• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Songbad Prokash

ইনস্টাগ্রাম

টুইটার


লিংকডইন

পিন্টারেস্ট

গুগল নিউজ


বই আলোচনা

মবিডিক: সাহসী সমুদ্রযাত্রা


সাদাত উল্লাহ খান
প্রকাশিত: মে ৩, ২০২৩, ০৭:৪৯ পিএম
মবিডিক: সাহসী সমুদ্রযাত্রা

বাংলা সাহিত্যে এখন চলছে মূর্খকরণ প্রক্রিয়া। কি কবিতায়, কি গল্পে, কি উপন্যাসে এবং এমনকি জ্ঞানশীল প্রবন্ধে কোথাও কোনো আলো দেখা যায় না। চারদিকে সীমাহীন অন্ধকার। চিন্তা ও শিল্পের জগতে শূন্যতা বিরাজ করছে। বুদ্ধিবৃত্তিক একটা শূন্যতা সর্বত্র। সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, চিন্𒁃তার রাজ্য, রাজনীতি সবখানেই স্থবিরতা দৃশ্যমা💯ন। বাংলা সাহিত্যে এখন অন্তহীন অন্ধত্ব! মানে বন্ধ্যাত্ব!

তাইতো ভিনদেশের ভিনভাষায় রচিত সাহিত্যের দিকে নজর দিলাম। এই গরমে ঈদের আগে আগে জনাব রুহুল কাদের বাব🥀ুল বাংলা একাডেমি প্রকাশিত হারমান মেলভিল (১৮১৯--১৮৯১) রচিত মবিডিক উপন্যাসটি আমাকে উপহার হিসেবে প্রদান করেছেন। এই উপন্যাসটি অনুবাদ করেছেন রুহুল কাদের বাবুল। জনাব রুহুল কাদের বাবুলকে অনেক ধন্যবাদ। আকারে ছোট♏, মাত্র ৬৮ পৃষ্ঠার এই বইটি একনাগাড়ে পাঠ করা যায়। চমৎকার অনুবাদ। ছোট ছোট বাক্যে কাহিনি বিবৃত হয়েছে। যে কোনো সাহিত্যরসিক মানুষ সহজেই আনন্দের সাথে এই বইটি পাঠ করতে পারবেন। বঙ্গোপসাগরের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠার কারণে ছোটবেলা থেকেই সমুদ্রের সাথে, সমুদ্রের পরিবেশের সাথে, সমুদ্রের যুদ্ধের কাহিনি, সমুদ্রযাত্রার বিচিত্র কাহিনি  এবং সমুদ্র সংক্রান্ত হাসিকান্নার সাথে পরিচিত। 

বইপুস্তকে পঠিত সমুদ্রজ্ঞানের চেয়েও বাস্তবজীবনে সমুদ্র আমাদের অনেক কাছের, আত্মীয়। সারা দুনিয়ার সাগরতীরের মানুষের অবশ্যই অনেক ধরনের সাগরযাত্রার কাহিনি জ্ঞাত আছে। তাইতো সাগরপাড়ের একজন মানুষ হিসেবে 🔜" মবিডিক" উপন্যাসটির প্রতি আমারও একটা আব𒁏েগ ও অনুরাগ আছে।

আমরা জানি " মবিডিক" বিশ্ববিখ্যাত একটি  অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস। এই উপন্যাসটি সম্পর্কে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা পুনর্মুদ্রণ প্রসঙ্গে বলেন, ‍‍` অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে মবিডি𝄹ক আমেরিকান সাহিত্যের অন্যতম ক্লাসিকের মর্যাদা লাভ করেছে।‍‍`

হারমান মেলভিল ♈প্রতিবাদী খ্রিস্টধর্মের অনুসারী এবং একজন মার্কিন নাগরিক। তাঁর বর্ণিত কাহিনি সম্পূর্ণতই সাগরকেন্দ্রিক, সেখানে আমরা প্রশান্ত মহাসাগর, জাপান সাগর এবং ভারত মহাসাগরের দেখা পাই। এই উ💟পন্যাসটিতে মার্কিন নাগরিক, বিলাতি নাবিক এবং ফরাসি নাবিকের দেখা পাই। সকল নাবিক, খালাসি এবং কাপ্তানের নাম পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে। 

উপন্যাসটির মূল চরিত্রের দুটো নাম একেবারেই ব্যতিক্রম , সম্পূর্ণ আলাদা সংস্কৃতির ও আꩲলাদা ভাষার, মানে সিমেটিক ভাষার। সেই আলাদা দুটো নাম হলো : ইসমাইল এবং ফেদাল্লাহ। সিমেটিক ভাষার নামধারী এই চরিত্রগুলো আমেরিকার চিরায়ত উপন্যাসের কথক, মানে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এই বিষয়টি আমাকে কিছুটা হলেও চমকে দেয়। তাই আমি হারমান মেলভিলের ধর্ম ও সংস্কৃতি বিষয়ক জ্ঞানগরিমার কিছুটা খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করি। অনুসন্ধানে দেখা যায়🐽 তিনি বাইবেলের পুরাতন নিয়ম ও নতুন নিয়ম অধ্যয়ন করেছেন এবং এগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত।

মবিডিক উপন্যাসের শুরু এই বাক্য ও কথা দিয়ে :  "আমার নাম কি জানো? ইসমাইল। আমি তোমাদেরকে অনেক অনেক বছর আগের সমুদ্রযাত্রার একটি গল্প শোনাব। ভারি মজার। তোমাদের মতো ছোট থাকতে আমি ভালোবাসতাম যত নিষিদ্ধ সমুদ্র পাড়ি দিতে, ভালোবাসতাম বর্বর উপকূলে পা দিতে এবং ভয়ংকরের সাথে মিতালি পাতাতে।"
মবিডিক উপন্যাসটি শুরু হয়েছে ইসমাইলের মুখের কথা দিয়ে, আবার শেষও হয়েছে ইসমাইলের কথা দিয়ে অর্থাৎ ইসমাইলের মুখে বর্ণিত বিবরণ ও বক্তব্য দিয়ে। উপন্যাসটির শেষ বাক্য ও সংলাপ হলো : "আমিই সেই অনাথ। ইসমাইল।" উপন্যাসটির অনেক চরিত্র ও কাহিনি আছে। তবে ইসমাইলের কথা ও সংলাপ দিয়ে আমেরিকার চিরায়ত একটা উপন্যাসের শুরু ও শেষ। এই বিষয়টি একজন সাধারণ পাঠক ও সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমাকে কিছুটা হলেও চিন্তা করতে বাধ্য করেছে। পশ্চিমা জগতে সাহিত্য সমালোচনার ইতিহাসে ইসমাইল ও ফেদাল্লাহ ♍চরিত্র বিষয়ক কোনো আলোচনা আছে কিনা আমার জানা নাই। যতটা জানি মবিডিক উপন্যাস সম্পর্কে উইলিয়াম ফকনার বলেছেন, ‍‍` উপন্যাসটি ঠিক যেন নিজেই লিখেছি।‍‍` 💞;

আর এই বইটি প্রসঙ্গে ডি. এইচ. লরেন্স বলেছেন, ‍‍`দুনিয়ার বিস্ময়কর ও সর্বাধিক আশ্চর্যজনক বইয়ের একটা হলো এই বইটি।ꦉ এই উপন্যাসটি দুনিয়ার অন্যতম সেরা চিরায়ত বই।‍‍`

তবে আমি তীব্র আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা থেকে হযরত ইসমাইল সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করি। ইসলামধর্মের ঐতিহ্য অনুসারে আমার জানা আছে আল কোরআনে হযরত ইসমাইলের কথা উল্লেখ করা আছে। তাই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের সাহায্য গ্রহণ করি। এখানে বলা কোনোমতেই বাহুল্য নয়, আমি সম্প্রতি ‍‍`ইসলামধর্মের সমাজবিজ্ঞান‍‍` নামে একটি বই অনুবাদ করেছি। উক্ত বইটিতে আল কোরআনের অনেক সুরা ও আয়াত উদ্ধৃত করা🥂 হয়েছে। সেই বইটির ইংরেজি নাম: ‍‍`দি সোশাল স্ট্রাকচার অব ইসলাম‍‍` এবং লেখকের নাম রুবেন লেভি (১৮৯১--১৯৬৬)। ইনি জাতে বিলাতি আর ধর্মে ইহুদি। তবে ই🐠সলামধর্ম বিষয়ে একজন অতি উঁচু মানের গবেষক ও পণ্ডিত। অনুরূপভাবে উপমা দেয়া যায় হারমান মেলভিলও একজন উঁচু মানের সিমেটিক সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ। 

মবিডিক উপন্যাসের কথক ইসমাইল আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেই সিমেটিক সংস্কৃতি ও আল কোরআনে উল্লেখিত হযরত ইসমাইলের নাম। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে হযরত ইসমাইল কে? কেন তিনি এত খ্যাতিমান? পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনে এই প্রশ্নের জবাব আছে। "সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাকে আমার 🌄বার্ধক্যে ইসমাইল ও ইসহাককে দান করিয়াছেন। আমার প্রতিপালক অবশ্যই প্রার্থনা শুনিয়া থাকেন ( সুরা : ১৪ , ইবরাহীম, আয়াত ৩৯, বাংলা অনুবাদ: আল কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, সাতাইশতম মুদ্রণ, অক্টোবর ২০০৩, ঢাকা) । সুরা ইবরাহীমের ৩৯ নাম্বার আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি হযরত ইবরাহীমের সন্তান হলেন হযরত ইসমাইল ও হযরত ইসহাক। 

মবিডিক উপন্যাসে সামুদ্রিক অভিযানে ইসমাইল চরিত্রটি আমেরিকার চিরায়ত সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই ঘটনার একটা ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব আছে। বাংলাদেশের সাহিত্যে এই ধরဣনের ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব এখন অদৃশ্য। আমরা যদি একবার চিরায়ত রুশ সাহিত্যের দিকে নজর দিই দেখতে পাব মহান লেখক লেভ তলস্তয়ের (১৮২৮--১৯১০) জীবনের শেষের দিকে রচিত  হাজি মুরাদ উপন্যাসটি এবং উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সংগ্রামী বীরযোদ্ধা হাজি মুরাদ।  আমেরিকার চিরায়ত লেখক হারমান মেলভিল এবং রাশিয়ার মহান চিরায়ত লেখক লেভ তলস্তয়ের মহত্ত্ব ও উদারতার একটা মিল আছে। এই ধরনের সাংস্কৃতিক উদারতা ও সহনশীলতার অভাব বাংলা সাহিত্যে এখন প্রবল। বাংলাদেশ বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটের এটাও একটা বড় কারণ। 

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা বর্তমানে চিন্তাজগতের এই ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক সংকট অনুধাবনে পুরোপুরি অক্ষম। কারণ দেশের ও সমাজের শিক্ষিত অপেক্ষাকৃত সুবিধাভোগী গোষ্ঠী যখন সার্বিকভাবে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করে এবং স্বেচ্ছায় বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব বরণ করে নেয়, তখনই শিক্ষাজগত ও সমাজের সর্বস্তরে মূর্খকরণ প্রক্রিয়া জোরদার হয়, বুদ্ধিবৃত্তিক অসারতা দেখা দেয়, সমাজে অন্ধত্ব নেমে আসে এবং সাথে সাথে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্ব বিরাজ করে। সাহিত্যে সৃজনশীলতা নিশ্চল হয়। এ কারণে বাংলাদেশে বিগত তিন দশকে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রতিভাཧ দেখা যায় নাই। ফলে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাহিত্য তরুণসমাজকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই পুরানো বাংলা প্রবাদ সামনে ভেসে ওঠে! বিপদ একাকী আসে না। সবখানেই অন্ধকার আর বিপদ। বাংলাদেশে এখন অন্ধকার ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিপদ যেন হাত ধরাধরি করে চলেছে।

এমন অন্ধকার সময়ে ভিনদেশি সাহিত্য, বিশেষ করে চিরায়ত সাহিত্য আমাদের মাঝে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে। মবিডিক উপন্যাসটি এমন সময়ে একটি উ🙈দাহরণ হতে পারত। সম্ভাবনা ও বাস্তবতাও অনেক। অনুবাদক জনাব রুহুল কাদের বাবুলকে অনেক ধন্যবাদ। তিনি এই অন্ধকার সময়ে আলো জ্বালিয়েছেন। 

তবে দুঃখের বিষয় বাংলা একাডেমি এই বইয়ের ক্ꦯষেত্রে উদাসীনতা বা দায়িত্বহীনতার বড় প্রমাণ রেখেছে। বইটির প্রচ্ছদে মুদ্রিত নাম : ‍‍`মবিডিক: একটি তিমির কাহিনী।‍‍` আসলে বাংলা একাডেমির বানান বিধি অনুসারে লিখতে হবে ‍‍` কাহিনি।‍‍` অথচ বইটির ভেতরে লেখা হয়েছে ‍‍`একটি তিমির কাহিনি।‍‍`

বাংলা একাডেমির উদাসীনতার আরেকটি নজির হলো মুদ্রণে তথ্যবিভ্রাট, বা তথ্য বিকৃতি। বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বইটির পুনর্মুদ্রণ প্রসঙ্গে লিখেছেন : অনূদিত ও সংক্ষিপ্ত কলরবে ‍‍`মবিডিক‍‍` বাংলা একাডেমি থেকে প্রথম প্রকাশ হয় ১৯৮৪ সালে। অথচ প্রকাশনা তত্ত্বাবধানকারী শ্রীমতি নাজমা আহমেদ প্রিন্টার্স  লাইনে মুদ্রণ করেছেন প্রথ💞ম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯। 

এমꦜন উদাসীনতার প্রমাণ 📖আরো রয়েছে। এই উপন্যাসটির পাতা উল্টালেই তা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পাঠক উপন্যাসের ৫৮ পৃষ্ঠায় গিয়ে দেখতে পারেন। 

বাংলা একাডেমির এমন উদাসীনতা🐷 কাম্য নয়। কাম্য হোক আর না হোক, একেই বলে মূর্খকরণ প্রক্রিয়া! মবিডিক  একটি সাহসী চিরায়ত উপন্যাস। এই উপন্যাসটির বহুল প্রচার কামনা করছি।

 

মবিডিক: একটি তিমির কাহিনি
হারমান মেলভিল
অনুবাদ: রুহুল কাদের বাবুল
দ্বিতীয় পুনর্মুদ্রণ: অক্টোবর ২০২২
বাংলা একাডেমি, ঢাকা
প্রচ্ছদ: মাসুমা খান
মূল্য : ১২০টাকা 

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!