ছোট বন্ধুরা, কিছুদিন আগে ভাষার মাসে তোমাদেরকে আমাদের গৌরবের ধন ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি স্থাপনা, শহিদ মিনারের গল্প শুনিয়েছিলাম। এবার মহান স্বাধীনতার মাসে শোনাব, বাংলাদেশের সম্ভবত সবচয়ে সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ সৌধটির কথা, যেটি ‘জাতীয় স্মৃতিসৌধ’ নামেই সবার কাছে পরিচিত। এই স্মৃতিসৌধটি আসলে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী ত্রিশ লক্ষ শহিদকে জাতীয়ভাবে স্মরণ করা, তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও তাঁদ꧟ের স্মৃতিকে অমর করে রাখার মহতী উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছে। স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালের বিজয় দিবসে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন খোদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তোমরা নিশ্চয়ই জানো এটি রাজধানী শহর ঢাকার অদূরে সাভার অঞ্চলে অবস্থিত। কিন্তু তোমরা কি জানো কেন এর স্থান হিসেবে সাভারকে বেছে নেওয়া হয়েছিল? এর কারণ, আমাদের স্বাধীনতার পেছনে এই সাভারের বিশাল অবদান রয়েছে। বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধটি হয়েছিল সাভারেই। আমাদের বীর মুক্তিবাহিনীও অসীম সাহস ও শৌর্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে পাকিস্তানী সৈন্যদের পরাজিত করে দ্রুত রাজধানীর দখল নিতে না পারলে কিন্তু এত সহজে দেশ স্বাধীন হত না। রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা আহত ও নিহত হয়েছিল। এছাড়া হানাদার বাহিনীর হাতেও প্রাণ দিয়েছিল আরও অগণিত সাধারণ জনগণ, স্বাধীনতার পর যাদের একাধিক গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছিল এ অঞ্চলে।
দেশ স্বাধীন হবার পরপরই যখন এরকম একটি ꦍস্মৃতিসৌধের জন্য সম্ভাব্য জায়গা খোঁজা হচ্ছিল তখন স্বাভাবিকভাবেই সাভারের নামটি উঠে আসে বারবার। পরবর্তীকালে এই গণকবরগুলোকে ঘিরেই এর স্থানটি চূড়ান্ত করা হয়। তোমরা যারা স্বাধীনতা কিংবা বিজয় দিবসে আমাদের স্বাধীনতার স্মারক এই মহান স্থাপনাটি দেখতে গেছ, তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, এর মূল চত্বরের খুব কাছেই বেশ কয়েকটি গণকবরকে খুব যত্ন করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেগুলোই হল উনিশশো একাত্তর সালে পাকবাহিনীর ব্যবহৃত বাস্তব বধ্যভূ💜মি ও স্বাধীনতার পরপর আবিষ্কৃত সেইসব সত্যিকার গণকবর।
এখন তোমরা আমাকে প্রশ্ন করতে পারো, এই যে এত সুন্দর জাতীয় স্মৃতিসৌধটি আমাদের, এর স্থপতি কে, কিংবা কে এর নকশা করেছেন? তোমরা জেনে অবাক হবে এটির স্থাপত্য নকশা যিনি করেছিলেন তাঁর বয়স তখন ছিল মাত্র ছাব্বিশ। তাঁর নাম সৈয়দ মাইনুল হোসেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন তরুণ স্থপতি তিনি তখন। আসলে ১৯৭৮ সালে এই স্মৃতিসৌধটির নকশা নির্বাচন করার লক্ষ্যে একটি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিলেন এই সৈয়দ মাইনুল হোসেন। এবং আশ্চর্যের বিষয় সবাইকে অবাক করে দিয়ে মোট ৫৭ জন প্রতিযোগীর মধ্যে তাঁর নকশাটিই প্রথম হয় এবং এর জন্য তিনি নগদ ২০ হাজার টাকা পুরস্কার পান। সবচেয়ে বড় কথা তাঁর নকশা অনুযায়ীই সৌধটি নির্মিত হয় এবং সেই সূত্রে তাঁর নামটি আমাদের দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় একটি স্থাপনার সঙ্গে ꧒চিরদিনের জন্য গাঁথা হয়ে যায়।
আরও একটি প্রাসঙ্গিক তথ্য, সেই প্রতিযোগিতার সকল বিচারক সর্বসম্মতিক্রমে তাঁর নকশাটিকেই শ্রেষ্ঠ বলে রায় দিয়েছিলেন। আর সেই বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় স্থপতি মাজহারুল ইসলাম স্বয়ং। অত্যন্ত পরিতাপের কথা,দেশের এই অত্যন্ত মেধাবী স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন একপর্যায়ে মানসিক অবসাদ ও অস্থিরতায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২০১৪ সালে মাত্র বাষট্টি বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে তার আগে তিনি দেশের আরও কয়েকটি প্রখ্যাত স্থাপনার দৃষ্টিনন্দন নকশা উপহার দিয়ে যান আমাদের। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তন,উত্তরা মডেল টাউন, চট্টগ্রাম ইপেজেড এর সদরদপ্তর ইত্যাদি। আমার ভাবতে ভালো লাগে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন আমি যে-ছাত্রাবাসের বাসিন্দা ছিলাম,তিনিও সেই সোহরাওয়ার্দি হলেরই একজন আবাসিক ছিলেন।
সে যাক,চারবছরের নির্মাণকাজ শেষে ১৯৮২ সালের ষোলই ডিসেম্বর এই বহুল প্রতীক্ষিত স্মৃতিসৌধটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। স্মৃতিসৌধ স্থাপনার মূল চত্বরের আয়তন ৮৪ একর,আর এর বাইরে চারদিক বেষ্টন করে রয়েছে আরও ২৫ একর স্নিগ্ধ সবুজ জমি ও জলাভূমি। মূল সৌধটি সিমেন্ট ও কংক্রিট নির্মিত হলেও এর আনুষঙ্গিক স্থাপনাসমূহে ব্যবহার করা হয়েছে মূলত দেশীয় লাল ইট। আর তার ফাঁকে ফাঁকে সবুজ ঘাস,বৃক্ষরাজি, নানা বর্ণের ফুল, অনেকগুলো জলাধার, উদ্যান, কৃত্রিম হ্রদ ইত্যাদি মিলে পুরো বাংলাদেশের নৈসর্গিক আবহটিকেই যেন খুঁজে পাওয়া যায় এই স্থাপনাটির হৃদয়জুড়ে। এতে রয়েছে আমাদের জাতীয় ফুল শাপলাফোটা একটি পুকুর, যার মধ্যে স্মৃতিসৌধটির ছায়া প্রতিফলিত হয়ে এক অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্যের জন্ম হয়। পুরো চত্বরটি বেশ অনেকটুকু জায়গা জুড়ে এবং তার মধ্যে নানারকম উঁচুনিচু ধাপ,আঁকাবাঁকা পথ, জলভরা পরিখা আর তার ওপর সেতুর অবস্থান।
মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার পর তাই অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে, দীর্ঘ ও বন্ধুর পথ পরিক্রমাশেষে একটি লম্বা সেতু পেরিয়ে অবশেষে মূল স্তম্ভের নিকটে যেতে হয় দর্শনার্থীদের। এবং এটি সচেতনভাবেই করা। এর কারণ হিসেবে স্থপতি মাইনুল হেসেন যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটি হচ্ছে, আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতাও তো কোনো সহজ পথে আসেনি;তার জন্য আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ নয়মাসের কঠিন ও রক্তাক্ত, বহু বাধা ও বিঘ্নভরা অমসৃণ পথ। আমাদের স্বাধীনতালাভের এমন অভিজ্ঞতাটিকেই তিনি প্রতীকায়িত করে এইভাবে স্থাপত্যের ভাষায় উপস্থাপন করেছেন তাঁর এই ব্যতিক্রমী ভাবনা ও নকশায়।
এত পথ পাড়ি দিয়ে শেষপর্যন্ত আমরা যে মূল সৌধটির কাছে গিয়ে উপনীত হই সেটিও কিন্তু কম আকর্ষণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ নয়। এটি মূলত সাতজোড়া সদৃশ কিন্তু অসম মাপের ত্রিভুজাকৃতি কৌণিক দেয়ালের সমাহার। দেয়ালগুলো ছোট থেকে ক্রমশ বড় হয়েছে। সর্বোচ্চ স্তম্ভটি সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যের ভিত্তির ওপর, আর সর্বদীর্ঘ ভিত্তির ওপর স্থাপিত স্তম্ভটি সবচেয়ে কম উচ্চতার। প্রাচীরগুলি মাঝখানে একটি ভাঁজ দ্বারা কোণাকারে একটির পর একটি সারিবদ্ধভাবে বসানো। কাঠামোটি এমনভাবে বিন্যস্ত যে, ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে একে ভিন্ন ভিন্ন আদলে দেখতে পাওয়া যায়। কখনও কয়েকটি তিনকোণা দৃষ্টিনন্দন জ্যামিতিক নকশা, কখনও উড়াল দেওয়া পাখির পাখনার মতো,কখনওবা ঢেউয়ের মতো ছন্দোময় উদ্ভাসিত অবয়ব। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দৃশ্যমান এর এই বহুবিধ ও বিচিত্ররূপের কারণে এটি দর্শকদের মনেও একইসঙ্গে নানান আবেগ ও অনুভূতির জন্ম দেয়। দূর থেকে সৌধটিকে একটি একক ও সংযুক্ত কাঠামো বলেই মনে হয়। কিন্তু কাছে গেলে দেখা যায় প্রত্যেকজোড়া দেয়ালের মাঝখানে কমপক্ষে দশ ফুট করে ব্যবধান রয়েছে। নকশার এই অভিনবত্বটুকু আমাদের জাতিগত বৈচিত্র্য ও ব্যবধানের মধ্যেও যে অটুট এক ঐক্য বিদ্যমান, তারই আভাস দেয়।আর একেবারে সামনে থেকে দেখলে মাঝখানে এসে মিলে যাওয়া যে সর্বোচ্চ স্তম্ভটিকে দেখতে পাওয়া যায়, যার উচ্চতা ১৫০ ফুট, সেটি মূলত আকাশপানে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো খোদ বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরই প্রতীক।
আরও একটি প্রশ্ন জাগতে পারে তোমাদের মনে, স্মৃতিসৌধের এই যে অদ্বুত সুন্দর সাতটি দেয়াল, সেগুলো আসলে কীসের প্রতীক? এর উত্তরে স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন আমাদের জানান যে, বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে যে সাতটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার অবদান সবচেয়ে বেশি,বস্তুত যে ঘটনাগুলোর ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ ক্রমে তার স্বাধীনতার স্বর্ণদুয়ারে পৌঁছাতে পেরেছে, এই দেয়ালগুলো সেই সাতটি অবিস্মরণীয় আন্দোলন কিংবা রাজনৈতিক ঘটনা পরম্বপরারই প্রতীক। সেগুলো হচ্ছে: ৫২র ভাষা আন্দোলন, ৫৪র নির্বাচন ও যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়, ৫৬র সংবিধান আন্দোলন, ৬২ সালের শিক্ষানীতি আন্দোলন, ৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও সবশেষে ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। আসলেই তো,তোমরাই বলো, এই সাতটি অনন্য ঐতিহাসিক মুহূর্তকে বাদ দিয়ে কি বাংলাদেশের অস্তিত্বকে কল্পনা করা সম্ভব?
লেখাটি শেষ করার আগে তোমাদের বলি, বাংলাদেশের সুন্দরতম এই স্মৃতিস্থাপনাটির ঢোকার মুখেই শ্বেতপাথরের ফলকে আমাদের প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত কবিতার লাইন বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। সেটি হচ্ছে: “বীরের এ রক্তস্রোত, মাতারꦬ এ অশ্রুধারা/এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা?” তোমাদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, স্বাধী💛নতার এই মহান মাসটিতে চলো প্রতিজ্ঞা করি, যেন ভুলেও কখনো আমরা আমাদের স্বাধীনতার সূর্যসৈনিক এইসব ‘বীরের রক্তস্রোত’ আর ‘মাতার অশ্রুধারা’র সামান্যতম অবমাননাও না করি।