তামিম ইকবালের নাম আমি প্রথম জেনেছিলাম ২০০৪ প্রিমিয়ার লিগ চলাকালে। ইন্দিরা রোডের হয়ে ঝড়ো সেঞ্চুরি করেছিলেন। পরের বছর ওল্ড ডিওএইচএসের হয়ে ১৮০ বা ১৮৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ২০০৫-এই ন্যাশনাল লিগের ঢাকা বনাম চট্টগ্রামের ওয়ানডে ম্যাচটা দেখতে ধানমন্ডি আবাহনী মাঠে যাই। ওই সময়ে ইংল্যান্ড আন্ডার নাইনটিন দল বাংলাদেশ সফর করছিল। একই দিনে বড় ভাই নাফিস ধানমণ্ডিতে আর ছোট ভাই তামিম ফতুল্লায় খেলতে নেমেছিলেন। তামিম আন্ডার নাইনটিনের হয়ে সেঞ্চুরি করেছিলেন, ঢাকার বিপক্ষে চট্টগ্রাম জিতলেও নাফিস বেশি রান করতে পারেননি। ঢাকার বাঁহাতি স্পিনা𓆉র মোশাররফ রুবেল সলিমুল্লাহ হলে বন্ধু নাজমুলের রুমমেট ছিলেন। রুবেল ভাইয়ের কল্যাণে ড্রেসিংরুমের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। নাফিস ইকবালের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো। ওনাকে বললাম, আপনার ছোট ভাই ইংল্যান্ডের সঙ্গে সেঞ্চুরি করেছে। নিজে রান না করতে পারার বেদনা মুহূর্তেই মুছে গেলো। উনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘দেইখেন, ও বাংলাদেশের সেরা প্লেয়ারদের একজন হবে। বড় বড় ছক্কা মারতে পারে। খুব সাহস ওর।’ নাফিস ইকবাল যেন এই সেদিন কথাগুলি বলেছিলেন। সেই তামিম ইকবাল খান আজ খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানলেন! খেলোয়াড় হিসেবে তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে কতখানি দিয়েছেন, তা আপনারা জানেন।
তামিমকে প্রথম সামনাসামনি দেখি ২০০৭ বিশ্বকাপের ক্যাম্পে। ততদিনে আমি রেডিও টুডেতে কাজ শুরু করেছি। আউটডোর ব্রডকাস্টার হিসাবে ক্যাম্প শুরুর দিনে লাইভ করতে গিয়েছিলাম। সেদিন অধিনায়ক হাবিবুল বাশার আর নবাগত সাকিব আল হাসানের লাইভ ইন্টারভিউ করার সুযোগ হয়েছিলো। অইদিন তামিমের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি, কেবল দূর থেকে দেখেছি। ২০০৯-এ কোরবানি ঈদে রেডিওতে তামিমকে নিয়ে একটা আড্ডাটাই🧔প অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করলাম। ততদিনে তিনি তারকা। ২০০৭ বিশ্বকাপে জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে মারা ছক্কা বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন, জিম্বাবুয়েতে ১৫৪ রানের ইনিংস খেলে ওয়ানডেতে তিনশ রান চেজ করে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের নায়ক হয়েছেন। রেডিওতে ঈদের বিশেষ আড্ডামূলক অনুষ্ঠানের অফার দিয়ে ফোন করলে উনি জানালেন লাইভ পারবেন না। কারণ ঈদে চট্টগ্রামে থাকবেন, তবে রেকর্ডেড হলে সম্ভব। বললাম, রেকর্ডই করবো। রেকর্ডিংয়ের সন্ধ্যায় নির্ধারিত সময়ের কুড়ি মিনিট আগেই এক বন্ধুকে নিয়ে তিনি রেডিও স্টেশনে হাজির! অইদিনই প্রথম সামনাসামনি কথা। সবাই বলেছিল তামিম খুব মুডি, সাবধানে প্রশ্ন করো। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে মন খুলে আড্ডা দিয়েছিলেন। লেগ সাইডে ব্যাটিং উন্নত করতে সিডন্সের সঙ্গে কাজ করা, জহির খানকে মারা সেই ছক্কার স্মৃতি, বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে ক্রিকেটার হওয়া, তার এবং পরিবারের জন্যে ভাই নাফিসের স্যাক্রিফাইস, কোনো একটা ফরম্যাটে ১০ হাজার রান করার স্বপ্ন, প্রিয় সিনে নায়ক, সিনেমা, প্রিয় গায়ক, গানের কথা তো বলেছিলেনই, বলেছিলেন প্রেমিকার কথাও (বর্তমানে স্ত্রী)। জাতীয় দলে খেলাটা তার প্রেম টিকায়ে রাখতে কীভাবে সহায়তা করছে, তা বলেছিলেন। তামিম থেকে দূরে রাখতে পরিবার মেয়েকে মালয়েশিয়ায় তার বোনের ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছিল। জাতীয় দলে খেলা শুরুর পর মালয়েশিয়ায় গিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করার, সময় কাটানোর সামর্থ তৈরি হয়েছে। ওই সময়ে এ ব্যাপারটি নিয়ে তিনি খুবই এক্সাইটেড ছিলেন। অনুষ্ঠান রেকর্ডিং শেষে একটা খামে সামান্য সম্মানী দেওয়া হয়েছিল। ওটা হাতে নিয়ে বলেছিলেন, চলেন কেএফসি যাই। আমাদের দুই বিল্ডিং পরেই কেএফসি ছিলো। এরপর বহু বহুবার মাঠ ও মাঠের বাইরে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। সবশেষ ইন্টারভিউ করেছিলাম অবিশ্বাস্য বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে কুমিল্লাকে ২০১৮ বিপিএল জেতানোর পর। আমার দেখা বাংলাদেশি কোনো ব্যাটসম্যানের খেলা সবচেয়ে নান্দনিক ইনিংসগুলির একটি। ওইদিন তামিম ইকবাল ব্যাট হাতে যা যা করতে চেয়েছিলেন, সবই করতে পেরেছিলেন।
কোনো একটা ফরম্যাটে দশ হাজার রান করার স্বপ্ন পূরণ হলো না। স্বপ্ন দেখছিলেন অধিনায়ক হিসাবে বিশ্বকাপ😼 জেতাবেন। সেই স্বপ্নের কবর দিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর তিন মাস আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন। উইনিং পারসেন্টেজে তিনি টাইগার ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল ওয়ানডে অধিনায়ক। সুপার লিগে তৃতীয় হয়ে বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন, প্রথমবার সাউথ আফ্রিকায় সিরিজ জেতানো অধিনায়ক তিনি। এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন না,♕ প্লিজ। হ্যাঁ, গত দুই-তিন বছরে ওনার ব্যাটিং স্টাইল নিয়ে আমি নিজেও সমালোচনা করেছি। সম্প্রতি রান করতে পারছিলেন না। তারপরও তামিম ইকবাল কিংবদন্তী। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ওপেনার। তা মিথ্যা হয়ে যায় না। টাইগার ক্রিকেটে অনেক অর্জনের নায়ক তিনি, অনেক রেকর্ডেই তিনি প্রথম।
জহির খানকে মারা সেই ছক্কা, ঘোষণা দিয়ে সেঞ্চুরি করে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম লেখানো, এরপর নটিংহ্যামে গিয়েও সেঞ্চুরি, ২০১১ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে সেই ম্যাচ জেতানো ক্যাচ, পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যাক টু ব্যাক ওয়ানডে সেঞ্চুরি, একই সিরিজে খুলনায় দ্বিতীয় ইনিংসে ম্যাচ বাঁচানো ডাবল সেঞ্চুরি এবং ছক্কা হাঁকিয়ে ডাবল সেঞ্চুরিতে পৌঁছানো, ২০১৮ এশিয়া কাপে ভাঙা হাত নি𓃲য়ে এক হাতে ব্যাট করতে নামা—এরকম অজস্র সোনালি স্মৃতি নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট রূপকথায় তামিম ইকবাল খান অমর হয়ে থাকবেন। কে যেন বলছিলো, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে দুইভাগে ভাগ করা যায়—জহির খানকে তামিম ইকবালের ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছক্কা মারার আগে ও পরে! সত্যিই তাই। আনন্দময় স্মৃতিগুলির জন্যে আপ♈নাকে টুপিখোলা ধন্যবাদ, খান সাহেব।