আওয়ামী সরকারের পতনের পর দেশ যে অরাজক পরিস্থিতির মুখে পড়েছে; অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পরই সেই অরাজকতার অবসান হবে, তেমনটি যদিও আশা করেনি কেউ, তবু আশা করা হয়েছিল যে হঠাৎ সৃষ্ট এই বিশৃঙ্খলার জীনে দ্রুতই লাগাম পরাতে সক♈্ষম হবে এই সরকার; গ্রহণ করবে দ্রুত কার্যকর কিছু উদ্যোগ, কিন্তু বাস্তবে তেমনটি হয়নি, এই সরকারের বিশৃঙ্খলা দমনের ব্যাপারটি অত্যন্ত ধীর ও অগোছালো। ফলে জনমনে ক্রমশ রোপিত হতে শুরু করেছে হতাশার বীজ, উঁকি দিতে শুরু করেছে নানান প্রশ্ন।
সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘটমান অনভিপ্রেত ঘটনাগুলোতেও জনমনে দেখা দিয়েছে অসন♎্তোষ ও বিতর্ক, বিরোধীপক্ষকে করে দিয়েছে সমালোচনার মোক্ষম সুযোগ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন আমাদের কাছে একটি পবিত্র স্থান, তেমনি শিক্ষকরাও আমাদের পরম শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ও দুর্নীতি যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো অশোভন ও বিব্রতকর বিষয়টিও কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে বিষয়টি যেন ডালভাত হয়ে গেছে, শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা, রাজি না হলে শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। যদিও বলপ্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পদত্যাগ করানোর ঘটনায় গত ২৫ আগস্ট শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তার প্রতিক্রিয়া জানানোর পর এই উদ্যোগে খানিকটা ভাটা পড়েছে। শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের কারও বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত অভিযোগ থাকলে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন করে পদায়ন ও নিয়োগের কার্যক্রম চলছে। জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা পেতে অসুবিধা হবে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ম-বিধি অনুযায়ী পদায়ন ও বদল করা হয়। তাদের বলপূর্বক পদত্যাগ করানোಌর সুযোগ নেই।’
এই ঘটনাগুলোর জের ধরে শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা অনেকটাই টালমাটাল। শিক্ষক-ছাত্রের চিরাচ𝔍রিত যে সম্পর্ক তাতে চির ধরেছে, দেখা দিয়েছে সন্দেহ, অবিশ্বাস, অনিরাপত্তাবোধ, যা শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের জন্যই অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর, অমঙ্গলকর। সমাজে প্রচলিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যে মধুর সম্পর্কের ধারণা, যা আমরা দেখে এসেছি সচ🍰রাচর, সেই সম্পর্কের এমন অবনমন যেমন কাম্য নয়, তেমনি তা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু, যা যে কোনো বিবেকবান মানুষকেই বিব্রত করে, ব্যথিত করে। কিন্তু সেই সঙ্গে কিছু প্রশ্নও কি জাগে না আমাদের মনে—কেন শিক্ষাগুরুর এই অমর্যাদা? কেন হঠাৎ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে এইসব শিক্ষার্থীরা? যে শিক্ষার্থী এখনো কৈশোর পেরোয়নি, যে শিক্ষার্থীর চোখে-মুখে স্বর্গীয় সারল্যের দ্যুতি, দুদিন আগেও যে শিক্ষকের চোখের দিকে তাকিয়ে সে কথা বলেনি ভয়ে, সে কেন হঠাৎ চড়াও হল তারই শিক্ষকের ওপর? কেন সে চাইছে তার শিক্ষকের পদত্যাগ? এসবের পেছনের কারণগুলো আসলে কী? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দুটি ঘটনা বলি তাহলে।
প্রথম ঘটনাটি এমন, মফস্বলের একটি এমপিওভুক্ত কলেজের একজন শিক্ষক নিয়মতান্ত্রিকভাবে অবসরে গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই তার পদটি শূন্য। একই কলেজে একজন অবৈতনিক (নন-এমপিও) শিক্ষক আছেন যিনি সবদিক দিয়েই যোগ্য, এই শূন্য পদে তিনি নিয়োগ পেতে পারেন, আইনানুগভাবেই সেটা করা সম্ভব, কিন্তু কলেজ কমিটির কয়েকজন অর্থলোভী সদস্যꩵ আর কলেজের কিছু অসৎ শিক্ষকের যোগসাজশে সেটি ভেস্তে যায়। তারা ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের দিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর করায়, শিক্ষার্থীরা সরল বিশ্বাসে স্বাক্ষর করে। পরে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা উক্ত অবৈতনিক শিক্ষককে অযোগ্য মꦰনে করে, তাকে শিক্ষক হিশেবে চায় না মর্মে কলেজ কর্তৃপক্ষকে লিখিত আকারে অভিযোগ দিয়েছে, যে কারণে ওই শিক্ষকের এমপিও হয়নি, তিনি এখনো নন এমপিও আছেন, এমপিও শিক্ষকের পদটি এখনো শূন্য রয়ে গেছে, যেহেতু এখন সব নিয়োগই এনটিআরসি-এর মাধ্যমে হয়, তাই উক্ত শিক্ষকের পদটি তারা এনটিআরসি-তে শূন্যও দেখাচ্ছে না ওই নন-এমপিও শিক্ষকের কাছ থেকে কিছু মোটা অংকের মালপানি আদায়ের ধান্দায়। শিক্ষার্থীদের এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা এই ব্যাপারে কিছুই জানে বলে জানায়। অথচ তাদের দোহাই দিয়ে উক্ত শিক্ষককে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে এবং শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে শিক্ষার্থীদেরও বঞ্চিত করা হচ্ছে শিক্ষা থেকে। যা ভয়ানক অন্যায়।
দ্বিতীয় ঘটনাটির চিত্র ঠিক উল্টো। নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী স্কুল থেকে বাসায় ফিরে তার অভিভাবককে জানাল আজ তারা স্কুলে একজন শিক্ষকের পদত্যাগের জন্য আন্দোলন করেছে। স্বাভাবিক কারণেই অভিভাবক রেগে গেলেন, কারণ দেশে চলমান অরাজকতায় শিক্ষকদের যেভাবে অপমান, অপদস্থ করা হচ্ছে তাতে নিজের সন্তান জড়িত হোক এটা কোনোভাবেই তিনি সমর্থন করতে পারেন না। তিনি এই আন্দোলনের কারণ জানতে চাইলেন। শিক্ষার্থী প্রথমে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলেও অভিভাবকের জেরার মুখে জানাল যে বিষয়টি যৌনহেনস্তামূলক, উক্ত শিক্ষক তাদের এক মেয়ে সহপাঠীকে একটা রুমে একা ডেকে নিয়ে আপত্তিকর আচরণ করেছে এবং এ কারণে তারা নবম-দশম শ্রেণির সব শিক্ষার্থী উক্ত শিক্ষকের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন করেছে। অভিভাবক জানতে চাইলেন, তারা যে অভিযোগের ভিত্তিতে আন্দোলন করেছে তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ কি আছে? জবাব পাওয়া গেল অনেক প্রমাণ আছে। তারা কীভাবে আন্দোলন করেছে? তাদের আন্দোলনের ধরণটা কেমন ছিল? জানতে চাইলে জানা গেল, তারা অধ্যক্ষের কাছে গিয়ে তাদের দাবি জানিয়েছে এবং তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত তারা অ🗹ধ্যক্ষের কক্ষের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। তখন অধ্যক্ষ স্কুলের সব শিক্ষকদের সঙ্গে মিটিং করে অভিযুক্ত শিক্ষককে আপাতত চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে উক্ত শিক্ষককে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে, চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হবে মর্মে শিক্ষার্থীদের কাছে অঙ্গিকার করেছেন।
ঘটনা দুটি মিথ্যে নয়। প্রথম ঘটনাটিতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের অজান্তেই ব্যবহৃত হয়েছে। এবং পরবর্তীতে মূল ঘটনা জানতে পেরে তারা শিক্ষকদের অসতত𒈔া ও দুর্নীতিতে তাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও বিমুখ হয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনাটিতে শিক্ষকের অনৈতিক আচরণে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন তা একটি নিয়মতান্ত্রিকতার ভেতর দিয়ে হয়েছে ফলে তাদের এই আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো সুযোগ নেই।
এবার♋ আসি শিক্ষক হেনস্তার বিষয়ে। এই যে শিক্ষকদের হেনস্তা করা হচ্ছে, তাদেরকে নানাভাবে অপমান, অসম্মান করে তা আবার সোস্যাল মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে, এগুলো মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর পেছনে যতটা আছে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা তার চেয়ে বেশি আছে স্বার্থান্বেষী মহলের হাত, যাদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বৈষ্যম্যবিরোধী আন্দোলনে অনেক শিক্ষকই সক্রিয় সমর্থন দিয়েছেন, অনেকে চাকরি বাঁচাতে মৌন সমর্থন দিয়েছেন, অনেকে নীরব থেকেছেন, অনেকে বিরোধিতা করে তৎকালীন নিপীড়ক সরকারের পক্ষেও কাজ করেছেন, কোনোটাই অস্বীকারযোগ্য নয়। আর প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব পছন্দ আছে, সে কাকে সমর্থন করবে বা করবে না সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত অভিরুচি, আর শিক্ষক মাত্রই মানুষ বৈ তো নয়। আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে শিক্ষকেরা দেবতা নন, তাদেরও ভুল হয়, তারাও নানান অনিয়ম, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করতে পারেন, বিবেকবর্জিত কোনো কাজে লিপ্ত হতে পারেন। সেক্ষেত্রেও কি শিক্ষক বলেই ছাড় পেয়ে যেতে পারেন তারা? শুধু শিক্ষক বলেই তাদের সব অন্যায়কে মেনে নিয়ে তবু কি শ্রদ্ধায় নত হব আমরা? মোটেই না। অবশ্যই তাদের শাস্তি চাইব, চাইব তাদের উপযুক্ত বিচার। কিন্তু সেটা কীভাবে? দেশে তো আইন আছে, বিচারব্যবস্থা আছে, আমরা সেখানে গিয়ে প্রতিকার চাইব, যতক্ষণ পর্যন্ত দোষী ব্যক্তিটি উপযুক্ত শাস্তির আওতায় না আসবেন ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের দাবিতে সরব থাকব, কিন্তু কোনোভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেব না, নিতে পারি না। সে অধিকার আমাদের নেই, যদি সেটা করি তাহলে আইনের চোখে সেটাও অপরাধ, সেক্ষেত্রে আমরাও অপরাধী হয়ে যাব। এবং শিক্ষার্থীরা যত দ্রুত এই কথাটি বুঝবেন ততই সবার মঙ্গল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কগণ শিক্ষার্থীদের এই হঠকারিতাকে সমর্থন করেন না বলে বিবৃতি দিয়েছেন, সরকারপক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। আশা করা যায় এবার শিক্ষার্থীগণ সচেতন হবেন।
পরিশেষে বলা যায় সে, শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর সম্পর্কের মধ্যে যে ভয়, অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব আর অশ্রদ্ধার ভাব দানা বেঁধে উঠেছে তা যেমন একদিনে হয়নি, তেমনি হঠাৎ করে তা দূর করাও অসম্ভব। শিক্ষকদের চিরাচরিত যে মূর্তি আমাদের মানসপটে আঁকা, তা শ্রদ্ধার, সম্মানের। শিক্ষকগণ আমাদের শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতার পাঠ দেন, মানসিকℱ উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেই শিক্ষক যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন, আদর্শচ্যুত হন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যায় আচরণে অভ্যস্ত হন তবে তিনি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধার্হ না হয়ে ঘৃণার পাত্র হবেন সেটাই স্বাভাবিক, এবং এটা অস্বীকার করার উপায় নাই যে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনাগুলোর অধিকাংশের পেছনেই এমন কিছু কারণ লুকিয়ে আছে, যা শিক্ষক সমাজের জন্যও লজ্জা ও দুঃখের।
সরকারের উচিত শিক্ষকদের নৈতিকতা এবং শিক্ষকসুলভ আচরণ বিষয়ক বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, যা ভবিষ্যতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। আর শিক্ষ💞ার্থীদেরও যে কোনো ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায় করার জন্য আন্দোলনের প্রয়োজন হলে তা নিয়মতান্ত্রিকভাবে, নিজেদের সংযত রেখে করা দরকার। সেটাই কাম্য ও শোভন।
লেখক : কথাশিল্পী ও শিক্ষক