বহু দিন পর দেশে এলো একটি আন্তর্জাতিক মানের সম্মান। সেই সম্মান আবার যেন-তেন নয়। সেই সম্মান এসেছে শ্বা෴সরুদ্ধকর টানা জয়ের ভেতর দিয়েছে। বলছিলাম, দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবল (সাফ) টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের মেয়েদের অপরাজেয় চ্যাম্পিয়নশিপ প্রসঙ্গে। পুরো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের মেয়েরা⛦ প্রতিপক্ষের জালে গোল দিয়েছেন ২৩টি। জবাবে বাংলাদেশের জালে গোল ঢুকেছে মাত্র একটি। তাও ফাইনালের দিন। নেপাল দিয়েছে সেই গোল।
বাংলাদেশের মেয়েদের দেওয়া ২৩ গোলের মধ্যে গ্রুপ পর্বে মালদ্বীপের বিপক্ষে ৩-০ গোল, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬-০ গোল, ভারতের বিপক্ষে ৩-০ গোলে জয়ী হয়। এরপর ভুটানকে ৮-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে বাংলাদেশের মেয়েরা। আর ফাইনালে ৩-১ গেলে নেপালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নের শিরোপা অর্জন করে। আর এই অর্জনকে দেশের দুই শ্রেণির মানুষ দুভাবে দেখছে। প্রথম শ্রেণি দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল, ফুটপ্রেমী, সর্বোপরি নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। দ্বিতীয় শ্রেণি মৌলবাদী, গোঁড়া ও সং🉐কীর্ণ মানসিকতার।
সাবিনা-রুপনা-কৃষ্ণাদের অনবদ্য জয়ে প্রথম শ্রেণি যতটা আনন্দে উদ্বেল, ঠিক ততটাই জ্বলে-পুড়ে মরছে মৌলবাদী একটি চক্রটি। তারা ধর্মীয় বক্তব্যের ছলে এই নারী খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে সাধারণ ধর্মভীরুদের উসকানি দিয়ে উত্তেজিত করে তোলা অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বলছে, এই ‘হাফ-প্যান্ট’ পরা নারীরা সাফজয়ের মধ্যে দিয়ে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেনি। বরং সারাবিশ্ব নাকি লজ্জায় মাথা হেঁট করে বাংলাদেশের নারীদের ‘লানৎ’ দিಞয়ে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, দেশের এত বড় জয়-গৌরবের পরও কতিপয় নিন্দুকের এমন বিষোদগারের কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কয়েকটি বিষয়টি সামনে আসবে।
১. অশিক্ষা-কুশিক্ষা
২. ধর্মান্ধতা
৩.পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা-নারীবিদ্বেষ
এই জয়ে নারী ফুটবলারদের বাংলাদেশ তো বটে, পুরো দক্ষিণ এশিয়া যখন প্রশংসায় বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে, তখন একদল কূপমণ্ডূক এই খেলো♏য়াড়দের ‘লানৎ’ দেওয়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। এর কারণ একটাই। অশিক্ষা-কুশিক্ষা। এই কূপমণ্ডূকদের বদ্ধমূল ধারণা, মেয়েরা থাকবে রান্নাঘরে। করবে ভাত-মাছ রান্না। পরিবেশন করবে পুরুষকে। বড়জোর থাকবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষার্থীদের