১.
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শৈশব থেকে ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী। প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা বা চিন্তা ছিল সুগভীর। প্রকৃতি ও পরিবেশের অন্যতম নিয়ামক হলো গাছ। পরিবেশ রক্ষা ও বাংলাদেশকে বৃক্ষসম্পদে সমৃদ্ধকরণে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ আগ্রহের বিষয় ছিল এই গাছ। এটা স্বাধীনতার আগে ও পরে দুই পর্বেই দেখা যায়। পাকিস্তান শাসনামলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের রক্ষাকবচ হিসেবে খ্যাত সুন্দরবনের গাছ রক্ষায় বঙ্গবন্ধু বলিষ্ঠভাবে চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক মামলায় কারাগারে কাটানো দিনগুলোতে তিনি জেলেই ফুল ও ফলের গাছ লাগানোর🔯 পাশাপাশি সবজির বাগান করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’য় জেলে বৃক্ষরোপণ এবং বাগান পরিচর্য𒀰ার দরদি বর্ণনা পাওয়া যায়।
অধ্যাপক টার্নার বলেছেন, ‘প্রকৃতি হলো এক পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া। মানবগোষ্ঠীর প্রচেষ্টাসমূহ ওই পুনরুৎপাদন, বিবর্তন ও উন্নতির এক ধারাবাহিক 🔥ও সম্প্রসারণ।...আমরা প্রকৃতির প্রধান অংশ, এর সংবেদনশীল অগ্রভাগ এবং তার অগ্রগতির দায়িত্বও আমাদের।’ (হাসানুজ্জমান চৌধুরী, উন্নয়নে পরিবেশতত্ত্ব, পরিবেশ ও পুঁজিবাদ, পৃষ্ঠা ২০৩-২০৪) ১৯৭২-৭৫ সময়কালে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন পরিকল্পনায় অধ্যাপক টার্নারের এই বক্তব্যের প্রতিফলন পাওয়া যায়। তিনি রাষ্ট্রের অগ্রগতির পরিকল্পন🅷ায় প্রকৃতির অন্যতম নিয়ামক গাছ, প্রাকৃতিক বন ও নদী-নালা—এগুলো নষ্ট করেননি বরং এগুলোর উন্নয়নে কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ দরকারি সব খাতের উন্নয়নে বহুমুখী পরিকল্পনা করেন। তাঁর সুদূরপ্রসা𒀰রী পরিকল্পনায় গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায় বৃক্ষরোপণ। কারণ, বৃক্ষ মানুষের পরম ও অকৃত্রিম বন্ধু। সুজলা-সুফলা-শ্যামলা যে বাংলাদেশের কথা আমরা বলি তার অনেকাংশেই বৃক্ষের অবদান। আবার প্রাণীর জীবনধারণের প্রধানতম নিয়ামক অক্সিজেন, যা পাওয়া যায় বৃক্ষ থেকেই। জীবন-জীবিকা ও দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থেও গাছের বিকল্প নেই। অপর দিকে, নতুন রাষ্ট্রের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রচুর কাঠের প্রয়োজন ছিল। তাই গাছ লাগানোর প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য বঙ্গভবন, গণভবন, উত্তরা গণভবন (নাটোর) এবং বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে গাছ লাগান বঙ্গবন্ধু। জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায়ও গাছ লাগান তিনি। বৃক্ষরোপণকে ছড়িয়ে দেন সমগ্র বাংলাদেশে। ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি নাটোরে অবস্থিত উত্তরা গণভবনে ‘হৈমন্তী’ ফুলের গাছ লাগান। (দৈনিক সমকাল, ১৪ অক্টোবর ২০১৯।) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘হৈমন্তী’ গল্পের সঙ্গে লেখাপড়া জানা অধিকাংশ বাঙালির পরিচয় থাকলেও হৈমন্তী ফুল সম্পর্কে অনেকেরই জানা নেই। এই ফুল বর্তমানে বিরল। গুরুত্ব বুঝেই বঙ্গবন্ধু এই ফুলের গাছ লাগান উত্তরা গণভবনে, যা আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মুক্তিযুদ্ধে যেমন দেশপ্রেমিক ছাত্রযুবারা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে তরুণদের অংশগ্রহণ অনস্বীকার্য—এই বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর সব সময়ই ছিল। দেশকে বৃক্ষ সম্পদে সমৃদ্ধ করতে তিনি তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এবং তরুণদের সঙ্গে নিয়ে নিজে গাছ লাগান। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আগের দিন ২৯𝓰 জুন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি প্রতি♍নিধিদল। এ সময় ছাত্ররা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সমস্যার কথা বঙ্গবন্ধুকে জানান। বঙ্গবন্ধু তাদের অসুবিধা ও দাবি-দাওয়াগুলো গুরুত্বসহকারে শোনেন। এরপর তিনি ছাত্রদের লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র পুনর্গঠনে কৃষি উন্নয়নে অংশ নিতে বলেন। দেশে সবুজ বিপ্লব সম্পন্ন করতে বৃক্ষরোপণে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য তিনি তরুণদের আহ্বান জানান। শুধু তা-ই নয়, তিনি তাঁর দাপ্তরিক কার্যালয় গণভবনে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে একটি চারা রোপণ করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বছরেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় সারা দেশে বৃক্ষরোপণকে ছড়িয়ে দিতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঘোষণা দিয়ে প্রতিটি বাঙালির কাছ থেকে একটি করে চারাগাছ উপহার চান বঙ্গবন্ধু। এমনই তথ্য পাওয়া যায়, ১৯৭২ সালের জুন মাসে তৎকালীন তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত একটি পুস্তিকায়। প্রকাশনাটিতে বলা হয়, ‘...গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা আমাদের কর্তব্য। এই কর্তব্যের কথা ভেবেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগের উদ্যোগে আগামী ১লা জুলাই হতে ১৫ই জুলাই পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে বৃক্ষরোপণ অভিযান চালানো হবে। কিন্তু একটি বিভাগের সামান্য কয়েকজন কর্মচারীর পক্ষে জনসাধারণের স𝔍হযোগিতা ছাড়া এত বড় দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। এ জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের গণপ্রতিনিধি, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, সমাজসেবী ও আপামর জনসাধারণের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, তাঁরা যেন নিজেদের এলাকায় স্কুল-কলেজ, কলকারখানা, রাস্তাঘাট ও বাড়িঘরের আশপাশে যেখানেই সম্ভব মূল্যবান গাছ লাগিয়ে এবং গাছের পরিচর্যা করে এই অভিযানকে সফল করে তোলেন।’ (বাশার খান, বৃক্ষপ্রেমী বঙ্গবন্ধু, পৃষ্ঠা ২০-২১) দ্ইু সপ্তাহব্যাপী এই বৃহৎ উদ্যোগে বন বিভাগ থেকে ফ্রি চারা বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম গাছ লাগানোর কর্মসূচিকে ব্যাপকতা ও সফল করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান একটি আদেশ জারি করেন।
এরপর ১ জুলাই ১৯৭২, শনিবার গণভবনে একটি নারিকেলগাছের চারা রোপণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমার দেশের সাড়ে তিন কোটি কর্মক্ষম লোক সবাই একটা করে গাছ লাগাবেন—এ🍌টাই আমার কাম্য।’ (পূর্বদেশ, ২ জুলাই ১৯৭২।) ওই দিন জানানো হয়, গণভবনের চারপাশে একশ নারিকেলগাছ ও তিনশ সুপারিগাছ লাগানো হবে। পরে ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু খুলনা সফর করেন। সফরে খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ পরিদর্শন করেন বঙ্গবন্ধু। কলেজ পরিদর্শনকালে তিনি কলেজ ভবনের সামনে একটি নারিকেলগাছের চারা রোপণ করেন। সেই গাছ আজও আছে। ইতিহাসের সাক্ষী সেই নারিকেলগাছটিকে🐓 স্মরণীয় করে রাখার জন্য গাছটির পাশেই বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে।
২.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা পর্ব ও বিজয়লগ্নের সাক্ষী বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যোন। এর নাম ছিল রেস♐কোর্স ময়দান। এখানে ঘোড়ার রেস হতো; রেসের মাধ্যমে মানুষ জুয়ার আসরে লিপ্ত হতো। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে জুয়ার আসর বন্ধ করে দিয়ে এখানে বৃক্ষের সমারোহ করেন। এর নামকরণ করেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানকে উদ্যানে পরিণত করার তথ্য পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু সরকারের উপসচিব ও পরে যুগ্ম সচিব পদে দায়িত্বপালন করা সাবেক সিএসপি কর্মকর্✱তা মনোয়ারুল ইসলামের স্মৃতিকথায়। তিনি লেখেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধু বললেন, এই ঘোড়ার ওপর বাজি ধরে বহু পরিবার ফতুর হয়ে গেছে। এটি আর চলবে না। তিনি বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ডেকে বললেন, ‘রেসিং ট্র্যাকের ওপর সারিবদ্ধভাবে নারিকেলগাছ লাগাও।’ একজন কর্মকর্তা আপত্তি জানিয়ে বললেন, ফলের গাছ লাগালে লোকজন সেই ফল চুরি করে খাবে এবং এ নিয়ে মারামারি হবে। বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, ‘জনগণের জমি, জনগণের গাছ। জনগণ যদি ফল খায়, আপনার-আমার আপত্তি কেন?’ (মনোয়ারুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু কালের সীমা ছাড়িয়ে, দৈনিক প্রথম আলো, ১৭ মার্চ ২০১৮।)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু বৃক্ষপ্রেমীই নন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ লাগানোর নির্দেশনা দিতে গিয়ে মানবিক ও উদার রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর স্বাভাবিক স্বভাব-চরিত্রের বৈশিষ্ট্যই ছিল꧒ এমনই। গাছ হবে, তাতে মানুষ ছায়া ও অক্স🔯িজেন পাবে। আবার ফল ধরলে ফল খাবে। কারণ তাঁর আদর্শ ও মূলনীতিই ছিল রাষ্ট্রের মালিক জনগণ।
বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক এই উদ্যানে ১৬ জুলাই ১৯৭২, নারিকেলগাছ লাগানোর মধ্য দিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। এ নিয়ে পরের দিন ১৭ জুলাই সমকালীন প্রায় সব সংবাদপত্রেই ছবিসহ সংবাদ প্💫রকাশিত হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ লাগিয়ে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু অনাবাদি জমি, স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালতসহ সমস্ত খালি জায়গাতে বৃক্ষরোপণ করার জন্য দেশের ছাত্র, জনতা, সরকারি কর্মচারীসহ আপামর জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
৩.
