• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২১ ভাদ্র ১৪৩১, ৩০ সফর ১৪৪৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Songbad Prokash

ইনস্টাগ্রাম

টুইটার


লিংকডইন

পিন্টারেস্ট

গুগল নিউজ


আদিবাসী জীবনকথা ১১

ঋষিদের জাতিসত্তা টিকে আছে নেহাল গ্রামে


সালেক খোকন
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৩, ০২:৫২ পিএম
ঋষিদের জাতিসত্তা টিকে আছে নেহাল গ্রামে

মধ্য দুপুর। গোটা রাস🔯্তায় কোনো লোকের দেখা নেই। চারপাশে সুনসান নীরবতা। ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা চারপাশে। সূর্যটাও মুখ লুকিয়েছে কুয়াশার চাদরে। এ রকম দ🀅িনে ঘর থেকে বেরোনোর সাধ্যি কার! তা-ও আবার কোনো শহরে নয়। দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার ধুকুরঝারির প্রত্যন্ত পথে। 


এখানকার আবহাওয়া নাকি সব সময়ই চরম ভাবাপন্ন। তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা তো আছেই। তাই বছর কয়েক ধরে শীতের তাপমাত্রা নেমে আসছে ৪ থেকে ৫ ডিগ্রিতে। আর গরমের সময়ে জিব বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
প্রচণ্ড শীতে মাঙ্কি ক্যাপে ঢাকা পরিচিতজনদের চেনাই দায়। মুখ চিনতে চোখ দুটোই একমাত্র ভর🎉সা। সেভাবেই চিনে নিলাম স্থানীয় যুবক বাবুকে। একটি মোটরসাইকেল নিয়ে ধুকুরঝারির মোড়ে অপেক্ষায় ছিল সে। 


আমাদের গন্তব্য নেহাল গ্রামের আদিবাসী পাড়ায়। সেখানে মুসহরদের ৬৫টি ꦚআদিবাসী পা🐓রিবারের বাস। পাকা রাস্তা থেকে পাড়াটি সাত কিলোমিটার ভেতরে। ইউনিয়নের নাম তিন নম্বর ধামইর। ইউনিয়নের নাম জানতে চাইলে, স্থানীয়রা উত্তরে বলে, ‘৩ নং’। মূল নামটিকে আড়ালে রেখে নম্বর বলতেই যেন সবাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। 


বাবুর মোটরসাইকেলটি এগোয় গ্রামের প্রধান সড়ক ধরে। ডান দিকে বাঁক নিয়ে হঠাৎ নামিয়ে দেয় সরু ♋একটি মেঠোপথে। দুপাশে বেড়ার ঘের। অনেক দূরে তাকালে দু-একটা গ্রাম চোখে পড়ে। বাবু জানাল একসময় এখানেই ছিল আদিবাসী মুসহরদের পাড়াটি। নানা কারণে জ꧂ায়গাটি চলে আসে স্থানীয় চৌধুরীদের দখলে। এ নিয়ে চৌধুরীদের সঙ্গে তাদের কিছুদিন দ্বন্দ্ব-সংঘাতও চলে। কিন্তু টিকতে পারে না তারা। কিন্তু তাতেও মুসহররা দমে যায় না। তারা চলে যায় আরও ভেতরের দিকে।


জমি๊ কিনতে আদিবাসীরা সবাই মিলে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। অতঃপর নেহাল গ্রামের শেষ প্রান্তে গড়ে তোলেন মুসহর পাড়াটি। সেটিও অনেক বছর আগের ঘটনা। এখন এই পাড়াতেই নিজেদের জাতিসত্তা নিয়ে টিকে আছেন মুস꧟হররা। নেহাল গ্রাম ছাড়াও দিনাজপুরের দেরাপাটিয়া, গোবিন্দপুর আর দারুইলে আছে তাদের আরও আদিবাসী পাড়া। 


বাবুর কথা হঠাৎ থেমে যায়। সেই সঙ্গে মোটরসাইকেলটিও। বড় একটি আম্রপালি আমবাগানের ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি। এখ⛎ানে শীত যেন ❀প্রকৃতির ছোঁয়ায় আরও জেঁকে বসেছে। খানিকটা পথ এগোতেই পৌঁছে যাই আদিবাসী পাড়াটিতে। 


🧸মুসহর পাড়ায় ছনে ঢাকা ছোট্ট ছোট্ট ঘর, খানিকটা ভিন্ন ঢঙের। একটি বাড়িতে ঢুকে কাউকে পাওয়া গেল না। বাড়িটির উঠানের মাঝে তুলসীগাছ। গাছটির গোড়াতে মাটির উঁচু ঢিবি করে লেপে দেওয়া হয়েছে। উঠানের এক কোণে বড় একটি মাটির চুলা। ছোট একটি ঘরের পাশেই লাগোয়া আরেকটি ঘর। এটি যে গোয়াল ঘর, তা বেশ বোঝা যায়। ঘরগুলোর মধ্যে কোনো জানালা নেই। বাবু জানাল মুসহরদের বাড়িগুলো নাকি এমনটাই হয়। তবে এꦰকসময় এদের অবস্থা আরও ভালো ছিল। তখন বাড়িগুলোতে ছিল সচ্ছলতার ছাপ। এখন এ আদিবাসীদের সবকিছুতেই পড়েছে দারিদ্র্যের ছাপ। 


গোটা পাড়াটি ঘুরে দেখি আমরা। শীত🥃ে কাঁপা দু-একটা কুকুরের পাশে বসে কিছু একটা ভাবছে এক বৃদ্ধা। বয়স নব্বইয়ের মতো। শরীরে কোনো গরম কাপড় নেই। পরনের কাপড়টিকে অবলম্বন করেই সূর্যের অপেক্ষায় বসে আছেন তিনি।


মুসহর পাড়া꧟র শেষ প্রান্তে টিনে ঘেরা একটি ঘর। সাইনবোর্ড দেখে জানা গেল এটি আদিবাসী শিশুদের একটি স্কুল। স্কুলটি পরিচালনা করে স্থানীয় এক এনজিও। মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের জন্য এ স্কুলই মুসহর আদিবাসীদের একমাত্র ভরসা।


পাশেই মানুষের জটলা। পাড়ার সবাই এসেছে সেখানে। তারা কথা বলছে ভিন্ন কোনো ভাষায়। তার কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের দেখে এগিয়ে আসেন কেশো ঋষি। গোত্রের মণ্ডল তিনি। কেশো জানালেন, নিজেদের মধ্যে মুসহররা কথা বলে ভিন্ন ভাষায়। এদের পূর্বপুরুষরা এসেছে ভার🤡তের মুংগাইর জেলা থেকে। ব্রিটিশ আমলে রেললাইনের কাজ হয়েছে সারা দেশে। সে সময় কাজের টানে তাদের পূর্বপুরুষরাও চলে আসেন এ দেশে।


পরিচিত হই পলিন ঋষির সঙ্গেও। গোত্রের একমাত্র শিক্ষিত যুবক তিনি। পলিন জানালেন, মুসহর আদিবাসীরা তাদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে ব্যবহার করে ‘ঋষি’ শব্দটি। 
মাসখানেক আগের একটি ঘটনা নিয়ে পাড়ার সবাই আলোচনায় বসেছে তখন। ঘটনাটি শুনে বাঙালি হিসেবে খানিক লজ্জিতও হই। কিছুদিন আগে কয়েকজন বাঙালি এসে জানান, আদিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য একটি এনজিও গরু-♉ছাগল দিয়ে সাহায্য করবে। তারা মুসহর পাড়ার আদিবাসীদের নানা তথ্য সংগ্রহ করে।𒅌 এরপর প্রত্যেকের কাছ থেকে খরচ হিসেবে নেয় ১৭০ টাকা। সরল মনেই আদিবাসীরা সব বিশ্বাস করেন। 


নির্ধারিত দিনে গরু-ছাগলের আশায় তারা প্রহর গোনেন। কিন্তু ওই লোকগুলো তখন লাপাত্তা। সারা দিন অপেক্ষা করে নিজেদের বিশ্বাসকে বোকামি ভেবে ঘরে ফিরে আসেন মুসহররা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এভাবেই ভেঙে যায় আদিবাসীদের বিশ্বাসগুলো। ফলেไ ধীরে ধীরে তাদের চরিত্রের মাঝে স্থান করে নেয় ‘অবিশ্বাস’ নামক শব্দটি।


পনিল ঋষির বাবা ফাগুয়া ঋষি ও মা সন্তোনা ঋষিসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ। এনজিও স্কুলটিতে তিন ঘণ্টা পড়িয়ে মাসে যে বেতন পান, তা দ🅘িয়ে নিজের পরিবার চালাতে হ🌺িমশিম খেতে হয় পলিনের।


তিনি জানালেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে মুসহরদের গ্রাম পরিষদ। এ গোত্রে এখন মণ্ডল, ছড়িদার আর পারমানি ছাড়া আর কো♕নো পরিষদ নেই। গোত্রের মণ্ডল কেশো ঋষি, গোবিন্দ ঋষি হলেন ছড়িদার এবং সমারু ঋষি পারমানির দায়িত্ব পালন করছেন।


গোত্রের মণ্ডল গোটা পাড়া ঘুরিয়ে দেখান আমাদের। হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় মুসহরদের বিয়ে নিয়ে। এ আদিবাসীদের নিজ গোত্রের বাইরে বিয়ে নিষিদ্ধ। অন্যদের মতো এরাও বিয়েবাড়িতে কলাগাছ দিয়ে মারোয়া সাজায়। বিয়ের আগে বর ও কনে নিজ নিজ বাড়িতে জোয়ালপূজা করেন। তাদের ভাষায়, 𝄹‘জোঙ্গাল বা আনকে পূজাইয়ে’। পনকে এরা বলে ‘পোনা দেখাল’। একসময় এদের বিয়েতে পণ দেওয়ার বিধান থাকলেও এখন মুসহর ছেলেদের খুশিমতো যৌতুক দিতে হয়।&nbsꦐp;


এ আদিবাসীদের বিয়ের নিয়ম মোতাবেক বরকে প্রথমেই বরণ করতে হয় শাশুড়ি, খালাশাশুড়ি, চাচিশাশুড়িকে। বরণ করাকে এরা বলে ‘চুমা য🍬ায়ে’। এরা বরকে বরণ করে ধানা (ধান), দুবরিয়া ঘাসা (দূর্বাঘাস), পানা (পান), গোবরা (গোবর) দিয়ে। 


বিয়েতে মেয়ের বাবাকে তার﷽ জামাতাকে দিতে হয় ডোনারিয়া (কাইতন), ধোতিয়া (ধুতি), গামছাবা (গামছা), পাঞ্জাবি প্🐷রভৃতি। একইভাবে ছেলের বাবা তার পুত্রবধূকে দেন নুউওয়া (বিয়ের শাড়ি), কুর্তা (ব্লাউজ) প্রভৃতি। সাঁওতালদের মতো একসময় এরাও সাদা কাপড় কাঁচা হলুদে ডুবিয়ে বিয়ের শাড়ি তৈরি করত। কিন্তু এখন সাধ্যের মধ্যে শাড়ি কিনতে পারায় মুসহররা কাঁচা হলুদে আর বিয়ের শাড়ি তৈরি করে না। 


পনিল জানান, নিয়ম মোওতাবেক মুসহরদের বিয়েতে বর-কনেকে মারোয়ায় বসিয়ে লগ্ন মিলন করতে হয় বলে লগ্ন মিলন কাজটি করা হয় একটি কাঁসার বাটিতে রাখা পানির মধ্যে। বরের ভাগির মা (ভাগনে) বাটির পানিতে আমপাতা ডুবিয়ে তাতে সিন্দুর (সিঁদুর) লাগানো চার (চাউল) ছেড়ে দেয়। দুটি চাল ভাসতে ভাসতে একসঙ্গে লেগে গেলেই তা ধরে ফেলা হয়। ধরে নেওয়া হয় এটিই বিয়ের উপযুক্ত সময়। 


তাদের ভাষায়, ‘কাংনা বানেল লাগা’। ঠিক সে সময়েই বর-কনেকে কানি আঙুলে সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। বিয়ের পরে চলে ‘দান্না কারবি’ পর্ব। একে একে সবাই আশীর্বাদ করে উপহার তুলে দেয় এ পর্বে। পাশাপাশি চলে নাচ, গান আর🃏 হাড়িয়া খাওয়া।


গোত্রের মণ্ডল জানান, অন্যান্য জাতির মতো মুসহরদের বিয়েতে কনেপক্ষকে বরের বাড়িতে দাওয়াত করা হয় না। বরং আট দিন পর বরই আবার কনেকে তার বাবার বাড়িতে দিয়ে আসে। মুসহররা বলে, ‘বেটিয়া দামদা আঠারোয়া এতে’ অর্থাৎ বেটি আট দিন ✤পরে জামাইসহ বাবার বাড়িতে🎶 আসে।


মুসহর পাড়ার একেবারে শেষ প্রান্তে একটি বাঁশঝাড়ের পাশে বসে আমাদের গল্প চলে। আসরে যোগ দেয় দারা ঋষি। বছরের কোন সময়টা মুসহরদের জন্য খারাপ সময়? প্রশ্ন করতেই দারা ঋষি জানাল, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক। এ সময়টাতে অন্যান্য আদিবাসীদের মতো এরাও মহাজনদের কাছে আগাম মজুর বিক্রি করে। পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই অভাবের এই সময়টাতে এরা জংলি আলু খেয়ে বেঁচে থাকে। জংলি আলুকে এরা বলে ‘অরুয়া চোতা হাওয়া’। কোথায় পাওয়া যায় এটি? জানতে চাই༺লে দারার উত্তর, ‘চোতা হাওয়া হওয়া হে বাসাক জাংলাম’ অর্থাৎ জংলি আলু হয় বাঁশের ঝোপে।


পাশ থেকে মণ্ডল জানালেন, অন্য আদিবাসীদের মতো এদেরও পূজার সময়টাই আনন্দের সময়। মুসহরদের সবচেয়ে বড় উৎসব ছটপূজা। এ পূজা হয় আশ্বিন-কার্তিকে ডালা বা চিতিয়া পূজার পর পরই। প্রথানুসারে এ পূজায় নিকটস্থ নদী বা পুকুরে সূর্য ডোবার আগে এদের পূজা দিতে হয়। ঠিক তার পরের দিনই সূর্য ওঠার আগে আগে আবার পূজা শেষ করতে হয়। এ ছাড়া গৃহদেবতা হিসেবে এরা তুলসীপূজা করে। গৃহদেবতাকে মুসহর ভাষায় বলে ‘সিরবা খারা’।
মুসহরদের সঙ্গে গল্প আরও জমে ওঠে। কথার পিঠে কথা চলে। চারদিকে অন্ধকার নামে। জোনাকির বাগানে চলে ঝিঁঝির ডাক। দূরে ডেকে ওঠে শেয়ালের দল। নেহাল গ্রামে বাজে আদিবাসীদের মাদলের বাদ্য। আমরাও হারিয়ে যাই অজানা সব কাহিনির রাজ্যে।
 

Link copied!