কবিগুরুর কথাতেই বলি, ‘ও যে সত্যি গল্প, অর্থাৎ গল্পই সত্যি!’ ঘটনার ঘনঘটায় পাঁচ কান হয়ে আজকাল গল্প আর সত্যগল্পের ভেদ বুঝতে পারা কঠিন বটে। কবি নিজেও অনেক সময় বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে উপস্থিত সবাইকে চমকে দিতেন। এই চমকে দেয়াতেই ছিল তাঁর আনন্দ।
‘একবার নিমন্ত্রণ খেয়ে গভীর রাতে ফিটন গাড়িতে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ মনে হলো পাশে কে যেন বসে আছে, যেন তার নিঃশ্বাস গায়ে লাগছে। গাড়োয়ানকে বারকয়েক জিজ্ঞেস করা হলো কিন্তু সে কথা বলে না! তারপর হঠাৎ মনে হলো সেই অশরীরী অস্তিত্ব সামনে এসে বসল। তার স্থির দুটি চোখ অন্ধকারের মধ্যে একদৃষ্টে আমার দিকে নিবদ্ধ। গাড়ি চলছে তো চলছেই। তারপর কখন বাড়ি এসে পৌঁছেছি মনে নেই। সকালে খোঁজ ꦫনিয়ে জানা গেল, কিছুদিন আগে ওই গাড়িতে একজন লোক উঠেছিল। গন্তব্যে এসে গাড়োয়ান ভাড়া চাইতেই দেখে লোকটি গাড়িতে নেই!’
স্বয়ং কবিগুরুর কণ্ঠে এমন ভূতের গল্প শুনে সবাই অবাক!
এরপর কী হলো? এরপর?
সবাই ধরেই নিয়েছেন এ ধরনের অভিজ্ঞতার নিশ্চয়ই গভীর কোনো অর্থ আছে। গুরুদেব নিশ্চয়ই বলবেন। কিন্তু তিনি স্পিকটি নট!
একদিন কথাপ্রসঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবী সেই গল্পের কথা তুলতেই রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, তুমি বুঝি সেটা সত্যি ভেবেছ? ও যে সত্যি গল্প, অর্থাৎ গল্পই সত্যি! কুচবিহারের রানী আমাকে দেখলেই গল্প শুনতে চাইতেন। তাঁরই জন্য এটা বানাতে হয়েছিল। গোঁফের আড়ালে হাসি লুকিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন তিনি।
মৈত্রেয়ী দেবী এ ঘটনা স্মরণ করে পরে লিখেছেন: ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফস্ করে মুখে মুখে এমন মজার গল্প বলে যেতেন—একটুও সময় লাগত না। কোনোটা বা গ্রাম্য ভাষায় কথাবার্তা, কোনোটার বা মেয়েলি ভাষা আর তার মধ্যে হাসির খোরাক ঠাসা হয়ে থাকত।’
অর্থাৎ✱ মজলিশ মাতিয়ে তুলতেও পারঙ্গম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবি রসে না-মজে ভক্ত শ্রোতাকুলের উপায় ছিল না। এ ক্ষেত্রে অন্তত দুটো সভার নাম করা যায় যেখানে হাসির ঢেউ উঠত। এক বাঙালসভা, এবং দুই খামখেয়ালি সভা।
১৮৯৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি খামখেয়ালি সভার সূচনাদিন। মূল উদ্যোক্তা যথারীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সঙ্গে ছিলেন বলেন্দ্রনাথ। এই সভার সভ্যরা ডিনার পার্টির আয়োজন করতেন। পুরো আয়োজনে রুচির ছাপ ফুটিয়ে তুলতে কেউ কার্পণ্য করতেন না। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আয়োজন নিয়ে মেতে উঠতেন সর্বাগ্রে। খাবারের পর চলত আবৃত্তি, গল্পপাঠ, একাঙ্ক নাটকের অভিনয় এবং অবশ্যই গান। দেখা যেত রবীন্দ্রনাথ গাইছেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এস্রাজ বাজাচ্ছেন, ওদিকে নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ সুর তুলছেন পাখোয়াজে। এরই ফাঁকে ফাঁকে হতো উপস্থিত কবি, লেখক, অভিনেতা, সংগীতশিল্পীর বুদ্ধিদীপ্ত, রসিকতাপূর্ণ আলোচনা। এই সভার আমন্ত্রণপত্র ছিল বেশ মজার। একটা শ্লেটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিবার কবিতা লিখে দিতেন। তারই একটি তুলে ধরছি:
‘শুন সভ্যগণ যে যেখানে থাকো,
সভা খামখেয়াল স্থান জোড়াসাঁকো।
বার বরিবার রাত সাড়ে সাত
নিমন্ত্রণ কর্তা সমরেন্দ্রনাথ।
তিনটি বিষয় যত্নে পরিহার্য
দাঙ্গা, ভূমিকম্প, পুণা-হত্যাকার্য।
এই অনুরোধ রেখে খামখেয়ালি
সভাস্থলে এসো ঠিক Punctually.’
বাঙালসভার পুরোভাগেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৭ সালে শান্তিনিকেতনে প্রথম এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। একবার সভার সভাপতি হলেন সুকুমার রায়। সেদিন সভায় পূর্ববঙ্গের ভাষায় একটি গল্প পাঠ হলো। শুধু তাই নয়, উপস্থিত সবাই পূর্ববঙ্গের ভাষায় কথা বলছেন। সবশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পালা। কিন্তু তিনি তো খাস পশ্চিমবঙ্গের। যদিও মামাবাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ি পূর্ব বাংলায়। তাই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি যশোর এবং খুলনার মাত্র দুটি কথাই জানি। তা হলো- কুলির অম্বল আর মুগির ডাল।
কবির কণ্ঠে পূর্ববঙ্গের উচ্চারণ শুনে সভায় হাসির রোল উঠল।
সীতা দেবী এ কথার সাক্ষ্য দিয়ে লিখেছেন: ‘সাধারণ কথাবার্তার ভিতর রঙ ও রস ছড়াইবার ক্ষমতা যতখানি ছিল, এমন কখনও কাহারও মধ্যে দেখি নাই। রবীন্দ্রনাথ নিজে গম্ভীরভাবে বলিয়া যাইতেন, শ্রোতারা হাসিয়া আকুল হইত।’
অথচ কী প্রবল হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব💙ের অধিকারীই না ছিলেন তিনি। সামান্যতম কষ্ট, গভীর অন্তঃবেদনা কাউকে বুঝতে দিতেন না। হাসি মুখে, কবিতার ঝরনায়, সুরের প্রবাহে, সহাস্য কৌতুকে সমস্ত দুঃখ গোপন করে গেছেন। এমনকি মৃত্যুপূর্বে র𒅌োগশয্যাতেও তিনি হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে চারপাশ আনন্দময় করে রাখতেন।
১৯৪১-এর ৩০ জু𝓀লাই। নিজ বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অপারেশন হলো। সবাই চিন্তিত। অপারেশন শেষে কবিকে যখন ঘরে আনা হলো, তখন সবার মুখ দেখে তাঁর মায়া হলো। গুমোট হাওয়া উড়িয়ে দেয়ার জন্য হেসে 🧸বললেন, ‘কী ভাবছ? খুব মজা, না!’
এই হলো রসিক রবীন্দ্রনাথ। তিনি ভৃত্যদের সঙ্গেও হাস্য𝓰কৌতুক করতেন। একবার নিজেই বলেছেন, ‘ঠাট্টা না করতে পেলে আমার চলে না সে চাকর দিয়ে। প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবীর পাহাড়ি বাংলোয় আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। এ সময় তিনি সকলের নিষেধ সত্ত্বেও একটি কবিরাজী ওষুধ খেতেন। ডাক্তারের পেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ খাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে বলতেন, দাসমনোবৃত্তি একেই বলে। যেহেতু ওটা সাহেবদের হাতে বিলেতে তৈরি, ওটা খারাপ হতেই পারে না। আর এটা (কবিরাজী) এই অভাগা দেশে তৈরি হয়েছে কিনা, এ খারাপ না হয়েই যায় না!
তারপরও মৈত্রেয়ী দেবী ওষুধটি একদিন খেয়ে পরীক্ষা করে পরদিন আবারও খেতে চাইলে কবিগুরু আপত্তি জানিয়ে বললেন, না, না, তোমার আর খাওয়া চলবেই না। আলু একি বিপদে পড়েছি রে? একে কি বলে? সহমরণের প্রবৃত্তি?
তখন আলু বলল, আচ্ছা, তাহলে আজ আমি খেয়ে দেখি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবার রেগে গিয়ে বললেন, তুই থাম্। তোর সঙ্গে সহমরণে যেতে কে চায়?
আলু কে?
আলু কবির পার্সোনেল অ্যাটেন্ডেন্ট সচ্চিদানন্দ রায়। কাছাকাছি যারা থাকতেন কবিগুরু প্রায়ই তাদের নতুন নামকরণ করতেন। পার্সোনেল সেক্রেটারি, এমনকি অ্যাটেন্ডেন্টদেরও রসিকতা করে ডাকনাম দিতেন।
সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর মাথায় বিরাট টাক দেখে কখনও ডাকতেন ‘বলডুইন’, কখনও ‘সুধাসমুদ্র’ আবার মাড়োয়ারীদের কাছ থেকে শান্তিনিকেতনের অর্থসংগ্রহ করার জন্য কখনও ডাকতেন ‘সুধোরিয়া’। সচ্চিদানন্দ রায়কে ডাকতেন ‘আলু’। কবির ভাষায়: ‘ওর একটা মজবুত রকম সংস্কৃত নাম ছিল, কিন্তু সে এখন আর কেউ জানে না। যেদিন শুনলুম ও পটোলের ভাই সেইদিন থেকে ও আলু। আজকাল আবার দেশী আলুতে কুলোচ্ছে না, তাই বলি পটেটো। আমার একদিকে বলডুইন, একদিকে পটেটো- জোরালো সব নাম।’
কবির সামান্য কথাতেও এভাবে ফুটে উঠত অসামান্য কৌতুকরস। রবীন্দ্রসাহিত্যেও তাই; কবির গুরুগম্ভীর গদ্যেও অনিবার্যভাবে উঁকি দেয় সূক্ষ্ম হাস্যরস। কবির নিজ হাতে গড়া শান্তিনিকেতন, সেখানেও বারো মাস বইত হাস্যকৌতুকচ্ছটা। সেখানকার ছাত্র অমিতাভ চৌধুরীর ভাষ্যে, শান্তিনিকেতনে কেউ ভালো না মন্দ নির্ধারণ হতো তাঁর রসবোধ দিয়ে। সে হাসতে জানে কিনা, রসিকতা বোঝে কিনা এই ছিল মাপকাঠি। বলাবাহুল্য রসিকতা চর্চায় কবিগুরু স্বয়ং ছিলেন সর্বাগ্রে। এ কারণেই তিনি বলতে পেরেছেন, ‘এত বুড়ো কোনকালে হব নাকো 𝕴আমি, হাসি তামাসারে যবে কব ছ্যাবলামি।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনেই সবচেয়ে বেশি শান্তি খুঁজে পেতেন। সময় এবং সুযোগ পেলেই ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিশে যেতেন। অনেক সময় শব্দ দিয়ে তাদের সঙ্গে কবিতা বানানো খেলা খেলতেন। কখনও আবার নিজেই ক্লাস নিতেন। একদিন ক্লাসে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ইংরেজিতে বল তো, সবির একটা গাধা আছে।
যাকে জিজ্ঞেস করা হলো সে বলল, Sobi is an ass.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উত্তর শুনে হেসে উঠলেন। তারপর ক্লাসে যে ছেলেটির নাম সবি, তার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখলি সবি, সুযোগ পেয়ে ও কেমন তোকে গাধা বানিয়ে দিলো!
এই শান্তিনিকেতনেরই অজস্র ঘটনা আছে যেগুলো রবি রসের সাক্ষ্য দেবে। একটি ঘটনা বলি:
এইচ. পি. মরিস শান্তিনিকেতনে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা পড়াতেন। একদিন তিনি প্রমথনাথ বিশীকে বললেন, গুরুদেব চিনির ওপরে একটি গান লিখেছেন।
শুনে প্রমথনাথ বিশী অবাক হতেই তিনি গুনগুন করে গাইলেন, চিনি গো চিনি, তুমি বিদেশিনী, তুমি থাকো সিন্ধুপারে। এরপর তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করে বললেন, যখন বিলাতি চিনি সমুদ্রপার থেকে আসত এ গানটি তখন লেখা। গানটি বড় মিষ্টি।
প্রমথনাথ বিশী এবার হেসে বললেন, চিনির গান অবশ্যই মিষ্টি হবে। কিন্তু এ ব্যাখ্যা কোথায় পেলেন?
মরিস সাহেব বললেন, কেন, গুরুদেব বলেছে!
প্রমথনাথ গুরুদেবের রসিকতার আভাস পেয়ে মনে মনে খুব একচোট হাসলেন। কিন্তু তিনি মরিস সাহেবের ভুল ভাঙিয়ে দিলে♌ন না।
আজ ১৬২তম রবীন্দ্রজয়ন্তী। কবির জন্মদিনের একটি ঘটনা দিয়েই লেখার ইতি টানছি।
কবিগুরু তখন কালিমপঙে। একদিন সকালে ডাক এলো। সে এক প্রকাণ্ড বোঝা- কবির জন্মদিন উপলক্ষে বিভিন্ন পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা, জন্মদিনের প্রণামের চিঠি, ভক্তের লেখা কবিতা ইত্যাদি।
কবিগুরু হঠাৎ মৈত্রেয়ী দেবীকে 💞বললেন, তুমি একটা কবিতা লিখলে না যে? কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি তোমার ভক্তি অসম্ভব কমে যাচ্ছে। ওইতো কাগজ কলম রয়েছে, চট করে, ‘হে রবীন্দ্র কবীন্দ্র’ বলে একটা লিখে ফেল। আমার নামটা ভারী সুবিধের, কবিদের খুব সুবিধে হয়ে গেছে। মিলের জন্য হাহাকার করে বেড়াতে হয় না। রবীন্দ্রের পর ‘কবীন্দ্র’ লাগিয়ে দিলেই হলো।