প্রকৃতি ও নারী, এই দুটিকে পুরু൩ষ রহস্যময় বলে এসেছে এবং এখনও বলে। কারণ বহু যুগ আগে যখন শষ্য ও সন্তানের প্রয়োজনীয়তা মানুষ উপলব্ধি করতে শিখলো, তখন তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তাদেরকে দাঁড় করিয়েছে সেইখানে, যেখানে শষ্য ও সন্তান দুটির জন্যই প্রত্যাশা ও অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। ফলে শষ্যের জন্য প্রকৃতি এবং সন্তানের জন্য নারীর দয়া, ক্ষমতা ও ইচ্ছের উপরই যেন নির্ভরশীল ছিল তারা♍। সন্তান ও শষ্য হবে কি হবে না, তা রহস্যে ঘেরা। ফলে প্রকৃতি ও নারী হয়ে উঠলো রহস্যের আধার।
এই রহস্যময়তা থেকেই শুরু হয়েছিল প্রকৃতি ও নারীকে পূজা দেবার চল। নারী উঠে এসেছিল দেবীর আসনে। গোত্রপ্রধান হিসেবেও নারীকে আমরা দেখতে পাই আদিম সমাজে। নারী-ঈশ্বরের কথাও শোনা যায়। সেই গোত্রপ্রধান কি বিরাট ঈশ্বর, দুই অবস্থা ও অবস্থান থেকে নারীর চ্যুতি ঘটেছে ক্রমে। অ্যাঙ্গেলস যাকে বলেছেন নারীর ঐতিহাসিক পরাজয়। কিন্তু তর্ক থেকেই যায়, ঈশ্বর কিংবা গোত্রপ্রধান, নারীকে যেভাবেই দেখা হোক না কেন, নারী কি আদৌ কখনো ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল? পিতৃতান্ত্রিক সিস্টেম যেভাবে সর্বব্যাপী বিস্তার𓃲িত হꦡয়েছে ও ক্ষমতা অধিকার করেছে, ঠিক সেই অর্থেই কি মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমাজে আদৌ ছিল?
ইতিহাসℱ পাঠ বলে, না। আদতে সে অর্থে মাতৃতন্ত্র ছিল না। আদিম সমাজে নারী পুরুষের সমতা ছিল, বা ক্ষমতার একটি সমবণ্টন ছিল বটে, নারীর স্বাধীনতাও ছিল। কিন্তু পিতৃতন্ত্রের আকারে মাতৃতন্ত্র আসলে ছিলোই না। নারীর স্বাধীনতা ছিল, কারণ তার তখন যৌনতার স্বাধীনতা ছিল। নারীর যৌনতাকে পরাধীন করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় নারীকে পরাধীনতার শেকল পরানোর খেলা। আর এই যৌনতার পরাধীনতার প্রয়োজন দেখা দিল তখনই, যখন পুরুষ, সম্পত্তির অধিকার ও দখল ধ🐬রে রাখতে বংশ রক্ষার প্রয়োজন অনুভব করলো। তার আগে পুরুষ পিতৃত্ব অনুভব করেনি কিংবা তার ভেতর আসেনি অধিকারের চেতনা।
আর ঠিক এ জায়গাতেই আটকে গেল নারী। ঠিক যেমন গর্ভধারণ ও সন্তানপালনের কারণে তাকে ছিটকে যেতে হয়েছিল শিকারী দল থেকে। হিংস্র পশু শিকারের জন্য ধাতব অস্ত্র ব্যবহারের পক্ষে তার গর্ভবতী অবস্থা কিংবা সদ্য প্রসূত শরীর যখন অপারগ হয়ে উঠলো, তখন পুরুষ ঘোষণা দিলো শিকারের কাজটি আসলে পুরুষের। নারীর কাজ সন্তানকে নিয়ে ঘরে থা♛কা, গেরস্থালী ও পশুপালন। তো সেই ঘরে থাকা অবস্থাতেই নারী উদ্ভাবন করলো কৃষির। কৃষি এলো বলেই স্থায়ী খাদ্যের যোগান রাখা সম্ভব হলো। শিকার না পেলেও খাবারের অভাব হবে না, সেটি নিশ্চিত হলো। নারী কৃষির আবিষ্কারক। সেই কৃষিকেই নারীর হাত থেকে ছিনতাই করা হলো, যখন জানা গেল যে কৃষি করতে জমি চাই, সেই জমির দখল নিতে হবে। পালিত পশুর দখল নিতে হবে। এই দখলের বুদ্ধি এল বলেই নারীকে সরে যেতে হলো। তবে দখলদার বাহিনী গড়তে নারীকেই যোগান দিতে হলো মানুষের, যে মানুষকে সে পেটে ধরে।
ব্যক্তিগত সম্পদের ধারণা বি👍স্তারের সাথে সাথে বাইরের জগতের কর্ম থেকে চ্যুত হলো নারী। তাকে পুরোপুরি পাঠিয়ে দেয়া হলো অন্দরে। যে অন্দরের কাজ তাকে ২৪ ঘণ্টাই ব্যস্ত রাখে, সন্তানের লালনপালন ও গেরস্থালীর কাজের একঘেয়েমী তার সমস্ত সৃষ্টিশীলতাকে ধ্বংস করে দেয়, সেই কাজের ভেতরেই পাক খেতে লাগলো নারী। অথচ এই ২৪ ঘণ্টা শ্রমের কোনো মূল্যায়ন হলো না। কারণ ততদিনে পিতৃতন্ত্র পুরুষাধিপত্যের ছক কাটতে শুরু করেছে। সেই ছকের হাতিয়ার হয়ে এল সমাজনীতি, ধর্মরীতি ইত্যাদি। নারীর শ্রমকে সঠিক মূল্যায়ণ করলে সেটি পুরুষের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে। তাই নারী অধিক শ্রম দিয়েও, মানুষের জন্মপ্রবাহ ধরে রাখার কঠিনতম কাজটি করেও, রয়ে গꦐেল অবমূল্যায়িত। কারণ তাকে দমন করার ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাবে পুরুষের আধিপত্য। আজও সেই অন্দরের অন্ধকার, পুরুষের আধিপত্য নারীকে আচ্ছন্ন করে আছে।
বলা হয়, নারী-ঈশ্বরকে হটিয়ে পুরুষ-ঈশ্বর প্রতিষ্ঠার চিন্তাটি পরিকল্পিত ও আগ্রাসী। যেদিন থেকে পুরুষ ঈশ্বর অধিষ্ঠিত, সেদিন থেকেই র𒊎ক্তপাতের শুরু। ঠিক যেরকম নারীর হাতে গোত্রপ্রধানের দায়িত্ব যতদিন, ততদিন প্রকৃতিও ছিল দুধেভাতে, যত্নে। সম্পত্তি বাড়ানো আর মুনাফার চেয়ে নারী প্রকৃতিকে আদরযত্ন করবার প্রয়োজন বেশি অনুভব করেছে। কিন্তু পুরুষ যখন প্রধান হয়ে উঠল, যখন শিল্প, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ক্ষমতায় সে ক্ষমতায়িত হলো, তখন পুরুষের মাথায় দিনরাত মুনাফার চিন্তা, ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়ানোর অভিলাষ। পুরুষ হয়ে উঠলো আগ্রাসী, সবদিক জয় করে তার সম্পদ বাড়াতেই হবে। তাতে নাশ হোক প্রকৃতি, তাতে অন্য মানুষ, প্রাণী, গাছপালা, পরিবেশ সবকিছু তার শাসন শোষণে অতীষ্ঠ হয়ে উঠুক, তার কিছু যায় আসে না। কারণ পিতৃতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা তাকে দিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের অনুভব আর ক্ষমতা। সে সব কিছু করতে পারে। এমনকি পুরুষ পুরুষকেও শাসন করতে শুরু করলো। শ্রেণিবিভাজন আর বর্ণভেদের জন্ম হলো। সে অর্থে এসব বিভাজনের পিতাও পিতৃতন্ত্র। পিতৃতন্ত্র পুঁজিবাদের বাবা।
নারী, পুরুষ ও সব লিঙ্গের সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য এই ইতিহাসটি জানা বোঝা খুব প্রয়োজন। নারীর প্রতি পুরুষের নির্যাতনের উৎস এই দখলের ইতিহাস। পুরুষতন্ত্র নারীর শ্রমের অধিকার হরণ করেছে, নারীর সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নিয়ে⛦ছে, নারীর বহির্জগতে বিচরণের স্বাধীনিতা ছিনিয়ে নিয়েছে, নারীর যৌনতা ও প্রজননের সিদ্ধান্তে জবরদস্তি করেছে; শুধু এসবই নয়, পিতৃতন্ত্র নারীর আদিম শারীরিক সক্ষমতাকেও অনেকখানি ধ্বংস করেছে। পিতৃতন্ত্র বারবার নারীর শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা সম্পর্কে ভুল বয়ান দিয়েছে। নারীর সম্পর্কে অপপ্রচার চা♐লিয়েছে।
নারীবাদ বুঝতে হলে পিতৃতন্ত্রকে বুঝতে হবে। পুরুষতন্ত্রের কৌশল ও অপরাজনীতি বুঝতে হবে। তাহলেই চিহ্নিত করা যাবে নারীর অভীষ্ঠ লক্ষ্য লিঙ্গ-সমতা আদায়ে কী কী করা প্রয়োজন। নারী যদি নিজেকে পিতৃতন্ত্রের জালে জড়িয়ে রাখে, মুক্তি মিলবে না কোনোদিনই। এই জাল ছিড়তে চাই শিক্ষা ও সচেতনতা। এই জাল ছিড়তে চাই অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, যাতে নিজের সিদ্ধান্তে নিজেকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে আসা সম্ভব হয়। কারণ পুরুষতন্ত্রের 🌠ঝাঁঝালো কৃত্রিম আলোয় বসে মুক্তি ঘটবার সুযোগ নেই। এই আলো জ্বালতে হবে নিজের হাতে, আর সেই আলোর নাম নারীবাদ, যা সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠা করবে, অবসা🌃ন করবে সকল বৈষম্যের।
লেখক: সম্পাদক, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর