বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বলিউডে তৈরি হয়েছে ‘পিপ্পা’ চলচ্চিত্র। এখানে ব্যবহৃত নজরুলসংগীত ‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ ভেঙে ফেল কররে লোপাট’ꩵ গানটিতে মূল সুর ভেঙে নতুন সুর দিয়েছেন ভারতীয় সুরকার এ আর রহমান। তার দেওয়া সুরটি মূল গানের বাণীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সংগীতবিশেষজ্ঞ ও সংগীতপ্রেমীদের মধ্যে নানাবিধ ক্ষোভও দেখা যাচ্ছে। ဣপ্রতিবাদের ভাষা ভিন্ন হলেও তাদের মূল বক্তব্য কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহাত্মক গানকে এমন ম্যাড়ম্যাড়ে, বিকৃত সুরে কিছুতেই উপস্থাপন করতে পারেন না এ আর রহমান। তিনি গুরুতর অপরাধ করেছেন। যা ক্ষমার অযোগ্য। শুধু গানের বাণীর প্রতি অশ্রদ্ধা-অবজ্ঞা করেছেন এমন নয়, বরং একটি জাতির আবেগ-অনুভূতির সঙ্গেও চরম বেঈমানি করেছেন।
আমরা জানি, একটি জাতির পরিচয় তার ভাষা-শিল্প-সংস্কৃতি-ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত। ফলে এক জাতির আবেগ-অনুভূতি ভিন্ন জাতির বোঝা বা অনুভব করা মোটেও সম্ভব নয়। আর যদি তা কিঞ্চিৎও বুঝতে হয় তাহলে ওই জাতির সংস্পর্শে এসে, যোগাযোগ বৃদ্ধি করে, অভিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা কর♏ে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়। এটা কোনো চাপিয়ে দেওয়া বিষয় নয় বরং কর্তব্য। কিন্তু বাংলা ভাষা ও ভাষাভাষীর আবেগের জায়গা, শ্রদ্ধার জায়গা নিয়ে কারো খেয়ালিপনা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এ আর রহমান সেই কাজটিই করেছেন। তিনি বাঙালি জাতির আবেগের সঙ্গে খেলেছেন। বাঙালি জাতির শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে বরং তার খ্যাতির দুঃসাহস দেখিয়েছেন। যে গান বাঙালি জাতির হৃদয়কে প্রকম্পিত করেছে, শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে সাহস যুগিয়েছে, হৃদয়ের দ্বিধাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করেছে সেই গানের বিকৃতি কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
নজরুলের নিজের সুর করা এমন একটি জনপ্রিয় গানে কীভাবে এ আর রহমান সুরের বিকৃতি ঘটালেন? তিনি নিজে একজন অস্কার জয়ী শিল্পী হয়ে অন্য আরেকজন সম্মানিত ব্যক্তির সুরকে কীভাবে এমন কাটাছেঁড়া করতে পারেন। খোদার ওপর খোদকারী করা গর্হিত অপরাধ। তার নিজের সুর করা গানের বাণী বা সুরে অন্য শিল্পী মাতবরি করলে কেমন লাগবে? এই বোধ একজন শিল্পীর অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। নতুবা তিনি মানুষ ꦯহতেই পারেন না। আর এ আর রহমানের এমন অযাচিত বাহাদুরি মোটেও বাহবা পাওয়ার যোগ্য নয়। এর জন্য অবশ্যই জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। গানের স্বত্ব নেই বলেই যে এমনভাবে নজরুলের গানকে ব্যবহার করা হবে এটা কোন নীতি-নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। এটি শুধু একটি গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং একটি জাতির প্রতিও চরম উদাসীনতা, নিষ্ঠুরতা ও রূঢ়তা বহন করে। বিকৃত সুরারোপকে আর বাড়তে দেওয়া ঠিক নয়। ভবিষ্যতে আর কেউ যেন এভাবে অতি দুঃসাহসিক কাজে অংশগ্রহণ না করতে পারেন এজন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্🍌তি প্রদান করতে হবে। বাঙালি জাতির মধ্যে, বাংলা ভাষাভাষীর মধ্যে প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছে তা অব্যাহত থাক। আইনি নোটিশের মাধ্যমে বিকৃত গানটি নিষিদ্ধ করা হোক।
নজরুলের গা🌳নে এ আর রহমানের বিকৃত সুর, এমন একটি দ্রোহের সংগীতে ๊না আছে ঝঙ্কার আর না আছে গায়কীর অলঙ্কার। গানটির মূল প্রভাব ও আলোড়ন থেকে বেরিয়ে এসে এ আর রহমান গানটিকে পঙ্গু করে ফেলেছেন। নজরুলের সুরে যে প্রাণে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে এসেছে এতোদিন সেখান থেকে নতুন সুরারোপে গানটিতে ঝিমিয়ে পড়া অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে। গানের বাণী না বুঝে, আবেদন না বুঝে রিমিক্স করে খুব জঘন্য একটা অপরাধ করেছেন। যা ক্ষমার অযোগ্য। একজন শিল্পীর প্রকৃত দায়িত্ব সুরের আগে গানের বাণীকে মর্মে ধারণ করা। তার আবেদন বুঝতে সক্ষম হওয়া। গানটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী, জাতির ইতিহাস কিভাবে জড়িত সবটা বুঝতে সক্ষম হওয়া তারপর তো সেখানে হাত দেওয়া কিন্তু তার গানটি শুনে মনে হচ্ছে, তিনি শুধু নিজের খ্যাতি ও দাম্ভিকতার জোরে নজরুলের গানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখেননি। বিপ্লব ও সংগ্রামের গগনবিদারী গর্জনকে তিনি অনেকটা বিড়ালের মিউমিউয়ানিতে আবদ্ধ করেছেন।
আমরা জানি, সিংহের গর্জন কখনও বিড়ালের দ্বারা দেওয়া সম্ভব নয়। তার জন্য সিংহেরই প্রয়োজন। এই সামান্য বোধটুকুও নেই এই শিল্পীর যার দরুন তিনি বিদ্রোহের গর্জন সৃষ্টিকারী নিনা🍎দকে মিউ-মিউয়ে রূপান্তর করেছেন। একজন বিশ্বনন্দিত সুরকার গানের সুরকে বিকৃত করে কপি রাইটের লঙ্ঘন করেছেন। এটা ফৌজদারি অপরাধ। তাকে আইনের আওতায় নেওয়া বাঙালির দাবি হয়ে উঠেছে। এই চূড়ান্ত অপরাধের শাস্তি দাবি করা একজন সচেতন নাগরিক কোনভাবেই উপেক্ষা করতে পারেন না।
এর আগে ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে গানটির সফল প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। পরিচালক খান আতাউর রহমান গানের মর্মবাণী ধারণ করে নজরুলের সুর ও বাণীকে স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু এত বছর পরে এ আর রহমান তার নিজস্বতা দেখাতে গিয়ে অন্যের সৃষ্টিকে ভণ্ডুল করতে পারেন না। তিনি নিজের সৃষ্টিতে নতুনত্ব আনতে পারেন কিন্তু প্রতিষ্ঠিত-আলোড়িত-ইতিহাসের অংশ- জাতির আবেগ নিয়ে খেলতে পারেন না। সেই অধিকার তাকে 💫রাষ্ট্র দেয়নি, কাজী নজরুল ইসলামের উত্তরাধিকারেরা দেননি। তাহলে কীভাবে এমন গর্হিত অপরাধ তিনি♒ করতে পারেন!
কাজী নজরুলের গান বাংলা ও বাঙালির অতি আপন সম্পদ। এই সম্পদ ও আবেগকে নিয়ে খেলা করা এ আর রহমানের উচিত হয়নি। কে না জানে কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি, আপামর বাঙালির প্রাণের কবি। কারার ঐ লৌহ কপাট গানটি শুনলে আজও রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে এ ছিল আমাদের প্রতিবাদের ভাষা। এই গানে⛦র বিকৃতি কোনো সুস্থ বাঙালি কোনোদিন সমর্থন করবে না। অবিলম্বে বিকৃত সুরারোপ করা গানটি প্রত্যাহার করা হোক। কেউই একজন কবির নিজস্বতাকে ছোট করার অধিকার রাখে না। একজন স্বনামধন্য অস্কারজয়ী সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালকের এমন গর্হিত কাজ কোনভাবেই মেনে ♒নেওয়া যায় না। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক