• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Songbad Prokash

ইনস্টাগ্রাম

টুইটার


লিংকডইন

পিন্টারেস্ট

গুগল নিউজ


হুমায়ূন আহমেদ, মৃত মিথের ভেতরে বসে থাকা জীবন্ত অ-মিথ


শরৎ চৌধুরী
প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০২৩, ০৯:১৭ এএম
হুমায়ূন আহমেদ, মৃত মিথের ভেতরে বসে থাকা জীবন্ত অ-মিথ

মিসির আলির বয়সে দেখা হুমায়ূন

মিসির আলি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এডজাংক্ট প্রফেসর, সাইকোলজি পড়ান। পড়ানোর বিষয়ে একজন সত্যিকারের আগ্রহী মানুষ। 🌞বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়ে মাস্টার্স শেষ করেছেন এবং সম্ভবত সুপারভাইজারেরꦺ সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় পিএইচডি আর করা হয়নি। পড়ানোর মনোযোগ, পরিশ্রম, একনিষ্ঠতা ও প্রতিভার কারণে শিক্ষার্থীদের মনে গভীর ছাপ রেখে চলেছেন। স্বাভাবিক নিয়মেই তার চাকরিটি স্থায়ী হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটি আর হচ্ছে না। বিভাগের চেয়ারম্যানের একাডেমিক ও ক্যারিয়ারগত ঈর্ষার কারণে সেটাকে আটকে দিচ্ছেন। বিদেশে যেসব কনফারেন্সে চেয়ারম্যান নিজেই যেতে যান, সেসব কনফারেন্সের দাওয়াত অবলীলায় পাচ্ছেন মিসির আলি। ঠিক এই সময়েই শিক্ষক মিসির আলি তার প্রাক্তন ছাত্রীর কাছ থেকে মফস্বলে নিজের স্বামীর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার নেমতন্ন পেলেন। সেই সঙ্গে একটি ‘ক্ষুদ্র সমস্যা’ সমাধানের আবদারও তিনি করলেন। আমন্ত্রণের কৌশল এমন যে মিসির আলি চাইলেই এড়িয়ে যেতে পারছেন না। এদিকে আবার কয়েক দিনের জ্বরে পড়ে যাওয়ায়, তৎক্ষণাৎ আর যেতে পারলেন না। তবে পরবর্তী সুযোগে আর দেরি করলেন না। পাঠক হিসেবে আমি আটকে গেলাম।

এই বর্💦ণনায় আমি হয়তো মিসির আলির দুটো গল্পকে মিশিয়েও ফেলতে পারি। ফলে আপনারা ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা কর꧅ি। মিসির আলির বয়স সম্পর্কেও আমরা নিশ্চিত হতে পারি না, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ যে আমাদের বারবার আটকে ফেলেন, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই দ্বিমত করবেন না। আবার এটাও নিশ্চয়ই মানবেন যে ভিন্ন ভিন্ন বয়সে হুমায়ূন পাঠের আনন্দ ভিন্ন।

আমার মা-বাবার প্রজন্মের লেখক

হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখির সঙ্গে পরিচিত পাঠকেরা ততক্ষণে অনুমান করে থাকতে পারেন যে মিসির আলির যাওয়ার জায়গাটা বৃহত্তর ময়মনসিংহের কোনো একটা অঞ্চল হবে। সামনে বা কাছেই নদী থাকবে, পুরোনো ভাঙা জমিদারবাড়িও থাকতে পারে। ষাটের দশকের তরুণ-তরুণী আমার বাব𓆏া-মা হুমায়ূনের বর্ণনায় এই অঞ্চলের নানান খুঁটিনাটি বিষয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তাদের কর্মজীবনের বহু বছর, রাজনীতি আর মুক্তিযুদ্ধের সময়টা তারা এই অঞ্চলে কাটিয়েছেন। তবে বিচিত্রা, ঈদসংখ্যা কিংবা বইমেলায় হুমায়ূন আসার আগেই আমার বাবা তীব্রভাবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ে নিমজ্জিত; আর মা, তলস্তয়ের আনা কারেনিনার বাইরে কিছু দেখতেই পারছেন না। তবু তাদের দুজনারই কাছে হুমায়ূন আহমেদ অনেকটা একই সময়ের একই এলাকার লেখক ও বন্ধু, ব্যাচের বলে বিবেচিত। লতায় পাতায় চেনেন, যদিও আমার জানামতে ওনাদের সামনাসামনি কখনো দেখা হয়নি। আমার বাবার একটা গোপন আত্মবিশ্বাস ছিল যে তিনি চাইলেই হুমায়ূনের মতো লিখতে পারেন। আমার অবশ্য সব সময়ই সন্দেহ ছিল। ঘটনাক্রমে আমারও কখনো ওনার সঙ্গে সরাসরি আলাপ হয়নি। একটু দূরত্ব থেকে আমি ওনাকে দেখেছি। দেখেছি ওনার মিথ হয়ে ওঠা।

হুমায়ূন আহমেদ এত গভীরে বিরাজমান যꦍে তাকে খু🅺ব মিস আমি করি না। তাকে নিয়ে কোনো মিথও আমার মধ্যে তৈরি হয় না। তবে পাঠকের নিয়তি হলো আমরা কোনো কোনোভাবে আমাদের লেখকদের জীবনযাপন করি। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে করি। যখন সচেতনভাবে করি তখন সেটা একরকম। বরং যখন অসচেতনভাবে করি সেটা বেশি ইন্টারেস্টিং। হুমায়ূন আহমেদ তেমনি একজন। এ রকম আরও অনেকে আছেন। প্রত্যেকের জীবনে আলাদা আলাদা তালিকা, কখনো কখনো কারও সঙ্গে কারওটা মিলে যায়।

হুমায়ূন আহমেদের পুনরুত্থান

বহু বছ🃏রের হুমায়ূন বিরতির পর আমার মধ্যে আবার হুমায়ূন তৃষ্ণা জেগে ওঠে জাপানে থাকাকালীন। এখন মনে ღপড়ছে যে খুব সচেতনভাবেই আমি হুমায়ূন আহমেদ থেকে সরে গিয়েছিলাম। অনেক লেখাকে টিনএজারদের জন্য মনে হতো। যদিও এখন মনে হচ্ছে যে আমি ভিন্নভাবে হুমায়ূন আহমেদকে বুঝি

হুমায়ূন আহমেদ আমার কাছে কিন্তু বিদেশের গল্প বলা লোকও। বর্তমানের তুলনায় নব্বইয়ে দুনিয়াটা এমন 🐲ছিল না। আপনি চাইলেই বিদেশের শহরগুলোতে ভার্চুয়াল ট্যুর দিতে পারতেন না। গুগল ছিল না, সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, ফলে মানুষের লেখা গল্পগুলো নতুন জায়গা সম্𝓀পর্কে জানা অর্থেও গুরুত্ব পেত। আপনার নিশ্চয়ই মনে মনে হাসছেন এই ভেবে যে এই সুযোগে অনেক লেখক বিদেশি গল্পের কপি করেই এ ভূখণ্ডে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। সেটার সত্যতা আছে। তবে গল্প আর তথ্য তো এক জিনিস না।

ঘটনাক্রমে আমিও পিএইচডি গবেষণায় আকণ্ঠ ডুবে আছি। হারুকি মুরাকামির দেশ হিসেবে যত স্তরে আমি জাপানকে জেনেছি তার বদলে এ এক নতুন জাপান। কাছে গেলেই যে সব সময় বেশি করে দেখা যায়, এই ধারণা নিয়ে আমার গভীর সন্দেহ তৈরি হতে শুরু করেছে। এই জাপান কেমন ম্যাড়মেড়ে, একটা সাজানো-গোছানো বন্দিশালা যেন। ইচ্ছেমতো বেড়াই, লং ড্রাইভ করি, দোকানে দোকানে থরে থরে শিভাস সাজানো থাকে। নিরাপত্তা, নৈঃশব্দ্য আর দারুণ সুন্দর। যদিও মনের ভেতরে কেউ বলছে যে আমার মাটির সঙ্গে, আমার সংবেদ-এর অপূর্ব এক সম্ভারের সঙ্গে গভীর এক টানকে যেন কোনো সামুরাই ঘ্যাঁচ করে কেটে দিয়েছে। আর আমি সেটা টেরও পেয়েছি অনেক পরে।🅠 জাপানের এই প্রিসিশন-কাটকে আমি ডড়াই। ফলে যখন থেকে আমার মধ্যে হারিয়ে ফেলার উপলব্ধি, শিরশিরে ভয় সময়েত হাজির হলো তখন থেকেই তীব্র এক শূন্যতা কাজ করছে। খুব গভীরে আমি জানি এই শূন্যতা আমার কাটাতেই হবে তা না হলে আমি এমনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব, যাতে আর কখনোই ফেরা হবে না। এটা কেবল দেশ, মানুষ, ভাষা থেকে হারিয়ে যাওয়া নয়। এট🐼া হল দরিদ্র হওয়ার ভয়। আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছিলাম যে আমি অসমৃদ্ধ হব।

কোন সে অ-সমৃদ্ধি?

আমার এই সমৃদ্ধির ভেতরে আছে লম্বা এনগেজমেন্টর ইতিহাস। সেই আশি-নব্বই থেকে পাঠক হিসেবে ইমাজিনেশন। আমাদের ইমাজিনেশন তখন ভিজ্যুয়ালি আটকে দেওয়ার সুযোগ কমই ছিল। আর আমরাও পাঠক হিসেবে সব মেনে নেব, এমন সম্ভাবনাও ছিল কম। বেয়াড়া ছিলাম। তখনকার পাঠক তাই সহজেই মনে মনে গল্পকার হয়ে উঠতেন। এই যেমন এখন চাইলেই আপনি ওসাকায় হাঁটার গল্প করতে পারেন বা লন্ডনে আপনার আত্মীয়স্বজন কী করছে, সেই ছবি দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারেন সোশ্যাল। এখন সেই দূরত্ব চলে এসেছে কাছে, ঢাকাতেই মাঙ্গা নিয়ে মুগ্ধ পাঠক-উদোক্তা-উদযাপন দল আছে, কমিককন হচ্ছে। চাইলেই ইন্সটাতে শেয়ার করতে পারেন আপনার ফুকেট আইল্যান্ডের ভ্রমণের ছবি, প্লাস্টিক ফ্যান্টাসটিক ট্যুরিজম অথবা একটু অ্যাডভেঞ্চারও না হয় যুক্ত করলেন। এখন যেমন সহজেই নকল করতে পারেন গ্লোবাল ট্রেন্ড; হাত বাঁকিয়ে বকের মতো করে লবণ ছিটাতে পারেন। নিজের তৈরি রান্নার ভিডিওতে। নিজেকে ভাবতে পারেন গ্লোবাল, হতে পারেন ভাইরাল। তবে সতর্ক করি এসবের সঙ্গে আপনার সমৃদ্ধ হওয়ার কোনো যোগাযোগ নেই। আপনাদের ইমাজিনেশন এই সব ꦍগ্লোবাল ইমেজের কাছে আর ট্রেন্ডের কাছে মার খেয়েছে ভীষণ। আপনারা হয়ে উঠেছেন প্রেডিকটেবল। আপনাদের নিজের কোনো গল্প নেই। আছে গল্পের ট্রেন্ড, গল্পের কপি। কপির কপি। ট্রেন্ড বুঝলেই আপনার গল্প ধরে ফেলা যাবে। আপনারা অতি অল্পে সন্তুষ্ট। রাগ করলেন? করেন একটু রাগ। যে হুমায়ূন 🃏আহমেদকে আমরা সমালোচনা করতাম গল্প ফুরিয়ে যাওয়া নিয়ে সেই হুমায়ূন আপনাদের কল্পনা সীমার বাইরে হাইলি ইমাজিনেটিভ।

ফলে লেখক, মানে যিনি লিখছেন (মানে কেবল কন্টেন্ট বানাচ্ছেন না, কপি মারছেন না); তার ব্যক্তিত্বের মিথস্ক্রিয়া থেকে আপনারা বঞ্চিত। এটা ভিডিওতে এসে আমি কীভাবে কী করলাম, এটা দেখানোর বিষয় না। ক্রিয়েটিভ প্রসেস এ যিনি সৃষ্টি করছেন, তিনি হয়ে পড়ছেন গুরুত্বহীন। আপনারা নিশ্চয়ই এখন এক্সপোজার আর বাজার নিয়ে বলবেন। উল্টো বলবেন আরে, এখন তো এনারা আরও বড় স্টার। আর এখানেই সমস্যা। স্টারডোম কারখানায় তৈরি হতে থাকলে ঘরে ঘরে স্টার। এত স্টার এ কেউই স্𝔍টার আসলে নন।

একটু তলিয়ে দেখুন খুব আলাদা করা কি যাচ্ছে? নানান কন্টেন্টের নানাবিধতার ঢলে এই ক্রিয়েটররা এক একটা বড় ঢেউই বরং। এর বেশি কিছু না। একটা মেশিনের ছোট্ট নাট-বল্টু। খেয়াল করে দেখেছেন কি যে আপনাদের চ🎃িন্তার ভাষায় “কন্টেন্ট রাইটার” জনপ্রিয় বেশ লেখক ততটা আর নয়। লেখক জিনিসটারই সংজ্ঞা বদলাচ্ছে। আবার মনে করুন ফেসবুক যখন লিমিটেড অপশন দিয়ে প্রোফাইল দিতে বাধ্য করে রাইটারের; আপনি তখন হয়তো সেটাই হতে চান। এটাকে গণতন্ত্রায়ন বলবেন অনেকে। আমার ভিন্নমত আছে। আমি মনে করি ফেসবুক রাইটার আর লেখক এক জিনিস নন। আপনার এজেন্সি কই? আপনার বিদেশ যাপনে সেই “বুড়ির” গল্প কই? অথবা “বেবি রুথ”? আপনি বলবেন আর গল্প তো এখন রিল-এ। রিল তো টেক্সট না। আপনার ইমাজিনেশন আটকা।

মাঝে মাঝে মনে হয় যে লেখকের ওপর আসলে আপনাদের আর আস্থা নেই। আপনারা মনে করছেন সব জেনে গেছেন সব বুঝে গেছেন। আসলে কিন্তু আরও বেশি করে মেশিনের নাট-বল্টুই হয়ে উঠছেন। রা🌌শিয়ান একটা মেয়ের প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যাওয়া আর পরে পার্কে আবিষ্কার করা আরেক ইন্দোনেশিয়ান তরুণীর সঙ্গে। যিনি প্রবল চুম্বনে আমার রাশান তরুণীকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে আছেন। সেই মন ভাঙার গল্প তো আমার কাছ থেকেই শুনতে হবে। এটাকে একবাক্যে বুঝে ফেলা যাবে না। অথবা সেই গল্প যেখানে বিদেশি বন্ধুদের দাওয়াত দিয়ে কারাওকেতে নিয়ে যান একদল জাপানি তরুণী এরপর একে একে ঘটতে থাকে অদ্ভুত সব ঘটনা। সেই গল্প তো আপনি অন্য কোথাও পাবেন না। হ্যাঁ, কাঠামো পেতে পারেন কিন্তু গল্পের কথক তো ভিন্ন। কথক ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এটা “ডারম্যান”-এর সো ইউ সির মোড়ল বাণীর প্যাকেজ না। এটার স্তর আরও অনেক, জটিল।

হুমায়ূন ইউনিভার্স, আমাদের লেখক-কিসের পাঠক?

আমার কাছে লেখকের মূল চরিত্র হলো অভিযাত্রিক, ফ্রন্টিয়ার, নতুন জমিতে গোড়াপত্তনকারীর। জমি না থাকলে জমি তৈরি হবে। গ্রাহক না থাকলে গ্রাহক নির্মিত হবে। ভাষা না থাকলে ভাষা নির্মাণ হবে। পাঠক না থাকলে পাঠক নির্মিত 💞হবে। একসময় গ্রাম হবে, গ্রাম থেকে শহর-নগর, এরপর রাষ্ট্র, অর্থনীতি, ফ্যাশন সবই হবে। মানে আমি বলতে চাইছি মার্ভেল আর অ্যাপল বহুদিন ধরেই যে ট্যাগলাইন হাজির করে সেই “ইউনিভার্সের” গল্প। বাণিজ্য-আলারা এখন বরং মোটা মোটা ইউনিভার্স তৈরি করেন আর আপনারা হা করে গেলেন। নিজেরটা কই বানান?

ইউনিভার্স তৈরির কাজ আসলে করেন লেখক। কোনো লেখক করেন দুই বা তিনটি বই দিয়ে, কেউ সমগ্রের পর সমগ্র হাজির করে। আপনারা লেখকের ইউনিভার্সকে এখন আর গণ্য করেন? দেখতে পান? রাউলিং নিয়ে অনেক উচ্ছ্বসিত থাকেন কিন্তু নিজের ভাষার কোন কোন লেখককে করেন? সত্যজিৎ রায়? হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সেই ইউনিভার্স তৈরি করা লোক। আমি মনে করি একজন লেখকের এর চেয়ে কম উচ্চাভিলাষী হওয়াটা পাপ। তাকে বরং সচিব হতে বা মন্ত্রী হওয়ার, বা একজন বারাক ওবামা হওয়ার পরামর্শ দেব আমি। শত বছরের 😼নির্জনতার হোসে আর্খাদিও বোয়েনদিয়ার কথা মনে আছে? মার্কেস সাহেব আমার মতে সেই হোসে আর্খাদিও বোয়েনদিয়া। হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে তেমনি ইউনিভার্স তৈরির কারিগর। পরিমাণে আর ব্যাপ্তিতে বাঙালি মুসলমান বা মুসলমান বাঙালি হিসেবে এই সাহসের বাহবা উনি পাবেন। হুমায়ূন আহমেদের অতিপ্রিয় বিষয় সাইকোলজি হলেও তিনি আরও বহু টুলুস ব্যবহার করেছেন, ভাষা এর মধ্যে একটি, এ ছাড়া শ্রেণি, ধর্মীয় বিশ্বাস, গ্রামকে নিয়ে শহুরে ফ্যান্টাসি আরও কত কি। ফলে উনি কলোনাইজারও। এই উপনিবেশকে আমি যেমন সম্মান করি, তেমনি ভাঙতেও চাই। মধ্যবিত্ত শ্রেণি কোথায় কীভাবে অস্তিত্বশীল, সেটা নিয়ে তর্ক করার বহু সময় আছে নিশ্চয়ই। তবে লেখার মধ্য দিয়ে শ্রেণির ইমাজিনেশন নির্মাণের মধ্য দিয়ে যে বাস্তবের শ্রেণি-চর্চা যে তৈরি হয়, এটা তো বলাই বাহুল্য। ফলে ওনার জনপ্রিয়তা নিয়ে ওনার সমসাময়িক লেখকদের ঈর্ষা বা তাচ্ছিল্যকে উনি ততটা গণ্য করেননি বলে মনে করি। সিরিয়াস সাহিত্য বনাম জনপ্রিয় সাহিত্য নামক হাস্যকর দ্বিমুখিতার ট্র্যাপ উনি এড়িয়ে গেছেন। চলুক না তর্ক, আপনার পক্ষ নিতেই হবে? হতেই হবে জনপ্রিয় কিংবা সিরিয়াস লেখকের কোনো একটা?

দ্য প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ হুমায়ূন: শ্রেণি উত্তরণ, চরিত্র, বাজার, অর্থনীতি, বাংলাদেশ

খেয়াল করে দেখবেন ওনার সব জনপ্রিয়✱ চরিত্রের মধ্যে রয়েছে এক প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ ব্যক্তিত্ব। এইꦕ ব্যক্তিত্বের বড় হওয়া, টিটকারি, ভীতি, বিশ্বাস, সন্দেহ, কূটচাল, শয়তানি, অভিযাত্রীক বোধ, ঘরকুনো থাকা, রোমান্টিকতা, নস্টালজিয়া, ধর্ম, বিজ্ঞান, শ্রেণি-গর্ব, তাচ্ছিল্য, মহাজগতের সঙ্গে যোগাযোগের বোধ, যুদ্ধ, ঘৃণা, প্রতিবাদ সবকিছুর একটা সাটল অনন্ত বহমান ধারাকে আপনি চাইলেই খুঁজে পাবেন। আমার কাছে এই হুমায়ূন তীব্রভাবে প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ। তবে আপনাকে খুঁজতে জানতে হবে, মনে রাখতে হবে যে সময়ের সঙ্গে পাঠকত্বের ধরন পাল্টাবে।

১৯৮০ বা ৯০ দশকের পাঠকের কাছে হুমায়ূন আহমেদ যা বা যেমন; ২০০৫ বা ১০-এর পরবর্তী পাঠকের কাছে তিনি🔯 হয়তো অন্যভাবে ধরা দেবেন। এমনকি হয়ে উঠতে পারেন তথাকথিত সিরিয়াস সাহিত্যিকও। উনি যা-ই হয়ে উঠুন, নানাবিধ সাহিত্যিক ধমকধামকের পরও উনি থাকবেন। আলোচনা, সমালোচনা চলতে থাকবে। যদিও আপনারা ইদানীং ওনাকে মিথ বানাতেই ব্যস্ত।

অত্যন্ত দয়াবতী, রূপসী, “বালিকাসুলভ” যে চরিত্রগুলো উনি তৈরি করেছেন, সেখানে ওনার যৌন ফ্যান্টাসি যেমন আছে, তেমনি এ সমাজের মধ্যবিত্ত পুরুষের ফ্যান্টাসি নির্মাণও আছে। যে “লঘুতা” নিয়ে ওনার সমালোচনা তাতেও আমি দেখি এক প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ মধ্যবিত্ত পুরুষকে। যিনি মানিক বন্দ্যোপ্যাধ্যায় দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়ে শুরু করেছিলেন এবং উত্তীর্ণ করে গেছেন নিজস্ব ভাষা ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে। শঙ্খনীল কারাগার তাই তেমনটাই হওয়ার কথা ছিল। যেটা তার দারুণ জায়গা সেটা হলো সেই সময়ের সাহিত্যের “জনপ্রিয়তার” সমালোচনায় 🥃ডুবে না গিয়ে তিনি শ্রেণি-গল্পকে জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন। কীভাবে?

একটা নতুন রাষ্ট্র যেখানে সংস্কৃতি মালিকেরা কলকাতামুখী, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মার খাওয়া। আত্মসম্মান নিয়ে দোলাচালে। আত্মপরিচয় নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। বই কেনা তো দূরের কথা, বই পড়ুয়ার সংখ্যাই সামান🎃্য। সেখানে “জনপ্রিয়” হয়ে ওঠা এক নীরব বিপ্লবই বটে। তিনি জানেন তিনি কী লিখতে পারেন, তিনি জানেন তিনি কী প্রডিউস করতে পারেন। টেক্সট কারখানা যদি নতুন ধর্ম বিধান হয় তাহলে তিনি নিজের শ্রেণি উত্তরণের চেষ্টা করবেন না কেন? এই হুমায়ূনকে নিয়ে অনেকগুলো বায়োপিক হবে না কেন? গসিপের বাজারের কথা বলছি না। বলছি শক্তিমান গল্পকারেরা, নির্মাতারা যেভাবে হুমায়ূন আহমেদসহ বাকিদের নিয়ে প্রচুর কাজ করতে পারেন। ফারুকী বুদ্ধিমান, এই কাজটা তিনি আগেই করে রেখেছেন।

২০২৩-এ এই রাষ্ট্রের বইয়ের বাজারের নেট অর্থনীতিতে কতটুকু? আমাকে যারাই বলেন হুমায়ূন আহমেদ শ্রেণির গল্প লিখেছেন খুব কম আর লিখেছেনও মধ্যবিত্তের পক্ষপাতিত্বে তাদের আমি বলি ওনার জীবনকে দেখেন। একজন লেখকের ধনী হওয়াটা এই সমাজ মানতে নারাজ, কী অদ্ভুত! প্রি-কলোনিয়াল মানসিকতা। আমি বরং সেলিব্রেট করি তার নুহাশ পল্লি, সেন্ট মার্টিনের বাড়ি, লেখার জন্য প্রকাশকদের লাইন, নাটক, সিনেমা বানানো। অনেকেই বলবেন লেখকের দায় তো উনি এড়িয়ে গেছেন; আসলেই কি? শঙ্খনীল কারাগারের 💖বা নন্দিত নরকের লেখক তাহলে গরিবি অমরতায় জীবন কাটাবেন? বা একজন শিক্ষকই থাকবেন, যার বিলাসিতা থাকবে না? এই ইমেজ এবং তাই কাঠামোর আমি বিরোধী। তাহলে ইদানীং কেন আপনারা নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার কেনার জন্য এত ঝাঁপ দেন? জগতের সব সুলেখক তাহলে আমেরিকাতেই জন্মাচ্ছে ইদানীং। এটা গভীরভাবে পোস্ট কলোনিয়াল আর পোস্ট এম্পায়ারিলিস্ট চিন্তা। একই সঙ্গে আপনাদের মগজ ধোলাই করা মার্কেটিং বায়াস। নানান বয়সের মানুষদের জন্য সৃষ্টি ও সংক্রমণে সত্যজিৎ দারুণ ও বহুমুখী; আমাদের হুমায়ূন দারুণতর। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারে ওনার ধারেকাছে কেউ নেই। গোয়েন্দাগিরির আকর পাল্টে দিয়েছেন তিনি। হুয়ায়ূনকে নিয়ে কই আপনাদের আন্তর্জাতিক সেলিব্রেশন, আন্তর্জাতিক𝔉 প্রচার ও প্রচারণা? কেন কিছু স্থানীয় স্মরণসভা আর বই বিক্রিতে আপনারা আটকা? আর গসিপ?

হুমায়ূন ভীষণভাবে রাবিন্দ্রীকও; তাতে কি ওনার হুমায়ূন হওয়া আটকানো গেছে? আমি মনে করি বাংলার মুসলিম কৃষি সমাজ (নানান চেহারায় জোতদার, স্বচ্ছল গৃহস্থ) থেকে প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মে উঠে আসা আধুনিক, শিক্ষিত মেধাবীদের যে লড়াই ও উচ্চাভিলাষ তার স্মরণীয় সফল প্রতিফলন হলেন হুমায়ূন আহমেদ। ছফা, হুমায়ুন আজাদ, সলিমুল্লাহ খানদের লক্ষ্য করুন। প্রজন্মের এই লড়াইকে আপনাদের বুঝতেই হবে। ইলিয়াস সাহেব এত তীক্ষ্ণ আর গুরুত্বপূর্ণ, কই তাঁর বই নিয়ে আপামর আলোচনা কোথায়? ফলে আপনাদের যাই মনে হোক না কেন প্রচলিত তরিকাতেও মেধাবী༒ হুমায়ূন অনেকগুলো সাহস একের পর এক দেখিয়ে গেছেন। উনি কিন্তু একসেন্ট্রিক উইয়ার্ডও, ওনার আপোসেরও শেষ নেই। সেসব নিয়ে লিখবো একসময়। তবে, এসব সত্বেও মুসলমান বাঙালির এই সাহস আমার খুব ভালো লাগে। খুব রেয়ার তো। আবার যতটা না রেয়ার তারচেয়েও বেশি আপনাদের বোধগম্যতার অভাব, যার ফলে আরও রেয়ার করে তুলছেন। একদিকে পরিবারের বড় ছেলে, মুক্তিযুদ্ধে বাবাকে হারানো, দারিদ্র্যে সঙ্গে লড়াই, যুদ্ধ পরবর্তী দেশে নিজের জায়গা বানানো, স্কলারশিপে বিদেশে যাওয়া, নিজ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি হওয়া এবং ছেড়ে দেওয়া। ক্রমান্বয়ে বই-সাংস্কৃতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠা, কোনোটাই সহজ কাজ নয়। এই যে ধুঁকে ধুঁকে আঁকড়ে বেঁচে থাকা মধ্যবিত্তের মধ্যে অদেখা যে সাহস, তা কিন্তু উনি জুগিয়েছেন পরিহাসের ছলে। উনি দেখিয়েছেন একজন মধ্য-বয়সী অন্তর্মুখী মানুষের ক্রমাগত তাচ্ছিল্য আর উপেক্ষা সহ্য করার করুণ ইতিহাস; আবার তারই ঠান্ডা মাথার প্রতিবাদ, অনাপোষ। উনি তো এই সংসারে মিসফিট। লেখকমাত্রই হয়ত মিসফিট। হিমুকে যতই টিনএজ রোমান্টিসিজম ভাবা হোক না কেন, আদতে সে একটি গভীর রাজনৈতিক চরিত্র। স্ট্যাটাসকে চ্যালেঞ্জ করার লোক। হাইলি রোমান্টিসাইজড এবং প্রায়শই সরাসরি না, আপোষে, ঝটিকা উপেক্ষায়, মাইন্ড গেমে, প্রহেলিকায়, জাদু বাস্তবতায়। বাস্তবতার অধিক বাস্তবতায়। হিমুকে আবার আপনাদের কারো কারো এখন সুপার হিউম্যানও মনে হতে পারে। বিষয়টা সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত। মনে করেন ‘হলুদ হিমু কালো র‌্যাব’-এর পর যদি এই সময়ে উনি লিখতেন ‘আয়না ঘরে একজন হিমু’—কেমন হত বিষয়টা? খুব প্রতিবাদী হতো? হয়তো হতো না। যদিও এই প্যাসিভ এগ্রেসিভও তো দেখা যায় না। এখন মজার বিষয় হলো আয়না ঘর এবং হিমু নামে ওনার বইও আছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে যে বা যারা বন্দীশালার নাম রেখেছেন আয়না ঘর; উনি কি হুমায়ুন পড়েছেন? এই যে তরুণের দল যারা হিমুকে দিয়ে সমাজের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক খুঁজে পেতেন সেই তরুণদের কি আর দেখতে পান আপনারা? শুনতে পান তাদের কথা? সেই দূরের মাইনাস ৪০ ডিগ্রির এক শহরের সঙ্গে তার ভালোবাসা যতটা তার ছিঁটফোঁটাও মহাখালীর সঙ্গে নেই। খালি পায়ে গভীর রাতে বেরিয়ে পড়া তরুণেরা কই? এতে কি তরুণদের ইউনিভার্স সংকুচিত হল নাকি আটকা পড়ল? একটা অদ্ভুত আয়না ঘরে আটকা পড়ল?

আপনাদের ওসি হারুনকে মনে পড়ে? আপনাদের মনে হয় না এই লোকটা তারুণ্যে হিমু পড়া লোক? যে সিস্টেমের ভেতরে বসেই প্যাসিভ রেজিসটেন্স করছে? আপনাদের গভীরে, খুব গভীরে এই লোকটা আছে না? নাকি ভুলেই গেছেন? আমার কাছে তীব্রভাবেই মনে হয় আজকাল যারা ওটিটির জন্য স্ত্রিপ্ট লিখছেন, তাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সফলতর যারা, তারা কোনো না কোনোভাবে হুমায়ূন দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত। বাংলা নাটকে মফস্বল বা গ্রামের যে বিগত দেড় দশক, সেটাতে ক্যারিকেচার যতটা, গল্প ততটা নয়। এত দরিদ্র্য আমরা কীভাবে হলাম? এই সময়টা আমার কাছে হুমায়ඣুনের ছোট গল্প, অশরীরি গল্প নিয়ে কাজ করার মোক্ষম একটা সময়। শ্রেণির গল্পকে পার্টিজানের বাইরে থেকে দেখার সময়।

হুমায়ুনের যে আত্মমর্যাদার লড়াইয়ের গল্প তাতে যে চরিত্ররা উঠে আসেন তাদের একটা বড় অংশ কিন্তু কোন না কোনভাবে শ্রেণি লড়াইরত। আমার যেমন ভীষণ মনে পড়ে সেই হুজুরের কথা যিনি একদা লজিং থাকতেন সম্পদশালী গৃহস্থ পরিবারে, সেই পরিবারের সুন্দরী তরুণীটি তার প্রেমে পড়ে। যদিও সেই দম্পতির কোনো সন্তান টেকে না। কারণ বিশ্বাস করা হয় যে স্ত্রীটির ওপর জ্বীনের নজর আছে এবং সন্তান জন্মদানের কয়েকদিনের মধ্যেই সেই শিশুটি নানান কারণে মারা যায়। এইভাবে পরপর কয়েকটি ঘটনা। পরে মিসির আলী আবিষ্কার করেন যে জ্বীন নয় বরং স্ত্রী স্বয়ং, সন্তানের মা নিজেই কাণ্ডটি করেন। প্রথম প্রেমের তীব্র উত্তেজনায় সচ্ছল ঘরের মেয়েটি বিয়ে করলেও লজিং মাস্টারের সঙ্গে বসবাস মেয়েটির শ্রেণিপতন ঘটায়, যা൲ সে কোনোভাবেই মানতে পারেনা। তিনি থাকেন নন্দিত এক নরকে। এই যে চাপা তীব্র দ্বেষ, তা কর্কশ স্বরে প্রকট হয় জিনের কণ্ঠে। এই ককর্শতা শ্রেণি ঘৃণার, মেনেও না মানতে পারার। নেগোশিয়েট না করতে পারার। কী অসামান্য এই গল্প। প্রেক্ষাপট মোটেই শহর নয় অজপাড়া গাঁ। এই দেশের গল্পে জ্বীন থাকবে না তা হয় নাকি। নব্বই দশক নিয়ে আমার যে এত অযাচিত উচ্ছ্বাস হয় তো রোমান্টিকতাও; তাতে বাকের ভাই নামক আইকনিক চরিত্রটি কীভাবে বাদ যাবে বলেন? বাকের ভাইয়ের পুনরুত্থানের গল্প তো আরও মজার। মিম থেকে ক্লিপ, শর্টস সবখানে বাকের ভাই আবার রাজত্ব করছেন। যদিও কেউ খেয়াল করছেন না যে শহর থেকে বাকের ভাই চরিত্ররা নাই হয়ে গেছেন। এই বিশেষ এন্টিহিরো চরিত্ররা আর নেই; ওনারা খোলস পাল্টে নতুন কিছু হয়েছেন, বাকের ভাই আর থাকেননি। আর এখানেই লেখকের প্রয়োজন। বাকের ভাই মন্ত্রী হলে আর কিছু যে থাকেন না পাঠক কি সেটা বুঝতে পারেন? চরিত্রের অমরত্ব থাকা দরকার সমাজে। আর সেটার নির্মাতা লেখকই, এখানেই তিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। যা বুঝতে পারি তাতে এখন মুনাও ক্ষমতাশালী অনেক; কিন্তু যে মুনাকে মানুষ মনে রাখবে তিনি আটকে আছেন ‘কোথাও কেউ নেই’-এ। কে বলে কেউ নেই? যিনি থাকার তিনি আছেন। তাহলে সবার মন্ত্রী এমপি হবার দরকার নেই, কী বলেন?

মুনার প্রসঙ্গ যখন উঠলই তখন হুমায়ূনের নারী✅ চরিত্রগুলোর দিকে তাকানো দরকার। যদি একটু তলিয়ে দেখি, তাহলে প্রথমে অনেককেই একটা টাইপের মনে হবে। যদিও এরপর এনারা কিন্তু অনেক স্তরায়িত। এই স্তর খুঁজে বের করার দায়িত্ব পাঠকের। মনে আছে ওই গল্পটা? আশ্রয়প্রার্থী নতুন দম্পতির গল্প। দারোয়ান একলা পেয়ে নারীটিকে গোসলখানার ফুটো দিয়ে দেখতো। এরপর দারোয়ানকে মেরে পুঁতে রাখা হয় সামনের লনে, কেউ বুঝতে পারে না। আমি তখনি যেন হুমায়ূন আর গুলতেকিনকে দেখতে পাই। একটি নব দম্পত্তির যে স্ট্রাগল এই সমাজে, বিশেষত ধনী নন যারা তাদের অন্তর্নিতিহ বাস্তবতা এই গল্পটি। দেবী আপনারা সহজেই মনে করতে পারবেন। কিন্তু আমার কাছে এটি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সিনেমা হিসেবে আরও নয়। তবে সামাজিক টেক্সট হিসেবেও দেবীর ভিন্ন পাঠ সম্ভব। সাইকোসোশ্যাল এনালাইসেসে এমনটা কি মনে করা যেতে পারে যে, দেবী নিজে আসলে নারীর প্রতি আগ্রহ বোধ করেন। হতে পারে তিনি বাইসেস্কুয়াল। যদিও তিনি নিজের কাছেই স্বীকার করতে পারেন না এই সত্য। এই যে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রের তীব্রতর ইএসপি সেটা কার জন্য? কেন?

আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হলো আয়না বিভ্রমের গল্প, যেখানে স্ত্রী তাঁর নতুন স্বামীর কাছে দুই রূপে আসেন, একবার অবিশ্বাস্য সুন্দরী, আরেকবার সাদামাটা একজন মানুষ হিসেবে। আহ! আপনি সেখানে বিউটির রাজনীতি দেখতে পান না? আবার স্বপ্নে যে ছেলেটি একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় একই দুঃস্বপ্নের লুপে আটকে যায়, ঘুম থেকে উঠে দেখে পায়ের পাতা কাটা, যেন ব্লেড দিয়ে কেটে দিয়েছে। অনেক যন্ত্রণা সত্ত্বেও ছেলেটি স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে চায় না, সেই মেয়েটির প্রেমে পড়ে যায়, তাকে একা রেখে কীভাবে আসবে? ফলে এক🤪সময় সে মারাই যায়। চলে যায় অন্য ভুবনে। আপনারা নোলানের ইনসেপশন নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত হন, কই হুমায়ূনের এই গল্প নিয়ে হন না কেন? কবে আপনাদের এই হীনমন্যতা কাটবে বলুন তো?

ক্লিশে এবং প্রাচীনপন্থী শোনাতে পারে অনেকের কাছে। আবার অনেকের মনে হতে পারে বিশেষ সময়ের প্রতি বায়াস। হয়তো আপনাদের অনুমান সঠিক, আবার অন্যদিকে মনে হয় যে নানাবিধ বাজওয়ার্ডের মাঝে সাহিত্যিকের গল্প বলার আর্টটাকে আমরা উপেক্ষা করছি খুব। গল্প বলা এত সহজ না। রাজনীতি, সমাজের আয়না, জনপ্রিয়তা, ফর্ম এসব যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গল্পও কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ ভীষণ গল্পবাজ প্রাণী। আপনারা মূলত গল্পই কনজিউম করেন আবার হত্যাও করেন। আশি, নব্বই এবং এমনকি আর্লি ২০০০ এ-ও আমরা এমনসব গল্পের মধ্যে ডুব দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি তা দুর্লভই এখন। আমার বরং প্রশ্ন জাগে যে সেই সময়ে হুমায়ূন হতে চাওয়া তরুণদের দেখে কি হু♐মায়ূন আহমেদ নিজে কি খুব ইমপ্রেসড হতেন? আমার কাছে, ক্ষমা করবেন ভীষণ আনইমপ্রেসিভই লাগে। আপনার কাজ তো হুমায়ূন হওয়া নয়।

হুমায়ুন জীবিত আছেন, ওনারে মিথ না বানানোই ভালো

মেসেঞ্জারে আমার প্রিয় এক ছোট ভাইয়ের অতি বিনয়ী কল। আলাপ শুরু হতেই বুঝলাম কারণটি। উনি বিয়ের দাওয়াত দিলেন। কাচুমাচুর কারণ বোঝা গেল। যেতেই হবে, কোনো ছাড় নেই। স্বাভাবিকভাবেই কনের নাম জানতে চাইলাম, ছোট ভাই উত্তর দিলেন ‘ফিহা’। বিস্ময় চেপে আমি প্রশ্ন করলাম, এই নাম কি হুমায়ূন আহমেদের ‘ফিহা সমীকরণ’ বই থেকে নেওয়া? মিষ্টি হেসে ছোট 🔴ভাই উত্তর দ😼িলেন, ‘হ্যাঁ’। আমার বিয়েতে যাওয়ার আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

এই অঞ্চলে হুমায়ূন উপাসনার বিষয়টি বেশ প্রবল। মৃত্যুর পর সেই মিথ আরও বেড়েছে। লোকজন কথায় কথায় স্যার আর পা ধরে সালাম করার বিষয়টি বলে কেঁদে ফেলেন। যদিও হুমাযূনের মতো আত্মবিশ্বাসী লোক দেখি খুব কম। সবাই অতি চালাক। প্রায় এক দশক হতে চলল এই তর্কের, কাছের লোকদের বলি, স্মার্ট-চালাক হয়েন না; তার চেয়ে বরং বুদ্ধিমান হন। এখন দেখি অধিকাংশই অন্যের আত্মবিশ্বাস ধার করে চলেন। এই স্মার্টনেস ওনাদের হয়েছে। এসবের ফলে ওনাদের সাবজেক্🤪টিভ নেগোসিয়েশন আর লেখক সত্তার বিশ্লেষণ দেখি কমেই চলেছে। বরং সংক্রমণ করার ভীষণ চাপই যেন দেখতে পাই; খ্যাতি, ভাইরাল, এত লাইক তত শেয়ার। হুমায়ূনের গল্𓄧পে চালাকদের কী হয় সেটা মনে আছে? ওই যে মধ্যবয়স্ক মানুষটি চাকরির শেষ পর্যায়ে, একসময় তিনি বেড়ালের কথা শুনতে শুরু করেন। ওনার শ্যালক দুলাভাইকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করেন, আর নিজের বিত্তের শো অফের মধ্যে থাকেন। গল্পের একপর্যায়ে দুলাভাই যে অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কিত সেটাও স্ট্যাব্লিশ করার চেষ্টা করেন। আর ঘটনাক্রমে শ্যালক দুই তরুণী গৃহকর্মীর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থা ধরা পড়েন। এখনকার শ্যালকেরা স্মার্ট হয়েছেন অনেক। ধরা পড়া বলে কোনো কিছু আর এক্সিস্ট হয়তো করে না। সবকিছুই যা ভিউ দেয় তা বিক্রয়যোগ্য। এরা ব্যবসায়ী, বোকা ব্যবসায়ী লেখক নন। ব্যবসার ট্রেন্ডের ফলোয়ার। যে হুমায়ূনের কথা আমরা বলছি তিনি ট্রেন্ড সেটার, ট্রেন্ড ফলোয়ার না। উনি ট্রেন্ডকে ক্রমাগতভাবে অস্বীকার করা মানুষ। খুবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তিনি প্যাসিভ হয়ে মিশেমিশে থেকেই এগ্রেসিভ হয়ে নিজের কাজ করে গেছেন।

এই সমাজে অনুগমনকারীদের প্রথম কাজ হয় অনুসরণীয়কে হত্যা করা। তাও অধ্যবসায়ী আক্রমণ না। কিছু আঁড়চ মাত্র। ফলে আমি প্রথমেই অস্বীকার করি হুমায়ূন হত্যাচেষ্টা, মিথ বানানো। বরং আবিষ্কার করতে চাই তার মহাবিশ্ব। হুমায়ূন প্রয়াণ দিবসে আর্টিকেল লেখার চর্চার হয়তো আর্কাইভাল গুরুত্ব আছে। তবে ভক্তি ও ভোক্তাগণ যাতে ওনাকে স্থবির মিথে পরিণত না করেন সেটা মনে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। কোনো পলিটিক্যাল পার্টির মতো আমি যেমন দাবি করি না হুমায়ূন কেন আরও ‘রাজনৈতিক’ হলেন না, আমার তেমনি কোনো হাহুতাশও নেই ওনার তথাকথিত ‘সিরিয়াস সাহিত্যিক’ না হওয়া নিয়ে। আমি বরং চিহ্নিত করতে চেষ্টা করি পাঠকের বই না কেনার প্রবণতার প্রতি। পয়সা দিয়ে ইন্টারেস্টিং কন্টেন্ট না পড়ার প্রতি। আমি বরং সেলিব্রেট করি বাংলাদেশের ভাষা সাহিত্য, আর তাই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একজন হুমায়ূন আহমেদের থাকাকে। মৃত মিথ নয়, জীবন্ত সত্তা হিসেবেই। আম﷽ার আর একটিও নতুন হুমায়ূন আহমেদের প্রয়োজন নেই, এক ছটাক হুমায়ূনও নয়। তবে আমি একসেন্ট্রিক লেখক পাঠক চাই অনেক। আমি চাই মানবীয় সকল দোষ ত্রুটির মধ্যে থাকা মানুষ। যারা একের পর এক রিডিফাইন করবেন ইমাজিনেশন। আমি চাই সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদা ভোগ করবেন লেখকেরা। হয়তো অসহনীয় হবে একত্র বসবাসের জনᩚᩚᩚᩚᩚᩚ⁤⁤⁤⁤ᩚ⁤⁤⁤⁤ᩚ⁤⁤⁤⁤ᩚ𒀱ᩚᩚᩚ্য, অথবা হবেন ভীষণ মিষ্টি ধরনের লোক। ঈর্ষাকাতরও হবেন। লেখালেখি কোনো বিশেষ জেন্ডারে আটকে থাকবে না। হবে না শুধু পুরুষের ক্ষেত্র বা নারীর বা কোনো বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর। হবে না বিশেষ সাহিত্যিক গোষ্ঠীর বা ভাষার এবং রাজনৈতিক দলের।

শিশুরা স্বপ্ন দেখবে লেখক হওয়ার। লেখকত্ব হয়ে উঠবে সবচেয়ে মর্যাদাকর পেশা। লেখক হওয়া হবে সবচেয়ে কম্পিটিটিভ। ক্ষমতা বাধ্য হবে লেখকের সঙ্গে নেগোশিয়েট করতে। পাঠক না হওয়া হবে লজ্জার। হুমায়ূন মহাবিশ্বের মতো বা তারও অধিক মহাবিশ্ব তৈরির জন্য আঁকুপাকু করবে মন। লেখক কনভেনশনে🌃 উপচে পড়বে লোক। হতে পারে এটা ফিকশন, একটা মিথ। যদিও হিমু জানতেন, মিসির আলি জানতেন, রুপা জানতেন, সবাই জানতেন জীবনই একটা মিথ। গুরুত্বপূর্ণ আনস্মার্ট প্রশ্ন তাই, আপনার মিথ কবে পড়ব?

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

Link copied!