোকার মতো সংগীতের কোনো একটা শাখাকে বেস্ট ভেবে নিজেদের ‘অ্যাভোব অল ক্রাউড’ ভাবার কোনো অর্থ নাই। ধীরে ধীরে যত সময় পার হতে থাকলো, বাংলা শোনা শুরু করলাম, হিন্দি শোনা শুরু করলাম, জাপানিজ, চাইনিজ, ম্যাক্সিকান, স্প্যানিশ, ইটালিয়ান, রাশিয়ান, সিম্ফনি, ক্লাসিক্যাল সব ধরনের মিউজিক শোনা শুরু করলাম। পৃথিবীটা বড় হয়ে গেলো আমার কাছে, বুঝতে পারলাম রক মিউজিক জাস্ট এ𓄧কটা জনরা বা স্টাইল ছাড়া আর কিছুই না। পৃথিবীতে সব মিউজিকই মিউজিক, ঠিক পৃথিবীর সব ভাষাই ভাষার মতো। কেউ বলতে পারবে না যে রাশিয়ান বা ম্যাক্সিকান ভাষাটা ভালো না, চাইনিজ ভাষাটা বেস্ট। মিউজিকও যেহেতু একটা ভাষা, যে যেই মিউজিক করে, সেটা তার নিজের ভাষা এবং তার জন্যে সেটাই বেস্ট। সেকারণে তার জনরার মিউজিককে ছোট করে দেখা জাস্ট মস্তিষ্কবিহীন বোকা মানুষের ইগো ছাড়া আর কিছুই না।
এসব ব্যাপারে রিয়েলাইজেশন আসার পর বাংলা গান করতে শুরু করে দিলাম। সোলসকে দেখলাম বিটিভিতে বাংলা গান গেয়ে প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে গেলো রাতারাতি। কালক্ষেপ না করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম বাংলা গান গাইতে। ১৯৮২/৮৩-র দিকে চাইম প্রতিষ্ঠা করে বাংলা সেমিফোক এবং জীবন ধর্মী গান করে মানুষের মন কাড়লাম আমরা। যদিও আমাদের ক্যাসেট বের হলো ১৯৮৫/৮৬-র দিকে। বুঝে গেলাম, বাংলা ছাড়া গতি নাই, ভাষার জন্যেও বাংলা দরকার, গানের জন্যেও বাংলা দরকার, ইভেন সস্তায় নেশা করার জন্যেও বাংলা দরকার। শুধু আমরা না, এরপর সব ব্যান্ড একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাংলা গান গাইতে। ফিডব্যাক বাংলা গান করলো, মাইলস বাংলা গান করলো, রেনেসা বাংলা গান করলো, উইনিং বাংলা গান করলো এবং আরও অনেক ব্যান্ড বাংলা গানের ক্যাসেট বার করলো। তাতে করে কী হলো? নব্বই দশকের বাংলা ব্যান্ডের উত্তরণ ঘটলো, ব্যান্ড মিউজিকে মাতৃভাষা বাংলা স্বীয় বৈশিষ্টে স্থান করে নিলো, অদ্ভুত সুন্দর সুন্দর গানের সৃষ্টি হলো এবং সাথে সৃষ্টি হলো কোটি কোটি🌠 বাংলা ব্যান্ড সংগীতের দর্শক শ্রোতা।