ইংরেজি নভেম্বর মাস, স্কুল ছাত্রছাত্রীদের বার্ষিক পরীক্ষার মাস। তার ওপর এ বছরটি একটু ব্যতিক্রম। সামনে নির্বাচন। কোমলমতি শিশুদের বিশেষ করে পরীক্ষার রুটিনে নির্বাচনী প্রভাব ফেলবেই। এমনিতেই স্কুল রুটিনে কোনো গ্যাপ দেওয়া হয় না, এবার নির্বাচন থাকায়, আরও তাড়াতাড়ি পরীক্ষা নিয়ে ফেলার আয়োজন হবে। তবে মনে রাখা দরকার, অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায়, এখনকার প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ের শিশুরা পড়ালেখায় কিছুটা দুর্বল থাকবে। করোনোর প্রভাবে এই শিশুরা স্কুলে না গিয়েই বিভিন্ন শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছিল।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির জন্য নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা ৬টি। অন্যদিকে বেসরকারি স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য বোর্ডের নির্ধারিত ৬টি বইয়ের বাইরে আরও ১৫-২০টি কিংবা তারও অধিক বেশি বই পড়ানো হয়ে থাকে। ধানমন্ডি এলাকায় একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে সরকারি ৬টি বইয়ের বাইরে, আরও প্রায় ৪ হাজার ৭৯৫ টাকার বই কিনতে হয়। দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য কিনতে হয় ৪ হাজার ২০৮ টাকার আর প্রথম শ্রেণির জন্য কিনতে হয়ে ৪ হাজার ১৫৬ টাকার বই। বাংলায় দক্ষতা অর্জনের নামে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণিতে লিলা মজুমদার, শঙ্খ ঘোষ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বই পড়ানো হয়। পাঠক, লিলা মজুমদার আর শঙ্খ ঘোষের বই পড়েছেন কি না জানি না, আমি তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তে দেওয়া পড়া পড়তে গিয়ে, বাংলা হলেও বুঝতে কয়েকবার পড়তে হয়েছে। সে বইগুলো থেকে জানার জন্য শুধু পড়ানো হয় না, রীতিমতো প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়।
স্কুলশিশুদের নিজেদের শরীরের ওজনের চেয়ে ব্যাগের ওজনই বেশি। ২০১৬ সালে হাইকোর্ট শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী ব্যাগ বহন না করতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। রায় পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে আইন করতে নির্দেশনা থাকলেও অগ্রগতি সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না। মাত্র স্বল্পসংখ্যক সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ভালো হওয়াই, অভিভাবকদের সবাইকে বেসরকারি স্কুলমুখী হতে হয়। অনেক বেসরকারি স্কুল শিশুদের পরীক্ষা নিতে সিলেবাস ও আগাম রুটিনও সরবরাহ করে না। একটি বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়ার পরে, পরের দিন কী বিষয়ে পরীক্ষা হবে, তা জানিয়ে দেওয়া হয় মাত্র। এটা শিশুদের সঙ্গে, শিক্ষার সঙ্গে একধরনের তামাশা বলে মনে করি।
প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষার রুটিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার রুটিন জানিয়ে দেওয়া হয় অনেক আগে থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে পড়ালেখা করেন, তাদের সপ্তাহে দুটির বেশি পরীক্ষা থাকে না। অনেক শিক্ষার্থীকে কম পড়তে হয় বলে, পরীক্ষার রুটিনের গ্যাপে পড়েই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।
অন্যদিকে স্কুল পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে পরীক্ষার রুটিনগুলোতে কোনো বিরতি দিয়ে পরীক্ষা নিতে দেখা যায় না। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলে শুক্রবার আর শনিবার বাদে প্রতিদিনই একটি বিষয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। আমরা যারা স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে বর্তমানে বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েদের অভিভাবক হয়েছি, নিজেদের স্কুলবেলার কথা স্মরণ করে, এখনকার শিশুদের পরীক্ষা রুটিনের কথা চিন্তা করে দেখতে পারি।
একজন স্কুলের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স কোর্সের ছাত্রের মতো মাত্র ৫-৭টি প্রশ্ন মুখস্থ করলে হয় না। তাকে এখন সৃজনশীল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে সিলেবাসে থাকা সবকিছু পড়তে হয়। বার্ষিক পরীক্ষার জন্য মাত্র দুটি অধ্যায় থেকে প্রশ্ন হয় না। তাকে পুরো বই, ভালো করে দেখে যেতে হয়। সিলেবাসে থাকা সব অধ্যায় পড়ে যেতে হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৮-১২ বছরের শিশুকে একটি পরীক্ষা শেষ করে, পরের দিন আরও একটি বিষয়ের পুরো সিলেবাস শেষ করে পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধ্য করাটি কতটুকু যৌক্তিক আমরা অভিভাবক, নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখতে পারি।
আমরা সাহিত্যে, নাটকে গল্পে যে মানের শিক্ষকের কথা পড়েছি, বর্তমানে এখনো কিছু কিছু নাটকে দেখা গেলেও, বাস্তবে তেমন শিক্ষকটি আর নেই। পাহাড়ে শিক্ষক নিয়োগে ২০-২২ লাখ টাকা প্রয়োজন হয় বলে লোকমুখে শোনা যায়। আমার বাবাকে দেখেছি অজপাড়াগাঁয়ে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষায় ফেল করে দেওয়ার বদলে উৎসাহিত করতেন। তাঁর স্কুলে কোনো ছাত্রকে ফেল করাতেন না। দুর্বল ছাত্রদের নিজে বাড়তি সময় দিতেন। বাসায় এনে পড়াতেন। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের প্রথম দিকের শিক্ষক ছিলেন শরদিন্দুবাবু। তিনি পড়াশোনাকে ভালোবাসতে প্রীতি আর প্রিয়তা দিয়ে শিখিয়েছিলেন বলে জানা যায় (দেখুন: নিষ্ফলা মাঠের কৃষক, পৃষ্ঠা ২০-২১)। জসীমউদ্দীন তাঁর ‘জীবন কথা’য় লিখেছেন, “ক্লাসে আমিই ছিলাম সবচাইতে ইংরেজিতে কাঁচা। তাই বাবু বসন্ত কুমার দাস আমাকেই সব চাইতে বেশি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করিতেন।” তিনি আরও বলতেন, “জসীমউদ্দীনকে যদি শিখাইতে পারি তবে ক্লাসে সব ছেলেকে শেখানো যাইবে।” (দেখুন: পৃষ্ঠা ২০০)। আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও লেখক অশোক মিত্র তাঁর ‘আপিলা চাপিলা’য় নিজের শৈশব বর্ণনা করতে গিয়ে শামসুদ্দিন স্যারের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “শামসুদ্দিন স্যার প্রতি রবিবার এবং ছুটির দিনে, পায়ে হেঁটে বা নিজের পয়সায় রিকশায় চেপে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের জানিয়ে আসতেন, কে কোন বিষয়ে ভালো, কে কোন বিষয়ে দুর্বল, কার হাতের লেখায় উন্নতি দরকার, কার স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে ইত্যাদি (পৃষ্ঠা ৯৩)। অশোক মিত্র তাঁর শামসুদ্দিন স্যারের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আরও লিখেছেন, “আমরা জ্ঞানান্বিত না হতে বদ্ধপরিকর, উনি ততটাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আমাদের বিদ্যার পরিধি বাড়াবেনই।” (দেখুন: স্বপন বিশ্বাস, ‘অশোক মিত্রের স্মৃতিতে ঢাকা’, কালি ও কলম, জুলাই ২৩, পৃষ্ঠা ৯৩)।
এখন নিয়োগ-বাণিজ্য, শিক্ষকদের দায়বদ্ধতাহীনতা, সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক অবহেলার কারণে খুব কমসংখ্যক স্কুল নিয়েই আমরা গর্ববোধ করতে পারি। যার দরুণ ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের পরিবর্তে কোচিংমুখী হয়েছে। অভিভাবকদের ছেলেমেয়েদের কোচিং সেন্টারের সামনে আড্ডায় মেতে উঠতে দেখা যায়। যাদের এই সব প্রচলনের সঙ্গে তাল মেলানোর সময় নেই, তারা বাসায় শিক্ষক রেখে কিংবা নিজেরা পড়িয়ে থাকেন। চাকরিজীবী ব্যস্ত অভিভাবকদের পক্ষে খুব কম সময় থাকে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখায় খোঁজখবর রাখার। শামসুদ্দিন স্যারদের ন্যায় ভূমিকার বদলে শিশুদের অবনতি দেখলে স্কুল শিক্ষকরা অভিভাবকদের ডেকে উপদেশ দিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেন। ফলে বাবু বসন্ত কুমার দাস, শামসুদ্দিন আর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারদের মতো কোনো শ্রদ্ধাভাজন স্যার আর তৈরি হয়নি।
শিশুরা তার নিজ বিদ্যালয়, শিক্ষক আর অভিভাবকদের পড়ালেখায় সহযোগী বন্ধু হিসেবে পাওয়ার বদলে, সবাই নানা প্রক্রিয়ায় চাপ সৃষ্টিকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। সমাজ ও রাষ্ট্র বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের প্রতি অবহেলার দরুন, শিক্ষকরাও মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে সমাজে উদাহরণ হয়ে উঠতে পারেননি। আমার বাবা উপজেলা পর্যায়ে একাধিকবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হয়েছিলেন বলে জানি, কিন্তু তাঁর স্বীকৃতিস্বরূপ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে খুঁজতে গিয়ে কিছুই পাইনি। এ বছর আমার সহপাঠী ও পরিচিতজনরা উপজেলা, জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। তারাও কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ঘোষণা ছাড়া কিছুই পাননি। রাষ্ট্র চাইলে নির্বাচিত সেরা শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করে উদ্বুদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকেও নিজে উদ্যোগী হয়ে শিক্ষকদের অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করতে দেখা যায়নি।
আমরা যদি শিক্ষকদের সম্মানিত, উদ্বুদ্ধ করতে না পারি, তাঁরা আমাদের শিশুদের দায়িত্ব নিতে অনুপ্রাণিত হবেন কী করে? স্কুলে শিশুদের শারীরিক নির্যাতন বন্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। শিক্ষার মান উন্নয়নে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও উন্নত, আরও শিশুবান্ধব করার উদ্যোগ থাকা আবশ্যক। স্কুলে যেখানে তিন ঘণ্টা সময় ধরে প্রশ্ন দিয়ে লিখতে দেওয়া হয়, সেখানে তাদের প্রতিটি বিষয়ের প্রস্তুতি নিতে সময় দেওয়া উচিত বলে মনে করি।
আমরা জানি, উন্নত বিশ্বে বার্ষিক পরীক্ষা বলে কোনো পরীক্ষা থাকে না। আমেরিকাপ্রবাসী বিজ্ঞানী ড. মংসানু মারমা থেকে জেনেছি, সেখানে শিশুদের ক⛎বিতা মুখস্থ করে লিখতে হয় না। শিশুদের জন্য আমাদের মতো জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বলেও কিছু থাকে না। শিক্ষকরাই শ্রেণিভেদে তাদের পাঠ্যসূচি তৈরি করে পড়ান। অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী সেন্টি চাকমা থেকে জেনেছি, সেখানে🌄ও কোনো বার্ষিক পরীক্ষা নেই। ক্লাস টেস্টই সব। পুরো দেশের শিক্ষার মানদণ্ড বুঝতে প্রতিবছর ৩, ৫, ৭ ও ৯ গ্রেডের শিশুদের ‘ন্যাপ্লান’ নামে এক দিনের পরীক্ষা নেওয়া হয় মাত্র।
আমরাই শিশুদের দুরন্ত শৈশব উপহার দেওয়ার বদলে অধিক বই, বাড়তি পরীক্ষা, লেখাপড়ার চাপ দিয়ে গৃহবন্দী করে রেখেছি। এখন পরীক্ষা নিতে গিয়েও যদি সিলেবাসে থাকা পড়াগুলো পড়ার সময় দেওয়া না হয়, সেটি হবে ꩵঅন্যায়। শিশুদের পরীক্ষা নেওয়ার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, মেধা প্রকাশের, মেধা বিকাশের সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার। কাউকে মেধা বিকাশে বাধাগ্রস্ত করা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। ঢাবির শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় যদি গ্যাপ পাᩚᩚᩚᩚᩚᩚᩚᩚᩚ𒀱ᩚᩚᩚন, শিশুদের আরও বেশি সময় পাওয়াটি তাদের একটি অধিকার বলে মনে করি।
লেখক: কলামিস্ট