বাংলাদেশের অন🐼্যতম প্রথিতযশা কবি আসাদ চৌধুরী। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার পদচারণা থাকলেও কবি হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। কবিতা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী ইত্যাদি রচনা করেছেন। এছাড়া কিছু অনুবাদকর্মও সম্পাদন করেছেন এই কবি।
১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তার রচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘যে পারে পারুক’ প্রকাশিত হয়। তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে তবক দেওয়া পান (১৯৭৫), বিত্ত নাই বেসাত নাই (১৯৭৬), প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় (১৯🅷৭৬), জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২), মধ্য মাঠ থেকে (১৯৮৪), মেঘের জুলুম পাখির জুলুম (১৯৮৫), আমার কবিতা (১৯৮৫), ভালোবাসার কবিতা (১৯৮৫), প্রেমের কবিতা (১৯৮৫), দুঃখীরা গল্প করে (১৯৮৭), নদীও বিবস্ত্র হয় (১৯৯২), টান ভালোবাসার কবিতা (১৯৯৭), বাতাস যেমন পরিচিত (১৯৯৮), বৃꦕন্তির সংবাদে আমি কেউ নই (১৯৯৮), কবিতা-সমগ্র (২০০২), কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩), ঘরে ফেরা সোজা নয় (২০০৬)। আসাদ চৌধুরীর কবিতায় হতাশা, অবক্ষয়, জীবনসংকট, মুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতি বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। কবির নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও দ্যোতনায় তা নতুনভাবে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে আসাদ চৌধুরীর অনবদ্য অবদান কখনোই ম্লান হওয়ার নয়।
‘জানাজানি’ কবিতায় তিনি দেশের প্রতি যেমন মমত্ববোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তেমনই প্রকৃতির প্রতি তার উদারচিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। প্রকৃতিকে কবি আলিঙ্গন করেছেন আপন ভালোবাসায়। তাই কবির নৈবেদ্য প্রকৃতির প্রতি, দেশের প্রতি। এ দেশ, মাটি ও মাতৃকাকে তিনি কখনোই উপেক্ষা করেননি বরং তার হৃদ🍃য়ে প্রগাঢ়ভাবে ধারণ করতে পেরেছেন বলেই কবিতার পরতে পরতে এঁকে দিয়েছেন ভালোবাসার অদম্💮য আকর্ষণ। চিন্তার গভীরতাকে নিমগ্ন করেছেন এভাবে:
বাংলাদেশের পাখি কেন মধুর সুরে ডাকে,
জানো?
জানি জানি জানি।
পাখির ভাষার মান দিতে যে
বাঙালি দেয় জান-
পাখি যে তা জানে,
তাইতো পাখি পাগল করে,
বিহান বেলার গানে।
বাংলাদেশের আকাশ কেন কপালে টিপ আঁকে,
জানো?
জানি জানি জানি।
উদার আকাশ যে ইশারায়
ডাক দিয়ে যায় প্রাণে,
বাঙালি তা জানে।
তাইতো আকাশ টিপ দিয়ে যায়,
ললাটের মাঝখানে।
(জানাজানি)
বাঙালি রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। দেশ𒈔কে শত্রুমুক্ত করেছে। এই অর্জনের পেছনেꩵর ইতিহাস আমাদের শিহরিত করলেও বাংলা মাকে ভালোবেসে এ দেশের সন্তানেরা দখলদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শুধু দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা, শ্রদ্ধা থেকেই তা সম্ভব হয়েছিল। কবি আসাদ চৌধুরী বলেছেন, পাখির ভাষাকেও এ দেশের মানুষ মূল্যায়ন করতে পারে। উদার আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধতা ছড়াতে পারে বাঙালি। তাই পাখি প্রভাতের গানে মানুষকে মুগ্ধ করে তোলে।
আসাদ চৌধুরী যেমন প্রকৃতিপ্রেমিক কবি তেমনই মানবপ্রেমী। তার কবিতায় ꦉদুইয়ের সম্মিলন ঘটেছে বিশেষভাবে। কবি মানুষকে ভালোবেসেছেন। তাই এই ধরাধামে লুক্কায়িত সত্যকে তিনি খুঁজতে চেষ্টা করেছেন। তার ধারণা সত্য ফেরারি। কোথাও সত্যকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রেমে সত্য নেই, পাগলের প্রলাপে নেই, নাটকের সংলাপে নেই, কবিতায় সত্য নেই, ভাষণে সত্য নেই। সত্য আজ ফেরারি। কবি যে সত্যকে খুঁজতে চেয়েছেন কবিতায় তা আজও ফেরারি। মানবজীবন চলছে হতাশা, অবক্ষয়ের মাঝে। গভীর সত্য এখানে বিদ্যমান নেই। প্রেমে যেমন নেই, নেই কোনো রঙ্গমঞ্চেও। সত্যর আজ বড়ই অভাব। কবির কবিতায় এই গভীর সত্যকে ধারণ করার বাসনা জেগেছে এভাবে:
কবিতায় নেই, সংগীতে নেই
রমণীর চারু ভঙ্গিতে নেই
পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই
নাটকের কোনো সংলাপে নেই
শাসনেও নেই, ভাষণে নেই
আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই
রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই,
উত্তরে নেই, প্রশ্নেও নেই
লেবাসে নেই, সিলেবাসে নেই
পারমিটে নেই, বোনাসেও নেই
হতাশায় নেই, আশাতেও নেই
প্রেম-প্রীতি ভালবাসাতেও নেই
এমন কি কালোবাজারেও নেই
কোথায় গেলেন সত্য?
