সামাজিক অবক্ষয় শুরু হলে তার ছোবল থেকে কিশোর-বুড়ো কেউ-ই রেহাই পায় না। উপরন্তু সে-স𝔍ব ‘সামাজিক ব্যাধি’ কিশোর মনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে তারা জড়িয়ে পড়ে ঝগড়াঝাঁটি থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়াল কর্মকাণ্ডেও। আর এসব অপরাধ দমনে প্রশাসনকে সাধারণত আইনি ব্যবস্থা নিতে তৎপর হতে দেখা যায়। কিন্তু সব ধরনের অপরাধ কি আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দমন সম্ভব?
প্রশ্ন করার সঙ্গত কারণ রয়েছে। শিশু-কিশোররা আইন জানে না। তাই যা জানে না, তা মানা-না মানার দায়ও তাদের ওপর বর্তানোর কথা নয়। কিন্তু আইন না জেনেও বিশেষ সময় তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। সমাজ-রাষ্ট্র তাদ♋ের দোষারোপ করে। ফলে একসময় না বুঝে বেআইনি-অনৈতিক পথে তারা পা বাড়ায়, ‘দুনিয়াদারি’ বুঝে ওঠার আগেই তারা সেই অপরাধ জগতের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। অথচ এই পরিণতির জন্য তাদের পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র যতটা দায়ী, ততটা তারা মোটেও নয়। এ ছাড়া তাদের এসব কর্মকাণ্ডকে অপরাধ বিবেচনা করে দণ্ড দিলেই তারা শুধরে যাবে, এমনটা ভাবার যৌক্তিক কারণ নেই। কারণ যে কাজ বড়দের জন্য অপরাধ, তা কিশোরদের ক্ষেত্রে ভুল মাত্র। অর্থাৎ কিশোররা জেনে-বুঝে এ ধরনের কাজ করে না। তারা যা করে, তা ভুল। সঙ্গদোষ ও মন্দ পরিবেশের কারণেই তারা ভুল পথে যায়।
উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক নির্দেশনা 💛এখানে স্মরণযোগ্য। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে সোমবার (৮ এপ্রিল) মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কিশোর অপরাধীদꦬের যখন মোকাবিলা করা হয়, সে ক্ষেত্রে যেন মনে রাখা হয় তারা ভবিষ্যতের নাগরিক। প্রথাগত অন্য অপরাধীদের সঙ্গে যেন না মিলিয়ে ফেলা হয়। তাদের জন্য বিশেষ কাউন্সিলিয় করার ব্যবস্থা, কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা, এই ধরনের সুযোগ-সুবিধাগুলোও যেন রাখা হয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘তাদের যেন দীর্ঘ মেয়াদে অপরাধী বানিয়ে ফেলা না হয়, সংশোধনের সুযোগ যেন থাকে। কারাগারে যেন অন্য আসামিদের সঙ্গে তাদের না রাখা হয়, সে বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আর এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প নিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কেও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।’
প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা যথার্থ। আমাদে♒র মনে রাখতে হবে, যে-সব কারণে কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তার অন্যতম পারিবারিক বন্ধন-পরিবেশের অভাব। এরপর রয়েছে সাহচর্𓂃য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আত্মীয়স্বজনের ব্যবহার। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিবারের মা-বাবার মধ্যে নিত্যকলহ লেগে থাকলে সন্তানের মনে তার প্রভাব পড়বে। মা-বাবার অশান্ত জীবন দেখে দেখে হতাশায় ভোগে। তারা সাধারণত মা-বাবার কলহ মেটাতে পারে না। বিপথগামী হয়ে পড়ে। এ ছাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের দুর্ব্যবহার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও সহপাঠীদের বিরূপ আচরণও তাদের মনে রেখাপাত করে। ফলে একসময় সেই আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
পরিবার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত, সমাজের চারদিকে যা কিছু ঘটে, তারই অনুকরণ করে কিশোররা। ফলে যে শিশু-কিশোরের পরিবার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত নিত্য বিবাদ-কলহ লেগে থাকে, সে স্বভাবতই বখে যায়। বড়রা যা করে, তা প্রথমে অনুকরণ করে। পরে সেই কাজ অভ্যাসে পর্যবসিত হয়। সমাজের একাধিক কিশোর যখন একই ধরনের আℱচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য তৈরি হয়। তারা নিজেদের সগোত্রীয় ভাবতে থাকে। এভাবে তাদের মধ্যে হিরোইজম কাজ করে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল, নিজের চেয়ে কম বয়সী ও সমবয়সীদের মধ্যে নিজের আধিপত্য বিস্তারে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে।
কিন্তু এই ‘কিশোর গ্যাং’ বন্ধের উপায় কী? এ🐼ই প্রশ্নের জবাবে মোটা দাগে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলা যেতে পারে। এগুলো হলো—
ক. পারিবারিক স্নেহ-মমতা।
খ. খেলাধুলার সঙ্গী নির্বাচনের সতর্কতা।
গ. শিক্ষায় আনন্দজনক পরিবেশ তৈরি।
ঘ. গণিতসহ বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ে যুদ্ধের নামে হত্যাকাণ্ডের মাহাত্ম্য বর্ণনা বন্ধ করা।
ঙ. মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া ও কাউন্সেলিং করা।
চ. সামাজিক আন্দোলন।
আগেই বলা হয়েছে, পারিবারিক কলহ কিশোরদের বিপথগামী করে তোলে। তাই শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে, পারিবারিক শান্তি-স্নেহমমতার চর্চা জরুর🍌ি। পরিবার থেকেই ভালোবাসার পাঠ গ্রহণ করলে তাদের মন হবে কোমল। মায়া-মমতায় তারা হয়ে উঠবে অভ্যস্ত। বাইরের জগতে গিয়ে আর হিংস্র হয়ে উঠতে পারবে না।
অভিভাবকদের নজর রাখতে হবে সন্তানরা কার সঙ্গে কোথায় মিশছে। তাদের আচরণে দিনে দিনে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না। এসব বিষয়ের ওপর বাবা-মায়ের ‘কোমল নজরদারি’ থাকতে হবে। তাহলে হঠাৎ খেয়ালের বশে সন্তান কুসঙ্গে যেতে চাইলেও ‘কোমল অনুশাসনের’ কারণে ফিরে আসবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ শিশুমনে প্রভাব ফেলে সবচেয়ে বেশি। কারণ দিনের সবচেয়ে বেশি সময় তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাটায়। সেখানের পরিবেশ চরিত্র গঠন ও মানসগঠনের অনুকূল না হলে শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়তে বাধ্য। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও জীবন গঠনের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে রাষ্꧒ট্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের।
ধর্মীয় শিক্ষা ও ইতিহাসের কোনো কোনো অধ্যায়ে প্রায় যোদ্ধাদের বীরত্বগাথা বর্ণনার ছলে হত্যাকাণ্ডের ওপর মাহাত্ম্য আরোপ করা হয়। এ ছাড়া গণিতেও ধর্মযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে হত্যার হিসাব শেখানো হয়। এই মাহাত্ম্যসর্বস্ব ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় কাহিনী পাঠে, গণিতচর্চায় ไশিশুমনে হিরোইজম বাসা বাঁধে। শিশু𒈔টিও বীরের মতো শত্রুর ওপর সশস্ত্র ঝাঁপিয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখে। এই দুঃস্বপ্ন থেকে তাকে রক্ষার স্বার্থে শিশু-কিশোর উপযোগী পাঠ্যবইয়ে হত্যাকাণ্ড-সংবলিত ইতিহাস-গণিতচর্চা বাদ দিতে হবে। তার শৈশব- কৈশোরকে করে তুলতে হবে স্বপ্নময়, ভালোবাসাপূর্ণ। এরপরও তাদের সুপথে আনতে না পারলে প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে। করাতে হবে কাউন্সেলিং।
তবে উল্লিখিত কাজগুলো করলেই তারা অপরাধ করবে না এই কথা শতভাগ জোর দিয়ে বলা যায় না। এই ধরনের অপরাধ বন্ধে সবচেয়ে জরুরি হলো, সামাজিক আন্দোলন। খুব বেশি আগের কথা নয়, মাত্র তিন দশক আগেও জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পরিবার-পরিকল্পনা বিভাগের স্বাস্থ্যকর্মীরা গ্রামগঞ্জ-শহরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়েছেন। এরপর দুই দশক আগে অ্যাসিড🎐 ছুড়ে নারীদের ঝলসে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছিল আশঙ্কাজনক হারে। সেই অপরাধও এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এর পেছনে সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি গণমাধ্যমে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তেমনিভাবে ‘গ্যাং-গ্রুপ’ বন্ধেও সর্বাত্মক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন-রেডিও চ্যা🌳নেলে ‘গ্যাং-গ্রুপ’ কালচারবিরোধী বার্তাসংবলিত নাটক-গান-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে। পাড়ায়-মহল্লায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের সৃষ্টিশীলতা, খেলাধুলা ও মানবকল্যাণের দীক্ষা দিতে হবে। তাদের মনে, শুধু মানুষ নয়, সর্বপ্রাণের প্রতিও প্রেম জাগাতে হবে। সমাজের ছোট-বড় মঙ্গলজনক কাজে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ যেন তাদের মনে বাসা বাঁধতে না পারে, সে ব্যাপারেও সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে। তবেই ধীরে ধীরে কমে আসবে কিশোর অপরাধ। কমবে ‘গ্যাং-গ্রুপ’ কালচারও।
লেখক: কবি-গবেষক-সাংবাদিক