নানা বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে অবশেষে শুরু হলো দেশের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। করোনার কারণে গত দুই বছরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের ওলটপালট হয়েছে। অল্প সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছে, পরীক্ষা ছাড়াই পাস মানে অটোপাস হয়েছে। এবার করোনার দাপট কমলেও বন্যা এসে পিছিয়ে দিয়েছে পরীক্ষা। যানজট পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার সকাল ১০টার পরিবর্তে বেলা ১১টায় পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সমস্যাটা আমলে নেওয়ায় সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ প্রাপ্য। শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ২১ হাজার ৮৬৮ জন। তবে প্রথম দিনেই অনুপস্থিত ছিল ৩৩ হাজার ৮৬০ জন পরীক্ষার্থী। অনুপস্থিতির সংখ্যাটা উদ্বেগজনক। করোনা মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। অনেক পরিবারের আয় কমে গেছে। সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্য হারিয়েছে অনেক পরিবার। শিক্ষার্থীদের অনেকে স্কুল বাদ দিয়ে কাজে লেগে গেছে। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর পরীক্ষার হলে অনুপস্থিতির বিষয়টি তাই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। একজন শিক্ষার্থীও যেন পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্ব। তব🐈ে আমার আজকের লেখার বিষয় পরীক্ষা নয়। পরীক্ষার দিনের একটি খবর পড়ে আর একটি ভিডিও দেখে মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল। সেই ভালো অনুভূতিটাই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই।
গত বৃহস্পতিবার এসএসসি পরীক্ষা শুরুর সকালে উত্তরা পশ্চিম থানার উদ্যোগে ‘সাপোর্ট’ নামে একটি বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া হয়। এ কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসামগ্রী, মাস্ক, সেনিটাইজার, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি ও কলম উপহার দেওয়া হয়। তবে উপহার নয়, সাপোর্ট কর্মসূচির আওতায় যানজটে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের দ্রুত পৌঁছে দেওয়া, শিক্ষার্থীদের সঠিক কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া, বাসায় ফেলে আসা প্রবেশপত্র এনে দেওয়ার মতো জরুরি কাজও করা হচ্ছে। এ জন্য পুলিশের ৩টি গাড়ি এবং ১০টি মোটরসাইকেল তৈরি রাখা হয়। প্রথম দিনেই তারা অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থীকে সহায়তা করেছেন। ‘সাপোর্ট’ কর্মসূচি উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীনের আইডিয়া। তিনি জানিয়েছেন, যত দিন পরীক্ষা থা📖কবে, তত দিনই এই কর্মসূটি চলবে। শুধু উত্তরা পশ্চিম থানা নয়, এ ধরনের কর্মসূচি দেশজুড়ে হওয়ার কথা, হওয়া উচিত। আর কোথাও না হলেও অন্তত উত্তরা পশ্চিম থানায় হচ্ছে, তাতেই আমরা আনন্দিত। স্যালুট জানাচ্ছি, মোহাম্মদ মহসীনকে। তবে এই স্যালুট নিছক ‘সাপোর্ট’ কর্মসূচি চালুর জন্য নয়। যে ভিডিওর কথা বললাম, সেটি দেখে এই মানবিক ওসির প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়েছে। এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনেই ভুল করে অন্য পরীক্ষা কেন্দ্রে চলে আসে রাজধানীর উদয়ন স্কুলের শিক্ষার্থী মীম। তার কেন্দ্র উত্তরা গার্লস স্কুল হলেও সে চলে আসে উত্তরা বয়েজ স্কুলে। ঘটনাটি জানার পর উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন নিজের গাড়িতে তাকে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে পৌঁছে দেন। পৌঁছে দেওয়ার চেয়ে আমার কাছে যেটা ভালো লেগেছে, ওসি মোহাম্মদ মহসীনের মানসিকতা। অনেকটা দৌড়ে গাড়ি পর্যন্ত যেতে যেতে মোহাম্মদ মহসীন বারবার পেছনে ফিরে মীমকে বলছিলেন, ‘টেনশন কইরো না মা, সময় আছে। একদম টেনশন নাই, তোমাকে আমরা পৌঁছায় দিচ্ছি। তুমি ইয়ে রাখো। পরীক্ষা ভালো দিতে হবে। আমরা তোমাকে সুন্দরভাবে পৌঁছায় দেবো মা। ভয় পেয়ো না মা।’ মোহাম্মদ মহসীনের কণ্ঠে অচেনা মীমের জন্য যে দরদ, যে মমতা; সেটাই আমাকে আপ্লুত করেছে। মোহাম্মদ মহসীনের কণ্ঠে আমি একজন মানবিক পুলিশ, একজন পিতার ছোঁয়া পেয়েছি।
বাংলাদেশের বাকি পুলিশ সদস্যরা মোহাম্মদ মহসীনের ভিডিওটি দেখতে পারেন। নিজেদের বদলে নিতে পারেন। পুলিশের আসলে এমনই হওয়ার কথা। পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু। কিন্তু বাংলাদেশে বাস্তবতা ভিন্ন। সাধারণভাবে মানুষ পুলিশকে ভয় পায়। কথায় বলে ‘বাঘে ছুঁলে এক ঘা, পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা’। এই ভয়ে সাধারণ মানুষ ভয়ে পুলিশের কাছে যেতে চায় না। পুলিশের হাতে আইন আছে, আছে সেই আইনকে ইচ্ছামতো অপপ্রয়োগের সুযোগ। অধিকাংশ মামলাতেই কিছু অজ্ঞাতনামা আসামি থাকে। এই ‘অজ্ঞাতনামা’রা হলো পুলিশের অস্ত্র। পুলিশ চাইলে যে কাউকে যেকোনো মামলার আসামি বানিয়ে দিতে পারে। নিরীহ মানুষকে ধরে এনে মাꦍদক মামলা বা অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ শুনি প্রায়ই। রাস্তাঘাটে মানুষের পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে ব্ল্যাকমেল করার ঘটনাও অহরহই ঘটে। তেমনই এক ঘটনার ভিডিও ফাঁস হয়ে যাওয়ায় এখন কারাগারে দুই পুলিশ সদস্য। এই দুইজন আটকে গেছেন বটে, তবে এমন ঘটনা প্রায় নিত্যদিনের। পুলিশ রিমান্ড মানেই যেন আতঙ্ক। এমনকি জরুরি জিডি করতেও মানুষ থানায় যেতে চায় না।
যেদিন এসএসসি পরীক্ষা শুরু হলো, মানে যেদিন উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন ‘সাপোর্ট’ নামে অসাধারণ একটি উদ্যোগ নিলেন; সেদিনই দৈনিক প্রথম আলোর শিরোনাম ‘ওসির ঘুষের টাকায় স্ত্রী কোটিপতি’। কোটিপতি স্ত্রীর স্বামী মো. শাহজাহানও ওসি, মোহাম্মদ মহসীনও ওসি। মাঝেমধ্যে শাহজাহান বা টেকনাফের ওসি প্রদীপ বা রমনা থানার ওসির সম্পদের পাহাড় বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু এদের মতো আরও অনেক ওসꦉি আছে দেশে। মোহাম্মদ মহসীনের মতো ওসির সংখ্যা বরং কম।
ওসি মহসীনের উদ্যোগ নিয়ে কথাশিল্পী মোজাফ্ফর হোসেন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যখন দেখবেন প𒁃ুলিশ সামাজিক/মানবিক বা নাগরিক-বান্ধক কাজ করে খবরের শিরোনাম/ভাইরাল হচ্ছে, তখন বুঝবেন সমস্যা আছে। ইঙ্গিতটা যেন, তারা এ ধরনের সেবামূলক কাজ এতই কম করছে যে মানুষ অল্পতেই বিস্মিত হচ্ছে। যেমন, আজকের খবরের শিরোনাম, ভুল কেন্দ্র থেকে সঠিক পরীক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষার্থীকে পৌঁছে দিল পুলিশ। খুব প্রত্যাশিত একটা দায়িত্ব পালন। এই ধরনের কাজে সাধ্যমতো পাবলিকও সহযোগিতা করে থাকে। এই নাগরিক ও মানবিক দায়িত্ব তো পুলিশের থাকতেই হবে। পুলিশ করেছে, মানে বিরাট ব্যাপার, তা তো না। পুলিশ না করলেই অস্বাভাবিক হতো কাজটি। শুধু পুলিশ বলে না, অন্যান্য ক্ষেত্রেও যে যার সেবাটা ঠিকমতো দিলে দেখি মানুষ বিস্মিত হয়। ঘুষ ছাড়া চাকরি বা কোনো কাজ হয়েছে, ব্যস খবরের শিরোনাম, এমনও দেখি। এগুলো সুস্থ সমাজের লক্ষণ না। যেটা সব সময় হওয়ার দরকার এবং যে দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক হয়ে ওঠার কথা, সেটি না হলে এসব ভাইরাল করেই আমাদের আনন্দে থাকতে হবে।’ মোজাফ্ফর একদম ঠিক লিখেছেন। যেটা হওয়ার কথা, সেটা এত কম হয়; আমরা চমকে যাই।
ওসি মহসীনের মানবিক উদ্যোগের খবর অনেক বেশি মানুষ পড়েছে। একটি অনলাইনের সর্বাধিক পঠিতের এক নম্বরে ছিল, ‘ওসির গাড়িতে পরীক্ষা কেন্দ্রে গেল🤪 মীম’। এর পরের সর্বাধিক পঠিত খবরটিই হলো, ‘আইজিপি হচ্ছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন’। পাশাপাশি সংবাদ দুটি আমার কাছে প্রতীকী মনে হচ্ছে। নতুন আইজিপি যদি দায়িত্ব নিয়ে পুলিশের মধ্যে অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষের প্রচলন কমাতে পারেন; যদি শাহজাহান-প্রদীপের মতো ওসির সংখ্যা কমিয়ে মহসীনের 𓄧মতো ওসির সংখ্যা বাড়াতে পারেন; তাহলে পুলিশ একদিন সত্যি জনগণের বন্ধু হবে। তখন আর মহসীনের মতো একজনের মানবিক উদ্যোগ দেখে আমরা চমকে যাব না। এটাই হবে পুলিশের নিত্যদিনের কাজ।
লেখক : সাংবাদিক