যেকোনো লেখাকে কোনোভাবে টেক্সট বলা যায় না। লিখলেই যেমন ‘কেউ কবি হয় না’। কবিতা কিংবা সাহিত্যের অন্য মাধ্যম হোক আন্তসম্পর্কের চিহ্নায়নের মধ্য দিয়ে যে অস্তিত্ব জটিল বাস্তবতা সৃষ্টি করে, তা সম্পর্ক স্থাপনের অভিজ্ঞান, যা সত্য ও ছায়াসত্যের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ঘটায়। কবিতা জ্ঞানের নয়, অস্তিত্বের অভিজ্ঞান। কবিতা সেখানে ভাষা পরাবিবরণের, ইশারার ও দুত্যিময়তার, যেখানে চিহ্নবিশ্ব নিত্য পাঠভেদে ভিন্নার্থ নিয়ে উন্মোচিত হয়। এ প্রসঙ্গে সক্রেটিসকে স্মরণ করা যায়। তাঁর একটি উক্তি এখনো গতিশীল ও ইস্পাতস্ফুলিঙ্গময়। অতি ব্যবহৃত হলেও বেশ ওজনদার, হিরেখণ্ড। তা হলো, ‘নিজেকে জানো।’ খ্রিষ্ট জন্মের আগে বলা কথাটি এখনো ওজন হারায়নি, বরং যাপনের সর্বত্র দীপ্যমান অনির্বাণের মতো প্রোজ্জ্বল, বাতিঘর। এর অন্বেষণ পরিচালিত করে একজন কবি (এখানে কবি অর্থে শিল্পের সব মাধ্যম সম্পৃক্তদের বোঝানো হয়েছে।) আত্মাভিজ্ঞানের দিকে, যার ব্যত্যয় একজন কবিকে ‘অপর’ হিসেবে চিরনির্দিষ্ট করে, এবং একই সঙ্গে সংকোচনের পাশাপাশি অর্জিত চিন্তার বিচ্ছুরণকে নেতিবাচকভাবে বিস্তৃত করে কবির মননবিশ্ব ও তার যথাপ্রাপ্ত স্থানিকতার ইতিবাচকতা। ফলে প্রতিবেদন কাঠামোর আবহে যাবতীয় সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান মুছে যেতে থাকে, এবং সামাজিকায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন কবি তার নির্মাণের ঐক্যের আন্তসম্পর্কের বুনন সম্বন্ধে গড়ে তোলেন নতুন চিহ্নবিশ্ব। আর এর মধ্য দিয়ে পরাগায়ন ঘটে মানুষ ও জগতের বৈচিত্র্যে স্বতঃস্ফূর্ত পরাব্যাপ্তি, অবাস্তব হয়ে ওঠে ভাষাপৃথিবীর অভিঘাতগুলো, এবং আত্মীকৃত অভিঘাতের কাছে কবির নিজস্ব সামগ্রিক যাপন প্রক্রিয়া, যেমন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপনিবেশের বীক্ষা, নতুন অভিজ্ঞতায় অবগুণ্ঠিত হয়। চিন্তার অচলায়তন ভেঙে চেতনার সামগ্রিকতার রূপ হয়ে ওঠে নৈর্ব্যক্তিক ভাষায় অনন্ত পরিসর। এ নির্মাণ কেবল সৃষ্টির আনন্দেই গ্রন্থিত সমগ্র চেনা পৃথিবীর সঙ্গে কবিকে, তার পরিবেষ্টিত মানুষ ও জগতের বৈচিত্র্যের সঙ্গে আত্মীয়তার সেতুবন্ধ তৈরি হওয়ার আনন্দেই তার অস্তিত্বের অববাহিকতায় নিরন্তর ভাঙচুর হতে থাকে। কিন্তু কিসের আনন্দে এ দ্বিবাচনিক ব্যাপ্তি, যে ব্যাপ্তি বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় তার দ্যোতক ও দ্যোতিতের ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় ব্যাপকতা স্পষ্ট করে। তার অখণ্ডতা (Synecdoche) নির্দেশ করে টেক্সটকে জাগিয়ে তোলে কাব্যশিল্পের অনুসন্ধিৎসার বিমোচনে বহুমাত্রিক মেটাফর। তবে জীবন-জীবিকার অন্বেষণে এবং ক্রমশ কঠিন হয়ে আসা জীবনসংগ্রামে কমবেশি মেজাজ হয়ে ওঠে লড়িয়ে, স্বার্থবোধ তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হতে থাকে, চিন্তাচেতনা, ভাবনা-বেদনা হয় একান্ত আত্মকেন্দ্রিক। এ আত্মমগ্নতার অন্য পিঠ হচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবোধ, যা কিছুটা স্বেচ্ছাবিলম্বিত মানসিক মুখোশ। ইংরেজিতে যাকে ‘এলিয়েনেশন’ অভিধায় চিহ্নিত করা হয়। এ মানসিক একাকিত্ব আমাদের সুকুমার হৃদয়বৃত্তিকে নিরন্তর পীড়া দেয়। শিল্প-সাহিত্যের মধ্যে আছে সেই মানসিক পীড়ার উপশমের লোশন। সাহিত্য তা-ই যা জগতের সঙ্গে, ভিন্নার্থে মানুষের সঙ্গে আমাদের সহিতত্ব বা যোগাযোগের সাঁকো রচনা করে। গম্ভীর অথচ অনুতরঙ্গ তার আনন্দ, তার চেয়ে পরিশুদ্ধ আনন্দের কথা অন্য কোথাও আছে কি না, বলা শক্ত।
সাহিত্যের অন্য পিঠে আছে ফলিত সাহিত্য। কেননা, বিজ্ঞান ও সাহিত্য একে অন্যের পরিপূরক। মানুষের অস্তিত্বে এ দুইয়ের মিশ্রণ দ্রবীভূত। বিজ্ঞান এক অর্থে ‘জ্ঞান’ বলে চিহ্নিত। ‘জ্ঞানই শক্তি’ বেকনের একটি কথা। ইশকুল পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েও আমাদের জীবনে তার সারবত্তা হারায়নি, বরং দিন দিন এর প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য উপস্থিত আমাদের যাপনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে। প্রাকৃতিক প্রচণ্ড ভয়াবহ শক্তিসমূহের সামনে হাঁটু গেড়ে পুষ্পাঞ্জলি, দোয়া-অর্চনা কিংবা মানব-পশুবলি অথবা তাবিজ-মন্ত্রতন্ত্র করার যুগ গেছে। প্রকৃতির মধ্যে খেয়ালখুশি, দয়ামায়া, নিষ্ঠুরতা-কঠিনতা, হিংস্রতা বলে কিছু নেই। প্রাকৃতিক শক্তিকে দোয়ায়-পূজায়-অর্চনায় তুষ্ট করে ফল পাওয়া যায় না। তাকে জ্ঞানের দ্বারা বশীভূত করে কাজ হাসিল করা যায়, অনায়াসে। প্রকৃতি সম্পূর্ণ নিয়ম মত চলে, তার একচুল এদিক-ওদিক হওয়ার জো নেই। এ নিয়ম-শৃঙ্খলা বিষয়ে আমাদের জ্ঞান যতই সঠিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ হবে, ততই প্রকৃতি হবে আমাদের করতলগত। আমাদের অন্তর্গতও।
এ জ্ঞান বা বিজ্ঞান ফলিত বিজ্ঞানের অংশ। তার মূল্য অনস্বীকার্য। ফলিত বিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত হলে প্রত্যাবর্তন করতে হবে লক্ষ হাজার বছর আগের গুহাবাসী পুরাপ্রস্তর ব্যবহারকারী আদিম মানুষের যুগে কিংবা তারও আগে। কিন্তু ফলিত বিজ্ঞান হলো সাশ্রয়ী নয়, পরাশ্রয়ী; আশ্রয় করে আছে বিজ্ঞানের ওপর। এবার ফেরা পূর্বপ্রসঙ্গে। অর্থাৎ ফলিত সাহিত্যের দিকে। প্রাচীনকালে সাহিত্যের মাধ্যমে ধর্মশিক্ষা, নীতিশিক্ষা দেওয়া হতো, এমনকি দার্শনিক তত্ত্বকথাও শেখানো হতো উপনিষদের শ্লোকে, ইশপের কল্পকাহিনিতে রুমির মসনবি, ফেরদৌসির শাহনামায় ও প্লেটোর ডায়ালগ-এ। ইদানীং রাজনৈতিক প্রয়োজনে সাহিত্যের ব্যবহার দেখা যায়, করা হয়ও। শ্রেণিচেতনা, শ্রেণিসংগ্রাম, সমাজবিপ্লব ইত্যাদির উপযুক্ত মনোভূমি তৈরি করা এবং বিপ্লবের পর শ্রেণিহীন সমাজ গঠনে অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা জাগানো—এমন সব মহৎ কাজের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন কবি কিংবা সাহিত্যিকেরা কোথাও স্বেচ্ছায়, কোথাও-বা রাষ্ট্রঈশ্বরদের আদেশে। জবরদস্তি, বলপ্রয়োগী আদেশ অবশ্য নিন্দনীয়, নেতিবাচক এবং শেষ পর্যন্ত অফলপ্রসূ। কিস্তু স্বেচ্ছায় ও সোৎসাহে যদি সাহিত্যিকরা তাদের বহু যত্নে-গড়া এ শক্তিমাধ্যমকে শ্রেণিযুদ্ধ ও সমাজ গঠনের মোক্ষম অস্ত্ররূপে ব্যবহার করে। তাতে দোষের বা নিন্দার কিছু নেই। মহৎ কাজের মহান অস্ত্র হওয়ায় সাহিত্যের অগৌরব হয় না। অগৌরব হয় তখনই যখন এসব সাহিত্যিক নামধারী কিংবা তাদের সারথি রাজনৈতিক নেতা আদেশ জারি করে—শুধু এটাই সৎ সাহিত্য, রাষ্ট্রিক যত্নে ও সমাদরে লালনীয় সাহিত্য; বাদ বাকি সব লেখাই অসৎ, বুর্জোয়া, ফ্যাসিস্ট, ঝুট সব হে ইত্যাদি স্লোগানসর্বস্ব; তাই শুধু নিন্দনীয় নয়, কঠোর হাতে দমনীয়। শ্রেণিস্তরের সঙ্গে সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গি সমান্তরাল থাকার কারণে তার উদ্ভব অস্বীকার করার কারণ নেই। সমান্তরালের মনোপলি দৃষ্টি ভেঙে পরিপূরকতার বাইনোকুলার স্বরের মধ্যে এটি উপ্ত।
বিশুদ্ধ বিজ্ঞান এমনকি তার বিশুদ্ধতম শাখা বিশুদ্ধ গণিত, কোথাও অবদমিত হয়েছে বলে কখনো শোনা যায়নি। এর মূল কারণ অবশ্য এই যে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ ও ফলিত বিজ্ঞানের মধ্যবর্তী সীমারেখা স্থির নয়, সদা চলনশীল কখনোবা গতিশীল। আজও যেটা বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের অন্তর্গত, অর্থাৎ জ্ঞানপিপাসা মেটানো ছাড়া মানুষের আর অন্য কোনো কাজে লাগছে না, তার ফলে ফলিত হয়ে কোনো ভয়াবহ আয়ূধ, মৃতসঞ্জীবনী কিংবা নিছক বিলাসদ্রব্য উৎপাদনের কাজে লেগে যাবে কি না, সচকিত কণ্ঠে বলা যায় না। কাজেই কি সমাজবাদী, কি পুঁজিবাদি কোনো দেশে বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক নিগৃহীত নন, রাষ্ট্রদেবতা বা রাষ্ট্রনায়কদের হুকুমদারি করতে হয় না তাদের, বরং তারা জামাই আদর পেয়ে থাকেন। এ আদর-আপ্যায়নের মধ্যে অপমান প্রচ্ছন্ন। একনিষ্ঠ প্রতিবাদদীপ্ত সাধনার যে মহৎ উদ্দেশ্য তাদের কাছে প্রতিভাত, এবং নিয়ত তাদের প্রেরণা জোগায়, সেটি হচ্ছে জগতের সত্যরূপে জানা এবং সে-ই জানার মধ্যে আনন্দ ও সৌন্দর্যপ্রাপ্তি ঘটে এ উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত হয়েও সামাজিক, কারণ জ্ঞানীদের সত্যোপলব্ধি এবং জ্ঞানানন্দ সবার জন্যই। কোনো বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিকদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। জ্ঞানী অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকদের কাজের এর পরমাত্মক মূল্য অস্বীকার বা স্বপ্নায়িত করে তাকে প্রযুক্তিবিদ্যার জোগানদার ভাবা—অতি প্রশ্রয় দেওয়ার পরিণতির নেতিবাচক দিকগুলো পরিষ্কার এখানে। তবে যাহোক, এ আলোচনার বিষয় কবি ও তার নির্মাণের আধেয়।
জ্ঞানী এবং কবি। কবি একঅর্থে জ্ঞানীও বটে। কবি শব্দের মাধ্যমে ভালোবাসা-বেদনায় দগ্ধ শব্দনির্মাতা, কবি, কথাশিল্পী এবং মহাকাব্যিক ও নাট্যকারদের বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ শিল্পের সব মাধ্যমকে চিহ্নিত করা এ শব্দের দ্বারা ধরে নিতে পারি। জ্ঞানী এবং কবি, দুজনই এক অনেকান্ত জগতের ত্রিকৌণিক কিন্তু অভিন্নরূপে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে বাইনোকুলারের সত্যোপল চোখে অবলোকন করে থাকে। স্বকীয় চিত্তের ঈষৎবর্জিত মুকুরে প্রতিবিম্বিত করে। একজন বুদ্ধি ও যুক্তি-তর্ক দিয়ে বুঝতে চায় তার যতটা বোধগম্য, ততটা সুশৃঙ্খলিত ও নিয়মানুগ। এ বোধগম্য রূপই সত্য বলে চিহ্নিত। অন্যজন হৃদয় ও উপলব্ধি দিয়ে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ানুভবের মধ্যে জগতের বৈচিত্র্য, বিশ্বভুবন ও মানুষকে পেতে চায়; তুলির কৌশলী আঁচড় ও রঙের প্রদীপ্ত ব্যঞ্জনায় বিভিন্ন রৈখিক মাত্রায় রূপায়িত করে। উপলব্ধি অর্থে এখানে প্রখর সূক্ষ্ম সমাজ সচেতনতাকে বোঝানো হয়েছে। এ অনুভূত রূপ সুন্দর বলে আখ্যায়িত। যে বুদ্ধির কাজ অর্থাৎ জ্ঞানান্বেষণ কখনোই অনুভূতিবর্জিত নয়, এবং অনুভূতির প্রকাশ অর্থাৎ বিশুদ্ধ কাব্য কখনো বুদ্ধি ও বুদ্ধিগ্রাহ্যজ্ঞানের স্পর্শ এড়াতে পারে না। তবে মাত্রার তারতম্য নিয়ে কথা, এ তারতম্য বেশি হলে মাত্রাভেদে গুণভেদে পরিণত হয়, অন্তত প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এখানে ‘সুন্দর’ কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। তার মধ্যে নয়-ছয়ভাবে বিক্ষিপ্ত, অনেকটা সীমিত কুৎসিতের স্থান আছে। সব খণ্ড খণ্ড সুন্দরের ইঙ্গিত তাৎপর্যবহ ব্যঞ্জনায় গ্রন্থিত হয়; সব খণ্ড সত্যের মধ্যে এ পরম সত্যের কুৎসিতের আভাস। প্রথমটি প্রতিফলিত হয় আমাদের কবিতায়-সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি দর্শনে-বিজ্ঞানে। বরং এ প্রতিবিম্বিত আত্মীয়তা আরও কাছের করোটি-শিরায় প্রোথিত, প্রবহমান। এ কথাটি অস্বীকার করার উপায় নেই, নিউটনের মহাকর্ষতত্ত্ব, আইস্টাইনের আপেক্ষিকবাদ, হাইসেনবার্গের পরমাণুবাদ, বস্তুজগতের স্মৃতিপ্রলয়তত্ত্ব, অ্যামিবার মতো এক কোষী জীব কিংবা আরও এক ধাপ নিচে নেমে এলে, দেখা যাবে, ভাইরাসকণা থেকে মানুষ পর্যন্ত প্রাণধারার ক্রমবিবর্তনবাদ কিংবা জয়নুলের সেই হাড় কাঁপানো দুর্ভিক্ষের ছবি কিংবা পাবলোর ছবি অথবা আরও এক ধাপ পেছনের দিকে দৃষ্টি ফেললে, দেখা যাবে, ভিঞ্চির সেই বিশ্বখ্যাত ছবি মোনালিসা কিংবা শ্যামা থেকে ঈষৎ ভিন্নার্থে কিন্তু সদর্থে সুন্দর, বোধগম্যতার অমৃত স্বাদে মেশানো অগম্যতার মাধুরী; পরিতৃপ্ত করে কেবল বৃদ্ধিকে নয়, রহস্যবোধকেও ব্যাপক অর্থে রসবোধকেও। আবার কোনো সাহিত্য সৃষ্টিতে যদি সত্যের কতকটা তির্যক কিন্তু অন্তর্গূঢ় না থাকে, তবে তা মহৎ সাহিত্যের মর্যাদা পায় না, শৌখিন বা ডেকরেটিভ এবং ডিক্লেয়ার আর্টের পর্যায়ে পড়ে, জড়োয়া গয়নার মতো দৃশ্যমান হয়েও জড়োয়া গয়নার মতোই অকিঞ্চিৎকর থেকে যায়। এ প্রসঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের হাতে গোনা কয়েকটি ছড়া-কবিতা ছাড়া তাঁর অধিকাংশ ছড়া-কবিতার উল্লেখ করা যায় এখানে। তাঁর ছড়া-কবিতায় ছন্দের টুং-টাং শুনতে বেশ লাগে, কিন্তু তার চেয়ে নিবিড় কোনো অনুভূতি জাগায় না আমাদের মনে, চিত্তে। এটা অনিবার্য সত্য যে, নির্মাণের জন্য যে নির্মোহ নৈর্ব্যক্তিকতার প্রয়োজন, এটা তাঁর মতো আরও অনেকের রচনার মধ্যে অনুপস্থিত, কেবল আছে উচ্চকিত শব্দবন্ধের মধ্যে আবর্তিত হওয়ার কৌশল; এবং একস্তরা অনুভূতি বা উপলব্ধির নির্মাণ। সাম্প্রতিক অনেক তরুণের রচনায়ও এ প্রবণতা লক্ষযোগ্য। তবে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আজীজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, ওমর আলী, বেলাল চৌধুরী, আবুল হাসান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার অমিনুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, মাহবুব সাদিক, সমুদ্র গুপ্ত; এবং ছোটগল্পে ও কথাসাহিত্যে আবু ইসহাক, শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকꦬত আলী, মাহমুদুল হক, রশীদ করীম, সেলিনা হোসেন, কায়েস আহমদ, নাসরীন জাহান, মামুন হুসাইন, নাজিম ওয়াদুদ প্রমুখের উল্লেখিত রচনা, প্রকৃত অর্থে, সৃষ্টির মোচড় অর্থাৎ স্বাক্ষর মেলে, যা একদিকে গভীর ও সুদূর ব্যাপ্তিতে গ্রন্থিত করে, পাশাপাশি শৈল্পিক মূর্চনার মাধ্যমে সামাজিকায়ন প্রক্রিয়াকেও প্রকাশ করে। সমকালীন ও ভবিষ্যৎ পাঠকের কাছে উল্লেখিত শব্দশ্রমিকদের রচনার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হওয়া জরুরি। তার স্বরূপ অন্বেষণ করার মধ্য দিয়ে আমাদের ༒সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্বের বিকাশকে ব্যাপ্তিত ও সম্প্রসারিত করে নিতে পারা যায়।
২.
এ অনিত্য জগৎ ও জীবনে কাব্যবিচারের মাপকাঠিও স্বভাবতই পরিবর্তনশীল। তাই বলে জামা-কাপড়, গয়না-গাটি নিত্যদিনের ফ্যাশনের মতো সপ্তাহে-সপ্তাহে, মাসে-মাসে, কিংবা বছরে-বছরে সাহিত্যিক মূল্যায়ন বদলায় না। যদি বদলায় তবে বুঝতে হবে নেতিবাচক আলোর কালো ছায়া আমাদের, সঙ্গে আমাদের সাহিত্য গ্রাস করে আছে। সহত্তম মূল্যের পূর্ণ মূল্যায়নে আমাদের ধৈর্য থাকতে হবে, অস্থিরতা-স্থবিরতা বর্জন করতে হবে দিগ্শূন্য ভুয়া তুলসীপাতা সাহিত্যিক ফ্যাশনের পেছনে যেন না ছুটে। একজন কবির (এবং মৌলিক) এটাই ধর্ম। তবে অনেক সময় তাকে কঠোর বা পাশবিক হতে হয়। মানবিকতাই বিশেষ পরিস্থিতিতে তাকে পাশবিক হতে শেখায়।
কবিতার সত্য জীবনের অনেক সত্যের চেয়েও, অনেক সময় মহৎ হয়ে ওঠে; এটাও সত্য, কবিতার সত্য জীবনের অন্যান্য সত্য থেকে ভিন্ন। তবে দূরের কেউ নয়। সরেজমিন তদন্ত করে অঙ্ক কষে বা বৈজ্ঞানিক কলকবজার সাহায্যে তা সাব্যস্ত করা যায় না। জীবনের অন্যান্য গূঢ় রহস্যের মতো কিংবা বাস্তব সত্যকে যুক্তি-তর্কে বা দার্শনিক জটিল মাপকাঠিতে মেপে দেখা সম্ভব নয়। কবিতার সত্য বাস্তব সত্যের চেয়েও সত্য এবং অর্থবহ। পাঠকের পরিণত পরিশীলিত হৃদয়ের গভীরে যদি সাড়া জাগে, তবে সেই হৃদয়ের স্বাক্ষরেই কবির উপলব্ধি সত্যের মর্যাদা লাভ করে। ডেকরেটিভ আর্ট, যাকে আমরা গোয়েন্দাকাহিনি নামে চিহ্নিত করি, যার একমাত্র কাজ চোখ বা কানকে খুশি করা এবং রহস্য রোমাঞ্চের হালকা ফুরফুরে হাওয়ার কৌতুক উপহার দেওয়া। অবশ্য জীবনের কোনো গভীর কিন্তু কংক্রিট ও অমূর্ত রহস্য উন্মোচন করে না। এসব সাহিত্যে জীবনের-জগতের কোনো ধরনের সত্যের দাবি করে না। এবং করতেও পারে না। এসব আর্টের সৌন্দর্যও কেবল উপরিতলের সৌন্দর্য, কিন্তু তাতে কোনো গভীরতা থাকে না। জীবনের কংক্রিটতা-অমূর্ততা কিন্তু চুম্বক-ইশারা এখানে অনুপস্থিত। এতে শুধু অ্যাডভেঞ্চারের সুড়সুড়ি থাকে, প্রায়ই তার চেয়ে কোনো নিবিড় অনুভূতি আমাদের মনে জাগায় না। তাই এসব ডেকটেটিভ আর্ট (অবশ্য আমাদের অনেকে এসবকে ডেকটেটিভ সাহিত্য বলে আখ্যায়িত করে থাকি) তার কাছে কোনো কিছু প্রাপ্তির আশা করা একেবারে অবাঞ্ছনীয়।
সত্যই সৌন্দর্যের প্রতীক। আর সৌন্দর্যের অভিব্যক্তিই হলো শিল্প। এ সম্পর্কে স্পিনোজা একটি সুন্দর কথা লিখেছেন, যা হৃদয় ও বুদ্ধিবৃত্তি উভয় প্রবাহে সুগভীর ব্যঞ্জনায় বিন্যস্ত হয়ে ফুটে ওঠে। এ যেন মানুষের সহজাত আকুতি। তিনি লিখেছেন, ‘The truth is cruel but it can be loved, and it makes free those who have loved it.’ এ সহজাত আকুতি সমুজ্জ্বল হৃদয়োপলব্ধি ও পরীক্ষিত বুদ্ধিকে অসীম কিন্তু সসীমের ব্যাপ্তিতে অভিন্ন মূর্চনায় প্রবহমান রাখে। যে সত্যকে আমরা ভালোবাসি, তাকে সুন্দর বলতে পারি। জ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিক বা বিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিক, নিরাবেগ, ব্যবহারিক জীবনের সত্যকে সুন্দর বলতে দ্বিধা হয়, কিন্তু কবিতার সত্য ও সুন্দর অভিন্নার্থ । হিংস্রতার সঙ্গে ভয়ংকরের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই। যখন জগতের-জীবনের কিংবা মানুষের কোনো সত্যকে, সুন্দরকে বা সৌন্দর্যকে সম্ভোগ করা হয় তখন তার নেতিবাচক দিক অর্থাৎ কুশ্রীতা-কদর্যতাকে, ক্লেদতা-নগ্নতাকে বাদ দিয়ে নয়। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ পরখ করার মতো সত্যের, সুন্দরের ইতিবাচক-নেতিবাচক─সব দিককে এগারো আঙুলে পরখ করা হয়। যেকোনো প্রতিভাবান কবি জগতের, জীবনের অসুন্দরকে, বেসুরতাকে আড়ালে তুলে রেখে সুন্দরের পূজা করেন না। তাদের নির্মাণ অসুন্দরের মধ্যে সুন্দরের সিম্ফনি অন্তর্লীন। তারা জীবনের, জগতের কদর্যতাকে, নগ্নতাকে, কুশ্রীতাকে অন্যার্থে বহু কৌণিক অসংলগ্নতা অসমান্তরাল অসমতা মর্মে মর্মে সম্ভোগ করেন, সূক্ষ্ম চোখের কাছে দেখেন প্রিয় পৃথিবীর অসহায় যন্ত্রণায় তিলে তিলে অবক্ষয়ের সচিত্র বায়োগ্রাফ। উদাহরণ হিসেবে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশের নাম সশ্রদ্ধ উল্লেখ করা যায়। তাঁদের কবিতায় অসুন্দরবোধ, অমঙ্গলবোধ ঈষৎ প্রচ্ছন্ন থাকলেও বোধের গভীর সামগ্রিকতা, পৃথিবীর সব মানুষের জন্য তাঁদের হৃদয় অনুকম্পিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, বিশেষত তাঁদের বেলায় এ কথা আরও সত্য এবং এ সত্যের প্রকাশ আরও ব্যাপক ও বিচিত্র। তাই জুলিয়াস সিজার, ওথেলো কিংবা কিং লিয়ারের মতো ট্র্যাজিডিকেও যখন সুন্দর বলা হয়, তখন কিন্তু যত মর্মান্তিক হোক তার ঘটনাপরম্পরা, কালবৈশাখীর বিদ্যুৎ-বিদীর্ণ কালো আকাশও সুন্দর দেখি। তখন অসুন্দর অলৌকিক সৌন্দর্যের ইশারায় বিমূর্ত হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়। সুন্দরের মধ্যে যে ভয়ংকর প্রোথিত সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসের শিরায়-শিরায়, অববাহিকাজুড়ে, তাকে জানতে হবে, নইলে কোনো সৃষ্টিই অলৌকিক মূর্চনায় নিঃসৃত হয় না। এবং এটা হবেও না। এককভাবে কোনো নির্মাণ বা সৃষ্টি আমরা সমৃদ্ধ সম্ভোগে ঘরে তুলতে পারব না। শুধু সুন্দরকে ভালোবাসা, ভালোবাসার ভগ্নাংশ মাত্র। তাতে সৃষ্টি অপূর্ণ থেকে যায়। নিঃসন্দেহে সব কবির মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা, একটা শক্তি, একটা প্রচণ্ড প্রাকৃত প্রেরণা কাজ করে; প্রতিশ্রুতি ও প্রতিভাবান কবির মধ্যে তার স্পষ্ট রূপ সূর্যের আলোর মতো প্রতিভাত হয়। সব মানুষের মধ্যেও তা অনুপস্থিত নয়, তাহলে কোনো কালে প্রতিভাবান কবির উদ্ভব ও বিবর্তন সম্ভব হতো না। কবির উদ্ভব ও ক্রমবৃদ্ধি, তার চিত্তের প্রসার ও উন্নতি সাধনই একক থেকে সমষ্টির সত্তায় প্রসারিত। একজন কবি জগতের সব বৈচিত্র্যের মধ্যে মানুষকে নিয়ে অর্থাৎ বিশেষ্যকে নিয়েই পুলকিত, আনন্দিত বা বেদনার্ত। তিনি বিশেষ্যের মধ্যে তার অন্তর্হিত অনন্য সত্যের অনিবার্য সত্যের প্রকৃত রূপটি ঈষৎ হলেও উন্মোচন করতে চান প্রতিদিনের প্রচলিত-অপ্রচলিত কারুকার্যময় শব্দের ভাষায় অথচ একটি বিস্ময়কর মহিমায় এবং অলৌকিক বিন্যস্ততায়। কিন্তু বিশেষ্যের মানুষের প্রতিদিনের কথা প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডের উচ্চারণে আকর্ষণীয় না থাকুক, গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় ধরা না পড়ুক অথবা প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে কা-কা সাদামাটা স্বর, দোয়েলের ডাক, কোকিলের গান, শাপলা, ইত্যাদি তার বিশেষত্ব ক্ষুদ্র চৌহদ্দির মধ্যে আবদ্ধ নয়, সীমাবদ্ধ নয়, তা কাব্যিক বিশেষত্ব, অর্থাৎ তা স্বধর্মত ইঙ্গিতময়, ব্যঞ্জনাময়। কিন্তু এ কিসের ব্যঞ্জনা? অবশ্য অভিজ্ঞতার অভিঘাতে কবির মনে জেগে ওঠা সূক্ষ্ম ও জটিল আবেগপুঞ্জেরই ব্যঞ্জনা। তবে আবেগ মানুষের ভেতরের অববাহিকায় অবস্থান করলেও বহিরাশ্রয়ী ব্যাপার, এবং তার আশ্রয় সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ক্ল্পানিক বস্তু বা ঘটনামাত্র। কী তবে? এটা বলা যায় যে, তা সৃষ্টির নির্দিষ্ট বিশেষ্যকে ছাপিয়ে সেই ইঙ্গিত বহুদূর প্রবহমান, বহুদূর পর্যন্ত সংবাদবাহী। কোনো কিছু নির্মাণের আগে, তা যতই ছোট হোক না কেন, কবির মনে নিশ্চয়ই অস্পষ্ট একটা ভাব প্রকাশের পথ খুঁজে ভাষার আশ্চর্য প্রণালি বেয়ে─উপকরণ, আঙ্গিক, উৎপেক্ষা ও প্রকরণের মাধ্যমে। কিন্তু মাধ্যম মাত্রেরই স্বভাবে যৎকিঞ্চিৎ দুর্বিনয় ও দুর্নম্যতা থাকে। তাতে সৃষ্টির কোনো ক্ষতি হয় বলে মনে হয় না।
সৃষ্টি মাত্রই অপূর্ণ। তাই কোনো প্রতিভাবান কবির সুখ নেই। নিরন্তর তার মধ্যে ভাঙচুর হতে থাকে। এটা এক দুঃসহ বেদনার মতো। যেমন একক ব্যক্তিতে সুখ নেই। নিজের ব্যক্তিসীমা আত্মস্থ হয়ে ছাপিয়ে উঠতে হয়, অন্যকেও দেখতে হয় তার বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিরূপে নয়। কারণ, সমষ্টির মধ্যে একক অস্তিত্ব দ্রবীভূত। তবে একক অস্তিত্ব অস্বীকার করে নয়। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে এমন সীমাহীন দেশকালে সম্প্রসারিত দৃষ্টি ও তজ্জনিত প্রশান্তি, যাকে নান্দনিক দৃষ্টি ও আনন্দ বলে চিহ্নিত করা হয় বিভিন্ন রৈখিক ব্যঞ্জনায়─কেবল কবির পক্ষেই আরক্তগম্য হতে পারে। কবি যখন সুন্দর বলে তখন ‘সুন্দর’ শব্দটি স্বভাবতই ব্যাপক বিস্তার লাভ করে, বুদ্ধির সঙ্গে হৃদয়ের ও ইন্দ্রিয়েরও ইতিবাচক মূর্চনায় মূর্ত হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে সার্ত্রের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘Man is a useless passion. তাঁকে আত্মস্থ করে বলা যায়, `Man is not only a useless passion, but s/he also possesses the intellectual passion’
এ কথা কবিদের ক্ষেত্রে আরও সত্য। আগে বলা হয়েছে সৃষ্টি অপূর্ণ। তবু অনাদিকাল থেকে অনন্তকালব্যাপী সৃষ্টিকর্ম চলে আসছে, এবং থাকবে। এই যে সৃষ্টি অপূর্ণ, আজ পর্যন্ত খুবই অপূর্ণ, নানা দোষত্রুটি বিচ্যুতি কদর্যতা রয়েছে এ পৃথিবীতে। কিন্তু জাগতিক অবিরাম পরিবর্তনের একটা ডিরেকশন আছে, একটা উদ্দেশ্য আছে। কালস্রোতে ভেসে উঠছে কত গ্রহলোক নক্ষত্রলোক, কত সৌরমণ্ডল। আরও কত কিছু। সবই চলেছে অপূর্ণ থেকে পূর্ণের দিকে। অবাধ নয় করে কোনো তবু অমোঘ যে গতি। তবে মেকি বিশ্বাসের (Make believe) ওপর ভিত্তি করে কোনো মহৎ সৃষ্টি মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। এ জন্য ভিত্তির প্রয়োজন। মহৎ বিশ্বাসই হলো তার পরম খুঁটি। তবে বিশ্বাস যুক্তি বিবেচনা বা বুদ্ধিবৃত্তির বিরোধী নয়। অন্যভাবে ঘুরিয়ে বলা যায় বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির-বুদ্ধি ও বৃত্তির যথার্থ কোনো সংঘর্ষ নেই। এ কারণে বিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তির প্রয়োগ ঘটে না। এবং এটা চলেও না। বরং বিশ্বাসকে অবলম্বন করার জন্য যুক্তির আবশ্যকতা ব্যাখ্যাহীনভাবে অপরিহার্য। কারণ, যুক্তি হচ্ছে একধরনের মানসপ্রক্রিয়া। আমি বা আমরা যা বিশ্বাস করি অথবা যা অবলম্বন করতে চাই অথবা যার প্রত্যয় আলোকিত-উদ্ভাসিত হতে চাই, তার বাস্তব রূপায়ণে অথবা প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আরও বলা চলে, সত্যকে ব্যাখ্যাযোগ্য করে তোলা। যদি সতই সর্বস্ব হয় কিংবা বিশ্বাস নিগূঢ় হয়, তবে সেই সত্য এবং বিশ্বাসের জন্য সব ধরনের যুক্তির অবতারণা করা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর দৃষ্টির সামনে জীবন ও জগতের, প্রকৃতির লীলা-বৈচিত্র্যে যে বর্ণ প্রলেপন দেখেছিলেন, সম্ভোগ করেছিলেন, হৃদয়বৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে তাকে তিনি চরম সত্য বলে মনে নিয়েছিলেন। আর মেনে নিয়েছিলেন যে, সকালবেলা ঘাসের ওপর আপতিত সূর্যরশ্মি সবুজ অথবা ঊষালগ্নে পশ্চিম দিগবলয়ে জলের কম্পমান সূর্যরশ্মি রক্তিম। নানাবিধ যুক্তির সাহায্যে তিনি এ সমস্ত ও বর্ণবিভাকে রূপ দেন। যদিও আমরা জানি যে বর্ণপ্রকরণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিগুলো সত্য নয়, তবু রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিগুলো বা সিদ্ধান্তগুলোকে তাঁর বিশ্বাসের পরম সারাৎসার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ যা বিশ্বাস করতেন, তাকে তিনি নির্মাণ করেছেন। আর তা এক বিশেষ ধরনের যুক্তির রসাবেশে দেখতে পাওয়া যায় যে, তিনি তাঁর বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছেন। ঠিক একইভাবে গ্যেটে, পাবলো নেরুদা, কিটস, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ তাঁদের অর্জিত দৃষ্টিভঙ্গিকে পরম বিশ্বাসের সঙ্গে নির্মাণ করেছেন। অনুরূপ শিল্পি পল ক্লি দৃষ্টির যথার্থ তাৎপর্যকে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা কেবল ভগ্নাংশকেই পাই, পূর্ণতাকে পাই না। তাই অবিশ্বাস জাগে এবং সংশয়ে দোদুল্যমান হতে হয়। আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় এসব অনুসন্ধান করা এবং অনুসন্ধানের সাহায্যে সত্যকে ও বিশ্বাসকে আবিষ্কার করা। এটা সত্য যে, বিশ্বাস কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। বিশ্বাস হলো একটি অলৌকিক প্রজ্ঞা, যা নিত্য নৈমিত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকাশ পায় মাত্র। একজন কবি কেবল কোনো কিছু প্রকাশ করেন না, তিনি তার নিজের বলে কোনো কিছু আবিষ্কারও করেন। তিনি যখন সত্যকে (অবশ্য জীবন ও জগতের কদর্যতা-নগ্নতাকে বাদ দিয়ে নয়, এসবের মধ্য দিয়েই) অনুসন্ধান করেন তখন কিন্তু সবকিছু একসঙ্গে পায় না ক্রমান্বয়ে জীবনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিচ্ছিন্ন উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে নানারূপে প্রতিভাত হয়: ‘The poet speaks to us of one thing, but in this one thing there seems to lurk the secret of all.’
এ যেন একজন কবির সহজাত অনুচ্চারিত উচ্চারণ। আমাদেরও। যদিও একজন কবিও চান জাগতিক সমন্বয় উপলব্ধি করতে, জীবনের অসংলগ্নতার কদর্যতার নগ্নতার মধ্যে জীবনের জগতের বৈচিত্র্য দেখতে। তবে সানগ্লাস বা দূরবীক্ষণের ভেতর দিয়ে নয়, চর্ম-অস্থি আবৃত প্রাণস্পন্দনের প্রবাহে হৃদয় দিয়ে, কল্পনা তুলি দিয়ে আঁকা চিত্রের সঙ্গে চিত্র যোগ করে, যে চিত্রকল্প নির্মাণ করেন কবি, তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য অবশ্য কবির হৃদয়ভাব ও ভাবনারই প্রকাশ। কিন্তু সে ভাব ও ভাবনার নিরালম্ব নয়। আলম্বন তার মানবিক, সর্বজাগতিক বিশ্ববোধ। অর্থাৎ যত আভাসে-ইঙ্গিতে হোক, যত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হোক, শেষ অবধি কবি প্রকাশ করতে চান তার বিশিষ্ট হৃদয় তথা সমগ্র ব্যক্তিস্বরূপ দিয়ে দেখা মানুষের রূপ, জগতের রূপ এবং মানুষ ও প্রকৃতিকে নিয়ে যে ভূমা তারই রহস্যময় রূপরেখা। সে রহস্য আমাদের মনের দরজায় সর্বদাই অত্যন্ত মৃদু আঘাত করে, কিন্তু দরজা খুললে দেখা যায়—নেই, কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই। এতে অবশ্য এমন কিছু থাকে, যার স্পর্শে জগৎ ও জীবনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক, আমাদের ভাবনা ও বেদনা, আমাদের আশা-নৈরাশ্য অল্পবিস্তর জীবন্ত রূপ নিয়ে ফুটে ওঠে, সত্য হয়ে ওঠে। একজন কবিই পারে এ নিঃসঙ্গতাকে নির্মাণ করতে। সব কবির দর্প আছে, থাকবে। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু তাদের কোনো দাপট নেই। কোনো দিন ছিল না, থাকবেও না। বাইরে থেকে অদ্ভুত, দাপুটে দেখালেও ভেতরে বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ার মতো মায়াবী বৃক্ষ, পারদের মতো অভিন্ন স্ফুলিঙ্গ। তাই কবি মূলত অহিংস মানুষ। একজন কবি তার কাজের জন্য উপস্থিত প্রয়োজন সাধনের জন্য যতটা দেখা দরকার, তার বাইরে তিনি তাকান না। অবশ্য প্রয়োজনে এক পা এগিয়ে যেতে পিছপা হন না। মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরলে তার চলে না; ছোটখাটো সত্যকে নিয়ে কার নিরন্তর ভাঙচুর, দুষ্টুমি, তাতেই তার কাজ বেশি ভালো চলে। বড় সত্যের কথা তার পক্ষে সময় ও শক্তির অপব্যয়। সৃষ্টিই যার ব্রত, তিনি মিথ্যাশ্রয়ী নন কখনো, কেবল নয়-ছয় ভগ্নাংশ সত্যের ক্ষুদ্র আয়তনের ওপর তার দৃষ্টি নিবন্ধ। দৃষ্টি সংকোচনই তার জন্য শাপেবর রূপে কাজ করে। খুব বেশি দৃষ্টি প্রসারণ তার সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বিঘ্নতা সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রয়োজনে যে তিনি মুদ্রার উল্টো ভূমিকায় অবতীর্ণ হন না—এ রকম নয়। এ রকম ধারণা করাও অমূলক। এমনভাবেই যখন তিনি যেকোনো বিচ্ছিন্ন তথ্যকে সমগ্র জগতের সঙ্গে সমষ্টির সঙ্গে সামঞ্জস্যযুক্ত করেন, এবং সেই তথ্যের সীমিত রূপরেখার মধ্যে যেনও সমগ্র বিশ্বজগতের মানবজাতির সামগ্রিক স্বরূপটিকে (অবশ্য একক সত্তাকে অস্বীকার করে নয়) ত্রিকৌণিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন, তখনই তার দেখা, তার নির্মাণ সার্থক। কারণ, তিনি সত্যদ্রষ্টা নিঃসঙ্গ নির্মাতা।
দার্শনিকরা এ পর্যন্ত জগৎকে বুঝতে চেয়েছেন, তার মূল কথা হচ্ছে, জগৎকে ঢেলে সাজানো। দার্শনিকরা যেমন, কবিরাও তেমনই। তবে এখানে ‘বুঝতে চেয়েছেন’ না-বলে সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন বলা অধিক যুক্তিসংগত ও প্রাসঙ্গিক। ধনী-গরিব, পায়ের নিচে মাটিহীন মানুষ, দলবহির্ভূত-অন্তর্গত জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের স্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য এ পোড়া-ফাঁপা পৃথিবীকে, অন্তত তার সামাজিক ব্যবস্থাকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়া খুব প্রয়োজন, এ কথা কে অস্বীকার করবে? এ প্রয়োজনের ডাক কর্মীমাত্রই তার অন্তর্নিহিত কর্মীসত্তাকে উদ্বুদ্ধ করে। কবিমাত্র তার চেনা-অচেনা এ পৃথিবীকে, তাকে পরিবেষ্টিত মানুষ, জগতের বিচিত্রতা, অদেখা মুদ্রার মতো উল্টে-পাল্টে দেখতে ভালোবাসেন। উল্টে-পাল্টে দেখাই তার নিত্যদিনের মানসপ্রক্রিয়াজাত, যা লৌকিক প্রজ্ঞার সহজাত। এ স্বভাব কেউ জন্মে লাভ করে না। তাকে অর্জন করতে হয়। তেমনি স্বতঃস্ফূর্ততা, সুহৃদ্যতা ও সুরুচি কেউ জন্মে থেকে পেয়ে আসে না। অন্যান্য শ্রমযোগ্য কা✃জের মতো নিয়মিত কঠিন পরিশ্রম-অনুশীলন করতে হয়। এখানেই একজন কবি ও সাধারণ মানুষের পার্থক্য। আত্মসচেতন মানুষমাত্রই এ সত্যটি অনুধাবন করতে পারেন। আর একে আঁকড়ে ধরে একজন কবি সত্যকে অন্বেষণ করেন। এ সত্য অন্বেষণ আত্ম-সংলগ্নতা আশ্রয় সমকালীন ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করে। এর মধ্য দিয়ে কবি তার কাব্যের শিল্পভাষ্য তৈরি করে, উন্মোচিত করে সমবায়ের দিগ্বলয়, যেখানে তার অপরতার জ্ঞানভাষ্য যাপনের প্রতিবেদনের সমগ্রতাকে একীভূত করে সত্যের পরিপূরতায় অস্তিত্বে জলতরঙ্গ। কবিতা যাপনের আন্তসম্পর্ক🌼ের চিহ্ন সমবায় ও বিস্তার কবিতায় সংযোগের অভিজ্ঞান, এবং প্রতিটি শিল্প, কবিতা কিংবা যা-ই হোক, মূলত চিহ্নের মিথস্ক্রিয়া, যা জীবনের ধরতাইগুলো ভিন্ন ভিন্ন অর্থময়তায় হিরণ্ময় করে রাখে দ্বিবাচনিক বয়ানের আধার ও আধেয়কে।