আমার কাছে ডিসেম্বর আসে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়ে। আনন্দের পাশে যেমন শুয়ে থাকে বেদনা, সুখের পাশে যেমন দুঃখ, তেমনি ১৬ ডিসেম্বরের উৎসবের পাশেই আছে ১৪ ডিসেম্বরের গভীর বেদনা। আমার কাছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন ১৬ ডিসেম্বর, সবচেয়ে বড় গৌরবেরও। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ,♏ ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ওঠে বিজয়ের লাল সূর্য। কিন্তু সূর্যে যে মিশে আছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের টাটকা রক্ত, সেটাও জানা যায় এই ১৬ ডিসেম্বরেই। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ছড়ানো বুদ্ধিজীবীদের ছিন্নভিন্ন দেহ, আমাদের বিজয়ের আনন্দকেই ম্লান করে দেয়। মনে করিয়ে দেয়, কত রক্ত, কত ত্যাগ, কত জীবন মিশে আছে আমাদের বিজয়ে।
নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলেও এর পেছনে আছে ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস। পাকিস্তানের জন্মের সাথেই রোপিত হয় বাংলাদেশের বীজ। ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান একটি অভিন্ন রꦚাষ্ট্র ছিল ভারতবর্ষ নামে। ব্রিটিশরা দুইশ বছরের শাসন শেষে ফিরে যেতে বাধ্য হওয়ার আগে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে ভেঙে দিয়ে যায়। সৃষ্টি হয় পাকিস্তান নামে এক অদ্ভুত রাষ্ট্রের। ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানে ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল ১১০০ মাইল। কিন্তু মানসিক দূরত্ব ছিল অলঙ্ঘনীয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা সেই দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ তো নেয়ইনি, বরং তাদের শোষণ, ব♛ঞ্চনা আর অবহেলায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে সৃষ্টি হয় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা।
মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমার কাছে এটি নিছক কথার কথা নয়। আমি মন থেকে বিশ্বাস করি, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমরা জীবনে চাইলে অনেক কিছু হতে পারবো। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবো না। মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের মায়া তুচ্ছ করে যুদ্ধ করেছিলেন বলেই আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। আমি ভাবি আর শঙ্কিত হই, সত্যি সত্যি যদি একাত্তর সালে বাংলাদেশ স্বাধীন না হᩚᩚᩚᩚᩚᩚᩚᩚᩚ𒀱ᩚᩚᩚতো, তাহলে আজ আমাদের কী হতো। মূল পাকিস্তানই আজ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। আর বঞ্চনার ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে, এ অঞ্চলের মানুষকে এখন না খেয়ে মরতে হতো। আর পাকিস্তানের সাথে থাকলে সঙ্গদোষে পাকিস্তানের পূর্ব অংশও ব্যর্থই হতো।
বাংলাদেশের বিজয়, দেশে-বিদেশে অনেকের জন্যই ছিল পরাজয়। তারা সেই পরজায় মেনে নিতে পারেনি। এমনকি বিজয়ের ৫১ বছর পরও তাদের সেই পরাজয়ের বেদনা কমেনি। স্বাধীনতার পরপর অনেকেই বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। বাংলাদেশের কেউ কেউ এখনও মনে করেন `স্বাধীন না হলেই ভালো হতো’। যদি কিসিঞ্জারদের আশঙ্কা সত্যিও হতো, তাও তো ব𓆉াংলাদেশ আমাদের দেশ; ধনী হোক, গরীব হোক, বাংলাদেশ আমার মা। মাকে তো আর ফেলে দেয়া যায় না। তারপরও যদি তাদের আশঙ্কা সত্যি হতো, বাংলাদেশ যদি সত্যি তলাবিহীন ঝুড়ি হতো, বাংলাদেশ যদি পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে থাকত; তাহলেও স্বাধীনতা বিরোধীদের `স্বাধীন না হলেই ভালো হতো’ এই মনোভাবের একটা যুক্তি পাওয়া যেত। কিন্তু সবার সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়, উন্নয়নের রোল মডেল। সব সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। কোনো কোনো সূচকে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে।
বলছিলাম স্বাধীনতা বিরোধীদের কথা। যারা এখনও অন্তরে পাকিস্তানকে লালন করে, মনে করে স্বাধীন না হলেই ভালো হতো। অবশ্য বাংলাদেশ বিরোধী মানুষ বাংলাদেশের জন্মের সময় থেকেই ছিল, বলা ভালো তার আগে থেকেই ছিল। ৭০-এর নির্বাচন আসলে ছিল বাংলাদেশের পক্ষে ম্যান্ডেট। সে নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে তা🀅রা চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। এই অংশটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের পাশে থেকে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে। স্বাধীনতার পর কিছুদিন তারা ঘাপটি মেরে ছিল। কিন্তু ৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতা বিরোধী অংশটি আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে তারা নিজেদের সংগঠিত করে, চলে আসে ক্ষমতার কাছাকাছি। জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার বদান্যতায় স্বাধীনতা বিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে ওঠে জাতীয় পতাকা। যদিও তারা কখনোই তাদের অবস্থান বদলায়নি, বাংলাদেশের অস্তিত্বকে মেনে নেয়নি। স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্তরসূরীরাও তাদের পূর্বসূরীদের আদর্শকেই ধারণ করেছে এবং ঝারে-বংশে তারা বেড়েছে। বিজয়ের ৫১ বছর পরও একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের অস্তিত্ব থাকাটাই লজ্জা ও বেদনার। বিশ্বের কোনো দেশেই স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনীতি করার সুযোগ থাকে না। আমাদের দেশে তারা শুধু সুযোগই পায়নি, বড় গলায় কথাও বলছে। যত দিন যাচ্ছে, তাদের গলাও তত চওড়া হচ্ছে যেন।
রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকবে, হানাহানি থাকবে। কিন্তু তবু বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকেরই গর্ব করা উচিত। এরপরও যারা বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে গর্ব করতে পারে না, মনে করে স্বাধীন না হলেই ভালো হতো; তাদের জন্য আমার সকল ঘৃণা আর করুণা। এই বাংলাদেশকে দাবায় রাখার সাধ্য আর কারো নেই।
যে স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন, দেশ স্বাধীন করেছিলেন; তার সব স্বপ্ন কি পূরণ হয়েছে? ৫১ বছর পর পেছন ফিরে দেখলে বুঝি অনেক অর্জন যেমন আছে, অনেক হতাশাও আছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে অনেকটাই এগিয়েছে বাংলাদেশ, তবে এখনও এই দেশে স্বাধীনতা বিরোধীরা তৎপর রয়েছে, সাম্প্রদায়িকতার শিকড় বিস্তৃত হয়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এখনও গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে অনেক অপ্রাপ্তি রয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা উদার, অসাম্প্রদায়িক, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন; সেই স্বপ্নের পথে আমাদের হেঁটে যেতে হবে আরো বহুদূর। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় এনে দিয়েছেন। এখন সেই বিজয়কে অর্থবহ করে তাঁদের স্বপ্নের পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার।