জাহানারা ইমামকে (৩ মে ১৯২৯-২৬ জুন ১৯৯৪) কোনো একটি পরিচয়ে আবদ্ধ করা যায় না। তাঁর প𝄹রিচয় বিশাল-ব্যাপক। তিনি অগ্নিকন্যা। শহীদজননী। যিনি তাঁর মনোবল দিয়ে ভেঙে দিয়েছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের বুকের পাঁজর। হৃদয়ে শত আঘাত-যন্ত্রণাকে পুষেও দেশমাতৃকার মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। স্বামী-সন্তান হারিয়েও শোকে মুহ্যমান না হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশকে চিরতরে শত্রুমুক্ত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এমনকি হৃদয়কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দেশের প্রতি কর্তব্য ভুলে যাননি সেই মহীয়সী শহীদজননী জাহানারা ইমাম।
সাহিত্যের গণ্ডি পেরিয়ে জাহানারা ইমাম শহীদজননী হিসেবে বেশি সুপরিচিত। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক-দলাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক রূপেও তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ষাট ও সত্তর দশকে স☂াহিত্যজগতে জাহানারা ইমাম পরিচিত ছিলেন। মূলত শিশু-কিশোর উপযোগী সাহিত্য সম্ভারের জন্য তাঁর সুনাম ছিল। তবে তিনি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেন দিনপঞ্জি রূপে লেখা তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’র (১৯৮৬) জন্য। শিক্ষাবিদ, শহীদজননী, সাহিত্যিক, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক কোনো পরিচয়কেই তাঁর থেকে আলাদা করা যায় না। তিনি সর্বগুণে গুণান্বিত এক মহীয়সী। তবে এই সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে তাঁকে অতিক্রম করতে হয়েছে হাজারও প্রতিবন্ধকতা।
অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামের এক রক্ষণশীল পরিবারে ১৯২৯ সালের ৩ মে জাহানারা ইমাম জ🔯ন্মগ্রহণ করেন। লেখকের ডাকনাম জুড়ু। তাঁর বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা হামিদা বেগম। তাঁরা ছিলেন সাত ভাই-বোন। তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর শৈশবকালে মুসলিম পরিবারের মেয়েদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার যথেষ্ট প্রসার ছিল না। তবে তিনি তাঁর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পিতা আবদুল আলীর তত্ত্বাবধানে রক্ষণশীলতার বাইরে এসে আধুনিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। যদিও সেখানেও ছিল নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা। সে সময় ঘোড়ার গাড়িতে করে পর্দা মুড়িয়ে অন্য মেয়েদের সঙ্গে স্কুলে যেতেন তিনি। বাবার চাকরির সুবাদে তাঁর স্কুলজীবন বিভিন্ন জায়গায় কেটেছে। বিবাহিত জীবনে লেখাপড়ায় তিনি প্রকৌশলী স্বামী শরীফ ইমামের দিক থ🦄েকে উৎসাহ ও আনুকূল্য পেয়েছিলেন।
১৯৪৫ সালে কলকাতার লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস করেন। বিএড পাস করার পর ১৯৬৫ সালে তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেন। পরে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে। ১৯৫২-১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। ফুলব্রাইট স্কলার জাহানারা ইমাম আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১৯৬৬ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্🐲ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীকালে ১৯৬৮-এর দিকে সে চাকরি ছেড়ে দেন। এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ব্যক্তিত্বময়ী জাহানারা ইমাম ষাটের দশকে ঢাকার সাংস্কৃতিক মহলে সুপরিচিত ছিলেন। জীবনের নানাবিধ সংকট কাটিয়ে উঠে স্বামী-সন্তান নিয়ে স❀ুখেই দিন কাটছিল লেখকের।
তবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেতারে এক ভাষণে ১৯৭১ সালের ১ মার্চের দুপুর ১টা ৫ মিনিটে জাতীয় প﷽রিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দেন। এর ফলে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এবং ২ মার্চেই প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। দেশে যখন তুমুল ডামাডোল সৃষ্টি হয় ঠিক তারপর মার্চের ১ তারিখ থেকে জাহানারা ইমাম লিখতে শুরু করেন তাঁর দিনলিপি ‘একাত্তরের দিনগুলি’। যা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এক অকাট্য দলিল।
জ্যেষ্ঠ সন্তান রুমীর বিদেশে গিয়ে প্রকৌশল বিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি লাভের কথা থাকলেও যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রুমী মায়ের অনুমতি নিয়েই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ঢাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য রুমী যখন ঢাকায় আসে তখন জাহানারা ইমাম নিজেও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন নানাভাবে। এই যুদ্ধে লেখকের সন্তান শহীদ হন, স্বামী অসুস্থ হন এবং অবশেষে মৃত্যুবরণ করꦫেন। বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রামের সেই দিনগুলোতে একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহবধূর জীবনসংগ্রাম এই গ্রন্থে উঠে এসেছে। লেখক জাহানারা ইমাম তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালি মায়েদের হৃদয়ের ক্ষত-দিনযাপনকে। তিনি একজন সংগ্রামী মা, দেশপ্রেমিকের স্ত্রী, একজন দৃঢ়চেতা বাঙালি নারী। যিনি দেশের জন্য স্বামী-সন্তানকেও উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করেননি।
তাঁদের বাড়ি কণিকা মুক্ত༒িযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। ক্র্যাক প্লাটুনকে ঢাকায় লালন-পালন করতেন তিনি। পুরোটা সময় লেখক দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর স্বামী শরীফ ইমাম ও তার বন্ধু সাজেদুর রহমান খান টাকা সংগ্রহ করে অল্প অল্প করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠাতেন। জুন মাসের শেষের দিকে ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের একটি চিঠি নিয়ে শাহাদাত চৌধুরী ও হাবিবুল আলম আসেন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চলাচল ব্যাহত করার উদ্দেশে খালেদ মোশাররফ তার কাছে বাংলাদেশের ব্রিজ ও কালভার্টের ব্যাপারে তথ্য চেয়ে পাঠান। এদিকে শরীফ ইমাম ব্রিজের ঠিক কোন কোন পয়েন্টে এক্সপ্লোসিভ বেঁধে ওড়ালে ব্রিজ ভাঙবে অথচ কম ক্ষতি হবে অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সহজে মেরামত করা যাবে💖, সেভাবে বিস্তারিত তথ্য দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। তাদের গোটা বাড়িই মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতায় রত। তাই সে সময় মুক্তিযোদ্ধারা এসে লুকিয়ে রাত যাপন করতেন এই বাড়িতে। তাঁর মাতৃস্নেহের প্রমাণ মিলে প্রতিক্ষণে। ১ আগস্টের ডায়েরির পাতায় তিনি লিখেছেন, ‘রুমী গেছে আটচল্লিশ দিন হলো। মনে হলো আটচল্লিশ মাস দেখিনি।’
এই দিনলিপিতে ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সময়কার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। দিনলিপির শুরু হয়েছে এভাবে, লেখকের বড় ছেলে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছেন। ১২ মে: বুধবার ১৯৭১ তারিখের দিনলিপিতে লেখক তুলে ধরেছেন: ‘জামী স্কুলে যাচ্ছে না। যাবে না। শরীফ, আমি, রুমী, জামী—চারজনে বসে আলাপ-আলোচনা করে আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম স্কুল খুললেও স্কুলে যাওয়া হবে না। দেশ কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে না, দেশে এখন যুদ্ধাবস্থা। দেশবাসীর ওপর হানাদার পাকিস্তানি জানোয়ারদের চলছে নির্মম নিষ্পেষণের স্টিমরোলার। এই অবস্থায় কোনো ছাত্রের উচিত নয🐭়। বই-খাতা বগলে স্কুলে যাওয়া।”
লেখকের দেশপ্রেম ফুটে উঠেছে বিশেষভাবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহোযোগিতায় তাই লেখক নিজেও বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছেন। সময়-সুযোগ বুঝে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করছেন। শেষ পর্যন্ত রুমী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তার ওপর নির্যাতন শেষমেশ মৃত্যু। লেখকের স্ব🥀ামীর ওপর নির্যাতন। আর শেষে দেখা যায় তাঁর ছোট ছেলে জামীও মেজর হায়দারের বডিগার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করে। সব মিলিয়ে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ দিনলিপিতে যুদ্ধকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের দুর্বিষহ চিত্র ফুটে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের এক অন্যতম দলিল এই গ্রন্থটি।
জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ দিনপঞ্জির আকারে রচিত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ। এখানে স্থান পেয়েছে একাত্তর💫ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা, জনজীবনের দুর্ভোগ, আতঙ্ক ও আত্মত্যাগের কথা। যুদ্ধের সময় ঢাকা নগরীর এই অবরু﷽দ্ধ চিত্র স্মরণ করিয়ে দেয় পুরো দেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতি। লেখক, শহীদজননী জাহানারা ইমাম তাঁর কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে বাঙালির হৃদয়ে চির জাগরূক থাকবেন।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক