ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে বাংলা ভাষায় রায় দিয়েꦚছেন হাইকোর্ট। ভাষা শহিদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে ভাষার মাসের শুরুর দিনে এই রায় ঘোষণা করেছেন বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলম সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায় ঘোষণার সময়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নাইমা হায়দার বলেন, “আজ ১ ফেব্রুয়ারি। ভাষার মাস আজ থেকে শুরু। ভাষা শহিদদের আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়ে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতি সম্মান জানিয়ে আজকের প্রথম রায়টি বাংলায় ঘোষণা করছি🎀।”
দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে রায় ও আদেশ অধিকাংশ বাংলায় দেওয়া হলেও উচ্চ আদালতে প্রাধান্য পায় ইংরেজিই। আইনি প্রতিশব্দের বেশির ভাগই বাংলায় না থাকা এর অন্যতম কারণের পাশাপাশি আছে দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ব্যাপারও। তাই প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও উচ্চ আদালতে রায়ের প্রধান ভাষা বাংলা হতে পারেনি। কিংবা এই দিকটাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাই বাংলায় দেওয়া যেকোনো রায়কে এখনও প্রতীকী হিসেবে দে꧂খতে হচ্ছে। আজকের এই রায়ও তাই। তবে উচ্চ আদালতে এটাই প্রথম বাংলায় দেওয়া রায় নয়, এর আগে অতি গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো মামলার রায় বাংলায় দিয়েছেন বেশ ক’জন বিচারপতিরা।
ভাষার প্রচলন নিয়ে আইনও আছে দেশে। কিন্তু এই আইন সকল জায়গায় সমানভাবে কার্যকর কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭-এর ‘প্রবর্তন ও কার্যকরী’ অংশের ৩(১) বলছে, “এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্র💃ে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে.” এবং (২) “৩(১) উপ-ধারায় উল্লেখিত কোন কর্ম স্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।”
আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশনা চেয়ে একটি রিটও হয়েছিল হাইকোর্টে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দের সেই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রুল জারি করা হলেও এখনও ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি হয়নি। ফলে এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি উচ্চ আদালত থেকে। এদিকে, সংবিধান যখন বলছে প্রজাতন্ত্রের ভাষা হবে বাংলা, যখন বাংলা ভাষা প্রচলন নিয়ে একটা আইন আছে দেশে তখন কি উচ্চ আদালত এটাকে এড়িয়ে যেতে পারেন? এখানে বাংলায় আইনের প্রতিশব্দের সীমাবদ্ধতা নꦫিয়ে কথা আসতে পারে, কথা আসতে পারে সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতির🌄া স্বাধীন এই কথাও তবে উচ্চ আদালত নিশ্চয়ই সংবিধান ও দেশের আইনের বাইরে নয়।
বিচারপতিরা স্♛বাধীন, এই যুক্তিতে তারা সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রভাষার বাইরে থাকতে পারেন? এখানে রাষ্ট্রভাষা, সরকারের ভাষা বা নির্বাহী ভাষা, আদালতের ভাষা হিসেবে ভাষার প্রকারভেদ নিয়ে যে কথা সামনে আসে সেটা কতখানি যৌক্তিক? প্রশ্ন আমাদের।
বাংলাবান্ধব বিচারব্যবস্থা গড়তে সমস্যা কোথায়? রাষ্ট্রভাষা বাংলার দেশে ইংরেজিতে দেওয়া রায় কতজনইবা বুঝতে পারেন, ক’জন বিচারপ্রার্থী বুঝতে পারেন? অথচ আদালতের এই রায় বিচারপ্রার্থীদের জন্যেই। মানুষ আদালতে আসেন🀅 আইনি প্রতিকার পেতে। যারা আসছেন তাদে🌺র কাছে অবোধগম্য ভাষায় রায়-আদেশ দেওয়া হলে সেখান থেকে বিনা ভোগান্তিতে কীভাবে তারা উপকৃত হবেন?
ইংরেজি ভাষার আন্তর্জাতিক উপযোগিতা রয়েছে। উচ্চ আদালতের অনেক রায় অনেক ক্ষেত্রে সীমান্ত ছাড়িয়ে দেশে-দেশে উদ🤪াহরণ হয়, এটাও স্বীকৃত। তবে বিচারপ্রার্থীদের কাছে কতখানি বোধগম্য এবং সেখান থেকে কতখানি উপকৃত হলো তারা সেটাও নিশ্চয়ই কম জরুরি নয়। বাংলাকে অগ্রাহ্য করে কিংবা কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখে এখানে ভিন ভাষায় দেওয়া রায়গুলো বিচারপ্রার্থীর কাছে বোধগম্য হচ্ছে কিনা সেটাও দেখা 🐟কি জরুরি নয়?
ইংরেজিতে দেওয়া রায় দীর্ঘদিনের অনুশীলন। এটা যতখানি আন্তর্জাতিক রূপের তারচেয়ে বেশি ঔপনিবেশিক আমলের ধারা বলেই ধারণা। বেশিরভাগ আইন ও আইনের প্রতিশব্দ বাংলায় নেই এটা একটা কারণ হতে পারে, তবে এই ধারা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত বলে মনে করি। এ নিয়ে যে কাজ হয়নি তাও না। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের সকল রায় বাংলায় রূপান্তরের জন্যে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার শুরু হয়েছে। এরআগে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইন কমিশন বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ বাস্তবায়নে কিছু সুপারিশমালা পেশ করেছে। কমিশন উচ্চ আদালতসহ সব আদালতের 🍎বিচারকার্যে বাংলাভাষা চালু করার সুবিধার্থে ইংরেজিতে রচিত বিদ্যমান আইনগুলো বাংলায় অনুবাদের সুপারিশ করে। এটা সম্ভবত বিবিধ কার্যাবলী শেষে বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে।
ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন ভাষা শহিদদের সম্মানের হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বাংলায় যে রায় দিয়েছেন সেটাকে প্রতীকী হিসেবে এখনও দেখতে হচ্ছে আমাদের। অথচ এমনটা হওয়া উচিত হবে না। বাংলায়ই হোক সকল রায়। যে সকল বিচারপতি ইতোমধ্যে কিছু রায় বাংলায় দিয়েছেন তারা এ ক্ষেত্রে হতে পারেন অনুকরণীয়। বিবিধ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলা ভাষাতেই রায় দেওয়া সম্ভব বলে তারা প্রমাণ করে🥃ছ𝓡েন।
সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন কেবল সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন এবং গৎবাঁধা বয়ানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সত্যিকার অর্থে এর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হইবে বাংলা” যখন সংবিধান দিচ্ছে এ ঘোষণা তখন দেশের সকল আদালতও এর আওতায় আসতে হবে। আদালতকে এর বাইরে রাখা কিংবা রাখতে চেষ্টা করা সমীচীন♏ হবে না!
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক