পাতালরেলে চেপে ভেন্যুতে আসার সময় প্রতিদিনই দেখি যাত্রীরা বই পড়ছেন, এই আট-দশ মিনিটের যাত্রাতেও। বই হাতে নিয়ে ট্রেনে উঠছেন। স্টেশন এলে বই বোগলদাবা করে নেমে পড়ছেন। এদের প্রত্যেকের কাঁধেই থাকে কয়েক কিলোগ্রামের ব্যাকপ্যাক এবং কারও কারও হাতে থাকে কফি মগও। কাজেই বোঝা যাচ্ছে কাঁধে যত বোঝাই থাকুক না কেন, তারা বই পাঠ থামাননি। তো এরাই তো উন্নতি করবে। আমি অনেককে ই-বুকও পড়তে দেখেছি সমান আগ্রহ নিয়ে। আমার থলিতেও বই থাকে, কিন্তু বই পড়ার নেশায় স্টেশন মিস করে ফেলতে পারি, এই শঙ্কায় নিজেকে বিরত রাখি। তবে আজই মোবাইলে এক আর্টিকেল পড়তে পড়তে নেমে গিয়েছিলাম নির্ধারিত স্টেশনের আগের স্টেশন ইউনিয়নে। নেমেই এক সেকেন্ডে বুঝতে পারি ভুল করেছি। রেলগাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার মিলি সেকেন্ড আগে আবার টুপ করে ভেতরে ঢুকে পড়ি। নয়তো পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হতো আরও পাঁচ-ছয় মিনিট। আমি নামি সেন্ট এন্ড্রুতে। সময় হাতে রেখেই বেরিয়েছি। তাই প্রথম স্ক্রিনিং শুরু হওয়ার পনেরো মিনিট আগেই হলে ঢুকতে পেরেছি।
হুর জিন-হো পরিচালিত দক্ষিণ কোরীয় ‘আ নরমাল ফ্যামিলি’র ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার আজ। দক্ষিণ কোরিয়ার ইন্ডাস্ট্রি এই মুহূর্তে ড্রামা ফিল্ম তৈরিতে সেরা। যদিও ছবিটি ডাচ উপন্যাস ‘দ্য ডিনার’ থেকে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু পরিচালক একে পুরোপুরি কোরীয় করে তুলতে পেরেছেন। টানটান উত্তেজনা ও বাঁক পেরিয়ে দর্শক এগোতে থাকে পরিণতির দিকে। জেওয়ান একজন সফল ও ধনী আইনজীবী, অন্যদিকে তার ছোট ভাই চিকিৎসক, নীতিবান ও মধ্যবিত্ত। উকিলের মেয়ে হেইয়ুন ও ডাক্তারের ছেলে সাইহু ভাইবোন। তারা একদিন বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি করে রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফেরার পথে এক গৃহহীন মানুষকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। সেই ঘটনার ফুটেজ সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে এবং ভাইরাল হয়ে যায়। এই মারপিট স্রেফ আনন্দের জন্য। ঘটনা আরও গুরুতর হয় যখন আহত লোকটি মারা যায়। দুই পরিবার তখন এই খুনে ছেলেমেয়ে নিয়ে কী করবে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। একবার তারা ভাবছে ওদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিত, আবার ভাবছে না, ওদের সুযোগ দেওয়া দরকার। এ নিয়ে নীতিনৈতিকতা ও আবেগের টানাপোড়েন দর্শককে আবিষ্ট করে ফেলে। পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার ধনী বাড়ির তরুণদের বেড়ে ওঠাকেও নজরে আনতে চান পরিচালক; ভোগবাদের প্রতি আকৃষ্ট এক মানবিক আবেগহীন, অনুশোচনাহীন ও উন্নাসিক তরুণ সমাজ; এবং এই তরুণদের সামলাতে না পারা দিশাহীন মা-বাবার অসহায় অবস্থা। ‘আ নরমাল ফ্যামিলি’ একটি উপভোগ্য পারিবারিক ছবি বটে।
ইদানীং দক্ষিণ কোরিয়ার ছবি দেখে আমার মনে হচ্ছে এসব চলচ্চিত্রের পরিচালকরা সগর্বে ঘোষণা দিতে পারেন: আমাদের ছবি দেখুন, চিত্ত দুলে না উঠলে মূল্য ফেরত! আমি টিফের আলোর বাক্স, মানে লাইটবক্স থেকে বেরিয়ে হাঁটা দিই প্রেস লাউঞ্জে। ঢুকে একটা মাফিন আর আপেলের শরবত নিয়ে লিখতে বসেছি। কিছুক্ষণ লেখার পর লক্ষ করি আমার পাশের মেয়েটি টাইপ করছে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে এবং একটু পর চোখ-নাক ভাসিয়ে সশব্দে কান্নাকাটি করছে। ঘটনা কী বোঝার জন্য তাকিয়ে দেখি হোয়াটসঅ্যাপে টাইপ করছে আর চোখের জলে ভাসছে। বেচারা কোনো হৃদয়ঘটিত সমস্যায় আছে বোধ হয়। হৃদয়ের সমস্যা কার নেই? হৃদয় থাকলে সমস্যাও হবে। স্বাভাবিক।
যেমন করাচির মেডিকেল স্টুডেন্ট মরিয়মও হৃদয়ের সমস্যায় পড়ে, কিন্তু সেই সমস্যা জম্বি হয়ে ফিরে আসে। কানাডিয়ান পাকিস্তানি পরিচালক ও লেখক জারার খান পরিচালিত ‘ইন ফ্লেমস’ ছবির কথা বলছি। এটাই পরিচালকের ডেব্যু ফিচার। মরিয়ম এক মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। বাবা মারা গেছে। মা আর এক ছোট ভাই রয়েছে। তাদের এক চাচা মরিয়মদের শেষ সম্বল ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টটাও কেড়ে নিতে চায়। এর মধ্যে আসাদ নামের এক ছেলের প্রেমে পড়ে মরিয়ম। তার সঙ্গে একদিন ঘুরতে বেরোলে দুর্ঘটনায় মারা যায় ছেলেটি। তখন কৈশোরের ট্রমা তীব্র হয়ে ফিরে আসতে থাকে মরিয়মের মনে। তার বাবাকে আসলে সে আর তার মা-ই খুন করেছিল। পারিবারিক কলহের সময় বাবা যখন মা ও মেয়েকে মারধর করছিল, গলা টিপে ধরছিল তখন তারাই তাকে উল্টো খুন করে ফেলে। তখন থেকে একই ট্রমায় পতিত হয় মরিয়মের মা-ও। তবে এই ভয়ের ঘেরাটোপ থেকে তারা শেষ পর্যন্ত বের হতে পারে। ছবির শেষে সমুদ্রপাড়ের ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি যেন গৃহবন্দী ট্রমাকে ভস্ম করে দেওয়ার রূপক। তার সঙ্গে ছাই হয় পুরুষতন্ত্র। ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা দেখি পুরুষতন্ত্র জম্বির আকারে বারবার মা ও মেয়ের সামনে এসে হাজির হয়। মেয়েদের গাড়ি চালানো, পার্কে প্রেমিকের পাশে বসা, নারীশিক্ষা—সবকিছুতেই বাধা। শুধু বাধা তো নয়, বারান্দার নিচে এসে হস্তমৈথুন, এমনকি ধর্ষণচেষ্টা। সব মিলিয়ে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারী জাগরণের কথা বলে এই ছবি। তবে মাঝে একটু ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়েছে, যেটা না করলেও চলত। পাশাপাশি আধ্যাত্মিক শক্তির প্রদর্শনীও অপ্রয়োজনীয় ছিল বলে মনে হয়েছে। ছবি শেষে মঞ্চে পরিচালক সবাইকে নিয়ে আসেন। বলেন পাকিস্তানের সমাজের সত্যিকার চিত্রই তারা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আমিও এই চিত্রের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছি বাংলাদেশের।
ছবি শেষ করে টিফ ভবনের দিকে এগোতে হয়। কানাডাপ্রবাসী, ডকুমেন্টারি অর্গানাইজেশন অব কানাডায় কর্মরত তাজিন আহমেদ অনেক দিন ধরেই বলছিলেন আমার সঙ্গে বসবেন। সময় মেলানো যাচ্ছিল না। এদিন সময় হলো। তাজিনের সঙ্গে 🔯বসে কানাডার ননপ্রফিট অর্গানাইজেশন, যারা প্রামাণ্যচিত্র বানায়, তাদের সম্পর্কে কথা হলো। ফাঁকে ‘পুটিন’ বলে এক বিশেষ খাবার ও আলগ্রে টি। টিফ রেস্তোরাঁর ভেতরে না, আমরা বাইরেই বসেছিলাম। কথা বলতে বলতে দেখি দূর থেকে হেঁটে আসছেন মীনাক্ষী শেড্ডি। উনিও আমাদের আলাপে যোগ দিলেন। তবে আমি দেখলাম হাতে একেবারেই সময়🐟 নেই, ছয়টা বেজেই গেছে প্রায়। আরেকটা স্ক্রিনিং আছে। বিদায় নিতে হলো।
স্কশিয়াব্যাংকে দেখতে গেলাম এবার ইরানের ছবি ‘একিলিস’। ফরহাদ দেলারামের প্রথম চলচ্চিত্র এটি। ইরান, জার্মানি ও ফ্রান্সের প্রযোজিত এই ছবিতে দেখা যায় ফিল্মমেকার ফরিদ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিক চাপে আত্মগোপন করে হাসপাতালে। সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয় রাজনৈতিক বন্দী হেইদির সঙ্গে। হেইদি স্বাধীন মতপ্রকাশের কারণে বন্দী। ফরিদের ডাকনাম একিলিস। গ্রিক পুরাণের সেই যোদ্ধার মতোই সে হেইদিকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়। আসলে তারা বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেতে চায়। এই ছবির♉ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো দেয়াল। জড়বস্তু হল🐈েও এর গুরুত্ব অপরিসীম। হেইদি প্রতিনিয়ত শুনতে পায় দেয়াল তাদের নির্দেশনা দিচ্ছে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে—দেয়ালেরও কান আছে। তো সর্বক্ষণ এই কান পেতে রাখা দেয়াল, নির্দেশনা দেওয়া দেয়ালকে ভেঙে ফেলতে চায় একিলিস। পরিশেষে সে ধাক্কা দিতে দিতে চিড় ধরিয়ে দেয় দেয়ালে। পরিচালক যেন জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছেন: আসুন, যে রাজনীতি ও সমাজ মুক্তচিন্তাকে দেয়ালবন্দী করে রেখেছে, সেই দেয়াল আজ ভেঙে ফেলি। আমার এই ছবিটি বেশ ভালো লেগেছে।
ছবি শেষ করে প্রক্ষালন কেন্দ্র ঘুরে বের হতেই বাবুল ভাইয়ের ফোন। তিনি বসে আছেন টিফের রেস্তোরাঁয়। গিয়ে দেখি সেখানে বসে আছেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা, কানাডাপ্রবাসী সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল। তিনি অটোয়া থেকে এদিনই টরন্টোতে এসেছেন। হেলাল ভাই বলছিলেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার কথা, আমাদের নিম্নগামিতার কথা। কথা প্রসঙ্গে তাকে জানালাম, স্প্যানিশ সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় হলো এখানে, তার নাম মারিওনা বরুল। হ্যাংলা-পাতলা, টমবয় লুক। নাক-কান-ঠোঁট পিয়ার্সিং করা। মারিওলার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয় প্রেস লাইঞ্জে। তো আজ ও বলছিল, আমাকে নাকি চেনা চেনা লাগে ওর। গতবার কান উৎসবে ছিলাম কি না জিজ্ঞেস করল। বললাম, হ্যাঁ ছিলাম তো, ফিপ্রেসি জুরি হিসেবে। মারিওলা চট করে বলল, হ্যাঁ গতবারই তো ওরা প্রথমবারের মতো ফিল্ম ক্রিটিকদের রেডকার্পেটে হাঁটাল। আমি একটু হেসে বললাম, ওই চলচ্চিত্র সমালোচকদের একজন ছিলাম আমি। হেলাল ভাই কথা টেনে বললেন, হ্যাঁ এ খবর বাইরের সাংবাদিকরা রাখলেও, দেশের সাংবাদিকরা রাখেন না।
পরে বাবুল ভাই ও হেলাল ভাই দুজনে মিলে আমাকে নিয়ে গেলেন টরন্টোর বাঙালি পাড়ায়, টরন্টো ফিল্ম ফোরামের অফিসে। গিয়ে দেখি মনিস রফিক ভাইও আছেন। আরও অনেকেই অফিসটিকে𒁃 সরগরম করে রেখেছেন। সবাই ব্যস্ত আসন্ন টরন্টো মাল্টিকালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নিয়ে। ভালো লাগল এই তৎপরতা। মনিস ভাই দেখি কোত্থেকে চট করে তেলে ভাজা পিঠা, পুরি আর চা নিয়ে এসেছেন। খেতে খেতে অন্যদের সঙ্গে গল্পটল্প হলো। নতুন অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হলো। ঘড়িতে দশটার ওপর বাজে, বাবুল ভাইকে বললাম, আজ উঠি তবে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মনিস ভাই গাড়ি ড্রাইভ করে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিলেন। আর হাতে দিলেন তার সম্পাদিত ‘বাংলা পত্রিকা’। সংক্ষিপ্ত সময়ে বেশি কথা বলা যায়নি মনিস ভাইয়ের সঙ্গে, তবে আন্তরিকতার উষ্ণতাটুকু পাওয়া গেছে। আমি চলে এলাম বাসায়, আর উনি আবার ছুটলেন কর্মচঞ্চল কার্যালয়ের দিকে।