পড়াবে। সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে ‘স্বামীপ্রভূ’র পদসেবা করবে। কিন্তু এসব ‘প্রথাগত সেবাকর্মে’ এই নারীরা নিযুক্ত না থেকে হয়ে উঠছে ‘বেপরোয়া’। তারা যাচ্ছে পুরুষদের মতো ফুটবল খেলতে। তাও হাফপ্যান্ট পরে। এখানে অশিক্ষাচ্ছন্ন-কুশিক্ষান্ধরা পোশাককে যেমন দুষছে, তেমনি খেলাকেও ‘পাপ’ হিসেবে দেখছে। সুশিক্ষার অভাব এই কুপমণ্ডূকদের এতটাই উদগ্র করে তুলেছে যে, তারা খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চা, জ্ঞানচর্চা, শিল্পচর্চার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এটি তাদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক-সামাজিক-অপসংস্কৃতি অভ্যাসের ফল যতটা, তারও বেশি তাদের মজ্জাগত। সুশিক্ষারও অভাব।
দ্বিতীয় কারণ ধর্মান্ধতা। ঠুনকো ধর্মের প্রাচীন ও ভঙ্গুর রীতিনীতির দোহাই দিয়ে মানববিদ্বেষীরা নারীকে সবসময় গৃহবন্দি করেই রাখতে চেয়েছে। তাদের সেই চক্রব্যূহ ভেদ করে নারীরা যখন ঘরের বাইরে এলো, তখনই ধর্মান্ধরা ক্রোধান্ধ হয়ে উঠলো। আর হাফপ্যান্ট পরে যখন বিশাল স্টেডিয়ামে ফুটবলে লাথি মেরে নান্দনিক দৃশ্যাবলী রচনা করে চলেছিল, তখন ধর্মান্ধরা আঁতকে উঠলো। এই নারীরা যতবার ফুটবলে কিক দিয়েছে, ততবারই মৌলবাদীদের দিলে সেই লাথি লেগেছে। তারা ব🎐িষ💛য়টি মেনে নিতে পারেনি। তাদের কামুক-চিত্ত চিরকাল বলে এসেছে নারী হলো ভোগ্যপণ্য, কোমল পণ্য। নারীর হাতে থাকবে ‘স্বামী-প্রভুর’ পরানো শেকল, পায়ে থাকবে বেড়ি। তারা কী করে ঘরের বাইরে এসে ফুটবলে লাথি দিতে পারে!
বিষয়টি এই ধর্মান্ধদের বিচলিত করে তুলেছে। তাই তারা ক্ষেপে উঠেছে। তাই তারা এই মায়ের জাতির অগ্রগতির পথকে রুদ্ধ করে দিꦡতে চেয়েছে। কিন্তু যুগে যুগে যতই মৌলবাদী-ধর্মান্ধ-ধর্মগুরু-পুরোহিতরা নারীকে দাসী বানিয়ে রাখতে চেয়েছে, ততই তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায়, শিল্পকলায় স্বীয়মহিমায় উজ্জ🍸্বল হয়ে উঠেছে। বাহুবলে জেগে উঠেছে। এই জেগে ওঠা কিংবা জ্বলে ওঠা, কোনোটাই মেনে নিতে পারেনি ধর্ম ব্যবসায়ীরা। তাই তারা পদে পদে বাধা দিতে চেয়েছে।
এই কথা অস্বীকার করার জো নেই, বহুযুগ ধরে পুরুষতন্ত্রের পদানত এই পৃথিবী। বিশেষত এই ভূ-খণ্ড। এই ভূ-খণ্ডে নারীকে একতাল মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছুই মনꦿে করা হয় না। পুরুষতন্ত্রের ধারক-বাহক পুরুষরা যেমন, তেমনি তাদের সহচরী নারীরাও নারীকে কেবল ভোগ্যপণ্যই মনে করে। তাই নারীর ইচ্ছাকে অবদমিত করে রাখতে পুরুষতন্ত্র নানা আয়োজন করে। সেসবಞ আয়োজনে সর্বাত্মক সহযোগিতাও দেয়, পুরুষতন্ত্রের সহচর এক শ্রেণির নারীও। আর সহজ-অবলা নারীরা যতক্ষণ পুরুষতন্ত্রের প্রভুত্ব স্বীকার করে, ততক্ষণ নারীদের প্রশংসায় তাবৎ দুনিয়া পঞ্চমুখ থাকে। কিন্তু যেখানে নারী আপন মহিমায় জ্বলে ওঠে, সেখানেই পুরুষতন্ত্রের রব ওঠে, ‘গেলো’, ‘গেলো’!
পুরুষতন্ত্রের অধিকাংশই আবার নারীবিদ্বেষী। নারী বিদ্বেষের যৌক্তিক কা🌌রণ স্পষ্ট না হলেও কিছু প্রচ্ছন্ন কারণ রয়েছে। এরমধ্যে নারীকে শর্তহীনভাবে ভোগ করা, ভোগ শেষে টিস্যুর মতো ছুড়ে ফেলার ইচ্ছা পুরুষতন্ত্রের আদিমতম ইচ্ছার একটি। নারীকে টিস্যুর মতো ব্যবহার করতে হলে, নারীকে হতে হবে নাদুস-নুদুস খরগোসের ছানার মতো। পুরুষ তাকে পুতুলের মতো হাতে তুলে আদর করবে, আদর শেষে ছুড়ে ফেলবে। কিন্তু যদি তার ভেতরের শক্তিতে জেগে ওঠে, তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে, তাহলে পুরুষ-নারীর উভয়ই শক্তিতে সমান হয়ে যাবে। সেই শক্তি শারীরিক যেমন, তেমনি বুদ্ধিবৃত্ত🐟িকও। আচরণে যেমন, তেমনি কর্মেও। পুরোহিত-মোল্লাতন্ত্রের ভয়টা ঠিক এখানেই।
এই মোল্লা-পুরোহিতদের একটাই সমস্যা—জগতে যা কিছুই ঘটুক, তারা সেই সব কিছুর বিচার করবে স্ব-স্ব ধর্মের নিক্তি দিয়ে। তারা একবারও ভেবে দেখে না, জগতে তাদের ধর্মের অনুসারী ছাড়াও বহু ধর্মের মানুষ বাস করে। এমন প্রতিটি ধর্মের মানুষই তার নিজের ধর্মকে একমাত্র বিশুদ্ধ ধর্ম দাবি করে। একইসঙ্গে নিজ নিজ ধর্মের বাটখারা দিয়েই পাপপুণ্যের হিসাব করে। সব ধর্মের বাটখারা আবার সমান সাইজের নয় যেমন, তেমনি সমান ওজনেরও নয়। তাই এক ধর্মে যেটা পাপ, অন্য ধর্মের কাছে সেটাই পুণ্য। যেমন, পৌত্তলিকদের কাছে মূর্তি হলো ভগবান-ঈশ্বরের প্রতীক, তারা সেই মূর্তি সামনে রেখে পূজা করে। আবার একেশ্বরবাদীদের কাছে মূর্তি হলো হারাম বা নিষিদ্ধ, মূর্তিপূজাকে তারা শিরক মনে করে। শিরক একেশ্বরবাদীদের কাছে জঘন্যতম পাপ। ফলে এক ধর্মের লোকের কাছে যা ইবাদত বা পুণ্য, অন্য ধর্মের লোকের কাছে💫 তা-ই পাপ বা অপরাধ। ফলে কোনো একটি ঘটনা ঘটলে যেমন এক ধর্মের লোক গেলো গেলো বলে তারস্বরে চিৎকার করে, অন্য ধর্মের লোক তেমনি স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
কোনো ধর্মান্ধই এটা মানতে চায় না—শেষপর্যন্ত ধর্ম হলো ব্যক༒্তিগত পালনীয় বিষয়, কোনোভাবেই সামষ্টিকভাবে আচরণীয় নয়। কিন্তু মোল্লা-পুরোহিতরা ব্যক্তিগত বিষয়কে জোর করে সামষ্টিকে পরিণত করতে গিয়েই যত গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলে। যেমন ইসলাম ধর্মের মোল্লা পারলে খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ-হিন্দু নারীকেও হিজাব পরানোর ফতোয়া 🔯দিয়ে বসেন, তেমনি হিন্দুধর্মে পুরোহিত পারলে মুসলমান-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ নারীকে শাঁখাসিঁদুর পরিয়ে ছাড়তে চান। দ্বন্দ্বটা সেখানেই বাধে।
আর সেই হীন মানসিকতার নীচু প্রকৃতির পুরুষতౠন্ত্রের প্রতিনিধিরাই আজ সাফ চ্যাম্পিয়ন নারীদের বিরুদ্ধে বিষোদগারে নেমেছে। এই শ্রেণি লাউড স্পিকার দিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কথার জালে শিল্পকলা, খেলাধুলা, সুকুমারবৃত্তি, মানবপ্রেম ও নারীর প্রতি সাধারণ ধর্মভীরুদের উসকানি দিচ্ছে, যেন তারা স্বাধীনচেতা ও ক্রীড়ামোদী নারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। একইসঙ্গে নারীদের বিদ্রূপ করে। সময় এসেছে, দ্রুত নারীবিদ্বেষী এসব মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ দমনের। সরℱকারকে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক: কবি-প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক।