সাধু এনড্রুর পদতলে গরীব মানুষের ডাস্টবিন ঘেঁটে খাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়লো সকালে। সেন্ট এনড্রু রেলস্টেশনের কথা বলছি। পশ্চিমে অবশ্য মিনিমালিস্ট মুভমেন্ট রয়েছে, যারা মানুষের অতিরিক্ত ফেলে দেওয়া খাবার ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে খায়, তবে এই নিঃস্ব মানুষটিকে সেরকম আন্দোলনের অংশ মনে হলো না। দারিদ্র কোথায় নেই?
উৎসবের চতুর্থদিন একটু দেরি করেই ভেন্যুতে পৌঁছেছি। মাঝে রেলগাড়িটা দেরি করলো, স্বয়ংক্রিয় দরজায় কি ঝামেলা হয়েছে সেজন্য। তার আগে বাসের জন্যও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। অবশ্য দেরি করাতে এক বৃদ্ধার সাথে আলাপের ফুরসত পাওয়া গেছে। বৃদ্ধার গলায় টিফের স্বেচ্ছাসেবকদের কার্ড ঝুলানো দেখে আগ্রহী হলাম। দেখি কার্ডে লেখা কেট। এত বয়সে উনি টিফে ভলান্টিয়ার কেন, এই কৌতুহল থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ফিল্ম ভালোবাসো খুব? উত্তরে কেট বলল, সে একসময় সিনেমায় অতিরিক্ত বা এক্সট্রা চরিত্রে অভিনয় করেছে। জিজ্ঞেস করলাম, কোন ছবি? বলে, সিলভার স্ট্যালনের একটি ছবিতে সে ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছে। ছবির নাম তার মনে নেই।
ষাটের কাছাকাছি বয়স, বা তারচেয়েও বেশি হবে। কথায় কথায় জানালেন আট শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে এই টিফে। আগেরদিন নাকি সে নিকোলাস কেইজকে দেখেছে। হলিউড এই তারকার ‘ড্রিম সিনারিও’ ছবির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হচ্ছে টিফে। তাই লাল গালিচায় নিকোলাস হেঁটেছেন আগেরদিন। তো স্বেচ্ছাসেবী কেট আমার সাথে সাথেই ভেন্যু পর্যন্ত এলো। আমি কি ছবি দেখব বা দেখেছি, তার অর্থনৈতিক অবস্থা সব নিয়ে কথা হলো। বোঝা গেল তিনিও দরিদ্র মানুষ, কিন্তু সিনেমার প্রতি একধরনের টান তার ভেতর আছে। অনেকটা আমার মতোই। গরীবের ঘোড়ারোগ। আমার হয়েছে সিনেমা রোগ। জড়বাদী চার্বাক দর্শনকে শিরোধার্য করে আমি ধার করে বিদেশের উৎসবে এসে ছবি দেখি, আর সেসব নিয়ে লিখি। এটা ঠিক ঘোড়ারোগও নয়, বলা যেতে পারে দরিদ্রের হাতিরোগ!
যাহোক, অনেকটা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতেই স্কশিয়াব্যাংক থিয়েটারে ঢুকি দিনের প্রথম ছবি ‘অ্যান্ড্রাগগি’ দেখার জন্য। ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরের যৌথ প্রযোজিত ছবিটি পরিচালনা করেছেন জাকার্তায় জন্ম নেওয়া তরুণ পরিচালক রেগাস ভানুতেজা। এটি তার দ্বিতীয় ফিচার ফিল্ম। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কুফল ও আসক্তি নিয়ে পরিচালক শিক্ষা দিতে চেয়েছেন, ছবির নাম বাংলা করলেও দাঁড়ায় ‘বয়স্ক শিক্ষা’। এই চলচ্চিত্রে প্রানি নামের এক মধ্যবয়স্ক নারী, স্কুলশিক্ষিকা, তার একটি প্রতিক্রিয়া অনলাইনে ভাইরাল হয়ে যায়। তারপর সেটাকে কেন্দ্র করে চলে কন্টেন্ট বানানোর ইঁদুর প্রতিযোগিতা। মানুষ যে সামাজিক মাধ্যমে কতটা অহেতুক সময় নষ্ট করে এবং এর কারণে মানুষের মানসিক শান্তি বিনাশ হয়, তারই বয়ান এই ছবি। প্রানির ভাইরাল ভিডিওর জবাবে তার ছেলেমেয়েরাও ভিডিও বানাতে শুরু করে। স্কুলের শিক্ষার্থীরাও জোট বেঁধে প্রচার শুরু করে শিক্ষকের পক্ষে। তাতে নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি হয় ইতি ও আদি। কাহিনির বুনোট আমার কাছে দুর্বল মনে হয়েছে, আরেকটু সবল হতে পারত।
এশিয়ার ছবি থেকে স্বাদ বদলের জন্য এবার দেখতে গেলাম যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘মেমোরি’, পরিচালনা করেছেন মিশেল ফ্রাঙ্কো। স্মৃতির ভেলায় দর্শকদের ভাসিয়ে নিয়ে এক সাধারণ মানবিক সম্পর্ককে অসাধারণ করে তুলেছেন পরিচালক। স্কুলের পুনর্মিলনীতে গিয়ে সিলভিয়াকে অনুসরণ করা শুরু করে সোল। সোলের স্ত্রী মারা গেছে। সিলভিয়াও ডিভোর্সি, এক মেয়ের মা। ওই অনুসরণের ঘটনা থেকেই শুরু হয় স্মৃতি-বিস্মৃতির খেলা। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ মুছে যায়। পরিচালকও চলচ্চিত্র থেকে কালের চিহ্ন মুছে দিয়ে এক অবলা প্রেমের গল্প বলে চলেন। যে গল্পে আশ্রয় আছে, সহায় আছে, আর আছে সহমর্মীতা। সোলের একজন কেয়ার গিভার দরকার। সিলভিয়া হয়ে ওঠে সেই যত্নদানকারী। কিন্তু একটা সময় পর সিলভিয়া বুঝতে পারে সোল হয়ে উঠছে তার আশ্রয়স্থল। নিজের অন্ধকার অতীত ভুলে সোলকেই জীবনের ধ্রুবতারা করে নেয় সিলভিয়া। সুন্দর ছবি। টিপিকাল হলিউডি ছবির মতো নয়। সেজন্যই বোধহয় প্রায় পাঁচশ আসনের প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় ভর্তি ছিল। এই ছবি সম্পর্কে আমি আগে জেনে আসিনি, বলা যায় জুয়া খেলেছি। ভালো হলে ভালো, খারাপ হলে ভাগ্য খারাপ। কিন্তু দেখে ঠকিনি।
আরেকটি ভিন্নধর্মী ছবি দেখা হলো স্কশিয়াব্যাংক থিয়েটারেই। ছবিটির নাম ‘ইয়েলো বাস’। ওয়েন্ডি বেডনার্জের ডেব্যু ছবি এটি। এবং টিফেও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রথম কোনো ছবি। ভারতের অভিনেত্রী তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায় এই ছবির মূল আনন্দ চরিত্রে অ🐷ভিনয় করেছেন। আনন্দের দুই মেয়ে। এক মেয়ে স্কুলবাসের ভেতর মারা যায়, স্কুল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে। এরপর শুরু হয় এক মায়ের বেদনা জর্জরিত সঠিক বিচার পাওয়ার অভিযান। স্কুলের প্রধান শিক্ষক তো বটেই, নিজের স্বামী ও বড় মেয়েও প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে তার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্কুলটি বন্ধ হয়। অন্যরাও নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। এই ছবির প্রযোজকও একজন নারী। ছবি শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে পরিচালক, অভিনেত্রীদ্বয় ও প্রযোজক সকলেই জানালেন তারা মা। কাজেই মায়েদের পক্ষেই এমন ছবি বানানো সম্ভব। গল্পটি হৃদয়স্পর্শী। তন্নিষ্ঠার অভিনয় ঠিকঠাক হলেও স্কুল সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও কর্মচারীদের অভিনয় গড়পরতা ছিলো। চলচ্চিত্র শেষের পর সবাই হাততালি দিলো। টিফের অডিয়েন্স বেশ মাপা। এরা ঠিক কানের দর্শকের মতো নয়। কানে যেমন কোনো🍌 কোনো ছবির শেষে তুমুল কড়তালি পড়ে। এখানে তেমন নয়।
ছবি শেষ হওয়ার আগেই মোবাইলফোনে বার্তা এলো মনে আর মনের মা দুজন এসেছে সিএন টাওয়ারের কাছে। ওখানে তারা এক্যুরিয়াম ঘুরে দেখেছে, তার আগে বেড়াতে গিয়েছিল সিলভার বার্চ বিচে। যদিও এটি লেক ওন্টারিওর কোলঘেঁষে, কিন্তু দেখতে সমুদ্র সৈকতের মতোই। মা ও ছেলে দুজনে মিলে বেশ ঘুরেটুরে টিফের কনসার্ট যেখানে হয় সেখানে অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। আমি ছবি দেখে বেরিয়ে ওরা সহ হাঁটতে হাঁটতে গেলাম অদূরের এক রেলগাড়ি জাদুঘরে। বিশাল খালি ময়দানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা সময়ের রেলগাড়ি। মনে বেশ দৌঁড়ঝাপ করে এই ট্রেন, সেই ট্রেনে চড়লো। শুধু তাই নয়, ট্রেনের ইঞ্জিন যে বৃত্তে ঘুরানো হয়, সেটিও রয়েছে সেখানে। মনে দেখে খুব আনন্দ পেলো। সংরক্ষণের এই সংস্কৃতি আমরা কোনোকালেই শিখে উঠতে পারলাম না। আমাদের দেশেও এমন রেলগাড়ির জাদুঘর হতে পারতো। উল্টো রেলের জায়গা বেদখল হয়ে বসে আছে দেশের সর্বত্র। খোদ ঢাকাতেই গোটা ট্রাকস্ট্যান্ড রেলের জমি দখল করে গড়ে ওঠা। কেউই এদের সরাতে পারে না, এতোটাই শক্তিশালী এরা। দখলবাজদেরই জয়জয়কার দেশে। তো খালি খালি তো আমাদের দেশ ছেড়ে লোকজন বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে না!
তবে আমি ভেবে দেখলাম, যে দেশে আমার বেড়ে ওঠা, যে ভাষায় আমি সাঁতার কাটি, সেই আব ও হাওয়া ছেড়ে ভিন্ন জলবায়ুতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। না, এটা দেশপ্রেম নয়। বলতে পারেন ভাষাপ্রেম। এসব আলাপ করতে করতে আমরা উবার ডাকলাম। বাড়ি ফেরার পথে মুদি দোকানে গেলাম নিত্যদিনের বাজার করতে। দোকানি সুদান বা এর আশপাশের কোনো দেশের। ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলো কেমন আছি। আগের একদিন পরিচয় হয়েছিল। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, তোমার ফেস্টিভাল কেমন চলছে? আমি বললাম, এই তো চতুর্থদিন শেষ হলো। ওদের উৎসাহ অনেক। বলল, এটা কি ব💝িশ্বের সবচেয়ে বড় উৎসব? বললাম, না একে চতুর্থ বড় উৎসব ধরা হয়। আর পয়লা নাম্বার কান চলচ্চিত্র উৎসব। তারপরও টিফের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়🦩েছে। এদের সিনেমা প্রোগ্রামিংও ভিন্নতর।