শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাপ্রবাহে শেষ পর্যন্ত কী হলো? জয় হলো কার? আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নাকি পদ আঁকড়ে থাকা উপাচার্যের? শিক্ষার্থীদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড এবং কাঁদানে গ্যাস হামলার ফলে ভিসির পদত্যাগ দাবি করে আসা শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙাতে শেষ পর্যন্ত কোনো মন্ত্রী, মেয়র, এমপি, শিল্পপতি, সচিব এমনকি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে কর্মরত কোনো শিক্ষক নন, এগিয়ে আসতে হয়েছে অবসরে যাওয়া অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে। অনেকে হয়তো এগিয়ে আসতে চেয়🧜েছিলেন, কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা তাদের বিশ্বাস করেনি, ‘না’ করে দিয়েছে। তাহলে কি ঘুরেফিরে শিক্ষকতার জয় হলো?
শিক্ষকতার বিজয় আর শিক্ষকদের বিজয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। ছাত্রদের বিজয় যেমন শিক্ষার বিজয় হয় না সব সময়, শিক্ষকদের বিজয়ও তেমনি অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকতার বিজয় হয় না। বলতে দ্বিধা নেই, শিক্ষকদের মধ্যেও দুর্বৃত্ত আছে, শিক্ষার্থীদের ম꧂ধ্যেও আছে। তাহলে দেশের সব দুর্বৃত্ত কি এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে? নিশ্চয় তা নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুর্বৃত্ত তৈরি করার কথা না। সমাজকে বদলে দেওয়ার জন্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্ম। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, সেখানে যদি দুর্বৃত্তায়ন ঘটে, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন বাদ থাকবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেহেশতি কোনো প্রতি🐬ষ্ঠান নয় যে এখানে সমস্যা থাকবে না। বিশেষ করে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমস্যা ছিল, আছে এবং থাকবে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগকারী সরকারি চাকরিজীবীদের সঙ্গে অন্যান্য সৃজনশীল ক্ষেত্রের তুলনা করলেই বোঝা যাবে কতটা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় চলছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান কোন পেশার মানুষের? গণমাধ্যম থেকে ধার নেওয়া তথ্যমতে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে মাত্র পাঁচটি খাত। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপিতে দুই-তৃতীয়াংশ বা ৬৭ শতাংশ অবদান রেখেছে এসব খাত। জিডিপিতে এই খাতগুলো সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন করেছে। দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে প্রমাণিত এই খাতগুলো হচ্ছে উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, পরিবহন, কৃষি এবং নির্মাণ। অন্যদিকে রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে কারা? কোন পেশার লোকজন এই সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার অধিকারী? নাম উল্লেখ না করলেও পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারেন কারা আমাদের বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সম্মান, মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী? এমন বৈষম্যমূলক একটা ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা বঞ্চনার অনুভূতি থাকবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। সংগত কারণে এই পরিস্থিতি বদলানোর চেষ্টা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অনুপস্থিত। কারণ, এতে করে ক্ষমতাকাঠামো ভেঙে যাবে, সুবিধাভোগীদের সুযোগ-সুবিধা কমে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার কৃষক শ্রমিকসহ সব উৎপাদকদের সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাঁকে হত্যা করা হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা আর রাজনীতিজীবীগণ সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর কোনো পরিকল্পনাকে সফল হতে দেননি। এরপর দীর্ঘদিন বাংলাদেশ শুধু সামরিক আর বেসামরিক আমলাদের যোগসাজশে চলেছে। একটা জ্ঞাননির্ভর ও ন্য♕ায্যতাভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণে এই সামরিক-বেসামরিক আমলারা মনোযোগী ছিলেন না কখনোই। যে রাষ্ট্রে কৃষক, শ্রমিক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পীরা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন, সেখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয় ঝামেলামুক্ত থাকবে, এটা আশা করা ঠিক নয়। সমাজের অন্যান্য বৈষম্যকবলিত প্রতিষ্ঠানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ও নানাবিধ অসুখে জর্জরিত। এর ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদি হন শিক্ষার্থী-অবান্ধব এবং গণবিচ্ছিন্ন, তাহলে সমস্যা আরও প্রকট হবে, এটা স্বাভাবিক।
বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘শিক্ষায় বিনিয়োগ শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও এই কথা বল🍬েন। কিন্তু বাস্তব হলো, বঙ্গবন্ধুর শিক্ষানীতি এখনো সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে জিডিপির কত শতাংশ বরাদ্দ হয়? শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আবার যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার অধিকাংশই চলে যায় বেতন-ভাতা ও অবকাঠামো খাতে। সাম্প্রতিককালে সম্ভবত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল জাতীয় বাজেটের ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দিক থেকেও ভালো অবস্থানে নেই শিক্ষা খাতের বাজেট। কয়েক বছর ধরে জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশের কাছাকাছি থাকছে শিক্ষার বরাদ্দ। ইউনেস্কো চায়, শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ এবং জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ হব⛄ে। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি নিকট অতীতে একবার বলেছিলেন, বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপির ৪ শতাংশ করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জাতীয় বাজেটের যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার একটা বড় অংশ ব্যয় হয় আবার শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পেছনে। যে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মেধার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার যোগ্যতা অর্জন করে, তার জন্য বাজেটে কতটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয়? হলগুলোতে কেমন পরিবেশে থাকে আমাদের শিক্ষার্থীরা? কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষে যে পরিবেশে থ𝔉াকে, তাকে কী বর্ণনায় তুলে ধরা সম্ভব আমি জানি না। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের থাকার পরিবেশ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পরিবেশের চেয়েও অনেক খারাপ। এটা আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি। একটা ছেলে বা মেয়ে প্রথম বর্ষে এসে এমন পরিবেশে থাকলে তার কাছ থেকে কি জাতি কিছু আশা করতে পারে বা আশা করা উচিত? অনেকে দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করেও গণরুমে থাকতে বাধ্য হয়। সবচেয়ে ভালো পরিবেশের একটা রুমেও ৮-১০ জন থাকে।
অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী ছাত্ররা তুলনামূলক ভালো রুমে থাকে। একেকটা হলে ১০-১৫ জন ছাত্র থাকে, যাদের চলাফেরা, ভাবসাব বেশ চোখে পড়ার মতো। তারা শুধু সিঙ্গেল সিটেই থাকে, এমন নয়; কারও কারও রুমে সোফা, রঙিন টেলিভিশন থাকে। এদের দখলে থাকে অনেকগুলো কক্ষ। এগুলোকে বলা হয়, ‘পলিটিক্যাল রুম’। এ ধরনের কক্ষে সিট বিক্রি করা হয়। এলাকার লোকজন থেকে শুরু করে আশপাশের মার্কেটের লোকজন মাসে সিটপ্রতি ২-৪ হাজার টাকা খরচ করে বসবাস করে। দুইটা কক্ষ দখলে রাখতে পারলে একজন ছাত্রনেতার বিরাট ব্যবসা হয়। এছাড়া হল এবং ক্যাম্পাসের নানা জায়গা বরাদ্দ দিয়ে নিয়মিত মুনাফা আদায় করা বহুদিন থেকে ওপেন সিক্রেট। আগে একটা হলে বড়জোর ৪-৫টা মোটরসাইকেল দেখা যেত। চারুকলা, সাংবাদিকতা ও নাটকের ছেলেমেয়েরা ইনকাম করত; কেউ কেউ পারিবারিকভাবেই সচ্ছল; এদের হয়ত🀅ো কয়েকটা মোটরসাইকেল থাকত। এখন দিন বদলে গেছে, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে রাতে গেলে দেখা যায়, শতাধিক মোটরসাইকেল সারি সারি রাখা আছে। এত টাকা কোত্থেকে আসে? ফুটপাতের ব্যবসা সব নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি করা ছাত্ররা। এই ব্যবসা এতটাই লাভজনক যে ক্যাম্পাসগুলোতে স্বেচ্ছায় আদু ভাই বনে যাওয়া ছেলেদের সংখ্যা বাড়ছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এই অনৈতিক সংস্কৃতি মেয়েদের মধ্যেও বেশ চালু হয়েছে, রাজনৈতিক আদর্শের জন্য নিজেদের বয়স বিলিয়ে দিচ্ছে, অবিশ্বাস্য! হলের প্রভোস্ট তথা দায়িত্বশীল শিক্ষকদের সঙ্গে&🍬nbsp;এমন আদু ভাই, অসৎ শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক নিয়মিত এবং মজবুত থাকে। এমনকি ভিসিদের সঙ্গেও এদের সম্পর্কই জোরা🙈লো হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্যের শিকার একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন আবার নতুন করে প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালী এবং সুবিধাভোগী শ্রেণির সৃষ্টি হয়, তখন সাধারণ ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা ক্ষোভ থেকেই যায়। এই পরিস্থিতি এক দিনে তৈরি হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সামরিক-বেসামরিক প্রশাসকগণ যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করতে চেয়েছেন, সেভাবেই নির্মিত হয়েছে। গায়ের জোরে, পুলিশ দিয়ে, মাস্তান দিয়ে, সন্ত্রাসী দিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়াকে দমিয়ে রাখার সংস্কৃতি তারাই তৈরি করেছেন। সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে।
জাতির পিতার আদর্শ যদি আমাদের সবার ভেতরে থাকত, আমরা যদি মেনে চলতাম, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় নয় শুধু সবখানেই একটা সাম্যবাদী ও যৌক্তিক পরিস্থিতি বিরাজ করত। না ঘুমিয়ে, না খেয়ে ছেলেমেয়েরা বিভাগে আসে পড়তে। পর্যাপ্ত ক্লাসরুম, ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ না পেয়ে শিক্ষার্থীরা এখানেও হতাশ হয়। শিক্ষকরা নিজেদের সাধ্যমতো শিক্ষার্থীদের পাঠদান করার চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীরাও নানাবিধ সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে চেষ্টা করে পড়াশোনা করার। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটা চাকরি পাবে, এই বিশ্বাস খুব কম ছেলেমেয়ের থাকে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা হাতে গোনা কয়েকটি পেশার জন্য যেহেতু সমস্ত সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা বরাদ্দ করেছেন, ছাত্রছাত্রীরাও ওভাবেই নিজেদের তৈরি করে। বুয়েটের ছাত্র আর কলার ছাত্র একই পদের জন্য লড়াই করছে। ছেলেমেয়েদের মাথায় শুধু বিসিএসের চিন্তা ঘুরপাক খায়। ক্লাস করছে হয়তো রসায়নের, কিন্তু ব্যাগের মধ্🎃যে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের বই। লাইব্রেরিতে চেয়ার দখল করার যুদ্ধ করছে প্রতিদিন। ফজরের আজানের সময় গিয়ে ব্যাগ রেখে দেয় রাস্তায়। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকগণ একটা অসুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। এমন একটা অসম, অসু🎃স্থ পরিবেশে ছেলেমেয়েরা যদি নিজেদের শিক্ষকদের কাছ থেকে স্বৈরাচারী আচরণের শিকার হয়, তাহলে বিপর্যয় হতে বাধ্য।
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের একটা অংশ এই পরিস্থিতিতেও নিজেদের শিক্ষার্থীদের তুলনায় অন্য কোনো বেসরকারি প্রꦉতিষ্ঠানে সময় বিনিয়োগ করতে অধিক আগ্রহী। এর অন্যতম কারণ হলো বেতনের টাকায় একটা ‘মানসম্মত’ জীবনযাপন সম্ভব নয়। লেখালেখি, গবেষণা করে খ্যাতি অর্জন করা গেলেও সব সময় খ্যাতি দিয়ে চলে না। শিক্ষককেই কেন ‘খ্যাতিমান সাধারণ’ জীবনযাপন করতে হবে? কয়েকটি পেশার মানুষ অধিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে,♏ সেখানে শুধু শিক্ষকদেরই কেন ‘দরিদ্র’ ও ‘মহৎ’ হতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মনে যদি এমন বঞ্চনার অনুভূতি থাকে তাহলে প্রাইমারি, হাইস্কুল এবং কলেজের শিক্ষকদের কী অবস্থা, একটু সবাই চিন্তা করুন। সরকারি শিক্ষকরা তা-ও নিয়মিত বেতন পান, বেসরকারিদের অবস্থা খুবই করুণ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে দেশের প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক হবে, এমন স্বেচ্ছা-স্বপ্ন কয়জন ছেলেমেয়ের মধ্যে আছে বা থাকবে? বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারেই কেউ থাকতে চায় না। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্কলারশিপের সুযোগ-সুবিধাও দিন দিন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এমন বৈষম্যমূলক পরিবেশে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই ভালোভাবে চলতে হবে ,এটা আশা করা উচিত নয় বলে আমি মনে করি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা ছেলেমেয়েরা সমাজ ও রাষ্ট্রের এত গোপন বৈষম্য জানে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে তারা জীবনকে একরকম দেখে, আসার পরে শিক্ষকদের কাছ থেকে শুনে বুঝতে পারে সব। এত কিছুর পরেও যখন ছাত্রছাত্রীরা কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে স্বৈরাচারী এবং আমলাতান্ত্রিক আচরণের শিকার হয় তখন তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।
বাংলাদেশে শিক্ষকদের ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা দীর্ঘদিনের আমলাতান্ত্রিক প্রচেষ্টা। ঢাল-তলোয়ার না 🌜দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো মানে নিশ্চিত পরাজয়ের সামনে ঠেলে দেওয়া আর এতে পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে হয় এবং দিন দিন এই প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইদানীং রাজনীতিবিদরাও কথায় কথায় শিক্ষকদের ‘ব্যর্থতাকে’ সামনে নিয়ে আসেন। নিজেদের ব্যর্থতা ও দুর্নীতির লজ্জাজনক উপাখ্যানকে জনমন থেকে দূরে রাখার প্রয়াসে শিক্ষকদের জ্ঞান দেওয়া একটা নিত্যদিনের চর্চা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি বিভাগের সভাপতি হিসেবে আমি খুব পরিষ্কার করে বলছি; এত কম বিনিয়োগে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কখনো উন্নত বিশ্বের মানে পৌঁছাবে না। যত দিন দেশের শীর্ষ আমলা ও রাজনীতিবিদদের ছেলেমেয়েরা সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে বাধ্য হবে না, তত দিন দেশের সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমস্যা থাকবেই। এত বঞ্চনার বাস্তবতা ও অনুভূতি নিয়ে আদর্শ পরিবেশ কেউ নিশ্চিত করতে পারবে না। এরপরেও যতটুকু বরাদ্দ আসে, সেখানে সবচেয়ে কম বরাদ্দ পায় শিক্ষার্থীরা। এই অন্যায্য পরিবেশে শিক্ষককে অ-নে-ক বেশি আন্তরিকতা আর মহব্বত নিয়ে পড়াতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটিপতি বা মন্ত্রী-এমপি-সচিবদের ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে না। গ্রামের, মফস্বলের বা শহরের সংগ্রামী মানুষের ছেলেমেয়েরা আসে। তাদের শুধু ক্লাসে পড়ালেই হয় না। শুধু পরীক্ষার রেজাল্ট দিলেই হয় না। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজখবর থেকে শুরু করে পকেটের খবর পর্যন্ত রাখতে হয় শিক্ষককে। কিন্তু শিক্ষক যদি ক্যাম্পাসের স্থানীয় দুর্বৃত্তদের সঙ্গে যোগসাজশ করে চলেন, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দুর্নীতির অংশ হয়ে যান, শিক্ষক না হয়ে প্রশাসক বনে যান, বিশ্ববিদ্যালয়কে করপোরেট অফিসকে বানিয়ে ফেলেন, তাহলে শাবিপ্রবির মতো ঘটনা ঘটবেই।
শিক্ষার্থীদের সম্মান করতে হবে। শিক্ষক তো আবহমান কাল থেকে শিক্ষার্থীদের দ্বারা সম্মানিত। জেনারেশন গ্যাপ দূর📖 করতে হবে ধীরে ধীরে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা বুঝে তাদের সঙ্গে নিয়ে চলা শিখতে হবে শিক্ষকদের। শিক্ষকদে♚র বুঝতে হবে শিক্ষার্থীরা তাদের অধঃস্তন কেউ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুস্থ পরিবেশের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভেতর চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তুলতেই হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়