তখন আমার কত বয়স, হয়তো ১৯-২০। কীভাবে জানি আমার অনেক সাহস ছিল। এখনকার মতো মতামতহীন চুপচাপ ছিলাম না। তো সিক স্যারের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে নতুন দিগন্তে এড্রেসে গিয়েছিলাম দেখা করতে। আমার মতো অর্বাচীনকে তিনি পাত্তা দেবেন ভাবিনি। চা খাওয়ালেন, কুশল বিনিময় করলেন। তারপর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি কিভাবে একটা ব্যর্থ ব্যাপার তা নিয়ে বলছিলেন। এমনিতেই আমি তাকিয়ে কথা বলতাম না, তার সামনে গিয়ে আরও মাথা নিচু করে ছিলাম। সূর্যের আলো জানলা দিয়ে মুখে আসছে, সিরাজুল ইসলাম জ্বলজ্বল করছেন। আমার জীবনে সেই বয়স অবধি সেরা অর্জন ছিল ওনার সাথে দেখা করা। আরেকদিনই কেবল সাথে দেখা হয়েছে, কল্পনা চাকমা নিয়ে এক প্রোগ্রামে। কি দারুণ ভাবে বলেছিলেন, “এই রাষ্ট্র হবার কথা ছিল সবার। কিন্তু না হয়েছে আদিবাসীর, না হয়েಌছে অনাবাসীর, না হয়েছে সংখ্যালঘুর, না হয়েছে সংখ্যাগুরুর। কল্পনা চাকমা দেখিয়ে দেয় এ রাষ্ট্র সামরিক বেসামরিক ক্ষমতায় থাকা মানুষের লালসার কাছে কতটা জিম্মি।” আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। বৃষ্টি বৃষ্টি দিন লোকজন কম, আমাকে ডাক দিয়ে স্যার বললেন, “কী খবর পাঞ্জাবিওয়ালা?” আমার তখন মনে হলো, জীবনে আর কী চাই। স্যারের হাজার হাজার ছাত্র না হয়েও উনি আমায় চেনেন। জন্মদিনে শুভেচ্ছা স্যার। আমি চাই আরও অনেকদিন বাঁচুন ও লিখতে থাকুন।
একটু দৃষ্টি ফেরাই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জীবনের দিকে। অনেকেই বলবেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আপোষপ্রবণ। আপোষ ও উন্নতিকে জীবনের অর্জন ভাবলে উনি ভিসি হতেন। খুবই 🦹সহজ ছিল ১৯৮৩ সালে তার ভিসি হওয়া। তিনি হননি। তার স্ত্রীও বলেছিলেন, “আ🐎মি তো একজন লেকচারারকে বিয়ে করেছিলাম।” এই যে না হতে চাওয়া, এই সৌন্দর্য, এসব প্রতিভাবান মানুষরা বুঝতেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বাবা খুব চাইতেন তিনি আমলা হবেন একদিন। এইজন্য ঢাকা ভার্সিটির ইকোনোমিক্সে পড়তে বলেছিলেন। ইংরেজিতে ভর্তি হয়েও পিতার মুখ উজ্জ্বল করেছেন। সিরাজুল ইসলামরা ছিলেন ১৩ ভাইবোন। তার বাবা সরকারি কর্মচারী। দেশভাগের পর তাদের কলকাতা থেকে আসতে হয়। ঢাকা তখন এক মফস্বল। আজিমপুরে কলোনি হয়েছে। সেখানে একটা মধ্যবিত্ত আবেশে সিরাজুল ইসলামদের বেড়ে ওঠা ও কৈশোর। ক্লাস নাইন থেকেই তিনি হাতে লেখা পত্রিকা বের করেন। তখনই তিনি প্রচুর পড়তেন। মাস্টার্সে যখন ফার্স্টক্লাস পেলেন, আজিমপুর জুড়ে আনন্দ হৈ হুল্লোড়। তিনি অন্যদের মত সিএসপিতে গি𒁏য়ে মেধা দেখানোতে উন্মুখ হয়ে যাননি, আর প্রশাসনকেও ভালো চোখে দেখতেন না। জানতেন পিতৃতন্ত্রের বিপদ। ভাগ্য ভালো ঢাকা ইউনিভার্সিটির চাকরিটা পেয়েছিলেন। এরপর তিনি লিডসে পিএইচডি করতে যাওয়া ছাড়া এ শহরেই ছিলেন ও আছেন। তিনি ছিলেন শিবরাম চক্রবর্তীর বিশাল ভক্ত। ভাবতেন তার মতোই গল্প উপন্যাস লিখবেন। কিন্তু তার ঝোঁকটা ছিল সাংবাদিকতার। কলাম ও উপসম্পাদকীয় এসবেই ছিল আগ্রহ। এই আগ্রহে থেকেই তিনি সংবাদে কলাম লিখেছেন অনেকদিন। সত্তর আশির দশকে তার কলাম অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। নামও ছিল কি সুন্দর, গাছপাথর।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর শিক্ষকতার অনুরক্ত আমি নই। কারণ আমি তার ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করিনি। আমি ভক্ত ওনার লেখনি ও সম্পাদনার। বছরের পর বছর তিনি ত্রৈমাসিক নতুন দিগন🌞্ত সম্পাদনা করে চলছেন। অত্যন্ত মানসম্মত কিন্তু দামে সস্তা একটা পত্রিকা। সেখানে সিক স্যারের লেখা তো থাকেই। সাথে থাকে শুরুতেই ওনার লেখা অসাধারণ এক সম্পাদকীয়, ভূমিকা আকারে। এত সুন্দর ভূমিকা বাংলাদেশে বিরল। বাংলাদেশে সিরিয়াস প্রবন্ধ সাহিত্যের কিংবদন্তি তিনি, শখানেকের ওপর বই আছে। বদরুদ্দীন উমর ছাড়া ওনার সমসাময়িক তো থাকুক অন্য আর কারও এত কাজ নাই। শরৎচন্দ্র থেকে জেমস জয়েস, নীরদ সি চৌধুরী থেকে চিত্তরঞ্জন, ফজলুল হক থেকে তাজউদ্দীন সবাইকে নিয়ে তার মনোগ্রাহী লেখা আছে। তার পর্যবেক্ষণ তীক্ষ্ণ এবং সমালোচনা অত্যন্ত গভীর। আমার মতো কম পঠনের লোকদের জন্যেও উনি দꦑর্পন। কত মানুষকে তিনি বিশ্লেষণ করে দিয়েছেন আমাদের জন্য। তিনি এত সুন্দর করে লিখেন, পড়ে একমত না হয়ে উপায় থাকে না। এবং তিনি তিন শত্রুকে চিনতে ভুল করেন না, পুঁজিবাদ আর ফ্যাসিবাদ ও পিতৃতন্ত্র।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখায় দুটো জিনিস থাকবেই, কৌতুক আর কৌতুহল। অত্যন্ত ভালো তার গদ্য। পড়তে এত আরাম ও এত উন্নত ভাষায় উনি লিখেছেন সারা জীবন। তার কথা বলার শব্দচয়ন ও বাচনভঙ্গি নিয়ে অনেকেই প্রশংসা করেন। আমি বলবো ওনার গদ্য মুখের ভাষার চেয়েও ভালো। কথা তো অনেকেই ভালো বলেন। আমার সারা জীবনের স্বপ্ন, ওনার মতো গদ্য লেখার। সাহিত্য, ইতিহাস থেকে সমকালীন রাজনৈতিক বিষয়আশয় সব নিয়ে তার লেখা আছে। ‘জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতা ও জনগনের মুক্তি’ দেশভাগের ওপরে একটা অসামান্য প্রামাণꦅ্য গ্রন্থ। তিনি বেকন নিয়ে লিখেছেন, ভাসানী নিয়ে লিখেছেন, কার্ল মাক্স নিয়েও লিখছেন। এবং তার অসংখ্য প্রবন্ধ নিবন্ধ ছোট ছোট কলাম নয়, রীতিমতো ছোটখাটো উপন্যাসের সমান সাইজ। লিখেছেন তার মা বাবা বন্ধুদের নিয়েও। আমার কাছে আহমাদ মোস্তফা কামালের মা নিয়ে একটা রচনা সব থেকে প্রিয়। তারপরেই আসবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পিতা ও মাতাকে নিয়ে লেখাগুলো। এত সুন্দর করে নির্মোহভাবে লেখা আপনজনদের নিয়ে।
জীবন যাপনেও ওনার পরিমিতিবোধ ইর্ষণীয়। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের এক গল্প আছে, উনি𓃲 বিটিভিতে উপস্থাপনা করতেন। কি সাধারণভাবে রিকশা দিয়ে যেতেন আসতেন। সামান্য বিটিভির টাকার চেক নিতে দুলাল ভাইয়ের অফিসে আসতেন, জ্বর নিয়ে রেকর্ডিং করতেন। দায়িত্ব মনে করতেন এসবকে। আমাকে এক লোক প্রশ্ন করেছিল, ‘তুমি সিক স্যারের ও ছফার ভক্ত এক সাথে কেমনে হও?’ আমি বলেছিলাম, “আমার কোনো সমস্যা হয় না। আমি পড়াশোনা করে ভক্ত। দুজনেরই লেখার প্রতি নিবেদন, স্বদেশচিন্তা ও বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখে যাওয়ায় আমি মুগ্ধ। আড্ডা দেওয়া ও শুনে শুনে ভক্ত হওয়াদের এসব সুবিধা নেই। দুজনই আমাকে সমৃদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত।”