(সত্য ফেরারি)
কবি আসাদ চৌধুরী সম্ভাবনার কথা বলেন। অবক্ষয়ের মধ্যেও তিনি খুঁজে ফেরেন জীবনের মানে। সর্বোপরি আশাবাদী হতে শেখান তিনি। জীবন থমকে গেলেও সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ান কবি। ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’ কবিতায় তিনি যুদ্ধকালীন দেশকেই যেন দেখাতে চেয়েছেন। এবং পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম অত্যাচারও ফুটে উঠেছে ছোট্ট কবিতায়। তখন মানুষ থাকলেও এই মানুষের প্রতিই বর্বরোচিত অত্যাচার হয়। বীরাঙ্গনার উদাস করা দৃষ্টি তো এই মানবজন্মেরই ফল। শুধু ধর্মকে উপজীব্য করে দেশভাগ এবং তৎপরবর্তীকালে পূর্ব-পাকিস্তানীদের ওপর নি﷽র্মম অত্যাচার হয়। তখনও এ জাতি মানুষই ছিল। তবু মানুষ হয়েও মানুষের প্রতি পিশাচদের বিবেক জাগ্রত হয়নি। কবি আক্ষেপ করে বলেছেন:
নদীর জলে আগুন ছিলো
আগুন ছিলো বৃষ্টিতে
আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার
উদাস—করা দৃষ্টিতে।
আগুন ছিলো গানের সুরে
আগুন ছিলো কাব্যে,
মরার চোখে আগুন ছিলো
এ—কথা কে ভাববে?
(তখন সত্যি মানুষ ছিলাম)
প্রকৃতি প্রেমে কবি সর্বদা জাগরুক; ফলে তার কবিতায় প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতা সর💦্বদা♕ পরিলক্ষিত হয়। কবি আসাদ চৌধুরী ব্যক্তিক জীবনকে দেখেছেন ইতিবাচক অর্থে। তিনি বলেছেন:
কোথায় ছিলেন
রূপোলি জ্যোৎস্না
ঢের সূর্যের হেম
কখনো নদীকে
সোনালী গীতিকে
এ কথা বলেছিলেম!
জন্মস🌠ূত্রেই প্রতিবাদী কবি আসাদ চৌধুরী। তার কবিতার ভাষাও ঝাঁঝালো। সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেই কবিতাকে প্রাণ দিতেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন♚। মানবপ্রেমকে চিরন্তন মনে করতেন। তাই তার কবিতায় মানবপ্রেম, প্রকৃতি, জীবনের সম্মিলন ঘটেছে। কবি লেখেন
প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল
বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম
আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।
এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে
বৃক্ষের আড়ালে সরে যায়-
বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে
তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে
শুধু মুখ টিপে হাসে।
মুক্তিযুদ্ধের আগুনঝরা স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। যুদ্ধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনিও কলমযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। কবিতার ভেতর দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের সত্যকে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে লেখা কবিতার কিছু অংশ মিথে 🌠পরিণত হয়েছে। কবি বলেন
তোমাদের যা বলার ছিল,
বলছে কি তা বাংলাদেশ?
শেষ কথাটি সুখের ছিল,
ঘৃণার ছিল, নাকি ক্রোধের, প্রতিশোধের
কোনটা ছিল?…
বলছে কি তা বাংলাদেশ?
(শহীদদের প্রতি)
কবি আসাদ চৌধুরীর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য সারল্য। সহজ-সরল ভাষায় তিনি সাধারণ্যে মিশে যান। ফলে তার কবিতায় হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া অনুভূতি জাগ্রত হয়। কবির কবিতায় পরিভ্রমণ করা তাই বেশ সহজ। মানুষ, প্রকৃতি, ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, অবক্ষয় থেকে আশাবাদ কোনো কিছুই তার কবিতার উপকরণ থেকে বাদ পড়েনি। এভাবেই তিনি জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ করেছেন পাঠককে। ষাটের দশকের এই কবি তার কবিতার ছোঁয়ায় বাংলার ঘরে ঘরে জ্বেলেছেন আলো। তুলে ধরেছেন লোকজ সংস্কৃতি, জীবন, মাটি ও মানুষকে। কবির 🦂অবিস্মরণীয় অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে শিল্প-সাহিত্যে।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক।