লিঙ্গ নির্মাণ বলে একটি কথা আছে। বায়োলজিক্যাল লিঙ্গ খুব সাধারণ প্রাকৃতিক ♕বিষয়। মানুষ যেকোনো লিঙ্গ নিয়ে জন্মাতে পারে। কিন্তু এই যে পুরুষ-নারী ইত্যাদি নিয়ে এত মারমার কাটকাট, এসবই সমাজের তৈরি। এসব সমাজ বানায়। একটা শিশু🉐 জন্ম নেওয়ার পর সেই শিশুকে নারী অথবা পুরুষ বানানোর কাজটা করে সমাজ। সমাজ ঠিক করে দেয় নারী হবে এ রকম, পুরুষ হবে ওই রকম। হতেই হবে। এই যে কাউকে সমাজের বৈশিষ্ট্যমতে নারী বানানো, এটাই স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ। সিমোন দ্য বেভোয়ারের সেই বিখ্যাত বাণী—কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে।
এই ক্রমশ নারী হয়ে ওঠা বা স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণের প্রক্রিয়াটা কেমন? সেটা নিয়েও অনেক কথাবার্তা, আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। নারী কেমন হবে, সেটা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্ধারণ করে ꦜদিয়েছে, এখনো দিচ্ছে। সেই নীতিমালা মতেই আমরা নারী হয়ে উঠি। আ♕মাদের কন্যাসন্তানদের নারী বানাই।
প্রথমত, নারী বানানোর আগেই যে ঘটনাটা পার করতে হয় তা হলো গ্রহণ করা। ঘরে একটা মেয়ে জন্মেছে, এটা গ্রহণ করাই বিরাট ব্যাপার আজও। ✱আবার কেউ কেউ আধুনিক হয়েছেন বলে মুখে প্রকাশ করতে পারেন না, তখন বলেন, বেশ তো, মেয়ে হয়েছে। কিন্তু ক্রমাগত মা-টিকে তাগিদ দেন আরেকটি সন্তান ধারণের জন্য, যাতে পরেরটা ছেলে হলে অপূর্ণতাটা পূর্ণ হয়ে যায়। শেষাব্দি ছেলেই তো বংশে বাতি জ্বালাবে। কন্যা লক্ষ্মী, পয়মন্ত বটে, তবে তাতে বাতি জ্বলে না। বাতি জ্বলতে চাই বিদ্যুৎ। আর এই বিদ্যুৎ হলো বিজ্ঞানের বিষয়, যা পুরুষই ভালো জানে। নারীর জন্য কলা। নারী হলো সুকুমার, শিল্প, সকরুণ ও কোমল। পুরুষ ভীষণ, প্রচণ্ড, গতিশীল, উদ্ভাবক। এই হলো লিঙ্গ নির্মাণ। পুরুষ ও নারীর বৈশিষ্ট্য বাতলে দিয়ে একটু একটু করে তাদের নারীতে ও পুরুষে নির্মাণ করা।
বিজ্ঞান দখল করে রেখেছে পুরুষ। কারণ, পিতৃতন্ত্র প্রচার করে পুরুষের মাথা ভালো। নারীর উদ্ভাবনী ক্ষমতা নেই। অথচ জগতের সব উদ্ভাবনের বাবা ওই কৃষিকাজ, সেই কৃষি উদ্ভাবনই হয়েছে নারীর হাত ধরে। কৃষি না হলে মানুষ কোনো দিন সভ্যই হতো না। কৃষিকাজ এলো বলেই মানুষ খাদ্যদ্রব্য নিয়ে নিশ্চিন্ত হলো। ফলে মন দিতে পারল অন্যদিকে। একদল গবেষকের মতে, এই কৃষি যত দিন নারীর হাতে ছিল, তত দিনই মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। যখনই পুরুষ কৃষিতে দখল নিল, তখনই নারীর দিন শেষ। নারী হয়ে গেল পুরুষের হালের বলদের মতো আরেকটা পোষা প্রাণী। নারীও যা, গরুও তাই। এরপর তো শিল্পের প্রসার, বা বিপ্লব যা কিছু হয়েছে সবই প্রকৃতি ও নারীকে ছেনে শুষে পুরুষের আধিপত্য বিস্তারের🍃 কাহিনি। ইকোফেমিনিস্টরা বলেন, বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরি করে মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু ক⛦রেছে। আর এই ইঞ্জিন-ফিঞ্জিন, বিজ্ঞানের মহামহা আবিষ্কার, সবই পুরুষের। পুরুষের হাতে বিজ্ঞান ছিল বলেই পুরুষ খালি টাকা কামাতে চেয়েছে। প্রকৃতির দিকে তাকিয়েও দেখেনি। অন্যদিকে নারী প্রকৃতিকে নিয়েই বাঁচতে চায়। ধ্বংস চায় না। আধিপত্য পছন্দ করে না। কিন্তু তার পছন্দ অপছন্দ দিয়ে কী যায় আসে? সে অধস্তন, নিচু শ্রেণির। পুরুষ তার শাসক। পুরুষ তাবত দুনিয়ার শাসক।
এই যে পুরুষের মাসকুলিনিটি, পৌরুষ, এটা নির্মাণ করে সমাজ। ছেলেসন্তানের হাতে খেলনা রিভলভার ধরিয়ে দিয়ে বাবা-মা বলে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলো সোনা’। ছেলের যুদ্ধ শুরু হয়। পুরো পৃথিবীর ওপরে তার সমাজরচিত পৌরুষ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার শিক্ষা মা-বাবার হাত ধরে শুরু। এরপর তার শিশ্নপূজা, সে-ও তো সমাজেরই। সমাজ তার পুরুষ লিঙ্গটিকে মহার্ঘ্য ভ🐎াবতে শেখায়। পাশে খেলতে থাকা ছোট বোনটির এই শিশ্ন নেই। পুরুষ শৈশবে জেনে যায়, নারী ও পুরুষ আলাদা, এবং বিষয়টি খুবই গুরুতর। ফ্রয়েড আবার এই শিশ্ন নিয়ে নারী পুরুষে হিংসে তত্ত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, পুরুষ শিশ্নটি নারীর ঈর্ষার কারণ। ফ্রয়েডের এই তত্ত্ব সমাদরে গৃহীত এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে, অথচ বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর বিখ্যাত ‘ম্যারেজ অ্যান্ড মোরালস’ বইয়ে লিখেছেন, এই যে ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের শরীর নিয়ে রাখঢাক ঢাকগুড়গুড় বাদ্যি বাজানো, এই যে কার লিঙ্গ কী, এই গর্বটর্ব—এসব🌺ই যৌনতা নিয়ে অযথাই একধরনের অবদমন তৈরি করে দেয়। বরং শরীর নিয়ে যদি এসব ফিসফাস গোপনীয়তা না হতো, তবেই মানুষ আরেকটি মানুষকে তার শারীরিক বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যসহই নিতান্ত একজন মানুষ ভেবে বড় হতে পারত। কে ছেলে আর কে মেয়ে, এই নিয়ে ভেবে ভেবে রাজ্যের যৌন বিকৃতি মনের ভেতরে পলি ফেলত না।
ফ্রয়েড বলুন, কি অ্যারিস্টটল, কি প্লেটো—তারা সমাজ নির্মাণের ছক কেটেছেন নারী পুরুষ-লিঙ্গ নির্মাণ করেই। আর তাদের আদর্শ সমাজে পুরুষই চালক। অ্যারিস্টটলের মতে, নারীর থাকতে হবে পুরুষের নিচে। কারণ, পুরুষই শ্রেষ্ঠ। সে কারণে ওই শিশ্নপূজা বলুন, কি পুরুষের আদর্শ শাসক হয়ে ওঠার প্রবৃত্তি নির্মাণ বলুন—সবই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লিঙ্গ নির্মাণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। হাজার হাজার বছর ধরেই এই লিঙ্গ নির্মাণ। তাই নারী যখন হাঁটে, তখন তার মাথা নিচু, মেরুদণ্ড বাঁকা। এটাই সতীর লক্ষণ, ভালো মেয়ের চিহ্ন। আর পুরুষ হাঁটবে সিনা টান করে, ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে দাঁড়াবে আর গাঁক গাঁক করে চ্যাঁচাবে। তবেই সে পুরুষ। নারী যদি বুক টান করে, নারী যদি জোরে কথা বলে, নারী যদি রুখে দাঁড়ায় তবেই সব্বোনাশ, যুগ যুগ ধরে অ্যারিস্টটল, প্লেটো, ফ্রয়েড থেকে শুরু করে ধর্মগুরু, প্রচারক, সমাজের বড় বড় মাথাদের কেটে দেওয়া ছক থেকে টুপ করে পড়ে গেল ব্যস! সেই নারী তখন নষ্টা, কুলটা, খারাপ, অসতী ও ভ্রষ্টা। ভ্রষ্টা মানে পতিতা। মানে সে পতিত। নারী পতিত হয় সমাজের নিয়ম না মানলে। পতিত হওয়া খারাপ। তাই আমাদের কন্যাসন্তানকে আমরা সতী হওয়ার শিক্ষা দিই। এই সতীত্বের দাবি মেটাতে গিয়ে মেয়েটির পোশাক থেকে শুরু করে তার চলা, বলা, নড়াচড়া সবই আমরা নিয়ন্ত্রণ করি। যে নিয়ন্ত্রণের রাক্ষস ছেলেসন্তানকে খায় না। তীব্র গরমে ছোট একটা প্যান্ট পরে সাইকেল নিয়ে শোঁ শোঁ করে পুরো মহল্লা ঘুরে আসে পুত্রধন। মেয়েটি তখন জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ায়। পরনে ফ্রিল দেওয়া কামিজ সালোয়ার, চুলের ভারে ঘাম চুইয়ে পড়ে। তবু ত🌱াকে মেয়ে হতে হবে। চুলে ত্বকে সৌন্দর্যের ঝিলিক না এলে মেয়ের কদর🌜 কমে যাবে। অন্যদিকে ছেলেটি দিনরাত রোদে পুড়ে জ্বলে গেলেও ক্ষতি নেই। সেটাই পুরুষালি। এটাই সমাজের নির্মাণ, ছক, নিয়ম।
এই নিয়ম বদলাতে হবে। লিঙ্গ নির্মাণের অসভ্য রাজনীতিকে চেনাটা তাই জরুরি। এর পেছনের খলনায়কদের কৌশলগুলো মাথায় ঢোকানো জরুরি। পিতৃতন্ত্র🎃 হলো নারীকে দমন আর গ্রাস করে নেওয়ার সুদীর্ঘ এক প্রক্রিয়া, এক সিস্টেম। এই সিস্টেম ভাঙতে হবে। না হলে মুক্তি নেই।
লেখক: সম্পাদক, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর