বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অনেক কিছু নিয়ে ধারণা বদলে যায়। যেমন অনেকের রুনা লায়লা নিয়ে উন্নাসিকতা আছে, অনেকেই তাঁকে খুব পছন্দ করে, কেউ কেউ হয়তো অপছন্দ করেন। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কানও ম্যাচিউরড হয়, তখন মনে হয় কত বড় শিল্পী রুনা লায়লা। রুনা লায়লাকে যারা অবজ্ঞা করে, তারা কত নির্বোধ। পাঁচ ছয় দশক ধরে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে রাজত্ব করছেন, এখনো গান সুর করছেন, গাইছ𝓀েন এ রকম মানুষ সাব༺িনা ইয়াসমীন ছাড়া আর কেউ নেই। গোটা জীবনই তাঁর কেটেছে সাবিনা ইয়াসমীনের সঙ্গে তুলনায়। এটা আসলে আমাদের অযৌক্তিক তুলনা। বাংলাদেশের খ্যাতিমান দুই শিল্পীকে অযথাই এক পাল্লায় আনা। দুজন দুভাবেই শ্রেষ্ঠ, তাঁদের নিয়ে তুলনা করার কিছু নেই। তাঁরা দুজনই বাংলা গানকে নিয়ে গিয়েছে উৎকর্ষের এক জায়গায়।
রুনা লায়লা শিল্পী হওয়ার পেছনে বড় অবদান তাঁর মায়ের। তাঁর মা চাইতেন খুব ভালো শিল্পী হবেন। এই জন্য তিনি খুবই পরিশ্রম করেছেন। রুনা লায়লা চার বছর নাচও শিখেছেন। ওস্তাদ হাবিব উদ্দিন আহমেদ ও ওস্তাদ আবদুল কাদের পিয়ারুর কাছে ক্ল্যাসিক্যাল শিখেছেন। বিখ্যাত গজলশিল্পী মেহেদী হাসানের ভাই ওস্তাদ গোলাম কাদেরের কাছে শিখেছেন গজল। সদ্য এই কিশোরী তখনই প্লেব্যাক গাও𒀰য়া শুরু করেন। এ জন্য সব থেকে বেশি কৃতজ্ঞ মঞ্জুর হোসেন নামের এক সংগীত পরিচালকের কাছে। সেই পরিচালক কীভাবে গাইতে হবে মাইকে, সিনেমায় গানের কণ্ঠ কীভাবে দেওয়া লাগে, এসব বিষয়ে খুঁটিনাটি বিষয়ে শিক্ষা দেন। কিশোর বয়স থেকেই রুনা লায়লা স্টার🍌। বড় বড় উর্দু গানের কিংবদন্তিদের সঙ্গে গান গাইতেন। ‘জুগনু’ ছবি দিয়ে ১৯৬৫ সালে তাঁর প্লেব্যাক ক্যারিয়ার শুরু হয়। আর বাংলা ছবিতে গান গাওয়া শুরু করেন সুবল দাসের সুরে ‘স্বরলিপি’ ছবিতে। ১৯৭৪ সাল অবধি তিনি পাকিস্তানেই ছিলেন। সেখানকার টেলিভিশন ও সিনেমায় কাজ করেছেন। ওই সময় অনেক বড় মাপের শিল্পীর সান্নিধ্য পেয়েছেন। বিখ্যাত সব লিজেন্ডের সঙ্গে কাজ করেছেন। সে সময় অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে আমাদের শবনমও ছিলেন। গানের শিল্পীদের মধ্যে মেহেদি হাসান, আহমেদ রুশদী, মালা বেগম—সবাই অনেক অভিজ্ঞ। তিনি ছিলেন তাঁদের তুলনায় নবীন। প্রত্যেকে রুনা লায়লাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন।
১৯৭৪ সালে তিনি যেমন ঢাকায় ফেরেন, তেমনই ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ভারতে তিনটা বড় শহরে কনসার্ট করার সুযোগ পান। সেই সফরেই ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠী অবগত হয় তাঁর গায়কী ও প্রতিভার সঙ্গে। লতা মুঙ্গেশকরের মতো প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর স্নেহধন্য হন। এখনো আশাজির কাছের বন্ধু রুনা লায়লা। বাংলাদেশের আর কোনো শিল্পীর এমন সৌভাগ্য হয়নি। কিছু হিন্দি ছবিতেও তিনি গান গেয়েছেন, ভারতের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে তাঁর একক অনুষ্ঠান হয়েছে। পশ্চিম বাংলায় তাঁর বাংলা গান অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল একসময়। কাশ্মীরের একটা হাসপাতালের জন্য চ্যারিটি কনসার্টে গান গেয়েও সেখানকার কর্তাব্যক্তিদের মন জিতে ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এটা আপনার ঘর। যখন মন চায় আসবেন।’ তবু তিনি দূরের মানুষই থাকতেন, যদি তিনি আমাদের জন্য বাংলাদেশের সিনেমায় গান না গাইতেন। বাংলা সিনেমায় সত্তর, আশি ও নব্বই দশক মানেই রুনা লায়লার গান। তাঁর কণ্ঠের জাদুতে মোহিত হয়েছে দর্শক-শ্রোতা সবাই। তিনি যখন আনোয়ার পারভেজের সুরে, ‘দ্য রেইন’ ছবিতে ‘চঞ্চলা হাওয়ারে ধীরে ধীরে চলরে গুন গুন গুঞ্জনে ঘুম দিয়ে যারে পরদেশী মেঘ রে, আর কোথা যাসনে’ আসলেই মনে হয় এ কণ্ঠ শুনলে মেঘও থেমে যাবে। আমরা যেহেতু সামাজিক ইতিহাসকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবি, তখন এই গানটার সঙ্গে মানুষের স্মৃতির গল্প শুনতে চাই। এক ভদ্রলোক ইউটিউবে জানাচ্ছেন, ‘পুরোনো খাতা বিক্রি করে তৃতীয় শ্রেণির টিকিট ১.৭০ টাকায় কিনে এ ছবি দেখে বাসায় এসে বড় ভাইয়ের হাতে মার খেয়েছি।’ কিংবা কিশোরগঞ্জের শ্যামল নামের এক লোক লিখেছিলেন, ‘১৭ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে তিনি এই সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন।’ এ রকম কত গল্প রুনা লায়লার কত গানের সঙ্গে। তখনকার শিল্পীরাও অদ্ভুত ছিল♈েন, হিংসা করতেন না, শিডিউল ওলটপালটের জন্য সাবিনার কত গান রুনা লায়লা গেয়েছেন, রুনা লায়লার কত গান সাবিনা গেয়েছেন।
দেশের গান যদিও সাবিনা ইয়াসমীনের মতো গাওয়ার সুযোগ পাননি। তবু রুনা লায়লার দেশের গানগুলোও প্রাণ ছুঁয়ে যায়, আমার ঘুরেফিরে খালি মনে পড়ে রুনা লায়লার একটা দেশের গান, আলাউদ্দীন আলীর কী মায়াবী সুর আর বিখ্যাত গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’ ইউটিউবে এই গানের একটা ইউটিউব কমেন্ট আমার ভীষণ প্রিয়, ‘গানটা যখন আমার মা গাইত তখন মনে হতো এত ভালো গান দুনিয়ায় হয় না!’ কিংবা ‘আমার মন পাখিটা যায় রে উড়ে যায়’ অথবা ‘নদীর মাঝি বলে’ শুনলেই চোখে পানি এসে যায় আমার। কী একটা মিষ্টি শৈশবের বাংলাদেশ টেলিভিশন ছিল আমাদের। মোট ১৮টি ভাষায় দশ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন তিনি। দেশে-বিদেশে তাঁর মতো শো করেছেন এমন শিল্পী উপমহাদেশে হাতে গোনা। রুনা লায়লাই সম্ভবত একমাত্র শিল্পী, যিনি বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান এই তিন দেশেই সমানভাবে জনপ্রিয়। এই খ্যাতি দারুণভাবে উপভোগও করেন তিনি। ভক্তদের ভালোবাসাতেই আজ তিনি বিশ্বজুড়ে পরিচিত। শ্রোতাদের জন্যই তিনি হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি রুনা লায়লা। আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা নারী কণ্ঠশিল্পীর পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। শুধু গানই নয়, চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শিল্পী’ নামক চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন রুনা লায়লা। রুনা লায়লা সংগীত পরিচালক হিসেবেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। সিনিয়র সাংবাদিক রাফি হোসেন একবার তাঁর বাসায় গিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি এত পুরস্কার পেয়েছেন রাখারই তো আর জায়গা নেই।’ কিছু মানুষ থাকে ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা নিয়েই সব জিতে নেন। রুনা লায়লা তেমনই, খালি মন দিয়ে শিখেছেন আর পরিশ্রম করেছেন। এ ছাড়া তিনি তেমন স্ট্রাগল করেননি। নিজের গায়কীতেই তিনি হয়েছেন এই উপহাদেশের আইকনিক এক সংগীতশিল্পী। যাকে সবাই চেনে, তিনি সব জায়গাতেই সাবলীল। বিশেষ করে পাকিস্তানে রুনা লায়লা যে ধরনের জনপ্রিয় তা অতুলনীয়। তার জন্মদিনের খবর পাকিস্তান টেলিভিশনে নিয়মিত পাওয়া যায়। বাংলা গান গেয়ে তাঁর মতো আসর মাতাতে কেউ পারেননি না আজও। তিনি আরও অনেক দিন বাঁচুন, এত গান গেয়ে তিনি পূর্ণ ক꧙রেছেন বাংলা গানের তাঁর কাছে নতুন করে চাওয়ার কিছু নেই। তিনি যেমন গাইতে পারেন চটুল গান ‘পান খাইয়া ঠোঁট’ আবার তিনি গেয়েছেন ন𓆏িখুঁত আধুনিক গান ‘শেষ করো না শুরুতেই খেলা’, ফোক সুরে বিভিন্ন গান তাঁর কণ্ঠে হয়ে উঠেছে মাধুর্যময়। জন্মদিনের শুভেচ্ছা, লিজেন্ড!