বাংলাদেশে যে কয়টি প্রাকৃতিক বনভূমি রয়েছে, তার মধ্যে মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় অন্যতম। ভাওয়াল গড় গাজীপুর ✱জেলার সদর ও শ্রীপুর উপজেলায় অবস্থিত। বঙ্গবন্ধুর সরকারের ১৯৭৪ সালের ‘বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন ১৯৭৪’-এর আওতায় ৫,০২২ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এ উদ্যোনটি পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়। ভাওয়াল গড় বর্তমানে বাংলাদেশের আকর্ষণꦜীয় পর্যটনকেন্দ্র।
এসব প্রাকৃতিক বনে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি থাকতে পারে&mdas🧔h;এমন সন্দেহে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন বন উজাড় করা হয়। মুক্তিফৌজের ভয়ে হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পায়নি মধুপুর ও ভাওয়াল গড়। গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্য বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় পাওয়া যায়, ‘...হানাদার আমলে মুক্তিবাহিনীর আস্তানা ধ্বংসের নাম করে মধুপুর বনের দশ বার মাইল এলাকার গাছপালা সব তারা পুড়িয়ে দিয়েছে।’ (দৈনিক বাংলা, ১৭ জুলাই ১৯৭২)
মনোয়ারুল ইসলামের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ভাওয়াল গড় অরক্ষিতই ছিল। যে কেউ চাইলে গুরুত্বপূর্ণ গাছ সেখান থেকে কেটে নিয়ে যেত। এ কারণে বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্ট💞ি আকর্ষণ করা হলে তিনি গড়টিকে রক্ষায় উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ঢাকার জেলা প্♓রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াতকে গণভবনে ডাকেন। এরপর গড়টিকে রক্ষায় আলোচনা করা হয়। বনে টিন দিয়ে অফিস ঘর বানিয়ে বন রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু করা হয়।
৪.
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে গাছের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের পরও ধারবাহিকভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। দাপ্তরিক ও রাজনৈতিক সফরে গিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বঙ্গবন্ধু বৃক্ষরোপণ করেন। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে স্বাধীন দেশে দ্বিতীয়বারের মতো বৃক্ষরোপণ পক্ষ শুরু করা হয়। এই পক্ষ উদ্বোধন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু উত্তরা গণভবনে নারিকেলগাছের চারা রোপণ করেন। এ নিয়ে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বৃক্ষরোপণ পক্ষ উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ সকালে উত্তরা গণভবন প্রাঙ্গণে একটি নারিকেলের চারা রোপণ করেন। এরপর ..🎃. প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সেক্রেটারি জনাব তোফায়েল আহমেদ এবং বাংলাদেশ রেডক্রসের চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফাও একটি করে চারা লাগান।’ (পূর্বদেশ, ২ জুলাই ১৯৭৩।) সেদিন বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে নারিকেলগাছ রোপণ করে লক্ষ করেন উত্তরা গণভবনের পুকুরপাড় ফাঁকা। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি বিভাগীয় ফরেস্ট অফিসারকে উত্তরা গণভবনটি পরিবেষ্টনকারী পুকুরের পাড়ে নারিকেলগাছের চারা লাগানোর নির্দেশ দেন।
স♍ে বছর বঙ্গবন্ধুর সরকার স্বল্পমূল্যে𓆏 ৩৩ লাখ চারা গাছ জনগণের মধ্যে বিক্রয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর মধ্যে ছিল ১২১ প্রকার ফলমূলের চারা। এছাড়া দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পকিল্পনায় প্রতিবছর ৬০ লাখ বৃক্ষের চারা বিতরণ করার লক্ষ্য স্থির করা হয়। সাধারণ পদ্ধতিতে বৃক্ষরোপণ ও বনাঞ্চলে উন্নয়নের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গাছ লাগানোর চিন্তা করেন। যাতে করে দেশের বনজ সম্পদ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
১৯৭৪ সালে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শুরু করা হয় ব্যাপকহারে। বৃক্ষরোপণ পক্ষ উদ্বোধন করা হয় ১ জুলাই। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে গাছ লাগানোর জন্য আলাদা আলাদা তারিখ ও এলাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এ বছরের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া হয়নি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। কারণ ১ জুলাই, ১৯৭৪ ছিল বেদনার দিন। খ্যাতিমান রাজনীতিক, আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, অকুতোভয় ভাষাসৈনিক, ১৯৭১ সালে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান এবং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য, চট্টগ্রামের গণমানুষের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী মারা যান। জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুতে বঙ্গবন্ধু খুবই শোকার্ত হয়ে পড়েন। অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোগীর দাফন-কাফন নিয়ে টানা তিন দিন ব্যস্ত সময় পার করেন শেখ🌟 মুজিব।
১৯৭৪ সালে বৃক্ষরোপণ শুরুর দিনসহ কয়েক দিন দেশব্যাপী শোকার্ত পরিবেশ বিরাজ করলেও বঙ্গবন্ধুর সরকারের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি থেমে থাকেনি। ২ জুলাই ১৯৭৪, বাংলার বাণীর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বৃক্ষরোপণ পক্ষকে সফল করার জন্য ঢাকায় বহুমুখী কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে জানায়, ‘...আগামী ৩রা জুলাই সাভারে রক্ꦐষীবাহিনীর ক্যাম্পে, ৪ঠা জুলাই বঙ্গভবন এবং জাতীয় সংসদ, ৫ই জুলাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও আওয়ামী লীগ কার্যালয়, ৬ই জুলাই বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, ৭ই জুলাই গুলশান, ৮ই জুলাই ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, ৯ই জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১০ই জুলাই ঢাকা, জুরাইন, ১১ই জুলাই ধানমন্ডি লেক এলাকা, ১২ই জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ১৩ই জুলাই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪ই জুলাই সাভার ডেয়ারী ফার্ম এবং ১৫ই জুলাই মীরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে বৃক্ষরোপণ। এছাড়া প্রত্যেক জেলায় ডেপুটি কমিশনারগণ নিজ নিজ এলাকায় স্থানীয় সংসদসদস্য, জনপ্রতিনিধি, বন ও অন্যান্য বিভাগীয় কর্মচারীদের সহযোগিতায় কর্মসূচী নেবেন। বৃক্ষরোপণ পক্ষকে সফল করার জন্য সারাদেশে নামমাত্র মূল্যে ১৫ লাখ চারা বিতরণ করা হবে।’
১৯৭৫ সালের বৃক্ষরোপণ পক্ষের স্লোগান ঠিক করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নকে উপজীব্য করে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর, অভাব ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার। সর্বোপরি সোনার বাংলা গঠন। সোনা বাংলা গঠনের বহুমুখী কর্মযজ্ঞ ও পদক্ষেপের অন্যতম অধ্যায় ছিল বাংলাদেশে বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ করা। ಞ১৯৭৫ সালের ১ জুলাই দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, ‘... মঙ্গলবার সারাদেশে বৃক্ষরোপণ অভিযান শুরু হচ্ছে। আগামী ১৫ই জুলাই পর্যন্ত এক পক্ষকালব্যাপী এই অভিযান চলবে। বৃক্ষরোপন অভিযান— ১৯৭৫-এর শ্লোগান হচ্ছে: বেশী করে গাছ লাগান, ভাল করে যত্ন নিন, সার্থক করে তুলুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আজ বিকেলে রামপুরাস্থ বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন সম্মুখে ‘রাজশিরিষ’ গাছের চারা রোপণ করে বৃক্ষরোপণ অভিযান—১৯৭৫-এর উদ্বোধন করবেন।’
বঙ্গবন্ধুর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামালে দেখা যায়, রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কর্মপরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে বৃক্ষরোপণ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়। একদিকে ভাওয়াল গড়সহ দেশের বনসম্পদ নতুনভাবে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করেন। আবার সারা দেশব্যাপী নতুন গাছ লাগানোর উদ্যোগও নেন, এই কাজে উদ্বুদ্ধ করতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ন💝িজেও চারা রোপণ করেন। তাই স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে বৃক্ষসম্পদ রক্ষাকারী রাষ্ট্রনায়ক এবং এর উন্নয়ন উদ্যোক্তা—পরস্পর সম্পর্কিত এই দুই ভূমিকায়ই পাওয়া যায়।
লেখক: সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক