কিছু কিছু বই পড়ার সময় সেখান থেকে বের হওয়া যায় না। 🍒যেমন আমি গত সপ্তাহ জুড়ে ‘দি বেল জার’ পড়ছিলাম। প্রাত্যহিক কাজ কর্ম ও বইমেলায় যাওয়া আসার কারণে পড়ার সময় পাচ্ছিলাম কম। তবুও যখনই পড়া শেষে ঘুমোতে যেতাম, ঘুম আসত না। সিলভিয়া প্লাথ রচিত ‘দি বেল জার’ এমনই বই যা আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। অবশেষে শেষ করতে পারলাম। এখনও আমি ‘দি বেল জার’ এর মোহেই আছি। এত অসামান্য একটা গ্রন্থ আমি এতদিন পড়িনি কেন বলে কিঞ্চিৎ দুঃখও হচ্ছে। তবে শেষ ভালো যার সব ভালো তার। বই আমার কাছে একটা সম্পর্কের মত, জীবনের মত, বয়ে নিয়ে যেত হয়, এড়ানো যায় না।
বলে রাখা ভালো, ‘দি বেল জার’ বাংলায় অনুবাদ করেছেন মোস্তাক শরীফ। তিনি সুলেখক ও অনুপম গদ্যকার এবং নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সিলভিয়া প্লাথ আমার আছে কবি হিসাবে পরিচিত। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সেই প্রয়াত হন। কিন্তু তার গদ্য লেখা যে এত পরিণত, এটা এই বইটার আগে জানতাম না। তিনি লিখেছেন এই বইটি কিছুটা জার্নালের মত। তবে তারিখ নেই, নাম ধাম পাল্টানো। কিন্তু আপনি যদি সিলভিয়া প্লাথ নিয়ে সামান্য ওয়াকিবহাল থাকেন তাহলেই বুঝবেন এটা আসলে এসথার গ্রিনউডের না, সিলভিয়া প্লাথেরই কলেজ জীবনের গল্প। ১৯৬৩ সালে সিলভিয়া প্লাথ ভিক্টোরিয়া লুকাস ছদ্মনামে লিখেছিলেন, এক ব্রিটিশ প্রকাশক বইটি বের করেছিল🌠। তার মা চাননি বইটা প্রকাশ হোক। তার মৃত্যুর পরে ১৯৭১ সালে বইটি প্রকাশিত হয় মার্কিন মুল্লুকে। দি বেল জার নাম রাখার কারণ তিনি বলেছেন, ‘বেল জারের বাঁকাচোরা কাঁচের মধ্য দিয়ে আমার পৃথিবী এবং সে পৃথিবীর মানুষদের দেখার চেষ্টা করেছি।’
বাংলার প্রখ্যাত গীতি কবি জালাল খাঁ তার একটা গানে লিখেছিলেন, ‘কুল নাই দরিয়ার কূলে-বৃক্ষ একটি মনোহর।’ গানের মতই সিলভিয়া প্লাথ তার যাপন করা জীবনে সাফল্যের পাশাপাশি দেখেছেন সেই দুঃখের সাগর। যেখানে বিভিন্ন ঝড় এসে তার জীবনকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। বুদ্ধ বলে গেছেন, সর্বম দুঃখম। মানে সব কিছুই দুঃখময়। সেই দুঃখকে গলার মালা বানিয়েই অল্প কিছুদিন দুনিয়ায় ছিলেন সিলভিয়া প্লাথ। সেই জীবনে খালি ঘটেছে মোহভঙ্গ আর হতাশা। অভাব অনটনে😼র ভেতরেও মেধাবী একটা জীবন ছিল তার। অল্প বয়সে পেয়েছিলেন মেধার মূল্যায়নও। কিন্তু তিনি সেই সময়ের প্রচলিত মানুষদের মত নন। কেন সেরকম হতেই হবে, কেন ওরকম করতেই হবে এসব প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরতো। বিভিন্ন দুর্ঘটনাও তার জীবনকে বিষিয়ে তুলেছিল। ডেইটে গিয়ে ‘রেইপড’ হবার মত পরিস্থিতি, প্রেমিকের যক্ষ্মা রোগ, সার্বক্ষণিক জাজ হবার ভয়, তার কাজ পাগল সাময়িক অফিসের বস, তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ও লজ্জিত মা সব কিছুর কি নিদারুণ গল্প আছে ‘দি বেল জার’ উপন্যাসটিতে।
সিলভিয়া প্লাথের উপন্যাসটায় যে জিনিসটা অনেক পাঠক ধরতে পারেনি সেটা হলো ওনার সার্কাজম। অনেক বিষয়🐈 নিয়েই তিনি এত মজা করেছেন, আপনার একই সাথে হতাশা ও কৌতুকবোধও আসবে। যেমন তার মেধাবী প্রেমিক যখন কবিতাকে উড়িয়ে দেওয়ার ছলে বলছিল, কবিতা লিখে কী হয়? অথবা কুমারীত্ব নিয়ে বিভিন্ন ছুৎমার্গ, ব্যাপারটা যে তার কাছে বোঝা হয়ে যাচ্ছে, সেই অংশগুলো। বিভিন্ন সময় নানান মানসিক রোগের চিকিৎসক ও হাসপাতালের শ্বেত শুভ্রতার ভেতরেও তার যে জীবন নিয়ে অস্থিরতা সেসব অংশ দারুণ। এত কঠিন সময়ের ভেতরেও চরিত্রটি নিজের সাথে মজা করছে। চিকিৎসক তার মাথায় ইলেকট্রিক শক ওয়েভ দেবেন, তাকে তিনি টেবিল ল্যাম্পের সাথে তুলনা করছেন। তার মুখে অন্য কথাဣ থাকলেও মনে যে আরেকটা সেটা প্রকট হয়ে ধরা পড়ছে। এসথারের জীবনের সাথে মাঝেমধ্যে আমাদের জীবনের মিলও খুঁজে পাওয়া যায়। সাফল্য, আনন্দ এসব তাৎক্ষণিক, জীবনে স্থায়ী হয়ে থাকে দুঃখবোধ ও হতাশা। এসথারেরে যেমন হুট করেই জীবনটা খুব তুচ্ছ মনে হতে থাকে।
কয়েক সপ্তাহ আগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক ছাত্র আত্মহত্যা করে সুন্দর একটা নোট লিখে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আমার বারবার মনে হচ্ছিলো এই বইটির কথা, সিলভিয়া প্লাথের ‘দি বেল জার’ সব যুগেই এম🍒ন ভাবেই প্রাসঙ্গিক থাকবে। মোস্তাক শরীফের অনুবাদ সহজপাঠ্য ও অসাধারণ। নিরুপম গদ্য ভঙ্গিতে তিনি চমৎকার ভাবে বইটি অনুবাদ করেছেন। আমার মাঝেমধ্যে কিছু অনুবাদ পড়লে মনে হয়, বুঝতে পারছি না, মূলটা পড়া দরকার। মোস্তাক শরীফের অনুবাদে সেই সমস্যা নেই।
বইয়ের নাম : দি বেল জার
মূল লেখক : সিলভিয়া প্লাথ
অনুবাদ : মোস্তাক শরীফ
প্রকাশক : বাতিঘর
মূল্য : ৪৫০ টাকা